বিশ্বাসের ভাইরাসের প্রভাবে রাজীব হত্যার মতো ভয়ঙ্কর আলামতগুলো যখন দিনের আলোর মত উদ্ভাসিত, আশা করা হচ্ছিল যে, সরকার এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। খুঁজে দেখবেন বিশ্বাসের ভাইরাসের উদ্ভব এবং সংক্রমণের মূল উৎসগুলো। কিন্তু তা না করে আওয়ামী সরকার চড়াও হল প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা ব্লগারদের ওপর। ২০১৩ সালের পয়লা এপ্রিল বাংলা ব্লগের চারজন স্বনামখ্যাত মুক্তমনা ব্লগারকে গ্রেফতার করল ‘সেকুলার বলে কথিত আওয়ামী সরকার। বুঝলাম হেফাজতি মওলানা আর আমার দেশ এর মত প্রোপাগান্ডা মেশিনের চাপে বিশ্বাসের ভাইরাসের ব্যাপারটা আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতেও। কিন্তু ভাইরাসের এহেন মহামারী দেখে তো আমরা চোখ বুজে থাকতে পারি না। আমার অনলাইন বন্ধুদের সাথে মিলে ব্লগারদের মুক্ত করার আন্দোলনে সামিল হলাম। শুরু হল পত্র-পত্রিকা, ফেসবুক এবং ব্লগে লেখালিখি। শুরু করলাম Worldwide Protests for Free Expression in Bangladesh’ ক্যাম্পেইন। সারা পৃথিবীর মুক্তচিন্তার সংগঠনগুলো এগিয়ে এলো আমাদের ডাকে। একটা সময় পর সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হল ব্লগারদের।
তখন থেকেই মনে হচ্ছিল, এই ইতিহাসগুলো সংকলিত করে রাখা দরকার। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। আমরা বড় বিস্মৃতি-পরায়ণ জাতি। দু’দিনেই ভুলে বসে থাকি আমাদের অর্জনগুলো, কখনোবা বিকৃতই করে ফেলি নিজেদের অজান্তে, কিংবা মিথ্যে প্ররোচনার শিকার হয়ে।
এ নিয়ে বইয়ের কথা মাথায় আসলেও সেটা যে এ বছরের মধ্যেই ঘটবে ঘুণাক্ষরেও মাথায় ছিল না। বইমেলা শুরুর দুমাস আগে কেউ বইয়ের কাজ শুরু করে সেটা আবার শেষও করতে পারে নাকি? কিন্তু সেই অসম্ভব কাজই সম্ভব করে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। তিনি যেভাবে তাগাদা দিয়ে আমার কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিলেন, বই আকারে পাঠকদের সামনে তুলে ধরলেন, সেটাও ভাইরাসের চেয়ে কম আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। তিনি এতো কম সময়ের মধ্যে শুধু বইয়ের লেখা আদায়ই করেননি, মনোরম একটি প্রচ্ছদ করে মেলা শুরুর বহু আগেই ফেসবুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার এহেন অবদান এবং নিরন্তর চাপাচাপি ছাড়া বইটি আলোর মুখ দেখতো না, তা হলফ করেই বলা যায়।
আর বইটি রচনার ব্যাপারে আর কারো কথা যদি নাও বলি, অন্তত একজনের কথা বলতেই হবে; সে আমার স্ত্রী বন্যা। এতো কম সময়ের মধ্যে এভাবে পাণ্ডুলিপি লিখে দিতে হবে জানতে পেরে পুরো সংসারের সবটুকু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে নিবিষ্ট মনে লেখার জন্য সময় করে দিয়েছে সে। নিজে অফিস করেছে, বাসায় এসে রান্না করেছে, মেয়ের কলেজের ভর্তির ব্যাপারে দেখভাল করেছে, এবং সর্বোপরি বাসার সমস্ত কাজ গুছিয়ে আবার আমার পাণ্ডুলিপির ব্যাপারেও অনেক পরামর্শ দিয়েছে। বন্যা নিজেও একজন শক্তিমান লেখক, এবং সবসময়ই আমার লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক। তার সমালোচনা এবং পরামর্শ সবসময়ই আমাকে ঋদ্ধ করে। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
বইটি এতো কম সময়ে পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি।
জীবন দীপান্বিত হোক, সমাজ হোক বিশ্বাসের ভাইরাস মুক্ত।
–ড.অভিজিৎ রায়
ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
.
.
‘বিশ্বাসী মন খাঁচায় বন্দি পাখি, আর মুক্তমন যেন মুক্ত বিহঙ্গ– ঘন মেঘের পর্দা ভেদ করে উড়ে চলা অবিশ্রান্ত এক ডানামেলা ঈগলা’ — রবার্ট গ্রিন ইঙ্গারসোল (১৮৩৩-১৮৯৯)
০১. একজন নাফিস এবং বিশ্বাসের ভাইরাস
ছবি। পেজ ২৪
কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামে একটি সুদর্শন ছেলের কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। গত বছরের (২০১২) অক্টোবর মাসে এই একুশ বছরের যুবক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গ্রেফতার হয়ে বিশ্বব্যাপী পত্র-পত্রিকার আলোচিত খবর হয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ ও এফবিআই। মিডিয়ায় বলা হচ্ছিল যে ২০০১ সালে ৯-১১ এর ঘটনার পর এটাই নাকি আমেরিকায় সবচেয়ে বড় ‘টেরোরিস্ট প্লট। আমাদের জন্য এটি উদ্বেগের ছিল, কারণ এই প্লটের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে একজন বাংলাদেশীকে। সন্দেহভাজনের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসায় নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে।
নাফিসের এই ঘটনা অবশ্য বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সারা বিশ্ব জুড়েই নানা ধরনের সন্ত্রাসবাদ, আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং সুইসাইড টেরোরিজম’এর মাধ্যমে নির্বিচারে হত্যা এবং আতংক তৈরি ধর্মীয় উগ্রপন্থী দলগুলোর জন্য খুব জনপ্রিয় একটা পদ্ধতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আল-কায়দার ১৯ জন সন্ত্রাসী চারটি যাত্রীবাহী বিমান দখল করে নেয়। তারপর বিমানগুলো কজা করে আমেরিকার বৃহৎ দুটি স্থাপনার ওপর ভয়াবহ হামলা চালায় তারা। নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর বা পেন্টাগনে ঐ হামলা চালানো হয়। প্রায় তিন হাজার মানুষ সেই হামলায় মৃত্যুবরণ করে। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী হামলা ছিলো এটি। এই হামলার পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ থাকলেও এটি অনস্বীকার্য যে এর পেছনে সবচেয়ে বড় মদদ আসলে বিশ্বাস-নির্ভর ধর্মীয় উগ্রতা। এতদিন পর্যন্ত এ ধরণের হামলায় আরবিয় কিংবা পাকিস্তানীদের নাম শোনা গেলেও বাংলাদেশী অভিবাসীরা সন্দেহের বাইরেই ছিল। নাফিসের এই ঘটনা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের হালহকিকত পাল্টে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।