স্বনামধন্য লেখক এবং ব্লগারেরাও এগিয়ে এসেছিলেন বাক-স্বাধীনতা রক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। তাদের অনেকেই নিজদের বইগুলো রকমারি থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। চরম উদাস, যার ‘লাইনে আসুন’ বইটি বইমেলায় মুড়ি-মুড়কির মত বিক্রি হয়েছে, তিনি তার মার্চ মাসের ১৫ তারিখে দেয়া স্ট্যাটসে লিখেছিলেন— “কোন বই রাখবে আর কোন বই সরাবে সেটা রকমারির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। মেয়েদেরকে আজেবাজে মেসেজ দিয়ে উত্যক্তকারী সেক্স ফ্রিক যদি হয় এই দেশের হাই প্রিস্ট এবং তার ধর্মকে যদি রকমারির কর্ণধাররা প্যান্ট ভিজিয়ে করজোড়ে মাফ চায়, তবে সেই মাফ চাওয়া ও প্যান্ট ভিজানোর অধিকার রকমারির আছে। আমার শুধু অধিকার আছে রকমারি বর্জন করার। আমি তাই করলাম। মাত্র দুদিন আগে আপনাদের কাছ থেকে কেনা আট হাজার টাকার বই হাতে পেয়েছি। এটাই হোক আমার শেষ বই এর অর্ডার। সেইসাথে যদি রায়হান আবির, অভিজিৎ রায়দের বই রকমারি থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তবে আমি অনুরোধ জানাবো আমার লাইনে আসুন’ বইটিও যেন তারা নিজেদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলে। আপনাদের প্যান্ট আপনারা ভিজান, যখন খুশী তখন ভিজান। শুধু সেই ভিজা প্যান্টের ভেতর আমাকে রাখবেন না। জাগরণের পূর্বাপর’ গ্রন্থের লেখক কবির আহমেদ তার ১৭ই মার্চের দেয়া স্ট্যাটাসে বলেছিলেন, ‘অনলাইন সন্ত্রাসবাদের প্রচারক ফারাবীর হুমকিতে রকমারি ডট কম তাদের সাইট থেকে অভিজিৎ রায়’র ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে এটা একটা সংবাদ হলেও আদতে রকমারি ডট কম যদি সত্যিকার অর্থে ব্যবসা অথবা অসাম্প্রদায়িকতা ধারণ করতো তাহলে ফারাবীর মতো লোকদের হুমকিতে কী বই প্রত্যাহার করতে পারতো? এটা স্পষ্টত তাদের সাম্প্রদায়িকতা লালনের শামিল। একই সাথে ন্যাক্কারজনকও। রকমারি সম্পর্কে আমি অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করে আসছিলাম দীর্ঘদিন থেকে। নিয়মিতভাবে সেখান থেকে আমি বই সংগ্রহও করেছি। ফারাবীর হুমকিতে অথবা এমন কোন কিছুর অপেক্ষার পালা শেষ হবার পর তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসার পর এখন থেকে আর কোন বই রকমারি থেকে সংগ্রহ করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবং একই সাথে বইমেলা ২০১৪তে প্রকাশিত গণজাগরণ আন্দোলন এবং তার পরের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখিত আমার ‘জাগরণের পূর্বাপর’ বইটিও রকমারি থেকে প্রত্যাহার করে নিলাম। সুলেখক রণদীপম বসু তার স্ট্যাটাসে বলেছিলেন, ‘রকমারি.কম-এর তাকে আমার গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন ‘অবমুক্ত গদ্যরেখা বইটা এখনো শোভা পেলে এখন নিজেকে অপমানিতই বোধ করবো। কেননা বইটা সম্পূর্ণই মুক্তমনা পাঠকদের জন্য লেখা। এখানে বলা দরকার, চরম উদাস, কবির আহমদের মতো অনেকেই জীবনে প্রথমবারের মতো বই প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি যে কতটা বড় সেটা লেখক মাত্রই জানেন। তারপরেও তারা সে অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে রেখে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন লেখকের স্বাধীনতাকে সম্মান করে। আমি জানিনা রকমারি তাদের সাইট থেকে বইগুলো তুলে নিয়েছেন কিনা, কিন্তু তারা যে আমার মতো লেখকের জন্য এই ত্যাগ স্বীকারটুকু করতে চেয়েছেন, তাতে মুগ্ধ হয়েছি আমি। দেশের মধ্যে তো বটেই দেশের বাইরের কিছু পত্রপত্রিকাতেও ব্যাপারটি ফিচার করা হয়েছিল[১৪]। সামান্য লেখক আমি। আমার সামান্য লেখা কাউকে কাউকে হয়তো অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু তার ব্যাপকতা যে এতো বেশি তা আমি কখনোই অনুধাবন করিনি। সুব্রত শুভ, তারিক আজিজ (অনিকেত), অনন্ত বিজয় দাশ, রায়হান আবীর, মারুফ রসূল, রায়হান রশীদ সহ অনেকেই মুক্তমনা, সচলায়তন, মুক্তাঙ্গনব্লগে কিংবা পত্রিকায় যেভাবে লিখেছেন, তাতে আমি সত্যই আপ্লুত[১৫]। ওমর ফারুক লুক্স, ফারজানা কবীর স্নিগ্ধা, আসিফ মহিউদ্দীন, বিপ্লব রহমান, মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, অঞ্জন আচার্য সহ অনেকেই এ নিয়ে ফেসবুক সহ বহু জায়গায় লিখেছেন। তাদের এ ঋণ বহন কিংবা শোধ কোনটাই করার সামর্থ্য আমার নেই। কেবল মনে মনে উচ্চারণ করেছি রবিঠাকুরের অমোঘ বাণী– ‘আমায় তুমি অশেষ করেছ!’ বস্তুতঃ তাঁদের মতো অগণিত লেখক, পাঠক এবং শুভানুধ্যায়ীরা আছেন বলেই বহু হুমকি ধামকির পরেও ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি অস্তিত্বের অতলান্তে হারিয়ে যায়নি, বরং নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে, আরো পরিশীলিত হয়ে আলোর মুখ দেখছে। বইটির প্রচার, প্রসার এবং সাফল্যের সবটুকু কৃতিত্ব আসলে তাদেরই।
নতুন এ সংস্করণে বইটির বেশ কিছু অংশ ঢেলে সাজানো হয়েছে। বইটির অনেক অংশই আগের চেয়ে পরিবর্ধিত। বিশেষ করে রাজীব হায়দার শোভন (থাবা বাবা) হত্যার প্রেক্ষাপটে ধর্মের প্যারাসাইটিক ধারণাই কি দায়ী নয়? অংশটি বিবর্ধিত করা হয়েছে নতুন কিছু তথ্যের আলোকে ইসলামের সুচনাকালে যেসব সহিংস পন্থা ব্যবহৃত হয়েছিল, গুপ্তহত্যা ছিল তার অন্যতম। আবু আফাক, কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিন্তে মারওয়ান এর পাশাপাশি আবু রাফেকে হত্যার বিবরণ হাজির করা হয়েছে। আবু রাফের ঘটনাটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে আবু রাফেকে হত্যার জন্য মহানবীর নির্দেশে যেভাবে পাঁচজন সাহাবীর একটি দল গুপ্তহত্যায় অংশ নিয়েছিল, একই কায়দায় মুফতি জসিমের নির্দেশে সাতজনের দল গঠন করে থাবা বাবাকে পল্লবী থানার সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বাণী এবং ধর্মগুরুদের দিকনির্দেশনা কীভাবে আজও জিহাদি প্রেরণা হিসেবে কাজ করে যায় ভাইরাস-আক্রান্ত মননের মাঝে তার সাযুজ্য আর সংশ্লিষ্টতা আরো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বইয়ে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বোখারী শরীফ থেকে এ সংক্রান্ত সঠিক হাদিসগুলো খুঁজে তথ্যসম্ভার নিখুঁত করে তুলতে সাহায্য করেছেন খ্যাতনামা গবেষক আবুল কাশেম। তাঁর পরিশ্রমলব্ধ অবদান নিঃসন্দেহে বইটিকে ঋদ্ধ করেছে। চট্টগ্রামনিবাসী মুক্তচিন্তক দুই তরুণ উল্লাস এবং রাহীর উপর শারীরিক আক্রমণ এবং গ্রেপ্তারের পর তাদের মর্মস্পর্শী ঘটনাটি বইয়ে যোগ করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে, দেশের নতুন কালাকানুন’ হিসেবে চিহ্নিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩)-এর ৫৭ ধারা নিয়েও কিছু নির্মোহ বিশ্লেষণ হাজির করতে হয়েছে। আর বইমেলার সময় বইটির প্রথম সংস্করণ খুব দ্রুতগতিতে বের করার খেসারত হিসেবে বইটিতে অল্প-বিস্তর মুদ্রণ এবং বানানপ্রমাদ রয়ে গিয়েছিল। কিছু কিছু জায়গায় ছিল অহেতুক পুনরুক্তিও। আমার আটলান্টানিবাসী লেখক-বন্ধু রাজর্ষি দেবনাথ বইটি পড়ে সেগুলো বের করে দিয়ে বইটিকে ত্রুটিমুক্ত করে তুলতে সহায়তা করেছেন। তাঁর অবদান ছাড়া এই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ কোনভাবেই পূর্ণতা পেত না। আর আমার সকল কাজের সবচেয়ে কঠোর সমালোচক আমার জীবনসঙ্গিনী বন্যা আহমেদের প্রেরণা সবসময়ই আমাকে অবাক করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি বলাই বাহুল্য।