পৃথিবীতে বই পুড়িয়ে, বইকে নিষিদ্ধ করে মুক্তচিন্তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা অবশ্য নতুন নয়। সেই প্রাচীন যুগ থেকেই শাসকে নিজদের চিন্তার বিপরীতে যাওয়া মতবাদ কিংবা ধ্যান ধারনাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ব্রুনোদের বাইবেলবিরোধী সৌরকেন্দ্রিক মতবাদকে নিষিদ্ধ করে ক্যাথলিক চার্চ একসময় সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা থামাতে চেয়েছিল। যখন তা সম্ভব হয়নি বিপরীত ধারার বইপত্র জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তাড়িয়ে নাশ করে দিতে চেয়েছে। এ ধরণের গ্রন্থহন্তারক কাজ ব্যাবিলনীয় শাসকেরা করেছে, এথেনীয়রা করেছে, রোমানরা করেছে। খ্রিষ্টান এবং মুসলিম শাসকদের হাতে একটা সময় ধ্বংস হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিখ্যাত প্রাচীন পাঠাগার। কথিত আছে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের বই-পত্তর ধ্বংস করতে গিয়ে খলিফা ওমর নাকি বলেছিলেন– ‘বইপত্রগুলো যদি কোরআনের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয় তবে সেগুলো আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। কাজেই ওগুলোর ধ্বংস অনিবার্য; আর বই-পত্তরগুলোতে যদি কোরানের শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোন কথাবার্তা আদৌ থেকেও থাকে তবে সেগুলো হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। কাজেই সে দিক দিয়েও ওগুলো ধ্বংস করা জায়েজ। তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি এবং তার অনুগত সৈনিকেরা ভারতবর্ষ আক্রমণের পর জ্ঞানবিজ্ঞানের সূতিকাগার নালন্দা বিদ্যানিকেতনও একই কায়দায় ধ্বংস করেছিলেন। এমনকি গত শতকে নাৎসী জার্মানির শাসকেরা রীতিমত বই পোড়ানোর বহ্নিউৎসব পালন করেছে ঘটা করে। অবশ্য মিত্র বাহিনীও পিছিয়ে ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের বোমারু বিমানগুলো নাকি টার্গেট হিসেবে প্রায়ই খুঁজে নিতো জার্মানির লাইব্রেরিগুলোকে। রাশিয়ার স্ট্যালিনীয় জামানায় যেমন বিপরীত চিন্তাকে নাশ করার তাগিদে অসংখ্য বই পোড়ানো হয়েছে, তেমনি আবার পঞ্চাশের অন্ধকার দশকে ম্যাকার্থিজমের বিশুদ্ধি অভিযানে আমেরিকান মননকে কমিউনিজমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যও বই পুড়তে আমরা দেখেছি। বই পোড়ানো ছাড়াও বইয়ের উপর নানা ধরণের সেন্সরশিপ আরোপ এবং নিষিদ্ধকরণের বহু আলামতের সাথেই আমরা পরিচিত। ভারতবর্ষে সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’, কিংবা বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ আমরা নিষিদ্ধ হতে দেখেছি চোখের সামনেই। বছর কয়েক আগে মামলা করে হুমায়ুন আজাদের ‘নারী গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। বিশ্বাসের ভাইরাস’কে নিষিদ্ধ করার প্রেচেষ্টাও এই তালিকায় নতুন সংযোজন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফারাবী নামক মুখচেনা লম্পট এবং ফতোয়াবাজের মুখের কথায় রকমারি কোন কিছু আগাপাশতলা বিচার বিবেচনা না করে যে সময়টিতে বিজ্ঞানমনস্ক বইপত্র উঠিয়ে নিয়েছে, ঠিক একই সময় তাদের সাইটে দর্পভরে শোভা পাচ্ছিল গোলাম আজম, মওদুদী, দেলওয়ার হোসেন সাইদীদের বই। শুধু তাই নয়, এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে রকমারি ডট কম অনলাইনে বিক্রি করে চলেছে, পৃথিবী নয় সূর্য ঘোরের মত অবৈজ্ঞানিক বই, কিংবা ‘আদি ও আসল সোলেমানী তাবিজের কিতাব জাতীয় গ্রন্থ[১১]। অথচ আধুনিক বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের গবেষোনা পত্র, জার্নাল,আর বইয়ের রেফারেন্স দেয়া শত কষ্টের ফসল ‘বিশ্বাসের ভাইরাস কিংবা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’–এর মতো বইগুলো তাদের জন্য তৈরি করেছে একেবারে জীবন-মরণ সমস্যা। তারা স্টোর থেকে উঠিয়ে নিয়েছে আমার সব বই। মিথ্যা লেবেল এঁটে দিয়েছে ‘আউট অব প্রিন্ট বলে। রকমারির এই হঠকারী সিদ্ধান্তের পর আমি আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম[১২]–
‘আমি সামান্য লেখক। কিন্তু যা লিখি সততার সাথে লিখি। কাউকে হুমকি ধামকি দেই না। আশা করব রকমারি এবং তাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা বিষয়টি মাথায় রাখবেন। দয়া করে ব্যবসার সাথে ব্যক্তিগত বিশ্বাস জরাবেন না। ফারাবী হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যু হুমকি দিয়েছে। তার হুমকি সত্য হলে আমরা কেউ আজ বেঁচে থাকতাম না। রকমারির উচিৎ লেখকের স্বাধীনতার প্রতি অবিচল থাকা। আমার বই রাষ্ট্র থেকে ব্যান করা হয়নি, আদালতে যায়নি। ফারাবীই বরং আদালতে চার্জশিটপ্রাপ্ত ফেরারী আসামী। তার কথায় আমার বইকে তালিকা থেকে সরানোর কারণটা হাস্যকর। আমরা তো কোন ধর্মীয় বই তালিকা থেকে সরাতে বলছি না। শুধু ধর্মীয় বই কেন, বহু জিহাদি বানী সমৃদ্ধ উগ্র বইপত্র থেকে শুরু করে বড় বড় রাজাকারদের লেখা বই রকমারিতে পাওয়া যায়। সব ছেড়ে আপনাদের চোখ পড়ল এমন এক লেখকের যিনি হুমকি ধামকি দেন না, কেবল যিনি বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন? আসলে ভয়টা কার? স্মরণ করি মিখাইল বুলগাকভের উপন্যাস মাস্টার এণ্ড মার্গারিটার’ বিখ্যাত উদ্ধৃতি—’পাণ্ডুলিপি পোড়ে না। মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে নাশ করা যায় না।
হ্যাঁ, আমি সত্যই মনে করি– মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে কোনভাবেই বিনাশ করা যায় না। এর প্রমাণ আমরা খুব ভালভাবেই পেয়েছি রকমারি-ফারাবী ঘটনার পরবর্তী সময়গুলোতে। রকমারি যখন কাপুরুষের মতো বিশ্বাসের ভাইরাস প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ‘পড়ুয়া” এবং “নক্ষত্র বুক শপ’ সহ অন লাইনে বই বিক্রির একগাদা প্রতিষ্ঠান আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় “বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটির বিক্রি অব্যাহত রাখতে[১৩]। তারা মুক্তচিন্তার বইপত্র বিক্রি থেকে কোনভাবেই পিছু হটবে না বলে জানায়। ফারাবী হুমকি দিয়ে বইটির বিক্রি বন্ধ করতে চেয়েছিল, অথচ ফারাবীর এই কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসের ভাইরাস বিক্রি তো বন্ধ হলোই না, বরং বইটির বিক্রি এক মাসের মধ্যে আমাদের প্রত্যাশাকে একেবারে অতিক্রম করে গেল। বহু পাঠক আগ্রহী হয়ে বইটি কিনেছেন, এবং আমাকে ম্যাসেজ করে জানিয়েছেন। অনেকে রকমারির সিদ্ধান্তে এতোটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তারা রকমারি বর্জন করুন’ নামে ফেসবুক ইভেন্ট খুলে এ প্রতিষ্ঠানটি বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। আমার বইয়ের বহু পাঠক সহমর্মিতা প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যেমন, খ্যাতনামা ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিঝুম মজুমদার তার একটি স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমি এই পর্যন্ত রকমারি থেকে ১৬,৫৮৫ টাকার বই কিনেছি দুইটি একাউন্ট থেকে। যদি ফারাবীর কথা অনুযায়ী অভিজিৎদা কিংবা নাস্তিকতা প্রচার করছে, এমন অভিযোগে বা এমন কারণে এমন বই রকমারি বাদ দিয়ে দেয়, তবে পাব্লিক-স্ট্যাটাস দিয়েই রকমারি বর্জন করব’। আরেকজন পাঠক সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোল লিখেছিলেন, ‘আমার অর্ডার হিস্ট্রিতে গিয়ে ক্যালকুলেটরে হিসাব করে দেখলাম- রকমারি থেকে দুই বছরে প্রায় সাড়ে নয় হাজার টাকার বই আমি কিনেছি। ঢাকায় থাকি না,তাই রকমারি আমার জন্য একটু বিশাল সুযোগ হিসেবে এসেছিল। অনেক কৃতজ্ঞতা জমা ছিলো সাইটের পরিচালকদের জন্য। সাইটের এডমিনদের এমন একটা জীবের কাছে আত্মসমর্পণ দেখে খুবই মন খারাপ লাগছে। শ্রদ্ধার জায়গাগুলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। আজাদ সাহেব ঠিকই বলে গেছেন- সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। কিছু পাঠক আবার আগে অর্ডার করা বই গ্রহণ না করে সরাসরি ফেরত পাঠিয়েছেন রকমারির কাছে। যেমন, বিশ্বাসের ভাইরাস বইটির পাঠক দেব প্রসাদ দেবু তার মার্চ মাসের একটি স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, খুবই নগণ্য প্রতিবাদ। অনেকটা ছোটবেলায় মা’র উপর রাগ করে ভাত না খেয়ে থাকার মতো। অভিজিৎ রায়ের বই প্রত্যাহারের জের ধরে রকমারি ডট কম থেকে আসা আজকের পার্সেলটা ফেরত পাঠালাম। বাজারির কিছু যায় আসেনা। হয়তো, কিন্তু সেটি আমার বিবেচ্য নয়, আমি এই ক্ষুদ্র প্রতিবাদেই তৃপ্ত।