অবশ্য ফারাবীর হত্যার ফতোয়া নতুন কিছু নয়। এই ফারাবী ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাইম লাইটে এসেছিল রাজীব হায়দার শোভন ওরফে থাবা বাবার জনাজা পড়ার জন্য নিয়োজিত ইমামকে হত্যার উস্কানি দিয়ে। প্রকাশ্যেই বলেছিল, যে ইমাম থাবা বাবার জানাজা পড়বে তাকেও হত্যা করা হবে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল সে সময়[৫]। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফারাবীকে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল দিন কয়েক পরেই। অনেকেই বলেছেন, এরপর থেকেই তার ডিজিটাল ফতোয়ার দাপট বেড়ে গিয়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। সে অতীতে ঢাকা জজ কোর্টের জেলা জজ জহুরুল হককেও হত্যার হুমকি দিয়েছিল। খ্যাতনামা ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্ট আসিফ মহিউদ্দীনকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিল ফারাবী একাধিকবার। মজার ব্যাপার হচ্ছে যাকে সে হত্যার হুমকি দেয়, দুই দিন পরে আবার তার কাছেই টাকা চায়। হত্যার হুমকি দেয়ার মতো টাকা চাওয়াটাও ওর বাতিক, কিংবা হয়তো ফ্যাশন (আমি যখন ফেসবুকে নতুন, আমার কাছেও বেশ কয়েকবার ম্যাসেজ দিয়েছিল ফেসবুকে টাকা পয়সা চেয়ে; একবার তো ১০,০০০ টাকা চেয়ে বসল স্মার্টফোন কিনবে বলে; আরেকবার ম্যাসেজ দিয়েছিল পয়সাওয়ালা সুন্দরী মেয়ে আছে কিনা যাতে কিনা সে বিয়ে করতে পারে)। অনেকের কাছে এও শোনা যায়, ফারাবীর টাকা চেয়ে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পোঁছিয়ে গিয়েছিল যে, মেয়েদের সাথে যৌনালাপ করতে করতেই সে নাকি তাদের কাছে টাকা চাইতে থাকতো। পাশাপাশি নাস্তিক, মুরতাদ এবং বিধর্মীদের হত্যার ফতোয়া তো আছেই। এর মধ্যে একবার দেখলাম, নাট্যব্যক্তিত্ব পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছিল— এফডিসির এই পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় যদি দেশের আলেম উলামাদের কাছে ক্ষমা না চায় তাইলে এই পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও থাবা বাবার মত করুন পরিণতি বরন করতে হবে[৬]। কিছুদিন আগে মুক্তচিন্তার লেখক পারভেজ আলমকে হত্যার ফতোয়া দিয়েছিল এই ডিজিটাল জিহাদি। তার নোটে খুব পরিষ্কারভাবেই লিখেছিল—
‘.. এই পারভেজ আলমের বাসা হচ্ছে শনির আখড়ায়। এই পারভেজ আলম প্রতিদিন বিকালবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবির হাটে আড্ডা দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা কে চরমভাবে কটাক্ষ করে status লেখার কারণে এই পারভেজ আলম কে হত্যা করা বাংলার মুসলমানদের জন্য এখন ফরজ হয়ে দাড়িয়েছে[৭]। হত্যার উস্কানির পাশাপাশি আবার অন্য ধরণের উস্কানিও আছে। কিছুদিন আগে সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে উস্কানি দিয়েছিল দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে অস্ত্র তুলে নিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ড্রাকুলা মানবী হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে ‘আরেকটি রক্তাক্ত ১৫ই আগাস্ট’ ঘটানোর উদাত্ত আহবান জানিয়েছিল এই উগ্রপন্থী ব্যক্তিটি। তার স্ট্যাটাসে ফারাবী বলেছিল[৮]—
‘শেখ হাসিনা বর্তমানে একটি ড্রাকুলায় পরিণত হয়ে গেছে। ড্রাকুলা তো সেই যে মানুষের রক্ত খায়। শেখ হাসিনা শুধু ড্রাকুলার ন্যায় বাংলার নিরীহ মানুষের রক্তই খাচ্ছেন না শেখ হাসিনার ভাত খাওয়ার জন্য, শেখ হাসিনার গোসল করার জন্য আরো অনেক বাংলার নিরীহ মানুষের রক্ত দরকার। শেখ হাসিনা বর্তমানে বাংলার নিরীহ মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে আছে। রক্ত রক্ত আমি তৃষ্ণার্ত এটাই এখন ড্রাকুলা মানবী শেখ হাসিনার নীতি। … আমাদের দরকার এখন আরেকটি ১৫ আগস্ট, ৭ নভেম্বর যার মাধ্যমে আমরা সিকিমের পরিণতি থেকে রেহাই পাব। তাই দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী কে আমি অনুরোধ করছি আজ রাতেই আপনারা একটা রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান করে আমাদের কে ড্রাকুলা মানবী রক্ত পিপাসু শেখ হাসিনার হাত থেকে উদ্ধার করেন।
এধরণের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। এ ধরণের বক্তব্য দিয়েও ফারাবী কিভাবে আইনের উর্ধে থাকে সেটা রীতিমত বিস্ময়কর। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মো আনোয়ার হোসেন বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে দেশের একটি প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকার একটি কলামে ফারাবীর ব্যাপারে এমনকি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন[৯]। অথচ দেশের আইনরক্ষকেরা এ ব্যাপারে ছিলেন বরাবরই নির্বিকার।
তাদের নির্বিকার থাকার একটি কারণ হয়তো যে ফারাবীর মৃত্যু হুমকিকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি। ফারাবী প্রতিদিনই ফেসবুকে কাউকে না কাউকে মৃত্যু হুমকি দিয়ে বেড়াতো। ফারাবীর মৃত্যু-হুমকির ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে ফেসবুকের প্রায় সকল মননশীল লেখক সাহিত্যিকেরা এতদিনে পরপারে সুখনিদ্রা যাপন করতেন। সত্যি বলতে কি ফারাবীর মতো লুম্পেনের দেয়া মৃত্যু ফতোয়া আমরা কেউই ‘সিরিয়াসলি নেইনি। কিন্তু আমরা না নিলেও একটি প্রতিষ্ঠান নিল। রকমারি-ডট-কম নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে অনলাইনে বই বিক্রি করে। ফারাবী বাংলাদেশের অনলাইন বই কেনার সাইট ‘রকমারি ডট কমের অফিসের ঠিকানা প্রদান করে পোষ্ট দেয় মার্চ মাসের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়। বাংলাদেশে নাস্তিকতা ছড়ানোর অপরাধে সে তার তাগুদি অনুসারীদের রকমারির অফিস আক্রমণের আহ্বান জানায় সে। একই সাথে স্ট্যাটাসে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্তাধিকারীর প্রোফাইল উল্লেখ করে তাকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়। যেখানে ফারাবীকে সাথে সাথেই আইনের হাতে সোপর্দ করার দরকার ছিল, বাংলাদেশের শুভবুদ্ধির সব মানুষকে ভীষণ রকম অবাক করে দিয়ে ‘রকমারি ডট কমের সত্ত্বাধিকারী মাহমুদুল হাসান সোহাগ ফারাবীর হুমকির পর তার স্ট্যাটাসে এসে আমি (অভিজিৎ রায়) সহ অন্যান্য লেখকদের বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার বই বিক্রি করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। কিন্তু তারপরও ফারাবী সন্তুষ্ট না হওয়ায় রকমারি ডট কম তার দেওয়া লিস্ট ধরে নিমেষেই সকল বই তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করে বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দেয়। অনেকেই এই ঘটনার সময় রকমারি ডট কমের সংশ্লিষ্টদের ফারাবীর ভয়ে ভীত হওয়ার বদলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেও সবার অনুরোধকে উপেক্ষা করে রকমারি ডট কম মৌলবাদী তোষণকেই তাদের নীতি হিসেবে গ্রহণ করে এবং নাস্তিকদের বই (পড়ুন বিজ্ঞান, যুক্তিবাদী এবং প্রগতিশীল বই) বিক্রি চিরতরে বন্ধ করে দেয়। অথচ সকল অপকর্মের হোতা ফারাবীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তারা (রকমারির এই মেরুদণ্ডহীণতার ফলাফল যে মোটেই ভাল হয়নি পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ ছিল তার প্রমাণ। ফারাবীর পদতলে রকমারির সত্ত্বাধিকারী মাহমুদুল হাসান সোহাগের অহেতুক ক্ষমাপ্রার্থনায় নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে এই কুখ্যাত ফারাবী এবং সেই সাথে শুরু হয় তার নিত্য-নৈমন্তিক হত্যা-হুমকি প্রদান। আমি যখন এ বইয়ের ভূমিকা লিখছি, তখন ফারাবীর আরেকটি হুমকি এবং আক্রমণের শিকার হয়ে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন চট্টগ্রামের মুক্তচিন্তার দুই তরুণ– মাহমুদুর রহমান রায়হান (রায়হান রাহী) এবং উল্লাস দাশ[১০])। তারা নিদেনপক্ষে ফারাবীকে বলতে পারতেন যে, বইয়ের যে অংশে আপত্তিজনক অংশ আছে তা তাদের দেখাতে, এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিবেন তারা। কিংবা বলতে পারতেন, যে বই রাষ্ট্র এবং সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ নয়, সে বই কারো মুখের কথায় আমরা সাইট থেকে সরিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু কোন অনুসন্ধান ছাড়াই, কোন যুক্তিনিষ্ঠ প্ল্যান-প্রোগ্রাম এবং পলিসি ছাড়াই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বই উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলেন। এটা কোন ধরণের ভাল ব্যাবসায়িক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ব্যবসা করতে হলে নিজস্ব বিশ্বাসকে সিস্টেমের বাইরে রাখাই বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বিপণন প্রতিষ্ঠান আমাজন ডট কম এর মতো একটি ভাল উদাহরণ তো ছিলই তাদের সামনে। আমাজন থেকে চাইলে যেমন ধর্মীয় বইপত্র কেনা যায়, তেমনি কেউ চাইলে রিচার্ড ডকিন্স, স্যাম হ্যারিস, ক্রিস্টোফার হিচেন্সদের মতো নাস্তিকদের বইপত্রও কিনতে পারেন বিনা বাধায়। কেউ হুমকি দিলেই আমাজন রিচার্ড ডিকিন্সের বই সরিয়ে নেয় না। রকমারির এ ধরণের একটি স্ট্যাণ্ড-এ অবিচল থাকা উচিৎ ছিল। আর উচিৎ ছিল ফারাবীর মতো মৃত্যু-হুমকি দাতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের। কিন্তু তারা সেটা না করে ভাইরাসকে জিইয়ে রেখে সাইটকে পবিত্র পানি দিয়ে পাক-গোছল’ দিতে মনস্থ করলেন। কিন্তু এ ভাবে তো সমস্যার সমাধান হয় না। কোন রোগ সারাতে হলে রোগের উৎসটা নির্ধারণ করা জরুরী।