• স্বতন্দ্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্রবন্ধ সংকলন)
• সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০, শুদ্ধস্বর)
• অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১, শুদ্ধস্বর, সহলেখক: রায়হান আবীর)
• বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্রবন্ধ সংকলন)
• ভালবাসা কারে কয় (২০১২, শুদ্ধস্বর)
• শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪, শুদ্ধস্বর, সহলেখক: অধ্যাপক মীজান রহমান)
• বিশ্বাসের ভাইরাস (২০১৪, জাগৃতি প্রকাশনী) ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫, অবসর প্রকাশনা সংস্থা)
.
উৎসর্গ
শহীদ রাজীব হায়দার শোভন (থাবা বাবা)
শাহবাগ আন্দোলনে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’-এর প্রথম শিকার
.
২য় সংস্করণের ভুমিকা
বিশ্বাসের ভাইরাসের ২য় সংস্করণ বেরিয়ে গেল। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় যখন বইটির প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল তখন ভাবতেই পারিনি এতো দ্রুত— মানে কয়েক মাসের মধ্যেই বইটির ২য় সংস্করণের ভূমিকা লিখতে হবে। কিন্তু লিখতে হল। নতুন সংস্করণের জন্য ভূমিকা লেখার পেছনে যেমন আনন্দের ছোঁয়া আছে, তেমনি পাশাপাশি আছে কিছুটা বেদনার ছোঁয়াও। সাধারণত কোন বইয়ের পুনঃপ্রকাশের সময় ভূমিকা লিখতে গিয়ে লেখকেরা বেদনার্ত হন না। মনঃক্ষুণ্ণ হন না। বরং খুশিতে হন আপ্লুত। সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? খুশি আমি যথেষ্টই, কিন্তু পাশাপাশি একটা জায়গায় আছে বেদনাও। নতুন বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে আমি খুশির পাশাপাশি বেদনার্ত হচ্ছি— এ কথা শুনে হয়তো অনেকে অবাক হবেন। কিন্তু সেটাই হচ্ছি। কারণ আছে অবশ্য। বইটি ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায় অন্যতম সফল বিক্রিত বই হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। বহু পাঠক লাইন দিয়ে বইটি কিনেছেন। অনেকেই বইটি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকেই পড়ে মুগ্ধ হয়ে অন্যদেরও পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, বইমেলা শেষ হতে না হতেই বইটির বেশ কিছু ভাল রিভিউ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। তারমধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে মুক্তমনা ব্লগার দেব প্রসাদ দেবুর ‘বিশ্বাসের ভাইরাস: মেনে নয়, মনে নিন’ শিরোনামের চমৎকার রিভিউটির কথা। সেটি একাধিক সাইটে প্রকাশিত হয়েছিল[১]। এ ছাড়াও বহু জায়গায় বইটি নিয়ে লেখালিখি হয়েছে। এ পর্যন্ত অখুশি হবার কোন কারণ ছিল না।
কিন্তু খুশির সেই স্রোতে যেন খানিকটা ভাটা পড়ে গেল এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে শাফিউর রহমান ফারাবী নামের এক উগ্র জিহাদি ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে। ফারাবী নামক চরিত্রটিকে যারা চেনেন, তারা জানেন– ফেসবুকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, লুচ্চামি লোফারি করা, অজানা-অচেনা মেয়েদের হঠাৎ করে ম্যাসেজ করে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া, নিজের মোবাইলে ফ্লেক্সিলোডের জন্য টাকা পয়সা চাওয়া সহ বহু ফাতরামির জন্য ফারাবী ইতোমধ্যেই কুখ্যাত (যারা ফারাবী এ কাজগুলোর সাথে সম্যকভাবে পরিচিত নন, তারা মুক্তমনায় অনন্ত বিজয় দাশের লেখা ‘ফারাবীর ফাতরামি’ লেখাটা পড়ে নিতে পারেন[২])। কিন্তু সেটাই ফারাবীর একমাত্র পরিচয় নয়। নারী লোলুপ ফারাবী একদিকে যেমন মেয়েদের সাথে ‘লুলামি’তে মহা-ওস্তাদ, ঠিক একই ধারায় আবার ধর্ম রক্ষার সাচ্চা সৈনিকও বটে। নারী অবমাননার পাশাপাশি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে পাওয়া যায় ইসলাম ধর্ম প্রচারণার তাগুদি পোস্ট। ধর্মপ্রচারণা আর নারী অবমাননা যে একসূত্রে বাঁধা, তা ফারাবীকে না দেখলে ভাল করে বোঝা যাবে না। মানুষিকতা’ গ্রন্থের লেখক এবং ব্লগার রায়হান আবীর বিডিনিউজ পত্রিকায় তার একটি কলামে ফারাবীকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন, তা খুবই তাৎপর্যমন্ডিত[৩]–
‘নিজেকে কখনও নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘হিজবুত তাহরির’ কখনও ‘শিবিরের অনুসারী বলে প্রচার করা ফারাবীর ব্লগে আগমন ঘটেছিলো মূলত সহব্লগার মেয়েদের বিরক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে, তার প্রথম পোস্টও ছিলো অজানা অচেনা মেয়েদের বিয়ে করার অনুরোধ জানিয়ে’। মূলত বিভিন্ন ভুয়া আইডি খুলে ফেসবুক এবং ব্লগে মেয়েদের অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়াই ছিলো তার কাজ। ফেসবুকে আপনারা যারা নিয়মিত, তারা খেয়াল করে দেখবেন, বাংলা ভাষায় ফেসবুকে যে সকল নারীবিদ্বেষী, অশ্লীল, যৌন সুড়সুড়ি যোগানো পাতা রয়েছে তাদের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এরা ইন্টারনেট থেকে নারীদের বিভিন্ন ছবি সংগ্রহ করে সেটা তাদের অনুসারীদের সামনে উপস্থাপন করে এবং একই সাথে আরও একটা বিষয়ে তারা সমান কম্পাঙ্কে পোষ্ট করে। কী সেই বিষয়টা? ধর্ম এবং যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম, তাই এই অশ্লীল পাতাগুলোর কাছেও ধর্ম বলতে কেবল ইসলাম ফারাবী যেন এই মানুষগুলোরই প্রতিনিধি। যার একমাত্র কাজ হলো নারীদের উত্যক্ত করা এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে পোষ্ট দেওয়া।
ফারাবীর মত মানুষকে নিয়ে লিখতে কারো ভাল লাগে না, ফারাবী নামটা কোন মননশীল বইপত্রে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। “বিশ্বাসের ভাইরাস বইটির ভূমিকায় ফারাবীর মত লোককে নিয়ে সময় এবং শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে— ব্যাপারটা সত্যই বেদনার। কিন্তু তারপরেও একটা জায়গায় গুরুত্ব আছে। আসলে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ধারণাটির সাথে সাথে ফারাবীর সম্পর্ক গভীর। বিশ্বাসের ভাইরাস মস্তিষ্ক অধিকার করে ফেললে কী হয়— তার সহজ সরল এবং জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে এই ফারাবী। ফারাবীর মত “বিশ্বাসের ভাইরাস আক্রান্ত’ মননেরা মনে করে যে লেখকেরা ধর্মকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেন, এ নিয়ে যুক্তিবাদী লেখা লেখেন, তাদের ধরে ধরে হত্যা করা জায়েজ। ফেসবুকে ফারাবীর খুব সহজ স্বীকারোক্তি— ‘ইসলাম অর্থ শান্তি নয়, ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পন। ইসলামের ভিতরে জিহাদ, কিতাল সবই আছে। আল্লাহর রসূলকে যারা ঠাণ্ডা মাথায় গালিগালাজ করবে, আমরা তাদের হত্যা করব, এতে লুকোচুরির কিছু নেই। আমি ইসলাম বা আল্লাহ রসুলকে গালিগালাজ করে কোন লেখা বা বই প্রকাশ করিনি। যারা আমার লেখালিখির সাথে পরিচিত তারা জানেন, আমার সবগুলো বই-ই আসলে প্রান্তিক বিজ্ঞান এবং দর্শনের অন্তিম সমস্যা নিয়ে আবর্তিত। কোন বিশেষ ধর্ম বা ধর্মগুরুর প্রতি লক্ষ্য স্থির করে কোন বই-ই লিখিত হয়নি। তারপরেও দেখছি আমার বই এবং লেখালিখি ফারাবীর মত বিশ্বাসের ভাইরাসাক্রান্ত মননের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্য ছিল যথেষ্ট। আসলে বিজ্ঞান এবং দর্শনের নির্মম সত্যগুলো সব সময়ই ধর্মবাদীদের বুকে শেলের মত বেঁধে। ধর্মরক্ষার জন্য তারা হয়ে উঠে মরিয়া। বছরের শুরুতেই আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল এই উগ্র জঙ্গি। স্ট্যাটাসে বলেছিল, আমাকে হত্যা করা নাকি মুসলমানদের জন্য এখন ‘ফরজ’ হয়ে গেছে। পরে আরো বেশ কয়েকবার হত্যার হুমকি দিয়েছিল। ফেসবুক মন্তব্যে আমাকে শেষবার যে হত্যার হুমকি দিয়েছিল তাতে সে বলেছিল– অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে। জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক বিডিনিউজ পত্রিকার একটি রিপোর্টে রীতিমত স্ক্রিনশট উল্লেখ করে ফারাবীর বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছিল সে সময়[৪]।