আমাদের দীর্ঘদিনের জমে থাকা প্রথাগত বিশ্বাসের ‘ভাইরাসগুলোও’ কি আমাদের সময় সময় এভাবে আমাদের অজান্তেই বিপথে চালিত করে না কি? আমরা আমাদের বিশ্বাস রক্ষার জন্য প্রাণ দেই, বিধর্মীদের হত্যা করি, টুইন টাওয়ারের উপর হামলে পড়ি, সতী নারীদের পুড়িয়ে আত্মতৃপ্তি পাই, বেগানা মেয়েদের পাথর মারি… মনোবিজ্ঞানী ডেরেল রে তার ‘The God Virus: How religion infects our lives and culture’ বইয়ে বলেন, জলাতঙ্কের জীবাণু দেহের ভিতরে ঢুকলে যেমন মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও মানুষের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তৈরি হয় ভাইরাস আক্রান্ত মননের।
নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম যেমনি ভাবে ঘাস ফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে, ঠিক তেমনি আমরা মনে করি ধর্মের বিভিন্ন বাণী এবং জিহাদি শিক্ষা মানব সমাজে অনেকসময়ই ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইটের মত সংক্রমণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী করে তোলে। ফলে আক্রান্ত সন্ত্রাসী মনন বিমান নিয়ে আছড়ে পড়ে টুইন টাওয়ারের উপর। নাইন-ইলেভেনের বিমান হামলায় উনিশ জন ভাইরাস আক্রান্ত মনন ‘ঈশ্বরের কাজ করছি এই প্যারাসাইটিক ধারণা মাথায় নিয়ে হত্যা করেছিলো প্রায় তিন হাজার জন সাধারণ মানুষকে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অধ্যাপক ব্রুস লিংকন, তার বই ‘হলি টেররস: থিংকিং এবাউট রিলিজিয়ন আফটার সেপ্টেম্বর ইলেভেন’ বইয়ে বিষয়টির উপর আলোকপাত করে বলেন, ধর্মই, মুহাম্মদ আতা সহ আঠারজনকে প্ররোচিত করেছিল এই বলে যে, সংগঠিত বিশাল হত্যাযজ্ঞ শুধুমাত্র তাদের কর্তব্য নয়, বরং স্বর্গ থেকে আগত পবিত্র দায়িত্ব[২৬]। হিন্দু মৌলবাবাদীরাও একসময় ভারতে রাম-জন্মভূমি অতিকথনের ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। বিগত শতকের আশির দশকে মাইকেল ব্ৰে নামের কুখ্যাত এক খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়ার গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোতে উপর বোমা হামলার পর বাইবেলের বাণীকে রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন আদালতে। এধরণের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাস থেকে হাজির করা যাবে, ভাইরাস আক্রান্ত মনন কীভাবে কারণ হয়েছিল সভ্যতা ধ্বংসের।
ছবি। পেজ ৩১
চিত্র: বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামে এক প্যারাসাইটের সংক্রমণে ঘাস ফড়িং পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে (বামে), ঠিক একইভাবে বিশ্বাসের ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত আল-কায়দার ১৯ জন সন্ত্রাসী যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলো টুইন টাওয়ারের উপর ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর (ডানে)। বিশ্বাসের ভাইরাসের বাস্তব উদাহরণ।
১১ সেপ্টেম্বরের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার পরে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স ফ্রি ইনকোয়েরি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘Design for a Faith-Based Missile’ নামে। তিনি সেই প্রবন্ধে আত্মঘাতী সন্ত্রাসীদের বিশ্বাস নির্ভর (ভাইরাসাক্রান্ত) মিসাইল হিসেবে অভিহিত করে লেখেন[২৭]–
‘কোন সন্দেহ নেই যে, পরকাল-আবিষ্ট আত্মঘাতী মস্তিষ্ক আসলেই একটি বিপজ্জনক অস্ত্র এবং সমুহ বিপদের কারণ। এটি তীক্ষ্ণ মিসাইলের সাথে তুলনীয়, এবং বহু ক্ষেত্রে এর পথনির্দেশ-ব্যবস্থা সেই সব পরিশীলিত অত্যাধুনিক এবং ব্যয়বহুল ইলেকট্রনিক ব্রেনের চেয়েও প্রকৃষ্ট। তারপরেও নৈরাশ্যবাদী সরকার, সংগঠন, এবং মোল্লাতন্ত্রের জন্য খুবই খুবই সস্তা’।
সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে আবারো ফিরে তাকাই। অনেকেই বলেন, ইসলামী সন্ত্রাসবাদ লালন পালনে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিশাল অবদান আছে। এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য। যেমন, বুশের রাজত্বকালে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের ব্যাপারটা কেউ ভুলে যায়নি। জনবিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্র না পাওয়া কিংবা সাদ্দামের সাথে আল কায়েদার কোন সম্পর্ক না খুঁজে পাওয়া কিংবা জৈব-যুদ্ধাস্ত্র না পাওয়া সত্ত্বেও নির্লজ্জ ভাবে ইরাকের উপর যে আগ্রাসন চালিয়েছে তা শুধু যে আমেরিকার চিরচেনা সাম্রাজ্যবাদী চেহারাটাকেই স্পষ্ট করে তুলেছিল তা নয়, ইসলামী বিশ্ব এই আগ্রাসনকে যে কোন কারণেই হোক ‘ইসলামের উপর আঘাত’ হিসেবে নিয়েছে। সেজন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সে সমস্ত দেশেই ইসলামী আত্মঘাতী বোমা হামলার মাত্রাটা বেশী ছিল যে দেশের সরকার ইরাক যুদ্ধে বুশ-ব্লেয়ারকে নগ্নভাবে সমর্থন করেছে সেসময়।
প্যালেস্টিনীয়দের বঞ্চিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলকে নগ্ন ভাবে সমর্থন করেছে তাও মুসলিম সমাজকে সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়েছে। এই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আর প্রতিহিংসার ব্যাপারগুলো ভুলে গেলে কোন আলোচনাই কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু তারপরেও কেবল আমেরিকার দিকে অঙ্গুলি তুলে ধর্মগ্রন্থগুলোকে কখনোই ‘ধোয়া তুলসীপাতা বানানো যায় না। ধর্মগ্রন্থের যে অংশগুলোতে জিহাদের কথা আছে, উদ্ভিন্নযৌবনা হুরীদের কথা আছে, মুক্তা সদৃশ’ গেলমানদের কথা আছে সে সমস্ত পবিত্র বাণীগুলো ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে কিংবা বছরের পর বছর সৌদি পেট্রোডলারে গড়ে ওঠা মাদ্রাসা নামক আগাছার চাষ করে বিভিন্ন দেশে তরুণ সমাজের কিছু অংশের মধ্যে এক ধরণের বিশ্বাসের ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে; ফলে এই ভাইরাস আক্রান্ত জিহাদিরা স্বর্গের ৭২ টা হুর-পরীর আশায় নিজের বুকে বোমা বেঁধে আত্মাহুতি দিতেও আজ দ্বিধাবোধ করে না। ল্যাংসেট ফ্লক প্যারাসাইটের মত তাদের মনও কেবল একটি বিশ্বাস দিয়ে চালিত– অমুসলিম কাফেরদের হত্যা করে সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম করতে হবে, আর পরকালে পেতে হবে আল্লাহর কাছ থেকে উদ্ভিন্নযৌবনা আয়তলোচনা হুর-পরীর লোভনীয় পুরস্কার। তারা ওই ভাইরাস আক্রান্ত পিঁপড়ে কিংবা ঘাস ফড়িং-এর মত হামলে পড়ছে কখনো টুইন টাওয়ারে, কখনো রমনার বটমূলে, ভারতের তাজ হোটেলে, লন্ডনের পাতাল রেলস্টেশনে, কিংবা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ভবনে।