সুন্দরীর সহচরী ভাল জানে চর্য্যা।
রতন মন্দিরে করে মনোহর শয্যা॥
দুই দুই তাকিয়া খাটের দুই ধারি।
ডৌল ভাঙ্গি টাঙ্গাইল চিকন মশারি॥
ভক্ষ্য দ্রব্য নানা জাতি মণ্ডা মনোহরা।
সরভাজা নিখতি বাতাসা রসকরা॥
অপূর্ব্ব সন্দেশ নামে এলাইচ্ দানা।
ফুল চিনি লুচি দধি দুগ্ধ ক্ষীর ছানা॥
চিনির পানা কর্পূর চন্দন কালাগুরু বিছানা-বালিস লেপ-তোষক ইত্যাদি দিয়ে যে ত্রিপদী চৌপদী, সে গুলো কবিতা কিম্বা ভাবের তিন পায়া চার পায়া টেবিল চৌকি বল্লেও বলা চলে। বিলাসীর দৃষ্টির সঙ্গে ভাবুকের দৃষ্টির কোনখানে যে তফাৎ তা স্পষ্ট ধরা যাবে দুই ভাবুকের লেখা বাসকসজ্জার বর্ণন দিয়ে; যথা—
অপরূপ রাইক রচিত।
নিভৃত নিকুঞ্জ মাঝে, ধনী সাজয়ে
পুনঃ পুনঃ উঠয়ে চকিত॥
ধুয়োতেই, ভাব-সচকিত চাহনি নিভৃত নিকুঞ্জের অপরূপ শোভা মনকে দুলিয়ে দিলে; আবার যেমন—
আজ রচয়ে বাসক শেজ,
মুনিগণ চিত হেরি মুরছিত
কন্দর্পের ভাঙ্গে তেজ।
ফুলের অচির, ফুলের প্রাচীর
ফুলেতে ছাইল ঘর,
ফুলের বালিস আলিস কারণ
প্রতি ফুলে ফুলশর।
বিলাসীর দৃষ্টিতে ধরা পড়লো ভাল ভাল কাযের সাজ সরঞ্জাম যা টপ করে গিলে খেতে ইচ্ছে হয় তাই, আর ভাবুকের দৃষ্টিতে ধরা গেল সেইগুলো যাদের দিকে নয়ন ভরে দুদণ্ড চেয়ে দেখতে সাধ হয়। বিলাসীর দৃষ্টি স্বার্থের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকে সৃষ্টির যথার্থ শোভা সৌন্দর্য ও রসের বিষয়ে মানুষটাকে বাস্তবিকই অন্ধ করে রাখে অনেকখানি, আর ভাবুকের দৃষ্টি কায-ভোলা ছেলেবেলার দৃষ্টি সৃষ্টির অপরূপ রহস্যের খুব গভীর দিকটায় নিয়ে চলে মানুষকে। কাযেই ভাবুকের শোনা-দেখা বলা-কওয়ার মধ্যে শিশুসুলভ এমনতরো সরলতা ও কল্পনার প্রসার থাকে। ভাবুকদৃষ্টি এত অপরূপ অসাধারণভাবে দেখে-শোনে, দেখায়-শোনায় যে কাযের মানুষের দেখা-শোনা ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করে দেখলে ভাবুকের চোখে দেখা ছবি কবিতা সমস্তই হেঁয়ালী বা ছেলেমান্ষির মতই লাগে। কাযের দৃষ্টি নিয়ে মানুষের মন কোন্খানে কি ভাবেই বা খেলা করছে, আর ভাবুকের দৃষ্টি নিয়েই বা মন কোথায় কি খেলছে কেমন করে, দেখলেই দুয়ের তফাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রথমে কাযের কাজির দেখা দিয়ে লেখা মনের খেলা ঘরের দৃশ্য—
মন খেলাওরে দাণ্ডা গুলি
আমি তোমা বিনা নাহি খেলি॥
এড়ি বেড়ি তেড়ি চাইল,
চম্পাকলী ধুলা ধুলী।
এইবার ভাবুকের দৃষ্টি কবির মনটিকে কোন কায-ভোলা জগতের খেলাঘরের ছুটির মাঝে ছেড়ে দিয়ে গেল তারি ছুটি গান—
“আকাশে আজ কোন চরণের আসা-যাওয়া,
বাতাসে আজ কোন পরশের লাগে হাওয়া,
অনেক দিনের বিদায় বেলার ব্যাকুল-বাণী,
আজ উদাসীর বাঁশীর সুরে কে দেয় আনি,
বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া।
কোন ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা,
মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা,
বকুল তলায় কায-ভোলা সেই কোন্ দুপুরে,
যে সব কথা ভাসিয়েছিলেম গানের সুরে,
ব্যথায় ভরে ফিরে আসে সে গান গাওয়া।”
কাযের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মাঝে মনের মরুভূমির উপরে যেন হঠাৎ আকাশ থেকে শ্যামল ছায় নাম্লো, জল ভরে এলো চোখের কোণে, কান শুনলে বাঁশীর সুর উন্মনা হয়ে, কায-ভোলা মন বকুল তলার নিবিড় ছায়ায় খুঁজতে লাগলো ছেলেবেলার হারানো খেলার সাথীকে, আর গাইতে লাগলো ক্ষণে ক্ষণে—
“শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।”
এমনিতরো ভাবুক দৃষ্টি দিয়ে সব মানুষের শিশুকাল সৃষ্টির যা কিছু—আকাশের তারা থেকে মাটির ঢেলাটাকে পর্যন্ত—একদিন দেখে চলেছিল, কিন্তু অবোলা শিশুকাল আমাদের কেমন দেখলে কেমন শুনলে সেটা খুলে বলতে পারলে না, এঁকে দেখাতে পারলে না। কবিতা ছবি ইত্যাদি লেখার কৌশল, ভাষার খুঁটিনাটি, ছন্দের হিসেব না জানার দরুণ শিশুকাল আমাদের কবির ভাষায় ছবির ভাষায় আপনাকে ব্যক্ত করতে পারলে না। শিশুর তরুণ দৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টির সামগ্রীকে সখীভাবে খেলাবার সাথী বলে চেয়ে দেখবার শুনে দেখবার ছুঁয়ে দেখবার একটা আগ্রহ থাকে, সেই একাগ্রতা দিয়ে দেখা শোনা ছোঁয়ার রসটা ছেলেমেয়েরা উপভোগ করে মহানন্দে, কিন্তু সে আনন্দ ব্যক্ত করে কেবল অভিনয় ছাড়া আর কিছু দিয়ে এমন সাধ্য শিশুর পুঁজি নিয়ে হয় না। শিশু যখন একটা কিছু বর্ণনা করে তখন তার মুখ চোখ হাত পা সমস্তই যেন ঘটনাটাকে মূর্তি দিয়ে বাইরে হাজির করবার জন্যে আকুলি ব্যাকুলি করছে দেখা যায়, যেটা বড় হয়ে আমরা কবিতায় অথবা ছবিতে ব্যক্ত করি সেটা অভিনয় ক’রে ব্যক্ত করা ছাড়া শিশুকাল আর কিছুই করতে পারে না; এমন বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে কেঁদে নেচে, কখন গলা জড়িয়ে, কখন ধূলায় লুটিয়ে, আধ আধ কথায় অতি মনোহর অতি চমৎকারী একটা নিজের অদ্ভুত রকমে সৃষ্টি করা ভাষায় শিশু আপনার দেখা শোনা সমস্তই ব্যক্ত করে চলে যে, বড় হয়ে যারা আপনাদের দৃষ্টি শ্রবণ স্পর্শনের উপরে অত্যন্ত কাযের চশমা এঁটে দিয়েছে তাদের বোঝাই মুস্কিল হয় শিশুকাল অনাসৃষ্টি কি দেখছে, কিবা দেখাতে চাচ্ছে, কি শুনছে কিবা শোনাচ্ছে! শিশুর হৃদয় যে ভাবে গিয়ে স্পর্শ এবং পরখ করে নেয় বিশ্বচরাচরকে, একমাত্র ভাবুক মানুষই সেই ভাবে বিশ্বের হৃদয়ে আপনার হৃদয় লাগিয়ে দেখতে পারেন শুনতে পারেন, এবং অবোলা শিশু যেটা বলে যেতে পারলে না সেইটেই বলে যান ভাবুক কবিতায় ছবিতে,—রেখার ছন্দে লেখার ছন্দে সুরের ছন্দে অবোলা শিশুর বোল, হারানো দিনগুলির ছবি। অফুরন্ত আনন্দ আর খেলা দিয়ে ভরা শিশুকালের দিন-রাতগুলোর জন্যে সব মানুষেরই মনে যে একটা বেদনা আছে, সেই বেদনা ভরা রাজত্বে ফিরিয়ে নিয়ে চলেন মানুষের মনকে থেকে থেকে কবি এবং ভাবুক—যাঁরা শিশুর মতো তরুণ চোখ ফিরে পেয়েছেন। খুব খানিকটা ন্যাকামোর ভিতর দিয়ে নিজেকে এবং নিজের বলা কওয়া গুলোকে চালিয়ে নিয়ে গেলেই আমাদের সৃষ্টির ও দৃষ্টির মধ্যে তারুণ্য ফিরে পাওয়া সহজেই যাবে এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা—শিশুকাল ন্যাকামি দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে না, সে যথার্থই ভাবুক এবং আপনার চারিদিককে সে সত্যই হৃদয় দিয়ে ধরতে চায় বুঝতে চায় এবং বোঝাতে চায় ও ধরে দিতে চায়। শুধু সে যা দেখে শোনে সেটা ব্যক্ত করার সম্বল তার এত অল্প যে, সে খানিকটা বোঝায় নানা ভঙ্গি দিয়ে, খানিক বোঝাতে চায় নানা আঁচড় পোঁচড় নয় তো ভাঙ্গা ভাঙ্গা রেখা লেখা ও কথা দিয়ে,—এইখানে কবির সঙ্গে ভাবুকের সঙ্গে পাকা অভিনেতার সঙ্গে শিশুর তফাৎ। দৃষ্টি দুজনেরই তরুণ কেবল একজন সৃষ্টি করার কৌশল একেবারেই শেখেনি, আর একজন সৃষ্টির কৌশলে এমন সুপটু যে কি কৌশলে যে তাঁরা কবিতা ও ছবির মধ্যে শিশুর তরুণ দৃষ্টি আর অস্ফুট ভাষাকে ফুটিয়ে তোলেন তা পর্যন্ত ধরা যায় না।