এখন মানুষের ব্যক্তিগত রুচির উপরে সুন্দর অসুন্দরের বিচারের শেষ নিষ্পত্তিটা যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে সুন্দর অসুন্দরের যাচাই করবার আদর্শ কোন্খানে পাওয়া যাবে এই আশঙ্কা সবারই মনে উদয় হয়। সুন্দরকে বাহ্যিক উপমান ধরে’ যাচাই করে নেবার জন্যে এ ব্যস্ততার কারণ আমি খুঁজে পাইনে। ধর, সুন্দরের একটা বাঁধাবাঁধি প্রত্যক্ষ আদর্শ রইলো না, প্রত্যেকে আমরা নিজের নিজের মনের কষ্টিপাথরেই বিশ্বটাকে পরীক্ষা করে চল্লেম—খুব আদিকালে মানুষ আর্টিষ্ট যে ভাবে সুন্দরকে দেখে চলেছিল—এতে করে’ মানুষের সৌন্দর্য উপভোগ সৌন্দর্য সৃষ্টির ধারা কি একদিনের জন্য বন্ধ হ’ল জগতে? বরং আর্টের ইতিহাসে এইটেই দেখতে পাই যে যেমনি কোন জাতি বা দল আর্টের দিক দিয়ে কিছুকে আদর্শ করে’ নিয়ে ধরে’ বসলো পুরুষ-পরম্পরায় অমনি সেখানে রসের ব্যাঘাত হতে আরম্ভ হ’ল, আর্টও ক্রমে অধঃ থেকে অধোগতি পেতে থাকলো। আমাদের সঙ্গীতে সেই তানসেন ও আকব্বরি চাল, ছবিতে দিল্লীর চাল বা বিলাতী চাল যে কুকাণ্ড ঘটাতে পারে, এবং সেই আদর্শকে উল্টে ফেলে চল্লেও যা হতে পারে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সমস্ত আমাদের সামনেই ধরা রয়েছে, সুতরাং আমার মনে হয় সুন্দরের একটা আদর্শের অভাব হ’লে তত ভাবনা নেই, যত ভাবনা আদর্শটা বড় হয়ে আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞান ও অনুভবশক্তির বিলুপ্তি যদি ঘটায়। কালিদাসের আমলে ‘তম্বী শ্যামা শিখরদশনা’ ছিল সুন্দরীর আদর্শ। অজন্তার এবং তার পূর্বের যুগ থেকেও হয়তো এই আদর্শই চলে আসছিল, মোগলানী এসে এবং অবশেষে আরমাণি থেকে আরম্ভ করে ফিরিঙ্গিনী পর্যন্ত এসে সে আদর্শ উল্টে দিলে এবং হয়তো কোন দিন বা চীনই এসে সেটা আবার উল্টে দেয় তারও ঠিক নেই। আদর্শটা এমনিই অস্থায়ী জিনিষ যে তাকে নিয়ে চিরকাল কারবার করা মুস্কিল। রুচি বদলায় আদর্শও বদলায়, যেটা ছিল এককালের চাল সেটা হয় অন্যকালের বেচাল, ছিল টিকি এল টাই, ছিল খড়ম এল বুট, এমনি কত কি! গাছগুলো অনেককাল ধরে’ এক অবস্থায় রয়েছে—সেই জন্যে এই গুলোকেই আদর্শ গাছ ইত্যাদি বলে’ আমাদের মনে হয় কিন্তু পৃথিবীর পুরাকালের গাছ পাতা ফল ফুলের আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা—অথচ তারাও তো ছিল সুন্দর!—সুতরাং পরিবর্তনশীল বাইরেটার মধ্যে সুন্দর আদর্শভাবে থাকে না। শিশু গাছ, বড় গাছ এবং বুড়ো গাছ প্রত্যেকেরই মধ্যে যে সুন্দরের ধারা চলছে, পরম সুন্দর হয়ে দেখা দেবার নিত্য এবং বিচিত্র চেষ্টা সেই প্রাণের স্রোত নিয়ে হচ্ছে গাছ সুন্দর। এমনি আমাদের মনে বা বস্তু ও ভাবের অন্তরে যে নিত্য এবং সুন্দর প্ৰাণের স্রোত গোপনে চলেছে তাকেই সুন্দরের আদর্শ বলে’ ধরতে পারি, আর কিছুকে নয়, এবং সেই আদর্শই সুন্দরকে যাচাই করার যে নিত্য আদর্শ নয় তা জোর করে কে বলতে পারে! সমস্ত পদার্থের সৌন্দর্যের পরিমাপ হল তাদের মধ্যে, অনিত্য রস যা তা নিয়ে বাইরের রং রূপ বদলে’ চলে কিন্তু নিত্য যা তার অদল বদল নাই। সব শিল্পকে যাচাই করে’ নেবার জন্যে আমাদের প্রত্যেকের মনে নিত্য সুন্দরের যে একটি আদর্শ ধরা আছে—তার চেয়ে বড় আদর্শ কোথায় আর পাবো? যে ভাবেই হোক যে বস্তুই হোক যখন সে নিত্য তার আস্বাদ দিয়ে আমাদের মনে পরমসুন্দরের স্বল্পাধিক স্পর্শ অনুভব করিয়ে গেল সে সুন্দর বলে’ আমাদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করলে। আমার কাছে কতকগুলো জিনিষ কতকগুলো ভাব সুন্দর ঠেকে কতক ঠেকে অসুন্দর, এই ঠেকলো সুন্দর এই অসুন্দর, তোমার কাছেও তাই, আমার মনের সঙ্গে মেলে না তোমারটি তোমার সঙ্গে মেলে না অামারটি। সুন্দরের অসুন্দরের অবিচলিত অাদর্শ চলায়মান জীবনে কোথাও নেই, সুতরাং যেদিক দিয়েই চল সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে বিতর্ক মেটবার নয়, কাযেই এই অতৃপ্তিকেই—এই সুখ-দুঃখে আলো-আঁধারে সুন্দর, অসুন্দরে মেলা খণ্ড-বিখণ্ড সত্য সুন্দর এবং মঙ্গলকে—সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়ে যে চলতে পারে, সেই সুন্দরকে এক ও বিচিত্রভাবে অনুভব করবার সুবিধে পায়। জগৎ যার কাছে তার ছোট লোহার সিন্দুকটিতেই ধরা আর জগৎ যার কাছে লোহার সিন্দুকের বাইরেও অনেকখানি বিস্তৃত ধূলোর মধ্যে কাদার মধ্যে আকাশের মধ্যে বাতাসের মধ্যে, তাদের দু’জনের কাছে সুন্দর ছোট বড় হয়ে দেখা যে দেয় তার সন্দেহ নেই! সিন্দুক খালি হ’লে যার সিন্দুক তার কাছে কিছুই আর সুন্দর ঠেকে না, কিন্তু যার মন সিন্দুকের বাইরের জগৎকে যথার্থভাবে বরণ করলে তার চোখে সুন্দরের দিকে চলবার অশেষ রাস্তা খুলে গেল, চলে গেল সে সোজা নির্বিচারে নির্ভয়ে। যখন দেখি নৌকা চলেছে ভয়ে ভয়ে, পদে পদে নোঙ্গর আর খোঁটার আদর্শে ঠেকতে ঠেকতে, তখন বলি, নৌকা সুন্দর চল্লো না, আর যখন দেখলেম নৌকা উল্টো স্রোতের বাধা উল্টো বাতাসের ঠেলাকে স্বীকার করেও গন্তব্য পথে সোজা বেরিয়ে গেল ঘাটের ধারের খোঁটা ছেড়ে নোঙ্গর তুলে নিয়ে, তখন বলি, সুন্দর চলে গেল!
সুন্দর অসুন্দর–জীবন-নদীর এই দুই টান—একে মেনে নিয়ে যে চল্লো সেই সুন্দর চল্লো আর যে এটা মেনে নিতে পারলে না সে রইলো যে কোনো একটা খোঁটায় বাঁধা। ঘাটের ধারে বাঁশের খোঁটা, তাকে অতিক্রম করে চলে’ যায় নদীর স্রোত নানা ছন্দে এঁকে বেঁকে,—আর্টের স্রোতও চলেছে চিরকাল ঠিক এই ভাবেই চিরসুন্দরের দিকে। সুন্দর করে’ বাঁধা আদর্শের খোঁটাগুলো আর্টের ধাক্কায় এদিক ওদিক দোলে, তারপর একদিন যখন বান ডাকে খোঁটা সেদিন নিজে এবং নিজের সঙ্গে বাঁধা নৌকাটাকেও নিয়ে ভেসে যায়। আর্ট এবং আর্টিষ্ট এদের মনের গতি এমনি করে’ পণ্ডিতদের বাঁধা এবং মূর্খদের আঁকড়ে ধরা তথাকথিত দড়ি খোঁটা অতিক্রম করে’ উপড়ে’ ফেলে’ চলে’ যায়। বড় আর্টিষ্টরা সুন্দরের আদর্শ গড়তে আসেন না, যেগুলো কালে কালে সুন্দরের বাঁধাবাঁধি আদর্শ হয়ে দাঁড়াবার জোগাড় করে, সেইগুলোকেই ভেঙে দিতে আসেন, ভাসিয়ে দিতে আসেন সুন্দর অসুন্দরের মিলে যে চলন্ত নদী তারি স্রোতে। যে পারে সে ভেসে চলে মনোমত স্থানে মনতরী ভেড়াতে ভেড়াতে সুন্দর সূর্যাস্তের মুখে, আর সেটা যে পারে না সে পরের মনোমত সুন্দর করে’ বাঁধা ঘাটে আটকা থেকে আদর্শ খোঁটায় মাথা ঠুকে ঠুকেই মরে, সুন্দর অসুন্দরের জোয়ার ভাঁটা তাকে বৃথাই দুলিয়ে যায় সকাল সন্ধ্যে!