এক সময়ে আর্টিষ্টদের মনে জায়গা জায়গা থেকে তিল তিল করে বস্তুর খণ্ড খণ্ড সুন্দর অংশ নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সুন্দর মূর্তি রচনা করার মতলব জেগেছিল। গ্রীসে এক কারিগর এইভাবে হেলেনের চিত্র পাঁচজন গ্ৰীক সুন্দরীর পঞ্চাশ টুকরো থেকে রচনা করে সমস্ত গ্ৰীসকে চম্কে দিয়েছিল। কিছুদিন ধরে ঐ মূর্তিরই জল্পনা চল্লো বটে কিন্তু চিরদিন নয়, শেষে এমনও দিন এল যে ঐ ভাবে তিলোত্তমা গড়ার চেষ্টা ভারি মূর্খতা একথাও আর্টিষ্টরা বলে’ বসলো! আমাদের দেশেও ঐ একই ঘটনা—শাস্ত্রসম্মত মূর্তিকেই রম্য বলে পণ্ডিতেরা মত প্রকাশ করলেন, সে শাস্ত্র আর কিছু নয় কতকগুলো মাপ-জোঁক এবং পদ্ম-আঁখি, খঞ্জন-নয়ন, তিলফুল, শুকচঞ্চু, কদলীকাণ্ড, কুক্কুটাণ্ড, নিম্বপত্র এই সব মিলিয়ে সৌন্দর্যের এবং আধ্যাত্মিকতার একটা পেটেণ্ট খাদ্যসামগ্ৰী! মনের খোরাক এভাবে প্রস্তুত হয় না, কাযেই আমাদের শাস্ত্রসম্মত সুতরাং বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক যে artificiality তা ধর্ম-প্রচারের কাযে লাগলেও সেখানেই আর্ট শেষ হলো একথা খাটলো না। একেষাং মতম্ বলে একটা জিনিয সে বলে’ উঠলো ’তদ্ রম্যং যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ’, মনে যার যা ধরলো সেই হ’ল সুন্দর। এখন তর্ক ওঠে—মনে ধরা না ধরার উপরে সুন্দর অসুন্দরের বিচার যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে কিছু সুন্দর কিছুই অসুন্দর থাকে না সবই সুন্দর সবই অসুন্দর প্রতিপন্ন হয়ে যায়, কোন কিছুর একটা অাদর্শ থাকে না। ভক্ত বলেন ভক্তিরসই সুন্দর আর সব অসুন্দর, যেমন শ্রীচৈতন্য বল্লেন—
“ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাম্বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি॥”
আর্টিষ্ট বল্লেন,—কাব্যং যশসে অর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে ইত্যাদি। যার মন যেটাতে টানলো তার কাছে সেইটেই হল সুন্দর অন্য সবার চেয়ে। এখন সহজেই আমাদের মনে এই দ্বিধা উপস্থিত হয়—কোন্ দিকে যাই, ভক্তের ফুলের সাজিতে গিয়ে উঠি, না আর্টিষ্টের বাঁশিতে গিয়ে বাজি? কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায়, ঘোরতর বৈরাগী এবং ঘোরতর অনুরাগী দুইজনেই চাইছেন একই জিনিষ—ভক্ত ধন চাইছেন না কিন্তু সব ধনের যা সার তাই চাইছেন, জন চাইছেন না কিন্তু সবার যে আপনজন তাকেই চাইছেন, সুন্দরী চান না কিন্তু চান ভক্তি, কবিতা নয় কিন্তু যিনি কবি যিনি স্রষ্টা—সুন্দরের যিনি সুন্দর—তাঁর প্রতি অচলা যে সুন্দরী ভক্তি তার কামনা করেন। আর্টিষ্ট ও ভক্ত উভয়ে শেষে গিয়ে মিলেছেন যা চান সেটা সুন্দর করে পেতে চান এই কথাই বলে’। মুখে সুন্দরী চাইনে বল্লে হবে কেন, মন টান্ছে বৈরাগীর ও অনুরাগীর মতোই সমান তেজে যেটা সুন্দর সেটার দিকে। মানুষের অন্তর বাহির দুয়ের উপরেই সুন্দরের যে বিপুল আকর্ষণ রয়েছে তা সহজেই ধরা যাচ্ছে—শুন্তে চাই আমরা সুন্দর, বলতে চাই সুন্দর, উঠ্তে চাই, বস্তে চাই, চল্তে চাই সুন্দর, সুন্দরের কথা প্রত্যেক পদে পদে আমরা স্মরণ করে চলেছি। পাই না পাই, পারি না পারি, সুন্দর বৌ ঘরে আনবার ইচ্ছা নেই এমন লোক কম আছে। যা কিছু ভাল তারি সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে দেখা হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। আমরা কথায় কথায় বলি—গাড়ীখানি সুন্দর চলেছে, বাড়ীখানি সুন্দর বানিয়েছে, ওষুধ সুন্দর কায করছে; এমন কি পরীক্ষার প্রশ্ন আর উত্তরগুলো সুন্দর হয়েছে একথাও বলি। এমনি সব ভালর সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে থাকতে যখন আমরা দেখছি তখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে সুন্দরের আকর্ষণ আমাদের মনকে ভালোর দিকেই নিয়ে চলে, আর বাকে বলি অসুন্দর তারও তো একটা আকর্ষণ আছে, সেও তো যার মন টানে আমার কাছে অসুন্দর হয়েও তার কাছে সুন্দর বলেই ঠেকে, তবে মনে ধরা এবং মন টানার দিক থেকে সুন্দরে অসুন্দরে ভেদ করি কেমন করে’? কাযেই সুন্দর অসুন্দর দুই মিলে চুম্বক পাথরের মত শক্তিমান একটি জিনিষ বলেই আমার কাছে ঠেকছে। সুন্দরের দিকটা হ’ল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক এবং অসুন্দরের দিকও হ’ল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক। এখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে চুম্বক যেমন ঘড়ির কাঁটাকে দক্ষিণ থেকে পরে পরে সম্পূর্ণ উত্তরে নিয়ে যায় তেমনি সুন্দরের টান মানুষের মনকে ক্ষণিক ঐহিক নৈতিক এমনি নানা সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে মহাসুন্দরের দিকেই নিয়ে চলে, আর অসুন্দরের প্রভাব সেও মানুষের মনকে আর এক ভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলে কদৰ্যতার দিকেই। কিন্তু সত্যিকার একটা কাঁটা আর চুম্বক নিয়ে যদি এই সত্যটা পরীক্ষা করতে বসা যায় তবে দেখবো সুন্দরের একটা চিহ্ন দিয়ে তারি কাছে যদি চুম্বকের টানের মুখ রাখা যায় তবে কাঁটা সোজা সুন্দরে গিয়ে ঠেকবে নিজের ঘর থেকে, আবার ঐ চুম্বকের মুখ যদি অসুন্দর চিহ্ন দিয়ে সেখানে রাখা যায় তবে ও কাঁটা উল্টো রাস্তা ধরেই ঠিক অসুন্দরে গিয়ে না ঠেকে পারে না। কিন্তু এমন তো হয় যে, আমি যদি মনে করি তবে অসুন্দরের গ্রাস থেকেও কাঁটাকে আরো খানিক টেনে সুন্দরের কাছে পৌঁছে দিতে পারি কিম্বা সুন্দরের দিক থেকে অসুন্দরে নামিয়ে দিতে পারি! সুতরাং সুন্দর অসুন্দরের মধ্যে কোন্টাতে আমাদের দৃষ্টি ও সৃষ্টি সমুদয় গিয়ে দাঁড়াবে তার নির্দেশ কর্তা হচ্ছে আমাদের মন ও মনের ইচ্ছা। মনে হ’ল তো সুন্দরে গিয়ে লাগলেম, মনে হ’লতো অসুন্দরে গিয়ে পড়লেম কিম্বা সুন্দর থেকে অসুন্দর অসুন্দর থেকে সুন্দরে দৌড় দিলেম, মন ও মনের শক্তি হল এ বিষয়ে নিয়ন্তা। টানে ধরলে যে চুম্বক ধরেছে তার মনের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রয়োজন না রেখেই কাঁটা আপনিই তার চরম গতি পায়, কিন্তু এই গতিকে সংযত করে’ অধোগতি থেকে ঊর্ধ্ব বা ঊর্ধ্ব থেকে অধোভাবের দিকে আনতে হলে আমাদের মনের একটা ইচ্ছাশক্তি একান্ত দরকার। বিল্বমঙ্গল বারবনিতার প্রেমোন্মাদ থেকে বিভুর প্রেমোন্মাদে গিয়ে যে ঠেকলেন সে শুধু তাঁর মনটি শক্তিমান ছিল বলেই। নিকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টে, অসুন্দর থেকে সুন্দরে যেতে সেই পারে যার মন উৎকৃষ্ট ও সুন্দর, যার মন অসুন্দর সেও এই ভাবে চলে ভাল থেকে মন্দে। অার্টিষ্ট কবি ভক্ত এঁদের মন এমনিই শক্তিমান যে অসুন্দরের মধ্য দিয়ে সুন্দরের আবিষ্কার তাঁদের পক্ষে সহজ। ভক্ত কবি আর্টিষ্ট সবাই এক ধরণের মানুষ; সবাই আর্টিষ্ট, আর্টিষ্টের কাছে ভেদ নেই পণ্ডিতের কাছে যেমন সেটা আছে। আর্টিষ্টের কাছে রসের ভেদ আছে, মনের অবস্থাভেদে সু হয় কু, কু হয় সু এও আছে, তাছাড়া রূপভেদও আছে; কিন্তু সু কু এর যে নির্দিষ্ট সীমা পণ্ডিত থেকে আরম্ভ করে অপণ্ডিত পর্যন্ত টেনে দিচ্ছে, এ রূপ সে রূপের মাঝে সেই পাকাপোক্ত পাঁচিল নেই আর্টিষ্টের কাছে। নীরসেরও স্বাদ পেয়ে আর্টিষ্টের মন রসায়িত হয়, এইটুকুই তফাৎ আর্টিষ্টের আর সাধারণের মনে। তুমি আমি যখন খরার দিনে পাখা আর বরফ বলে’ হাঁক দিচ্ছি আর্টিষ্ট তখন সুন্দর করে’ খরার দিন মনে ধরে’ কবিতা লিখলে—‘কাল বৈশাখী আগুন ঝরে, কাল বৈশাখী রোদে পোড়ে! গঙ্গা শুকু শুকু আকাশে ছাই!’ রসের প্রেরণা সুন্দর অসুন্দরের ধারণাকে মুক্তি দিলে, আর্টিষ্টের মধ্যে সুন্দর অসুন্দরে মিলিয়ে এক রসরূপ সে দেখে চল্লো। আর্টিষ্ট রূপমাত্রকে নির্বিচারে গ্রহণ করলে—কেন সুন্দর কেন অসুন্দর এ প্রশ্ন আর্টিষ্ট করলে না, শুধু রসরূপে যখন বস্তুটিকে দেখলে তখন সে সাধারণ মানুষের মত আহা ওহো বলে’ ক্ষান্ত থাকলো না, দেখার সঙ্গে আর্টিষ্টের মন আপনার সৌন্দর্যের অনুভূতিটা প্রত্যক্ষ করবার জন্য সুন্দর উপায় নির্বাচন করতে লাগলো। সুন্দর রং চং সুন্দর ছন্দোবন্ধ এমনি নানা সরঞ্জাম নিয়ে আর্টিষ্টের সমস্ত মানসিক বৃত্তি ধাবিত হল সুন্দরের স্মৃতিটিকে একটা বাহ্যিক রূপ দিতে, কিম্বা সুন্দরের স্মৃতিটিকে নতুন নতুন কল্পনার মধ্যে মিশিয়ে নতুন রচনা প্রকাশ করতে। সুন্দর বা তথাকথিত অসুন্দর দুয়েরই যেমন মনকে আকর্ষণ করবার শক্তি আছে, তেমনি মনের মধ্যে গভীর ভাবে নিজের স্মৃতিটি মুদ্রিত করবারও শক্তি আছে—সুতরাং সুন্দরে অসুন্দরে এখানেও এক। সুন্দরকেও যেমন ভোলবার জো নেই অসুন্দরকেও তেমনি টেনে ফেলবার উপায় নেই। দুই স্মৃতির মধ্যে শুধু তফাৎ এই, সুন্দরের স্মৃতিতে আনন্দ, অসুন্দরের স্পর্শে মন ব্যথিত হয়, সুখও যেমন দুঃখও তেমনি মনের একস্থানে গিয়ে সঞ্চিত হয়, শুধু দুঃখকে মানুষ ভোলবারই চেষ্টা করে আর সুখের স্মৃতিকে লতার মত মানুষের মন জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতেই চায় দিন রাত। সাধারণ মানুষের মনেও যেমন, আর্টিষ্ট মানুষের মনেও তেমনি সহজ ভাবেই সুন্দর অসুন্দরের ক্রিয়া হয়, শুধু সাধারণ মানুষের সঙ্গে আর্টিষ্টের তফাৎ হচ্ছে মনের অনুভূতিকে প্রকাশের ক্ষমতা বা অক্ষমতা নিয়ে। দুঃখ পেলে সাধারণ মানুষ বেজায় রকম কান্নাকাটি সুরু করে, আর্টিষ্টও যে কাঁদে না তা নয়, কিন্তু তার মনের কাঁদন আর্টের মধ্য দিয়ে একটি অপরূপ সুন্দর ছন্দে বেরিয়ে আসে। অসুন্দরের মধ্যে, অ-সুখের মধ্যে আর্টিষ্টের কাছ থেকে রস আসে বলেই আর্ট মাত্রকে সুন্দরের প্রকাশ বলে গণ্য করা হয়, এবং সেই কারণে আর্টের চর্চায় ক্রমে সুন্দরের অনুভূতি আমাদের যেমন বৃদ্ধি পায় তেমন সৌন্দর্য সম্বন্ধে তর্ক বিতর্ক পড়ে’ কিম্বা শুনে হয় না। আসলে যা সুন্দর তা কখনও বলে না, আমি এই জন্যে সুন্দর; আমাদের মনেও ঠিক সেই জন্যে সুন্দরকে গ্রহণ করবার বেলায় এ প্রশ্ন ওঠে না যে, কেন এ সুন্দর! আসলে যে সুন্দর নয় সেই কেবল আমাদের সামনে রং মেখে অলঙ্কার পরে’ হাব ভাব করে’ এসে বলে আমি এই কারণে সুন্দর, মনও আমাদের তখনি বিচার করে বুঝে নেয় এ রংএর দ্বারা অথবা অলঙ্কারে বা আর কিছুর দ্বারায় সুন্দর দেখাচ্ছে কি না! আসলে যা সুন্দর তাকে নিয়ে আর্টিষ্ট কিম্বা সাধারণ মানুষের মন বিচার করতে বসে না, সবাই বলে—সুন্দর ঠেক্ছে, কেন তা জানি না। কিন্তু সুন্দরের সাজে যে অসুন্দর আসে তাকে নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং আর্টিষ্টের মনে তর্কের উদয় হয়। কিন্তু পণ্ডিতের মন দার্শনিকের মনের ঠিক বিপরীত উপায়ে চলে, অসুন্দরের বিচার সেখানে নাই, সব বিচার বিতর্ক সুন্দরকে নিয়ে। যা সুন্দর আমরা দেখেছি তা নিজের সুন্দরতা প্রমাণের কোন দলিল নিয়ে এল না কিন্তু আমাদের মন সহজেই তাতে রত হল, কিন্তু পণ্ডিতের সামনে এসে সুন্দর দায়গ্ৰস্ত হ’ল—প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠলো সুন্দরকে নিয়ে—তুমি কেন সুন্দর, কিসে সুন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি! সুন্দর, সে সুন্দর বলেই সুন্দর, মনে ধরলো বলেই সুন্দর, এ সহজ কথা সেখানে খাটলো না। পণ্ডিত সেই সুন্দরকে বিশ্লেষণ করে দেখবার চেষ্টা করছেন—কি নিয়ে সুন্দরের সৌন্দর্য? সেই বিশ্লেষণের একটা মোটামুটি হিসেব করলে এই দাঁড়ায়—(১) সুখদ বলেই ইনি সুন্দর, (২) কাযের বলেই সুন্দর, (৩) উদ্দেশ্য এবং উপায় দুয়ের সঙ্গতি দেন বলেই সুন্দর, (৪) অপরিমিত বলেই সুন্দর, (৫) সুশৃঙ্খল বলেই সুন্দর, (৬) সুসংহত বলেই সুন্দর (৭) বিচিত্র অবিচিত্র সম বিষম দুই দিয়ে ইনি সুন্দর।—এই সব প্রাচীন এবং আধুনিক পণ্ডিতগণের মতামত নিয়ে সৌন্দর্যের সার ধরবার জন্যে সুন্দর একটি জাল বুনে নেওয়া যে চলে না তা নয়, কিন্তু তাতে করে’ সুন্দরকে ঠিক যে ধরা যায় তার আশা আমি দিতে সাহস করি না; তবে আমি এই টুকু বলি—অন্যের কাছে সুন্দর কি বলে’ আপনাকে সপ্রমাণিত করছে তা আমাদের দেখায় লাভ কি? আমাদের নিজের নিজের কাছে সুন্দর কি বলে’ আসছে তাই আমি দেখবো। আমি জানি সুন্দর সব সময়ে সুখও দেয় না কাযও দেয় না—বিদ্যুৎ-শিখার মত বিশৃঙ্খল অসংযত উদেশ্যহীন বিদ্রুত বিষম এবং বিচিত্র আবির্ভাব সুন্দরের! সুন্দর, এই কথাই তো বলছে আমাদের—আমি এ নই তা নই, এজন্যে সুন্দর ওজন্যে সুন্দর নই, আমি সুন্দর তাই আমি সুন্দর। আর্টের মধ্যে রীতিনীতি, চক্ষু-জোড়ানো মন-ওড়ানো প্রাণ-ভোলানো ও কাঁদানো গুণ, কিম্বা এর যে কোন একটা যেমন আর্ট নয়, আর্ট বলেই যেমন সে আর্ট, সুন্দরও তেমনি সুন্দর বলেই সুন্দর। সুন্দর নিত্য ও অমূর্ত, নানা বস্তু নানা ভাবের মধ্যে তার অধিষ্ঠান ও আরোপ হলে তবে মনোরসনা তার স্বাদ অনুভব করে—এমন সুন্দর তেমন সুন্দর সুখদ সুন্দর সুপরিমিত সুন্দর সুশৃঙ্খলিত সুন্দর! আমাদের জিব যেমন চাখে মেঠাই সন্দেশ সরবৎ ইত্যাদি পৃথক পৃথক জিনিষের মধ্য দিয়ে মিষ্টতাকে—ঠিক সেই ভাবেই জীব বা জীবাত্মা মনোরসনার সাহায্যে আপনার মধ্যে সুন্দরের জন্য যে প্রকাণ্ড পিপাসা রয়েছে সেটা নানা বস্তু ধরে’ মেটাতে চলে। অতএব বলতে হয়, মন যার যেমনটা চায় সেইভাবে সুন্দরকে পাওয়াই হ’ল পাওয়া, আর কারু কথা মতো কিম্বা অন্য কারু মনের মতো সুন্দরকে পাওয়ার মানে—না পাওয়াই। মা-বাপের মনের মতো হলেই বৌ সুন্দর হল একথা যে ছেলের একটু মাত্র সৌন্দর্য জ্ঞান হয়েছে সে মনে করে না। বৌ কাযের, বৌ সংসারী, বৌ বেশ সংস্থানসম্পন্না, এবং হয়তো বা ডাক-সাইটে সুন্দরীও হতে পারে অন্য সবার কাছে, কিন্তু ছেলের নিজের মনের মধ্যে কায কর্ম সংসার সুরূপ কুরূপ ইত্যাদির একটা যে ধারণা তার সঙ্গে অন্যের পছন্দ করা বৌ মিল্লো তো গোল নেই, না হলেই মুস্কিল। হিন্দিতে প্রবাদ আছে ‘আপ্ রুচি খানা—পর রুচি পহেরনা’, খাবারের স্বাদ আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র ভাবে নিতে হয় সুতরাং সেখানে আমাদের স্বরাজ, কিন্তু পরণের বেলায় পরে যেটা দেখে’ সুন্দর বলে সেইটেই মেনে চলতে হয়, না হলে নিন্দে; সুতরাং সেখানে কেউ জোর ক’রে বলতে পারে না এইটেই পরি পাঁচজনে যা বলে বলুক, আমরা নিজের বুদ্ধিকেও সেখানে প্রাধান্য দিতে পারিনে, দেশ কাল যে সুন্দর পরিচ্ছদের সম্মান করে তাকেই মেনে নিতে হয়। একটা কথা কিন্তু মনে রাখা চাই, সাজ গোজ পোষাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির সম্বন্ধে কিছু ওলট পালট সময়ে সময়ে যে হয়ে আসছে তা ঐ ব্যক্তিগত স্বাধীন রুচি থেকেই আসছে। সুতরাং সব দিক দিয়ে সুন্দর অসুন্দরের বোঝা-পড়া আমাদের ব্যক্তিগত রুচির উপরেই নির্ভর করছে। যদি সত্যই এই জগৎ অসুন্দরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, নিছক সুন্দর জিনিষ দিয়ে গড়া পরিপূর্ণ সুখদ সুশৃঙ্খল ও সর্বগুণান্বিত একটা কিছু হতো তবে এর মধ্যে এসে সুন্দর অসুন্দরের কোন প্রশ্নই আমাদের মনে উদয় হতে না। আমরা এই জগৎ সংসার চিরসুন্দরের প্রকাশ ইত্যাদি কথা মুখে বল্লেও চোখে তা দেখিনে অনেক সময় মনেও সেটা ধরতে পারিনে, কাজেই অতৃপ্ত মন সুন্দরের বাসনায় নানা দিকে ধাবিত হয় এবং সুন্দরের একটা সাক্ষাৎ আদর্শ খাড়া করে, দেখার চেষ্টা করে এবং সুন্দরকে অসুন্দর থেকে বিচ্ছিন্ন করে’ দেখলে আমাদের সৌন্দর্যজগৎ যে খণ্ড ও খর্ব হয়ে পড়ে তা আর মনেই থাকে না। সুরূপ কুরূপ দুয়ে মিলে সুন্দরের অখণ্ড মূর্তির ধারণা করা শক্ত কিন্তু একেবারে যে অসম্ভব মানুষের পক্ষে তা বলা যায় না। ভক্ত কবি এবং আর্টিষ্ট এদের কাছে সুন্দর অসুন্দর বলে দুটো জিনিষ নেই, সব জিনিষের ও ভাবের মধ্যে যে নিত্য বস্তুটি সেটিই সুন্দর বলে’ তাঁরা ধরেন। ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য যা কিছু তা অনিত্য, তার সুখ শৃঙ্খলা মান পরিমাণ সমস্তই অনিত্য, সুতরাং সুন্দর যা নিত্য, সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তার সঙ্গে মেলা মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব বলা যেতে পারে। আমাদের মনই কেবল গ্রহণ করতে পারে সুন্দরের আস্বাদ—সুতরাং মনোরসনা রোগ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার মতো ভীষণ বিপত্তি মানুষের হতে পারে না। আর্টের দিক দিয়ে যৌবনই সুন্দর বার্ধক্য সুন্দর নয়, আলোই সুন্দর অন্ধকার নয়, সুখই সুন্দর দুঃখ নয়, পরিষ্কার দিন বাদলা নয়, বর্ষার নদী শরতের নয়, পূর্ণচন্দ্রই চন্দ্রকলা নয়—কেউ একথা বলতে পাবে না। যে একেবারেই আর্টিষ্ট নয় শুধু তারি পক্ষে বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডভাবের একটা আদর্শ সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নেওয়া সম্ভব। কবীর ছিলেন আর্টিষ্ট তাই তিনি বলেছিলেন—“সবহি মূরত বীচ অমূরত, মূরতকী বলিহারী”। যে সেরা আর্টিষ্ট তারি গড়া যা কিছু তারি মধ্যে এইটে লক্ষ্য করছি—ভালমন্দ সব মূর্তির মধ্যে অমূর্তি বিরাজ করছেন! “ঐসা লো নহিঁ তৈসা লো, মৈঁ কেহি বিধি কথৌঁ গম্ভীরা লো”—সুন্দর যে অসুন্দরের মধ্যেও আছে এ গভীর কথা বুঝিয়ে বলা শক্ত তাই কবীর এক কথায় সব তর্ক শেষ করিলেন “বিছুড়ি নহিঁ মিলিহো”—বিচ্ছিন্নভাবে তাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু এই যে সুন্দরের অখণ্ড ধারণা কবীর পেলেন তার মূলে কি ভাবের সাধনা ছিল জানতে মন সহজেই উৎসুক হয়; এর উত্তর কবীর যা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে সব আর্টিষ্টের এক ছাড়া দুই মত নেই দেখা যায়—“সংতো সহজ সমাধ ভলী, সাঁঈসে মিলন ভয়ো জা দিনতে সুরত ন অন্তি চলি॥ আঁখ ন মুদুঁ কান ন রূংধু, কায়া কষ্ট ন ধারূঁ। খুলে নয়ন মৈ হঁস হঁস দেখুঁ সুন্দর রূপ নিহারূঁ॥” সহজ সমাধিই ভাল, হেসে চাও দেখবে সব সুন্দর, যার মনে হাসি নেই তার চোখে সুন্দরও নেই। যার প্রাণে সুর আছে বিশ্বের সুর বেসুর বিবাদী সম্বাদী সবই সুন্দর গান হয়ে মেলে তারি মনে। আর যার কাছে শুধু পুঁথির সুর-সপ্তক স্বরলিপি ও তাল বেতালের বোল মাত্রই আছে, তার বুকের কাছে বিশ্বের সুর এসে তুলোট কাগজের খড়মড়ে শব্দে হঠাৎ পরিণত হয়।