সুতরাং সুন্দরের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আদর্শ আর্টিষ্টের নিজের নিজের মনে ছাড়া বাইরে নেই, কোন কালে ছিল না, কোন কালে থাকবেও না এটা একেবারে নিশ্চয় করে’ বলা যেতে পারে। সুন্দর যদি খিচুড়ি হ’তো তবে এতদিনে সৌন্দর্যের তিল ও তাল মিলিয়ে কোন এক বেরসিক পরম সুন্দর করে সেটা প্রস্তুত করে’ যেতো তথাকথিত কলারসিকদের জন্য, কিন্তু একমাত্র যাঁকে মানুষ বল্লে ‘রসো বৈ সঃ’ তিনিও সুন্দরের পরিপূর্ণ আদর্শ জনে জনে মনে মনে ছাড়া আপনার সৃষ্টিতে একত্র ও সম্পূর্ণভাবে কোথাও রাখেননি। তাঁর সৃষ্টি, এটি সুন্দর অসুন্দর দুইই, এবং সব দিক দিয়ে অপূর্ণও নয় পরিপূর্ণও নয় এই কথাই তিনি স্পষ্ট করে’ যে জানতে চায় তাকেই জানিয়েছেন। শান্তিতে-অশান্তিতে সুখে-দুঃখে সুন্দরে-অসুন্দরে মিলিয়ে হ’ল ছোট এই নীড়, তারি মধ্যে এসে মানুষের জীবনকণা পরম সুন্দরের আলো পেয়ে ক্ষণিকের শিশির-বিন্দুর মতো নতুন নতুন সুন্দর প্রভা সুন্দর স্বপ্ন রচনা করে চল্লো। এই হ’ল প্রথম শিল্পীর মানস কল্পনা ও এই বিশ্বরচনার নিয়ম, এ নিয়ম অতিক্রম করে’ কোন কিছুতে পরিপূর্ণতাকে প্রত্যক্ষরূপ দিতে পারে এমন আর্টও নেই আর্টিষ্টও নেই। যা বিশ্বের মানুষের মনে বিচিত্র পদার্থের মধ্য দিয়ে বিচিত্র হয়ে ফুটতে চাচ্ছে সেই পরম সুন্দরের স্পৃহা জেগেই রইলো, মিটলো না। যদি পরম সুন্দরের প্রত্যক্ষ উপমান পেয়ে সত্যই কোন দিন মিটে যায় মানুষের এই স্পৃহা, তবে ফুলের ফুটে’ ওঠার, নদীর ভরে’ ওঠার, পাতার ঘন সবুজ হয়ে ওঠার, আগুনের জ্বলে’ ওঠার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও ছবি আঁকা মূর্তি গড়া কবিতা লেখা গান গাওয়া ইত্যাদির স্পৃহা আর থাকে না। চাঁদ একটুখানি চাঁচ্নী থেকে আরম্ভ করে’ পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠবার দিকে গেলেও যেমন শেষে একটুখানি অপরিণতি তার গোলটার মধ্যে থেকেই যায়, তেমনি মানুষের আর্টও কোথাও কখনো পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠে না। মানুষ জানে সে নিজে অপূর্ণ, তাই পরিপূর্ণতার দিকে যাওয়ার ইচ্ছা তার এতখানি। গ্রীস ভারত চীন ঈজিপ্ট সবাই দেখি পরম সুন্দরের দিকে চলেছে, কিন্তু সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা কেউ পায়নি, কেবল পেতে চাওয়ার দিকেই চলেছে। আজ যেখানে মনে হল আর্ট দিয়ে বুঝি যতটা সুন্দর হ’তে পারে তাই হ’ল, কাল দেখি সেইখানেই এক শিল্পী দাঁড়িয়ে বলছে, হয়নি, আরো এগোতে হবে কিম্বা পিছিয়ে অন্য পন্থা ধরতে হবে। পরম সুন্দরের দিকে মামুষের মন ও সঙ্গে সঙ্গে তার আর্টের গতি ঠিক এই ভাবেই চলেছে—গতি থেকে গতিতে পৌঁছচ্ছে আর্ট, এবং একটা গতি আর একটা গতি সৃষ্টি করছে, ঢেউ উঠলো ঠেলে, মনে করলে বুঝি চরম উন্নতিকে পেয়েছি অমনি আর এক ঢেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে বল্লে, চল, আরো বাকি আছে। এইভাবে সামনে আশেপাশে নানা দিক থেকে পরম সুন্দরের টান মানুষের মনকে টানছে বিচিত্র ছন্দে বিচিত্রতার মধ্য দিয়ে, তাই মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতি তার আর্ট দিয়ে এমন বিচিত্র রূপ ধরে আসছে—চিরযৌবনের দেশে ফুল ফুটেই চলেছে নতুন নতুন।
মানুষ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মনে মনে ভাবে, সুন্দর! ঠিক সেই সময় অার একটি সুন্দর মুখের ছায়া আয়নায় পড়ে; যে ভাবছিলো সে অবাক হয়ে বলে, তুমি যে আমার চেয়ে সুন্দর, অমনি স্বপ্নের মতো সুন্দর ছায়া হেসে বলে, আমার চোখে তুমি সুন্দর! এই ভাবে এক আর্টে আর এক আর্টে, এক সুন্দরে অার এক সুন্দরে পরিচয়ের খেলা চলেছে, জগৎ জুড়ে সুন্দর মনের সুন্দরের সঙ্গে মনে মনে খেলা। পরিপূর্ণ সৌন্দর্যকে আর্ট দিয়ে ধরতে পারলে এ খেলা কোন্ কালে শেষ হয়ে যেতো। যে মাছ ধরে তার ছিপে যদি মৎস্য-অবতার উঠে আসতো তবে সে মানুষ কোন দিন আর মাছ ধরাধরি খেলা করতো না, সে তখনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে কলম হাতে মাছ বিক্রির হিসেব পরীক্ষা করতে বসতো, আর যদি তখনও খেলার আশা তার কিছু থাকতো তো এমন জায়গায় গিয়ে বসতো যেখানে ছিপে মাছ ধরাই দিতে আসে না, ধরি ধরি করতে করতে পালায়! পরম সুন্দর যিনি তিনি লুকোচুরি খেলতে জানেন, তাই নিজে লুকিয়ে থেকে বাতাসের মধ্য দিয়ে তাঁর একটু রূপের পরিমল, আলোর মধ্য দিয়ে চকিতের মতো দেখা ইত্যাদি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি আর্টিষ্টদের খেলিয়ে নিয়ে বেড়ান, আর্টিষ্টের মনও সেইজন্যে এই খেলাতে সাড়া দেয়, খেলা চলেও সেইজন্যে। এক একটা ছেলে আছে খেলতে জানে না খেলার আরম্ভেই হঠাৎ কোণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ধরা পড়ে’ রস-ভঙ্গ করে’ দেয় আর সব ছেলেগুলো তার সঙ্গে আড়ি দিয়ে বসে। তেমনি পরম সুন্দরও যদি আর্টিষ্টদের সামনে হঠাৎ বেরিয়ে এসে রস-ভঙ্গ করতে বসেন তবে আর্টিষ্টরা তাঁকে নিয়ে বড় গোলে পড়ে যায় নিশ্চয়ই। আর্টিষ্টরা, ভক্তেরা, কবিরা—পরম সুন্দরের সঙ্গে সুন্দর সুন্দর খেলা খেলেন কিন্তু পণ্ডিতেরা পরম সুন্দরকে অনুবীক্ষণের উপরে চড়িয়ে তাঁর হাড় হদ্দের সঠিক হিসেব নিতে বসেন। কাযেই দেখি যারা খেলে আর যারা খেলে না সৌন্দর্য সম্বন্ধে এ দুয়ের ধারণা এবং উক্তি সম্পূর্ণ বিভিন্ন ধরণের। পণ্ডিতেরা সৌন্দর্য সম্বন্ধে বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথা লিখে ছাপিয়ে গেছেন, সেগুলো পড়ে’ নেওয়া সহজ কিন্তু পড়ে’ তার মধ্য থেকে সৌন্দর্যের আবিষ্কার করাই শক্ত। আর্টিষ্ট তারা সুন্দরকে নিয়ে খেলা করে সুন্দরকে ধরে আনে চোখের সামনে মনের সামনে অথচ সৌন্দর্য সম্বন্ধে বলতে গেলে সব আগেই তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় দেখতে পাই। ‘সুন্দর কাকে বল’ এই প্রশ্নের জবাবে আর্টিষ্ট ড্রুরার বল্লেন, ‘আমি ও সব জানিনে বাপু’ অথচ তাঁর তুলির আগায় সুন্দর বাসা বেঁধেছিল! লিয়োনার্ডো দ্য ভিন্চি যাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর্ট থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র জিনিষ নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেছে, তিনি বলেছেন—পরম সুন্দর ও চমৎকার অসুন্দর দুইই দুর্লভ, পাঁচ-পাঁচিই জগতে প্রচুর।