এইবার শিল্পের একটা মন্ত্র দেখ, পরিষ্কার সত্য কথা—“রূপভেদা: প্রমাণানি ভাবলাবণ্যযোজনম্॥ সাদৃশ্যং বর্ণিকাভঙ্গ ইতি চিত্ৰং ষড়ঙ্গকম॥” ভারতবর্ষ থেকে ওদিকে আমেরিকা কোন দেশের কোন চিত্রবিদ এর উল্টো মানে বুঝে, ভুল করবে না, কেননা চিত্রকরের কারবারই হল এই ছটার কোনটা কিম্বা এর কোন কোনটাকে নিয়ে। একটা চিত্রে পুরোমাত্রায় এ ছয়টা পাবো না নিশ্চয় কিন্তু দুটো চারটে চিত্র ওল্টালেই বুঝবো কেউ রূপ-প্রধান কেউ প্রমাণ-সর্বস্ব, কেউ ভাবলাবণ্য-যুক্ত, কেউ বর্ণ ও বর্ণিকাভঙ্গে মনোহর, কেউ যড়ঙ্গের দুটো নিয়ে চিত্র, কেউ পাঁচটা নিয়ে হয়েছে ছবি।
মত অপেক্ষা রাখে সমর্থনের, মন্ত্র যা তা নিজেই সমর্থ—প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও সত্যের দ্বারায় বলীয়ান। ধর্মের যেমন-তেমন শিল্পকলাতেও মানুষ মতও চালিয়েছে মন্ত্রও দিয়েছে। তার মধ্যে মত গুলো দেখি কোনটা চলেছে, কোনটা চলেনি এবং মত ধরে কোন শিল্প ম’রলে, কোনটা আধমরা হয়ে রইলে, কিন্তু শিল্পের মূল মন্ত্রগুলো সেই পৃথিবীর আদিমতম এবং নতুনতম শিল্পে সমানভাবে কায করে চল্লো। মত, খণ্ডন হ’ল মহাকলরবের মধ্যে কিন্তু মন্ত্রের সাধন করে চল্লো মানুষ নীরবে, মানবের ইতিহাসে এটা নিত্য ঘটনা, মানুষের গড়া শিল্পের ইতিহাসেও এর প্রমাণ যথেষ্ট রয়েছে। সাদা মানুষ, সে কালে মানুষ সম্বন্ধে শক্ত মত নিয়ে এগোয় কিন্তু কালো মানুষ পদে পদে সেই মতের সমর্থন করে চলে না কিন্তু মানুষ যেখানে মানুষের কাছে মন্ত্র নিয়ে এগোয়—মানুষে মানুষে অভেদমন্ত্র দয়ার মন্ত্র প্রেমের মন্ত্র— সেখানে মতভেদ হয় না সাদায় কালোয়, তেমনি শিল্পের বাস্তব ও কল্পনা মানুষি ও মানসী, প্রতিকৃতি ও প্রকৃতি, reality ও ideality এই সব নানাদিকে যে সব মতগুলো আছে তা নিয়ে এর সঙ্গে ওর বিবাদ কিন্তু কলাবিদ শিল্প সাধক বাস্তব জগতের এবং কল্পনা জগতের মধ্য থেকে শিল্পের যে সব মন্ত্র আবিষ্কার করেছে সেগুলো গ্রহণ সম্বন্ধে বিচার বিতর্ক অথবা মতামতের কথা কোন দলের কেউ তোলে না। বৌদ্ধযুগ থেকে আরম্ভ করে মোগল এবং ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত আমাদের কলাবিদ্যা সমস্ত এমন কি কলাবিদদের আকৃতি প্রকৃতি পর্যন্ত নানামতের চাপনে রকম রকম লক্ষণে চিহ্নিত হয়েছে। এই যে আমাদের নানা কলাবিদ্যার নানা আকৃতি ও প্রকৃতির বিভিন্নতা এগুলো কোন এক কালের শাস্ত্রমত বা লোকমত বা ব্যক্তিবিশেষের মতের সঙ্গে মেলালে দেখবো নিখুঁৎ মিলছে না—অজন্তার অতুলনীয় চিত্র সে হয়ে যাচ্ছে চিত্রাভাষ, মোগল শিল্প হয়ে যাচ্ছে যবন-দোষ-দুষ্ট এবং তার পরের শিল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে সকল দোষের আধার। চীন দোষ, জাপান দোষ, ব্রিটন দোষ, জার্মাণ দোষ,—দোষের অন্ত নেই মতের কাছে। কিন্তু শিল্পশাস্ত্রের মধ্য থেকে শিল্পের মন্ত্রগুলো বেছে নাও এবং সেই সকল মন্ত্র দিয়ে পরখ কর, এক ভারত শিল্পের অসংখ্য অবতারণা ঠিক ধরা যাবে-—ভারত শিল্পের সেই সত্যরূপ যেটি নিয়ে ভারত শিল্প বিশ্বের শিল্পের সঙ্গে এক এবং পৃথক। কোন শিল্পের স্বরূপ শাস্ত্রমতের মধ্যে ধরা থাকে না সেটা শিল্পের নিজের মধ্যেই ধরা থাকে। ভারত শিল্পের কেন সব শিল্পের প্রাণের খোঁজে যে শিক্ষার্থীরা চলবেন তাঁদের এই মত ও মন্ত্রের পার্থক্য প্রথমেই হৃদয়ঙ্গম করা চাই মতকে মন্ত্র বলে ভুল করলে চলবে না। যুদ্ধের সময় দুপক্ষের সেনাপতি মত দেন, কোন পথে কি ভাবে ফৌজ চলবে, ব্যুহ রচনা করবে এবং সেই মতো ম্যাপ প্রস্তুত করে’ নিয়ে ফৌজের চালনা হয়। শিল্পশাস্ত্রকারের মতগুলো এই ম্যাপ, দেশের শিল্প কখন কি মূর্তি ধরেছিল তার প্রথা ও প্রণালীর সুস্পষ্ট ইতিহাস শাস্ত্র থেকে পাওয়া যায় বলে তার মধ্যে কোন একটা পথে যদি আজ আমরা শিল্পকে চালাতে চাই তো এই সব প্রাচীন মত শিল্পে পেটেণ্ট নেওয়ার বেলা খুব কাজে আসবে, দেশের প্রাচীন artএর ইতিহাস লিখতে কাজে আসবে, গত artএর নূতন থিসিস লিখতে কাজে আসবে, এমন কি artist না হলেও art সম্বন্ধে original research লেখার পক্ষেও এই সব মত যথেষ্ট রকম ব্যবহারে লাগবে কেননা এদের copyright বহুদিন শেষ হয়েছে,–কিন্তু শিল্পকে যারা চায় তাদের কাছে এই সব মত বেশী কাজে আসবে না। শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে এমন কি বৈদ্যশাস্ত্রের বৈষ্ণব শাস্ত্রের এক কথায় নিখিল শাস্ত্রের অপার সমুদ্রের তলায় ও শিল্পেরই মধ্যে যে সব মন্ত্রগুলো এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে সেগুলো উপকারে লাগবে। যে জানতে চায় শিল্পকে তাকে মত ও মন্ত্র দুই উদ্ধার করে করে চলতে হয়। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের ম্যাপ ধরে চল্লেই যুদ্ধে জিৎ হয় না, এটা পাকা সেনাপতি পাকা সেপাই দু’জনেই বোঝে, ম্যাপের সীমানার পরে যে অনির্দিষ্ট সীমানা তার কল্পনা সেনাপতিও ধরে থাকে সিপাহীও ধরে থাকে এবং বীরত্বের যে একটি মন্ত্র দুঃসাহস তাকে মনে পোষণ করে অগ্রসর হয়, জিতলে পুরস্কার হারলে তিরস্কার!” নূতনকে জয়ের কল্পনা তাদের মনকে দোলায়, ম্যাপে দাগা মতামতের উল্টোপথে অনেক সময়ে তারা চলে মন্ত্রের সাধনে শরীর পাতনে, হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে তারা মন্ত্রণা করে সেনা ও সেনাপতি, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে পথ বিপথ অতিক্রম করে গিয়ে দেয় হানা অজানা পুরীর দরজায়, হঠাৎ দখল হয়ে যায় একটা রাজত্ব যেন মন্ত্রবলে! শিল্পকে পেলে তো কথাই নেই, শিল্পের মন্ত্রগুলো পেলে শিল্প পেতে দেরী হয় না, কিন্তু মতগুলোতে পেয়ে বসলে শাস্ত্রমতে যাকে পাওয়া বলে তাকেই পায় মানুষ, শিল্প রচনাকে পায় না মনোমত মনোগত এ সবের কল্পনাকেও পায় না।
দৃষ্টি ও সৃষ্টি
“Those organs which guide an animal are under man’s guidance and control.”
–Goethe