“… রূপ নিরুপম সোহিনী
শারদ পার্ব্বণ—বিধুবরানন, পঙ্কজ কানন মোদিনী।
কুঞ্জর-গামিনী-কুঞ্জ-বিলাসিনী, লোচন খঞ্জন-গঞ্জিনী।
কোকিল নাদিনী, গীঃ পরিবাদিনী, হ্রীঃ পরিবাদ-বিধায়িনী।
ভারত-মানস মানস-সরস, বাস বিনোদ বিধায়িনী।”
এর থেকে আর একটুখানি নামলেই কেবল সুর সার বাক্য রেখা রং ইত্যাদি দিয়ে মনের চোখে কানে সুড়সুড়ি দেওয়া—
“নাহি তালবোধ ভাল, নিত্য ধ্বংস কারক।
চিত্ত মর্ম্ম, ধর্ম্মকর্ম্ম, মর্ম্ম বোধ জারক।”
চতুরশীতি লক্ষ জন্মের তপস্যালব্ধ জীবনটা নিয়েই মানুষ যখন ছিনিমিনি খেলে বেড়াচ্ছে, তখন যুগযুগান্তরের তপস্যা দিয়ে কত মহৎ জীবনের ব্যর্থতার দুঃখ থেকে সার্থকতার আনন্দ দিয়ে লাভ করা ভাষাসমূহকে নিয়ে মানুষ যে নয়-ছয় করে খেলা করবে তার বাধা কি? শিল্পরূপিণী সুন্দরী ভাষাকে পেতে তপস্যার দুঃখ আছে—“art interprets the mightier speech of nature. It is a poetical language for it is an utterance of the imaginated addressed to the imaginated and to rouse emotion”—(Gilbert)
অনাহতের ধ্বনি ব্যক্ত করে যে ভাষা, অরূপের ইঙ্গিত ও রূপ দর্শন করার যে ভাষা, নিশ্চল নির্বাক পাষাণকে চলায় বলায় যে ভাষা, তাকে বিনা সাধনায় মনে করলেই কি কেউ পেয়ে থাকে! ভাষা যখন তপোবনের ঋষিদের তপস্যার সামগ্ৰী, তখন তারা যে কোন দুর্ভেদ্যতার দুর্গ থেকে বাণীকে জয় করে’ এনেছিলেন তা তাঁরা জানিয়ে গেছেন—“সোমরস নিপীড়ন করিতে করিতে এই প্রস্তর সকল কথা কহুক, আমরাও কথা কহি, ইহারা কথা বলিতেছে, ইহাদের কথায় কথা কও…ইহারা শব্দ করিতেছে……ইহাদের শব্দে পৃথিবী ধ্বনিত হইতেছে…ইহাদের শব্দ শুনিয়া জ্ঞান হয় যেন পক্ষীরা আকাশে কলরব করিতেছে……তৃণভূমিতে কৃষ্ণসার হরিণেরা যেন চলাচল করিয়া নৃত্য করিতেছে……সোমরস নিপীড়ন-কালে প্রস্তরেরা শব্দ করিতেছে, যেন ক্রীড়াভূমিতে ক্রীড়াসক্ত শিশুরা জননীকে ঠেলিয়া ঠেলিয়া কোলাহল করিতেছে।” ভাষার তপস্যায় বলীয়ান্ মানুষ পাথরের কারাগার থেকে বার করে’ নিয়ে এলো যে ভাষাকে, চিরসুধাময়ী রসের নির্ঝরিণী তারি চতুঃষষ্টি ধারা হ’ল—কথা, ছবি, মূর্তি, নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি কলাবিদ্যা।
সন্ধ্যার উৎসব
“আশ্বিনে অম্বিকা পূজা বলি পড়ে পাঁঠা,
কাৰ্ত্তিকে কালিকা পূজা ভাই-দ্বিতীয়ার ফোঁটা।
অঘ্রাণে নবান্ন দেয় নতুন ধান কেটে,
পৌষ মাসে বাউনী বাঁধে ঘরে ঘরে পিঠে।
মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী ছেলের হাতে খড়ি,
ফাগুন মাসে দোলযাত্রা ফাগ ছড়াছড়ি।
চৈত্র মাসে চড়ক সন্ন্যাস গাজনে বাঁধে ভারা,
বৈশাখ মাসে তুলসী গাছে দেয় বসুধারা।
জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠীবাটা জামাই আনতে দড়,
আষাঢ় মাসে রথযাত্রা যাত্রী হয় জড়।
শ্রাবণ মাসে ঢেলা ফেলা ঘি আর মুড়ি,
ভাদ্র মাসে পচা পান্তা খায় মনসা বুড়ি।”
এই তো আছে বার মাসই। এর উপর ফাঁকে ফাঁকে আরো উৎসব এখন ঢুকেছে। যেমন শোক-সভার উৎসব, স্মৃতি-সভার উৎসব,—এ-যে সভার সাম্বৎসরিক উৎসব। এর উপরে জেলে যাবার উৎসব, হরতালের উৎসব তাও আছে ঘরে বাইরে। যে দেশে এত উৎসব সে দেশের ছেলেরা, বুড়োরা, যুবোরা—আনন্দ সাগরের কুলে গিয়ে ওঠার কথা তো তাদের এতদিন। কিন্তু আনন্দের বদরিকাশ্রম দূরের কথা—এই অফুরন্ত আনন্দের মাঝে একটু চড়া পড়ে গেছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। এ এক রকম আনন্দের ভাসান—ভাঙ্গা নৌকার কাঠ ঠিক এই ভাবে চলে স্রোতে গা ভাসিয়ে, কোথায় যায় সে তা নিজেই জানে না। একই তালে চলে সে দুলতে দুলতে, চলার তার বৈচিত্র্য নেই লক্ষ্য নেই কেবলি জোয়ারে খানিক এগিয়ে চলা ভাঁটায় আবার দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসা যেখানকার সেখানে। জীবন্ত জিনিষের উৎসব করে চলার মধ্যে বৈচিত্র্য থাকে। ঋতু-চলাচলের সঙ্গে কালের চলাচলের সঙ্গে গাছ পালারা তাল মিলিয়ে চলে। গাছের পাখী আকাশের মেঘ, সকাল-সন্ধ্যার গ্রহ-তারা তাল মিলিয়ে চলে। না হলে হয় বেতালা—বেতালে উৎসব মাটি হয়। কালভেদে দেশভেদে বিভিন্ন রকমে উৎসব করে’ চলার রহস্যটি পেয়েছে মানুষ এই পৃথিবীতে এসে—গাছেদের কাছ থেকে আকাশের কাছ থেকে এবং যে মাটিতে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে তার কাছ থেকে। মাটির বুকের তালে তাল রেখে যে চলতে পারে না, সে খুঁড়িয়ে চলে কিম্বা পড়ে যায় ধুপ্ করে মাটিতে। বাতাসের তালে তাল দিয়ে চলতে যে পাখীর ডানা না চায় সে উঁচুতে উড়তে পারেই না। ডানা ঝট্পট্ করে’ হয় মরে’ যায়, নয় তো পাখী থাকে না, খাঁচায় বাঁধা পড়ে। খায় দায় আর বনের দিকে চায়—“খায় দায় পাখীটি বনের দিকে আঁখিটি”। এই ভাবে অবিচিত্র দিনের অনুৎসবের অনুৎসাহের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একদিন তার পক্ষিলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। জীয়ন্তে মরা থেকে মুক্তি পেয়ে সে শেষে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। খাঁচার পাখী পড়তে বল্লে পড়ে, শিষ দিলে গান গায়; কিন্তু তাতে বলতে পারিনে পাখী উৎসব করেছে। তেমনি হুকুম মতো হয় হস্টেল বল আর হস্টেলের বাইরেই বল আমাদের উৎসব—এইবার পড়, এইবার গাও, এইবার খাও, এইবার সভার রিপোর্ট দাও, এইবার শোক প্রকাশ কর, এইবার স্মৃতি রক্ষা কর— এইভাবে দেশযোড়া একটা খাঁচার মধ্যে আমাদের নিয়ে কে যে খেলাচ্ছে তা বুঝিনে। শুধু বুঝি সুর লাগছে না, তালে ঠিক পা পড়ছে না, কোন রকমে চলেছি—হুকুমে উঠে’-বসে’ পড়ে’-শুনে’ হেসে’-খেলে’। আমাদের ছেলে-বুড়োর শিক্ষা-দীক্ষা উন্নতি অবনতি নিয়ে কত বিষয়ে কতদিকে লোক কত মাথা ঘামাচ্ছে এবং তাতে তারা আনন্দও পাচ্ছে। পাখী পড়িয়ে আনন্দ, পাখীকে শিষ দিয়ে ডেকে গাইয়ে আনন্দ, খাইয়ে আনন্দ, শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আনন্দ, কিন্তু পাখীর কিসে আনন্দ তা তো দেখে না কেউ। দাঁড়ের পাখীর কোন আনন্দ নেই শিকল কাটার আনন্দটুকু ছাড়া, এটা তো কর্তারা বোঝে না—বড় বড় রিপোর্ট লিখে চলে খাঁচার পাখীর সু ও কু ব্যবহার সম্বন্ধে এবং তাতেই তারা আনন্দ পায়। বারোমাস বেঁধে মার দিয়ে পাঁজিপুঁথি দেখে ছুটি নেওয়া গেল উৎসব করতে। এ যে আজকের নিয়ম হয়েছে তা নয়; এ নিয়ম এ দেশে বরাবরই চলে আসছে। বসন্তের হাওয়া না লাগলেও বাসন্তী পূজো পাঁজির ঠিক দিন ক্ষণ দেখে আসছে দেশে বছরের পর বছর কত যুগ ধরে’ তার ঠিক নেই। যদি বল বসন্তের ঋতু সেও তো ঠিক মাস ধরে’ আসে। আসে বটে, কিন্তু পাঁজির গণনা কিম্বা ঘড়ির কাঁটা ধরে’ আসে না। বরাবর দেখি গাছের পাতাগুলো হঠাৎ সবুজ হয়ে ওঠে, হঠাৎ কোকিল পাপিয়া দূরদেশ থেকে এসে গান ধরে। উত্তর থেকে বাতাস ফিরে যায় দক্ষিণে হঠাৎ, আবার চলেও যায় হঠাৎ, বসন্তকালের আসর ভেঙ্গে যায়, ফুলের ডালা নুয়ে পড়ে, রোদ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে, নদী শুকিয়ে ওঠে, আকাশে আগুন লেগে যায় দেখতে দেখতে। দিন যেন আর কাটে না। যখন তখন হঠাৎ আকাশ ঢেকে মেঘ আসে ঝড় আসে বাতাস বয় ঢল নামে নদীতে। আনন্দের বন্যা ছোটে বর্ষা নামে জল ঝরে জল-ঝড়ে। তারপর আকাশ হঠাৎ নীল চোখ মেলে চায় পৃথিবীর দিকে। সোনায় লেখা সবুজ সাড়ি পরে পৃথিবী চলে দিগন্তে উৎসব করতে, তারপর শিশির ঝরে পাতায় পাতায়, হিমের পরশ লাগে, শিউরে ওঠে বাতাসের মন অচেনা হাতের ছোঁয়া পেয়ে, কোকিল গান ধরে—উহু উহু। এই উৎসব তো হচ্ছে ফিরে ফিরে কতকাল কিন্তু এ তো তবু পুরোনো হয় না অবিচিত্র হয় না, বেসুরো বেতালা হয় না আমাদের বারো মাসে তেরো এবং তার চেয়ে বেশি পাৰ্ব্বণের উৎসবের মতো। এ যে প্রকৃতির উৎসব বা প্রকৃত উৎসব, এ নিত্যকাল ধরে চলেছে, চলবে ঋতু চক্রের চিহ্ন ধরে। সে কেন নতুন নতুন কবিকে নতুন নতুন শিল্পীকে নতুন শোভা নতুন রস দিয়ে মুগ্ধ করে, চলে—তার কারণ সন্ধান করে দেখি যে, উৎসব যা হ’চ্ছে তা স্বাভাবিক। তার মধ্যে নিয়ম একটা আছে কিন্তু বিচিত্রতায় সেটা ঢাকা। সেই নিয়মের ঠাট এমন ভাবে লুকানো থাকে যে বোঝাই যায় না। উৎসবের ধারার হিসেব আজ যেটা নিলেম সেটা কাল আবার তেমনি ভাবে থাকবে কি না, কিম্বা আমি যেমন হিসেবটা দেখলেম অন্যের চোখে উৎসবটার হিসেব সেই ভাবে পড়বে কি না তা বলা যায় না। এই হ’ল স্বভাবের নিয়মে উৎসবের রহস্য। কিন্তু মানুষের উৎসবের আমরা যে ভাবে নিয়ম বেঁধে দিয়েছি, তাতে করে’ ঐ অম্বিকা পূজা থেকে মনসা পূজার আনন্দ যেমন আজকের আমাদের কাছে পুরোনো হয়ে পড়ছে, আমাদের এখনকার উৎসবগুলোও ঠিক সেই দশা পাবে, পেয়ে বসে’ আছে। দপ্তরীর বাড়ির রুলটানা খাতার শোভা খাতার প্রথম পাতা দেখলেই বোঝা গেল, আর দেখতে হয় না নিরেনব্বই খানা পাতায় কি আছে। কিন্তু ভাল গল্পের বই, তারও সোজা ফর্মাবাঁধা হিসেবমতো চেহারা, কিন্তু বিচিত্রভাব বিচিত্র রস এসে তার প্রত্যেক পৃষ্ঠা রহস্যপূর্ণ ও বিচিত্র করে’ দেয়, কোন বই এক পাতা উল্টেই ফেলে দিই কোনটা বা শেষ হয়ে গেলেও ভাবি আরো হ’লে হ’ত। ভাল গানেও এই, বার বার শুনলেও মন চায় আবার শুনি, ভাল ছবি, তার বেলাতেও এই; এবং সব প্রকৃত জিনিষের মধ্যে এই গুণটি আছে। এবং এই জন্য বাঙলার ইতিহাসের চেয়ে ভাল বাঙলা উপন্যাস ছেলে মেয়েরা কিনে পড়ে জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে। হস্টেলের কেউ ভাল নভেল কিনলে কিছুদিন ধরে’ সন্ধ্যেবেলা একটা যেন উৎসব পড়ে’ যায় সেখানে। আবার নভেল পড়া এবং উৎসব করা দুই যখন বাতিকে দাঁড়ায় তখন আর ভালমন্দ কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না—একটা কিছু হ’লেই হ’ল এই ভাব দাঁড়ায় তখন। আমাদের সমস্ত কাণ্ড-কারখানা আমোদ-আহ্নাদ যেমন-তেমন হ’চ্ছে, যেমনটি হওয়া উচিত তেমনিটি হচ্ছে না; তার কারণ উৎসবের বাতিক চেগেছে এমন বিষম রকম—দেশে যে উৎসবের বাতি কেমন জ্বল্লো সেদিকে নজর দেবার সময়ই নেই। সময়ে সময়ে দেশে মরার ও জেলে গিয়ে পচবার উৎসব পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাতিক চাগে আমাদেরও মরালোকের শ্রাদ্ধ বাসর সাজাবার এবং জেলের মধ্যে দুগ্গোপূজো লাগাবার। উৎসাহটাই যে উৎসবের জনয়িতা তা তো নয়, রক্ত যখন অতিরিক্ত রকম উৎসাহে চলাচল করছে মস্তিষ্কে— তখন বুঝতে হবে জ্বর এল বলে’, নয় জ্বরের চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটলো বলে’৷ হঠাৎ খেয়াল হ’ল একটা সাম্বৎসরিক কি সম্মিলনী কি আরকিছু খুব ধূমধামে করতে হবে, তখনি ছুটোছুটি পড়ে গেল বক্তা ধরতে ষ্টেজ বাঁধতে, বাদ্যি জোগাড় করতে। এ তে স্বাভাবিক অবস্থার কায নয়। স্বভাবের নিয়মে বসন্ত কালের উৎসব মনে হয় বটে হঠাৎ সুরু হ’ল, কিন্তু এটা ভুল্লে চলবে না যে কোকিলকে এই উৎসবে আসতে হবে বলে’ ফাল্গুন মাস আসবার দশ এগারো মাস আগে থেকে সে গলা সাধছিল এমন গোপনে যে বাতাসও টের পায়নি। গাছগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে শীতকাল ভোর পাতা ফুল কত কি জোগাড় করে’ রেখেছে। উৎসবের ঢের আগে বসে’ যায় বোধন, তাই সুন্দর হয় উৎসব এবং তার রেশ চলে অনেক দিন ধরে’ বাতাসের মধ্যে ঝরা বাসি ফুলের সৌরভের মতো। এই স্বাভাবিক ছন্দে যে উৎসব হয় সেই উৎসব ঠিক উৎসব, শিক্ষা-দীক্ষা সমস্তই স্বাভাবিক অবস্থা না পেলে দেশে উৎসবের বাঁশি বাজবে না বাজবে না’ তা যতই কেন ফুলুটে ফুঁ দাও না, যতই কেন হারমোনিয়মের হাপর জোরে টিপে সুরের আগুন জ্বালাতে চাও না। বাঁশী বলবে না বাতি জ্বলবে না। সন্ধ্যার উৎসব আরতিটা এমনতরো হঠাৎ আয়োজন তো নয়, সেখানে সারাবেলার আয়োজন মেলে গিয়ে সারা রাতের আয়োজনের সঙ্গে। আকাশে তাই তো অতখানি রং লাগে, বাতাসে অতটা সুর ভরে—