বায়ু, যাঁর রূপ একেবারেই নেই ধ্বনি আছে, পদ নেই কিন্তু পদক্ষেপের চিহ্ন যিনি রেখে যান, অঙ্গ যাঁর দেখি না কিন্তু স্পর্শ করেন যিনি শীতল বা উষ্ণ, এই বায়ুকে রূপ দিয়ে নিরূপিত করা অন্যমনস্ক ভাবে তো যায় না। খালি ক্রিয়াপদ দিয়ে কখন পদ্য লেখা যায় না। কিন্তু এই ক্রিয়াপদ ছবিতে মূর্তিতে অভিনয়ে ঢের বেশি কাজ করে, কিন্তু এর সদ্ব্যবহার খুব পাকা আর্টিষ্টের দ্বারাই সম্ভব। রাফেল-প্রমুখ পুরাণো ইতালীর আর্টিষ্টরা ছবিতে বায়ু বইছে দেখাতে হলে আগে আগে ছবির আকাশপটে গোটাকতক গালফুলো ছেলে ফুঁ দিয়ে ঝাঁটার মতো খানিক ঝড় কি দক্ষিণ হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে এইটে আঁকতো, কিন্তু বায়ুর যথার্থ রূপ এমন চালাকি দিয়ে ধরা না ধরা সমান, ওটা ছেলেমান্ষি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভারত-শিল্পের বায়ু দেবতার মূর্তি—তাও আমাদের ইন্দ্র চন্দ্র বরুণের মতোই ছেলেমান্ষি পুতুল মাত্র। একই মূর্তি, একই হাবভাব, ভাবনার তারতম্য নেই। দেবমূর্তিগুলো তেত্ৰিশ কোটি হলেও একই ছাঁচে একই ভঙ্গিতে প্রায়শঃ গড়া, তারতম্য হচ্ছে শুধু বাহন মুদ্রা ইত্যাদির। একই বিষ্ণু যখন গরুড়ের উপরে তখন হলেন বিষ্ণু, সাতটা ঘোড়া জুড়ে দিয়ে হলেন সূর্য! একই দেবীমূর্তি, মকরে চড়া হলেই হলেন তিনি গঙ্গা, কচ্ছপে বসে’ হলেন যমুনা! বেদের ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণের রূপকল্পনার মধ্যে যে রকম রকম ভাবনার ও মহিমার পার্থক্য, গ্রীকমূর্তি আপোলো, ভিনাস, জুপিটার, জুনো ইত্যাদির মূর্তির মধ্যে যে ভাবনাগত তারতম্য তা ভারতের লক্ষণাক্রান্ত মূৰ্তিসমূহে অল্পই দেখা যায়। একই মূর্তিকে একটু আসবাব রং চং আসন বাহন বদলে’ রকম রকম দেবতার রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। বায়ু আর বরুণ, জল আর বাতাস দুটো এক নয়, দুয়ের ভাষা ও ভাবনা এক হতে পারে না। এ পর্যন্ত একজন গ্ৰীক ভাস্কর ছাড়া আর কেউ বায়ুকে সুন্দর করে, পাথরের রেখায় ধরেছে বলে আমার জানা নেই। এ মূর্তির একটা ছাঁচ আচার্য জগদীশচন্দ্রের ওখানে দেখেছি—গ্রীকদেবীর পাথরের কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে ভূমধ্য সাগরের বাতাস খেলছে চলছে শব্দ করছে—ছবি দেখে বুঝবে না, মূর্তিটা স্বচক্ষে দেখে এসো। এই যাঁর রূপ নেই অথচ ক্রিয়া আছে কথার ভাষায় সেই বায়ুকে দেবতাকে ক্রিয়া দিয়ে রূপ দিতে চেয়ে ঋষির মন যেমনি উদ্যত হলো বুক ফুলিয়ে, বাতাসের দুর্দমনীয় গতি পৌঁছলো অমনি ভাষায়; সে কতখানি তা ঋষির ভাষার অত্যন্ত বিশ্রী তর্জমাতেও ধরা পড়ে—“রথের ন্যায় যে বায়ু বেগে ধাবিত হন তাঁহাকে আমি বর্ণন করি, বজ্রধ্বনির ন্যায় ইঁহার ধ্বনি আবার ইনি বৃক্ষসমূহ ভগ্ন করিতে আসেন, ইনি দিক্ বিদিক্ রক্তবর্ণ করিতে করিতে শূন্যপথে গমনাগমন করেন, ধরণীর ধূলি বিকীর্ণ করিতে করিতে চলিয়া যান, পর্বতাদি যে কিছু স্থির পদার্থ তাহারা বায়ুর গতিবশে কম্পমান হইতে থাকে এবং ঘোটকীরা যেমন যুদ্ধে যায় তদ্রূপ এই বায়ুর প্রতি অভিগমন করে।” যুদ্ধের ঘোড়ার গতি নিয়ে কালিদাসেরও মনের ভাষা বার হয়েছিল বর্ষা-বৰ্ণনে—
“সসীকরাম্ভোধরমত্তকুঞ্জরস্তড়িৎপতাকোঽশনিশব্দমদলঃ।”
সমাগতো রাজবদুদ্ধতদ্যুতি র্ঘনাগমঃ কামিজনপ্রিয়ঃ প্রিয়ে॥
এই মনের উদ্দামগতি বাংলা ভাষাকেও তেজে চালিয়ে নিলে—
“ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে,
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভ-রভসে,
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা,
শ্যামগম্ভীর সরসা॥”
সারথির মানস রাশের মধ্য দিয়ে যেমন ঘোড়াতে গিয়ে পৌঁছয় তেমনি মনের ভাবনার সামান্য ইঙ্গিতও ভাষার মধ্যে দিয়ে চলাচল করে, তা সে ছবির ভাষা কবির ভাষা বা অভিনেতার কি গায়কের বা নর্তকের ভাষা, যে ভাষাই হোক। “The art of painting (নিরূপণ ও বর্ণনা-শিল্প সমস্তই) is perhaps the most indiscreet of all arts”—বাচন করা চলে ঢেকে ঢুকে আসল মনোভাব গোপন রেখে, কিন্তু বর্ণন করা চলে না সে ভাবে, যেমন, মেয়েটি কালো কিন্তু তার ঘটকালীটারও লোভ আছে বলে’ কন্যাকে ‘শ্যামাঙ্গী’ বলে’ বাচন করা গেল, কিন্তু তুলনায় বর্ণন করতে হলে মনের ভাব গোপন থাকা শক্ত, ধরা পড়ে যায় ঘটক। কথার যেটুকু বা বাচন করবার ফাঁক আছে ছবির তাও নেই; হুবহু বর্ণন, নয় মিথ্যা বর্ণন, দুই রাস্তা ছাড়া ছবির গতি নেই। ফটোগ্রাফ মেয়ের কালো রংটার বেলায় ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারে, ছবি কিন্তু পারে না। সত্যি বলতেই হয় মনকে ছবিতে ধরবার বেলায়, এই জন্যই বলা হলো—“It is an unimpeachable witness to the moral state of the painter at the moment when he held the brush (শতং বদ মা লিখ) all the shades of his nature even to the lapses of his sensibility all this is told by the painter’s work as clearly as if he were telling it in our ears.”—Fromentin
হাওয়া যেখানে নেই সেখানে শব্দ হয় না, জ্বালালেও আগুন ধরে ন, আলো যেখানে নেই রূপ সেখানে থেকেও নেই, তেমনি মন যেখানে নেই কথা সেখানে থেকেও নেই, মনে বেদন এল, নিবেদন হ’ল তবে ছবিতে কবিতায় নাট্যে৷ মন কার নেই? কিন্তু মনের কথা গুছিয়ে বলার ক্ষমতা যার তার নেই এটা ঠিক। ছাত্র পরীক্ষার দিনে খুব মনের আবেগ ও মনঃসংযোগ দিয়ে লিখছে; সে মন এক, আর সেই ছাত্রই দেশে গিয়ে যাত্রা জুড়েছে, কি মাঠে বসে মন দিয়ে বাঁশী বাজাচ্ছে, সে মন অন্য প্রকার। তেমনই সাধারণ মন আর রসায়িত মন, কবির মন আর্টিষ্টের মন আর তাদের হুঁকোবরদারের মন ও মনের আবেগে তফাৎ আছে। খুব খানিক মনের আবেগ নিয়ে লিখে কিম্বা বলে কয়ে চল্লেই কবি চিত্রকর অভিনেতা হয় তা নয়। অভিনেতা যদি মনের আবেগে কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো রুদ্রমূর্তিতে বেরিয়ে সত্যই দ্বিতীয় অভিনেত্রীর গলা কেটে বসে, তবে তাকে নট বলবে, না পাগল, মুর্খ এসব সম্বোধন করবে দর্শকরা! কিম্বা রঙ্গমঞ্চের নাচে দর্শকদের মধ্যে কেউ যদি মনের আবেগে মুগ্ধ হয়ে হঠাৎ কোমর বেঁধে নানা অঙ্গভঙ্গি সুরু করে দেয় তবে তাকে নটরাজ বলে’ ডাকে কেউ! অভিনেত্রী বেশ তাল লয় সুর দিয়ে কেঁদে চলেছে, হঠাৎ উপরের বক্স থেকে আবেগভরে ছেলে-কাঁদা ও ঘুম-পাড়ানো সুরু হলো, তার বেলায় শ্রোতারা ধমকে ওঠে কেন ছেলেকে ও ছেলের মাকে? মনের আবেগ তো যথেষ্ট সেখানে ভাষায় প্রকাশ হচ্ছিল কিন্তু বলে তো চল্লো না সেটা! তবেই দেখ শিল্পের অনুকূল আর তার প্রতিকূল এই দুই রকম মনের পরশ রয়েছে। মালি যেমন বেছে বেছে ফুল নেয়, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুলের তোড়া ফুলের হার গাঁথে, শিল্পীর মনের পরশ ঠিক সেইভাবে কায করে যায় বাক্য রং রেখা ভঙ্গি ইত্যাদিকে ভাবের সূত্রে ধরে’ ধরে’। নিছক আবেগের উচ্ছৃঙ্খলতা আছে, সংযম নির্বাচন এসব নেই। ছেলে কাঁদার ঠিক উল্টো যে পাকা নটীর কান্নার সুর কৃত্রিম সুরে হলেও সেটা মনোরম হয় শিল্পীর বর্ণন ভঙ্গি নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে। বাষ্পের মতো শুধু খানিক আবেগের সঞ্চয় নিয়ে ছবি বল আর লেখাই বল শিল্প বলে’ যে চলে না তার নমুনা এই—