‘অার কাল হৈল মোর কদম্বের তল
আর কাল হৈল মোর যমুনার জল।’
বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো কালো যমুনা তার ধারে কদমতলা, তার ছায়ায় সহচরী সহিত রাধিকা—
‘আর কাল হৈল মোর রতন ভূষণ
আর কাল হৈল মোর গিরি গোবর্দ্ধন।’
রাধিকার রত্ন অলঙ্কারের ঝিকমিকি থেকে দূরের কালো পাহাড়ের ছবি দিয়ে Landscapeটা সম্পূর্ণ হল, ছবি মিলে গেল কথার সঙ্গে, কান চোখ দুয়ের রাস্তা একত্র হয়ে সোজা চল্লো মনোরাজ্যে! এর পর আর ছবি নেই বর্ণনা নেই শুধু কথা দিয়ে বাচন—
‘এত কাল সনে অামি থাকি একাকিনী
এমন ব্যথিত নাহি শুনএ কাহিনী।’
এ বারে কথিত ভাষার ছবির সাক্ষাদ্দর্শন—
‘জলদ বরণ কানু, দলিত অঞ্জন জনু
উদয় হয়েছে সুধাময়—
নয়ন চকোর মোর, পিতে করে উতরোল
নিমিষে নিমিখ নাহি রয়।
সই দেখিনু শ্যামের রূপ যাইতে জলে!’
একেবারে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ছবি-দেখা কথার ভাষা দিয়ে! এইবার অঙ্গভঙ্গি আর চলার সঙ্গে কথার যোগাযোগ পরিষ্কার দেখাবো—
‘চলিতে না পারে রসের ভরে
আলস নয়ানে অলস ঝরে
ঘন ঘন সে যে বাহিরে যায়
আন ছলে কত কথা বুঝায়।’
চোখের সামনে চলাফেরা সুরু ক’রে দিলে কথার ভাষা অভিনয় করে নানা ভঙ্গিতে।
চিত্রিত ভাষা কথিত ভাষা অভিনীত ভাষা এসব যদি এ ওর কাছে লেনা দেনা করে চল্লো তবে কথিত ভাষার ব্যাকরণ অলঙ্কারের সূত্র আইন কানুন ইত্যাদির সঙ্গে আর দুটো ভাষার ব্যাকরণাদির মিল থাকতে বাধ্য। কথার ব্যাকরণে যাকে বলে ‘ধাতু’, ছবির ব্যাকরণে তার নাম ‘কাঠামো’ (form)। ধারণ করে রাখে বলেই তাকে বলি ধাতু। ধাতু ও প্রত্যয় একত্র না হ’লে কথিত ভাষার শব্দরূপ পাই না, ছবির ভাষাতেও ঠিক ঐ নিয়ম—মাথা হাত পা ইত্যাদি রেখে দিয়ে একটা কাঠামো বা ফর্মা বাঁধা গেল। কিন্তু সেটা বানর না নর এ প্রত্যয় বা বিশ্বাস কিসে হবে যদি না ছবিতে নর বানরের বিশেষ প্রত্যয় দিই! শুধু এই নয়, বিভক্তি যিনি ভাগ করেন ভঙ্গি দেন, তাঁর চিহ্ন ইত্যাদি নানা ভঙ্গিতে কাঠামোয় জুড়ে দেওয়া চাই। বর্ণে বর্ণে রূপে রূপে নানা বস্তুর সঙ্গে নানা বস্তুতে সন্ধি সমাস করার সূত্র আছে, ছবির ব্যাকরণে, বচন ক্রিয়া বিশেষ্য বিশেষণ সর্বনাম অব্যয় এমন কি মুগ্ধবোধের সবখানি অলঙ্কারশাস্ত্রের সবখানির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া চলে ছবির ব্যাকরণ আর অলঙ্কারের ধারাগুলো। কথিত ভাষার বেলায় ‘ভৃ’ ধাতু গক্ প্রত্যয় করে যেমন ‘ভৃঙ্গ’, ছবির ভাষায় কালো ফোঁটার উপরে দুটো রেফ্ যোগ করলেই হয় ‘দ্বিরেফ্ ভৃঙ্গ’ আবার ভৃঙ্গের কালো ফোঁটায় রেফ্ না দিয়ে শুণ্ড প্রত্যয় দিলে হয় ‘ভৃঙ্গার’ যেমন ‘ভৃ’ ধাতুতে ‘গিক’ প্রত্যয় জুড়লে হয় ‘ভৃঙ্গি’।
ছবি লেখার উৎসাহ নেই কিন্তু ছবির ব্যাকরণ লেখার আম্বা আছে এমন ছাত্র যদি পাই তো চিত্ৰকরে আর বৈয়াকরণে মিলে এই ভাবে আমরা ছবি দেওয়া একটা ব্যাকরণ রচনা করতে পারি, কিন্তু এ কাজে নামতে আমার সাহস নেই কেননা ব্যাকরণ বলে জিনিষটা আমার সঙ্গে কি কথিত ভাষা কি চিত্রিত ভাষা দুয়ের দিক দিয়েই চিরকাল ঝগড়া করে বসে আছে। সংকীর্তিত ভাষা যেমন, তেমনি সংচিত্রিত ভাষাও একটা ভাষা, ব্যাকরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে এইটে যদি সাব্যস্ত হল তবে এও ঠিক হ’ল যে ছবি দেখা শুধু চোখ নিয়ে চলে না ভাষা-জ্ঞানও থাকা চাই দ্রষ্টার, ছবি-স্রষ্টার পক্ষেও ঐ একই কথা। ‘রসগোল্লা খেতে মিষ্টি, টাপুর টুপুর পড়ে বৃষ্টি’, এটা বুঝতে পারে না পাঠশালায় না গিয়েও এমন ছেলে কমই আছে, কিন্তু শিশুবোধের পাঠ থেকে ভাষা-জ্ঞান বেশ একটু না এগোলে—
‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে
হৃদয়-কমল-বন মাঝে!’
এটা বোঝা সম্ভব হয় না চট্ ক’রে বালকের। শুধু অক্ষর কিম্বা কথা অথবা পদ কিম্বা ছত্রের পর ছত্র লিখতে পারলে অথবা চিনে চিনে পড়তে পারলেই সুন্দর ভাষায় গল্প কবিতা ইত্যাদির লেখক বা পাঠক হয়ে ওঠা যায় একথা কেউ বলে না, ছবি অভিনয় নর্তন গান ইত্যাদির বেলায় তবে সে কথা খাটবে কেন! যেমন চিঠি লিখতে পারে অনেকে তেমনি ছবিও লিখতে পারে একটু শিখলে প্রায় সবাই, কিন্তু লেখার মতো লেখার ভাষা, আঁকার মতো আঁকার ভাষার উপর দখল ক’জনে পায়? কাযেই বলি যে ভাষাই হোক তাতে স্রষ্টাও যেমন অল্প তেমনি দ্রষ্টাও ক্বচিৎ মেলে। ভাষাজ্ঞানের অভাব বশতঃ ফুলকে দেখারূপে আঁকা এক ফুলের ভাষা শুনে নিজের ভাষায় ফুলকে বর্ণনা করায় তফাৎ আছে কে না বলবে!
বাঙ্গলা দেশে অপ্রচলিত সংস্কৃত ভাষা, কিন্তু সেই অপ্রচলিত ভাষা চলিত বাঙ্গলার সঙ্গে মিলিয়ে একটা অদ্ভুত ভাষা হয়ে প্রচলিত যেমনি হ’ল, অমনি বাঙ্গলার পণ্ডিত সমাজে খুব চলন হল সেই ভাষার, সবাই লিখলে কইলে বুঝলে বুঝালে সেই মিশ্র ভাষায়, চলিত বাঙ্গলায় খাঁটি বাঙ্গলায় লেখা অপ্রচলিত হয়ে পড়লো, ফল হ’ল—এক কালের চলতি ভাষা সহজ কথা সমস্তই দুর্বোধ্য হয়ে পড়লো, এমন কি কথার অক্ষর মূর্তিটা চোখে স্পষ্ট দেখলেও কথাটার ভাব-অর্থ ইত্যাদি বোঝা শক্ত হয়ে পড়ল। বাঙ্গলা অথচ অপ্রচলিত কথাগুলোর বেলায় যদি এটা খাটে তবে ছবির ভাষার বেলায় সেটা খাটবে না কেন? ছবির মূর্তির অপ্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাষা বোঝাও দুঃসাধ্য হয়ে যে পড়ে তার প্রমাণ দেশের ইতিহাসে ধরা থাকে, আর সেইগুলোর নাম হয় অন্ধযুগ, এই অন্ধতার মধ্য দিয়ে আমাদের মতো পৃথিবীর অনেকেই চলেছে সময় সময়! চোখে দেখা মাত্রই সবখানি বোঝা না গেল সে ছবি ছবিই নয় একথা না হয় শিল্পীর উপরে জবরদস্তিতে চালানো গেল, কিন্তু আমাদের নিজ বাঙ্গলার মুখের কথা আমরা অনেক সময়ে নিজেরাই বুঝিনে বোঝাতেও পারিনে ভাষাতে পণ্ডিতেরা না বুঝিয়ে দিলে, তবে কি বলবো বাঙ্গলা ভাষা বলে বস্তুটা বস্তুই নয়?—‘ছীয়াল’, ‘ছিমনী’, ‘ছোলঙ্গ’ এই তিনটেই বাংলা কথা, কিন্তু বুঝলে কিছু? ফরিদপুরের ছেলে ‘ছোলঙ্গ’ বলতেই বোঝে, বহরমপুরের লোক বোঝে না, বাঙ্গলা শব্দকোষ না আয়ত্ত হ’লে ওয়েবষ্টার জ্ঞান নিয়েও বুঝতে পারে না ‘ছোলঙ্গ’ হচ্ছে বাতাবি লেবু, লারঙ্গ ছোলঙ্গ টাবা কমলা বীজপুর। ‘ছিয়াল’, ‘ছিমনী’ এ দুটোও বাঙ্গলা কিন্তু বাঙ্গলার সাধুভাষা বলে কৃত্রিম ভাষা নিয়ে যারা ঘরকন্না করছেন তাঁরা এর একটাকে শৃগালের অপভ্রংশ আর একটাকে ইংরাজি চিম্নি কথার বাঙ্গলা বলেই ধরবেন কিন্তু এ দুটোই তা নয়—ছীয়াল মানে শ্ৰীল বা শ্ৰীমান ও শ্ৰীমতী, আর ছিম্নী মানে পাথর-কাটা ‘ছেনী’, শৃগালও নয় চিমনিও নয়। দুশো বছর আগে যে ভাষা চলিত ভাষা ছিল, পট ও পাটার ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রাচীন বাঙ্গলা পুঁথির ভাষাও অপ্রচলিত হয়ে গেছে; সুতরাং যে শোলোক্টা এবারে বলবো তা বাঙ্গলা হলেও আমাদের কাছে চীনে ভাষারই মতো দুর্বোধ্য—