ইজিপ্টের লোক এককালে সত্যিই বিশ্বাস করতো যে, জীবন কায়া ছেড়ে চলে যায় আবার কিছুদিন পরে সন্ধান করে’ করে’ নিজের ছেড়ে ফেলা কামিজের মতো কায়াতেই এসে ঢোকে। এইজন্যে কায়ার মায়া তারা কিছুতে ছাড়তে পারেনি, ভৌতিক শরীরকে ধরে’ রাখার উপায় সমস্ত আবিষ্কার করেছিল, একদল কারিগরই তৈরি হয়েছিল ইজিপ্টে, যারা ‘কা’ প্রস্তুত করতো; তাদের কাযই ছিল যেমন মানুষ ঠিক সেই গড়নে পুত্তলিকা প্রস্তুত করা, গোরের মধ্যে ধরে’ রাখার জন্য; ঠিক এই সব ‘কা’-নির্মাতাদের পাশে বসে’ ইজিপ্টের একদল রচয়িতা artistic anatomyর বৃহত্ত ও অন্যথা-বৃত্ত দিয়ে পুত্তলিকা বা ‘কা’-নির্মাতাদের ঠিক বিপরীত রাস্তা ধরে’ গড়েছিল কত কি তার ঠিক নেই, দেবতা মানুষ পশু পক্ষী সবার anatomy ভেঙে চুরে তারা নতুন মূর্তি দিয়ে অমরত্বের সিংহাসনে বসিয়ে গেল। ইজিপ্টের এই ঘটনা হাজার হাজার বৎসর অাগে ঘটেছিল; কায়া-নির্মাতা কারিগর ও ছায়া-মায়ার যাদুকর দুই দলই গড়লে কিন্তু একজনের ভাগ্যে পড়লো মূর্ত—যা কিছু তাই, আর এক জনের পাত্রে ঝরলো অমূর্ত রস স্বর্গ থেকে,—এ নিয়মের ব্যতিক্রম কোন যুগের আর্টের ইতিহাসে হয়নি হবার নয়। ইজিপ্ট তো দূরে, পাঁচ হাজার দশ হাজার বছর আরো দূরে, এই আজকের আমাদের মধ্যে যা ঘটছে, তাই দেখ না কেন; যারা ছাপ নিয়ে চলেছে মর্ত্য জগতের রূপ সমস্তের, তারা মূর্ত জিনিষ এত পাচ্ছে দেখে’ সময়ে সময়ে আমারও লোভ হয়,—টাকা পাচ্ছে হাততালি পাচ্ছে অহংকে খুব বেশী করে পাচ্ছে। আর এরূপ যারা করছে না তারা শুধু আঁকা বাঁকা ছন্দের আনন্দটুকু, ঝিলিমিলি রঙ্গের সুরটুকু বুকের মধ্যে জমা করছে, লোহার সিন্দুক কিন্তু রয়েছে খালি; বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই কালে কালে খুব আদর করে’ আর্টিষ্টদের যা সম্ভাষণ করেছে তা উর্দ্দূতে বলতে গেলে বলতে হয়—খেয়ালী, হিন্দীতে—বাউর বা বাউল, আর সব চেয়ে মিষ্টি হ’ল বাংলা—পাগল। কিন্তু এই পাগল তো জগতে একটি নেই, উপস্থিত দশবিশ লক্ষ কিম্বা তারও চেয়ে হয়তো বেশী এবং অনুপস্থিত ভবিষ্যতের সব পাগলের সর্দার হ’য়ে যে রাজত্ব করছে, উল্কার মতো জ্যোতির্ময় সৃষ্টি রচনা সমস্ত সে ছড়িয়ে দিয়ে চলেছে পথে-বিপথে সৃজনের উৎসব করতে করতে। এমন যে খেয়ালের বাউল, জগতের আগত অনাগত সমস্ত খেয়ালী বা আর্টিষ্ট হ’ল তার চেলা, তার পথ চলতে ঢেলাই হোক মাণিকই হোক যাই কুড়িয়ে পেলে অমনি সেটাকে যে খুব বুদ্ধিমানের মতো ঝুলিতে লুকিয়ে রাতারাতি আলো আঁধারের ভ্রান্তি ধরে’ চোখে ধূলো দিয়ে বাজারে বেচে এল তা নয়—মাটির ঢেলাকে এমন করে’ ছেড়ে দিলে যে সেটা উড়ে এসে যখন হাতে পড়লো তখন দেখি সোণার চেয়ে সেটা মূল্যবান, আসল ফুলের চেয়ে হ’য়ে গেছে সুন্দর! বাঙলায় আমাদের মনে আর্টের মধ্যে অস্থিবিদ্যার কোন্খানে স্থান, এই প্রশ্নটা ওঠবার কয়েক শত বৎসর আগে এই পাগলের দলের একজন আর্টিষ্ট এসেছিল। সে জেগে বসে’ স্বপন দেখলে—যত মেয়ে শ্বশুর ঘরে রয়েছে আসতে পারছে না বাপের বাড়ী, একটা মূর্তিতে সেই সবারই রূপ ফুটিয়ে যাবে! আর্টিষ্ট সে বসে গেল কাদা মাটি খড় বাঁশ রং তুলি নিয়ে, দেখতে দেখতে মাটির প্রতিমা সোণার কমল হয়ে ফুটে’ উঠলো দশ দিকে সোণার পাপড়ি মেলে! এ মূর্তি বাঙলার ঘরে ঘরে দেখবে দুদিন পরে, কিন্তু এরও উপরে ডাক্তারি শাস্ত্রের হাত কিছু কিছু পড়তে আরম্ভ হয়েছে সহরে। বাঙলার কোন অজ্ঞাত পল্লীতে এই মূর্তির মূল ছাঁচ যদি খোঁজ তো দেখবে—তার সমস্তটা artistic anatomyর নিয়মের দ্বারায় নিয়তির নিয়ম অতিক্রম করে’ শোভা পাচ্ছে ব্যতিক্রম ও অতিক্রমের সিংহাসনে।
শিল্প ও ভাষা
“বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে
ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥”
বাঙ্গলা ভাষা যে বোঝে সেই এ শ্লোকটা শুনলেই বলবে—‘বুঝলেম’, কিন্তু ‘ভারতী’ কাগজের মলাটের নিচে থেকে টেনে বার ক’রে আজকালের একখানা ছবি সবার সামনে যদি ধরে দিই, সাড়ে পনেরো আনার চেয়ে বেশি লোক বলবে, ‘বুঝলেম না মশায়!’ এই শেষের ঘটনা ঘটতে পারে, হয় যে ছবিটা লিখেছে সেই আর্টিষ্টের ছবির ভাষায় বিশেষ জ্ঞান না থাকায়, অথবা যে ছবি দেখেছে চিত্রের ভাষার দৃষ্টিটা তার যদি মোটেই না থাকে। ভারতীর বন্দনাটা যে ভাষায় লেখা সেই ভাষাটা আমাদের সুপরিচিত আর ‘ভারতী’র ছবিখানা যে ভাষায় রচা সে ভাষাটা একেবারেই আমাদের অপরিচিত; সেই জন্য চিত্র-পরিচয় পড়েও ওটা বুঝলেম না এমনটা হতে বাধা কোন্খানে? চীনেম্যানের কানের কাছে খুব চেঁচিয়ে সরস্বতীর স্তোত্র পাঠ করলেও সে বুঝবে না, কিন্তু ছবির ভাষার বেলায় সে অনেকখানি বুঝবে, কেননা ছবির ভাষা অনেকটা সার্বজনীন ভাষা। ‘আবর্’ কথাটা ফরাসীকে বল্লে সে গাছ বুঝবে, আবার ‘আবর্’ শব্দ হিন্দুস্থানীর কাছে মেঘরূপে দেখা দেবে, ইংরেজ সে শব্দটার কোনরূপ অর্থ আবিষ্কার করতে পারবে না, কিন্তু আঁকার ভাষায় ‘আবর্’ হয় গাছ নয় অভ্র স্বরূপ হয়ে দেখা দেয়; কথিত ভাষার মতো কৃত্রিম উপায়ে জোর ক’রে চাপিয়ে দেওয়া রূপ নিয়ে নয়। সুতরাং ছবির ভাষার মধ্যে, বলতেই হয়, অপরিচয়ের প্রাচীর এত কম উঁচু যে সবাই এমন কি ছেলেতেও সেটা উল্লঙ্ঘন সহজেই করতে পারে, কিন্তু ঐ একটু চেষ্টা যার নেই তার কাছে ঐ এক হাত প্রাচীর দেখায় একশো হাত দুর্গপ্রাকার,—ছবি ঠেকে সমস্যা। কবির ভাষা চলেছে শব্দ চলাচলের পথ কানের রাস্তা ধরে’ মনের দিকে, ছবির ভাষা অভিনেতার ভাষা এরা চলেছে রূপ চলাচলের পথ আর চোখের দেখা অবলম্বন ক’রে ইঙ্গিত করতে করতে, আবার এই কথিত ভাষা যেটা আসলে কানের বিষয় এখন সেটা ছাপার অক্ষরের মূর্তিতে চোখ দিয়েই যাচ্ছে সোজা মনের মধ্যে; ‘নবঘনশ্যাম’ এই কথাটা—ছাপা দেখলেই রূপ ও রং দুটোর উদ্রেক করে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে!