যে শিল্পজগৎ সত্য কল্পনার দ্বারা সজীব নয় সে বুদ্বুদের উপরে প্রতিবিম্বিত জগৎ-চিত্রটির মতো মিথ্যা ও ভঙ্গুর; দর্পণের উপরেই তার সমস্তখানি কিন্তু দর্পণের কাচ ও পারার এবং বুদ্বুদের জলবিন্দুটির যতটুকু সত্তা—তাও তার নেই। রচনা যেখানে রচয়িতার স্মৃতি ও কল্পনার কাছে ঋণী সেইখানেই সে আর্ট, যেখানে সে অন্যের রচনা ও কল্পনার কাছে ঋণী সেখানে সে আর্ট নয়, আসলের নকল মাত্র। হোমার, মিল্টন দুজনেই অন্ধ ও কবি কিন্তু বিদ্যমান ও অবিদ্যমানের দুয়েরই ঋণ বিষয়ে তাঁরা অন্ধ ছিলেন না তাঁরা বাস্তব কল্পনা করে’ গেছেন অন্ধ কল্পনা করেননি। কালিদাস, ভবভূতি চক্ষুষ্মান কবি কিন্তু তাঁরাও কল্পনা বাদে বাস্তব কিম্বা বাস্তব বাদে কল্পনার ছবি রেখে যান নি। গানের সুর সম্পূর্ণ কাল্পনিক জিনিষ কিন্তু এই বাস্তব জগতের বায়ুতরঙ্গের উপর তার প্রতিষ্ঠা হ’ল, কথার ছবির সঙ্গে সে আপনাকে মেলালে তবে সে সঙ্গীত হয়ে উঠলে,—অনাহত আপনাকে করলে আহত বাতাস ধরে, কিন্তু হরবোলার বুলি বাস্তব জগতের সঠিক শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি দিলে সেইজন্য সে সঙ্গীত হওয়া দূরের কথা খুব নিকৃষ্ট যে টপ্পা তাও হ’ল না। বাস্তবকে কল্পনা থেকে কতখানি সরালে কিম্বা কল্পনাকে বাস্তব থেকে কতটা হঠিয়ে নিলে art হয় এ তর্কের মীমাংসা হওয়া শক্ত, কিন্তু কল্পনার সঙ্গে বাস্তব, চোখে-দেখা জগতের সঙ্গে মনে-ভাবা জগতের মিলন না হলে যে art হবার জো নেই এটা দেখাই যাচ্ছে। “One of the hardest thing in the world is to determine how much realism is allowable to any particular picture.” —Burn Jones. এই হ’ল ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ চিত্রকর Burn Jonesএর কথা। অনেক দিন ধরে চিত্র এঁকে যে জ্ঞান লাভ করলেন শিল্পী তারি ফলে বুঝলেন যে বস্তুতন্ত্রতা ছবিতে কতখানি সয় তা ঠিক করা মুস্কিল। ইংরেজ শিল্পী এখানে কোন মত দিলেন না, ছবি আঁকতে গেলে সবারই যে প্রশ্ন সামনে উদয় হয় তাই লিখলেন, কিন্তু আমাদের দেশে মত দেওয়া যেমন সুলভ, মত ধরে চলাও তেমনি সাধারণ—কে চিত্রবিদ তার সম্বন্ধে পরিস্কার মত, কি চিত্র তারও বিষয়ে পাকা শেষ মত প্রচারিত হ’ল এবং সেই সব মতের চশমা পরে’ ভারতবর্ষের চিত্রকলার অাদর্শগুলোর দিকে চেয়ে দেখে’ অজন্তার শিল্পও আমাদের শ্রদ্ধেয় অক্ষয়চন্দ্র মৈত্র মহাশয়ের চোখে কি ভাবে পড়লে তার পরিষ্কার ছবি কার্তিক সংখ্যার প্রবাসীর কষ্টিপাথর থেকে তুলে দিলেম—“যাহা ছিল তাহা নাই। যাহা আছে সেই অজন্তাগুহার চিত্রাবলী, তাহাতে যাহা আছে, তাহা কিন্তু চিত্র নহে চিত্রাভাস। তাহা পুরাতন ভারতচিত্রের অসম্যক্ নিদর্শন, চিত্র-সাহিত্যদর্পণের দোষ-পরিচ্ছেদের অনায়াসলভ্য উদাহরণ। তাহা কেবল বিলাসব্যসনমুক্ত যোগযুক্ত অনাসক্ত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের নিভৃত নিবাসের ভিত্তি বিলেপন…ভারতচিত্রোচিত প্রশংসা লাভের অনুপযুক্ত। তাহা এক শ্রেণীর পূর্ত কর্ম …তাহাতে যাহা কিছু চিত্রগুণের পরিচয় পাওয়া যায় তাহা অযত্নসম্ভূত আকস্মিক,…চিত্র-গুণের এবং চিত্র-দোষের যথাযথ পর্যবেক্ষণে যাঁহাদের চক্ষু অভ্যস্ত, তাঁহাদের নিকট অজন্তা-গুহা চিত্রাবলী ভারত চিত্রের অনিন্দ্যসুন্দর নিদর্শন বলিয়া মর্যাদা লাভ করিতে অসমর্থ। যাঁহাদের তুলিকাসম্পাতে এই সকল ভিত্তি-চিত্র অঙ্কিত হইয়াছিল, তাঁহারাও পুরাতন ভারতবর্ষে ‘চিত্রবিৎ’ বলিয়া কথিত হইতে পারিতেন না। তাঁহারা নমস্য; কিন্তু চিত্রে নহে, চরিত্রে। তাঁহাদের ভিত্তি-চিত্রও প্রশংসার্হ; কিন্তু কলা-লালিত্যে নহে, বিষয়-মাহাত্ম্যে।” (শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্র, ভারত চিত্র চর্চ্চা)। মতের চশমা দিয়ে দেখলে অজন্তার ছবিতে কেন চাঁদের মধ্যেও অপরিণতি ও কলঙ্ক দেখা যায় এবং সেই দোষ ধরে বিশ্বকর্মাকেও বোকা বলে’ উড়িয়ে দেওয়া চলে, কিন্তু সৃষ্টির প্রকাশ হ’ল স্রষ্টার অভিমতে, শিল্পের প্রকাশ হ’ল শিল্পীর অভিমতটি ধরে’, ব্যক্তিবিশেষের বা শাস্ত্রমতবিশেষের সঙ্গে না মেলাই তার ধর্ম, কাযেই কলঙ্ক ও অপরিণতি যেমন হয় চাঁদের পক্ষে শোভার কারণ, শিল্পের পক্ষেও ঠিক ঐ কথাটাই খাটে। চিত্র-ষড়ঙ্গের কতখানি পরিপূর্ণতা পেলে চিত্র চিত্র হবে চিত্রাভাস হবে না, মডেল ড্রয়িং কতখানি সঠিক হ’লে তবে অজন্তার ছবিকে বলব চিত্র আর কতখানি কাঁচা থাকলে অজন্তার চিত্রাবলী হবে “চিত্র সাহিত্যদর্পণের দোষ-পরিচ্ছেদের অনায়াসলভ্য উদাহরণ” তা বলা কঠিন, তবে পাকা ড্রয়িং হলেই যে সুন্দর চিত্র হয় না এটা বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী রোঁদা বলেছেন—“It is a false idea that drawing in itself can be beautiful. It is only beautiful through the truths and the feeling that it translates….There does not exist a single work of art which owes its charm only to balance of line and tone and which makes appeal to the eye alone.” —Rodin. আদর্শ জিনিষটি নিছক অবিদ্যমান জিনিষ, বস্তুতঃ তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলন অসম্ভব, ধর্মে-কর্মে, শিল্পে সমাজে, ইতিহাসে, কোন দিক দিয়ে কেউ মেলেনি, না মেলাই হ’ল নিয়ম। সৃষ্টিকর্তার নিরাকার আদর্শ যা আমরা কল্পনা করি তার সঙ্গে সৃষ্ট বস্তুগুলো এক হ’য়ে মিল্লে সৃষ্টিতে প্রলয় আসে, তেমনি শাস্ত্রের আদর্শ গিয়ে শিল্পে মিল্পে শিল্প লোপ পায়—থাকে শুধু শাস্ত্রের পাতায় লেখা ভারত-শিল্পের ছ’ছত্ৰ শ্লোক মাত্র। দাঁড়ি পাল্লা বাটখারা ইত্যাদি নিয়ে চাল ডাল ওজন করা চলে, ছবির চারিদিকের গিল্টির ফ্রেমখানাও ওজন করা যায়, ছবির কাগজটা—মায় রংএর ডেলা, রংএর বাক্স, তুলি এমন কি শিল্পীকে পর্যন্ত সঠিক মেপে নেওয়া চলে, কিন্তু শিল্পরস যে অপরিমেয় অনির্বচনীয় জিনিষ, শাস্ত্রের বচন দিয়ে তার পরিমাণ করবে কে? তাই শাস্ত্রকারদের মধ্যে যিনি রসিক ছিলেন, শিল্প সম্বন্ধে লেখবার বেলায় মতের আকারে মনোভাব প্রকাশ করলেন না তিনি; শিল্পের একটি স্তোত্র রচনা করে অলঙ্কারশাস্ত্রের গোড়া পত্তন করলেন, যথা—“নিয়তিকৃতনিয়মরহিতাং হ্লাদৈকময়ীমনন্তপরতন্ত্রাং। নবরসরুচিরাং নিৰ্ম্মিতিমাদধীতি ভারতী কবের্জয়তি॥” নিয়তিকৃতনিয়মরহিতা আনন্দের সঙ্গে একীভূত অনন্তপরতন্ত্র নবরসরুচির নির্মিতিধারিণী যে কবি ভারতী তাঁর জয়। শুধু ভারতশিল্পের জন্য নয়, কাব্যচিত্র ভাস্কর্য সঙ্গীত নাট্য নৃত্য সব দেশের সব শিল্পের সবার জন্য এই মন্ত্রপূত সোণার পঞ্চপ্রদীপ ভারতবর্ষ ছেড়ে যে মানুষ একদিনও যায়নি সে জ্বালিয়ে গেছে। মতের ফুৎকারে এ কোন দিন নেভ্বার নয়, কেননা রস এবং সত্য এই দুই একে অমৃতে সিঞ্চিত করেছে। সূর্যের মতে দীপ্যমান এই মন্ত্র, এর আলোয় সমস্ত শিল্পেরই ভূত, ভবিষ্যৎ, বৰ্ত্তমান, কল্পনারাজ্য ও বাস্তবজগৎ যেমন পরিষ্কার করে দেখা যায় এমন আর কিছুতে নয়। মতগুলো আলেয়ার মত বেশ চক্মকে ঝকঝকে কিন্তু আলো দেয় যেটুকু তার পিছনে অন্ধকার এত বেশী যে, সেই আলেয়ার পিছনে চলতে বিপদ পদে পদে।