Site icon BnBoi.Com

প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পসমগ্র – প্রেমেন্দ্র মিত্র

প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পসমগ্র – প্রেমেন্দ্র মিত্র

 জনৈক কাপুরুষের কাহিনী – প্রেমেন্দ্র মিত্র

সকালবেলা করুণা নিজ হাতে চা নিয়ে এলো।

চায়ের আনুষঙ্গিকের বহর দেখে না হেসে পারলাম না, বললাম—”তোমাদের এদেশী জলহাওয়া ভালো হতে পারে, কিন্তু আমার জীর্ণ করবার ক্ষমতাটা এখনো স্বদেশী আছে—এই দুদিনে তার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।”

উত্তরে শুধু একটু হেসে প্লেটগুলো টেবিলের ওপর সাজিয়ে করুণা চলে যাবার উপক্রম করতে আবার ডেকে বললাম-”তুমি কি আমার সঙ্গে লৌকিকতা শুরু করে দিলে নাকি? বিমলবাবু লৌকিকতা করলে নাহয় বুঝতাম, কিন্তু-”কথার মাঝখানেই করুণা বললে—”বিমলবাবুর হয়েই যদি করি— দোষ আছে কি?”–তারপর হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

চায়ের পেয়ালা সামনে ঠাণ্ডা হতে লাগলো। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।

না, করুণার ব্যবহারটা মোটেই ভালো লাগছে না, একথা নিজের মনের কাছেও স্বীকার করতে আর বাধা নেই।

করুণা নাটকীয় একটা কিছু করে বসবে তা অবশ্য আশা করিনি। আশা কেন, সেটা রীতিমতো আশঙ্কার বিষয়ই ছিলো। গোড়ায় তার সহজ স্বাভাবিকতায় তাই বুঝি আশ্বস্তই বোধ করেছি। কিন্তু মনের কোনো গোপন কোণে আহত অহংকার তারপর ধীরে ধীরে সাড়া দিতে শুরু করেছে। মনে হয়েছে, এতটা হবার বুঝি দরকার ছিলো না। সূর্য অস্ত গেছে যা কিন্তু তার বিলম্বিত রঙ পশ্চিমের মেঘে একটু লেগে থাকলে ক্ষতি কি ছিল!

নাটকীয় না হয়ে করুণা অতিমাত্রায় কঠিন ও সংযত হয়ে উঠলে বুঝি সবচেয়ে খুশি হতাম। ধরা দেবার ভয়ে তার সেই সযত্ন সাবধানতায় আমার আত্মাভিমান সবচেয়ে বোধহয় তৃপ্ত হত।

কিন্তু করুণা নাটকীয় উচ্ছাস বা কঠিন ঔদাসীন্য—দুই-এর কোনো দিক দিয়েই গেলো না।

তাতে আমার কিছু আসে যায় না, অনায়াসে এই কথাই ভাবতে পারতাম। এবং তাই ভাবাই ছিলো উচিত। সত্যি করুণার সঙ্গে দেখা হবার কোনো আশা বা আকাঙ্ক্ষা আমার তো ছিলো না। তার সঙ্গে দেখা হবার কথাও নয়। বিশাল পৃথিবীর জনতায়। এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে আমরা হারিয়ে গেছিলাম যে কোনো দিন আবার পরপ্রকে খুঁজে পাওয়াই ছিলো অভাবিত।

কিন্তু সেই অভাবিত ব্যাপার যখন ঘটলো তখন দেখলাম, করুণাকে অনায়াসে ভুলে গেছি যখন মনে করেছি তখনও সে আমায় ভুলতে পারে না—মনের এ গোপন গর্বটুকু ত্যাগ করতে পারিনি।

এ রকম একটা গর্ব থাকা খুব অস্বাভাবিক বোধহয় নয়।

সে-সব দিনের কথা একেবারে ভোলা তো যায় না! বিশেষ করে সেই একটি বিকেল। সারাদিন বাইরে অবিশ্রান্তভাবেই বৃষ্টি পড়েছে, ইচ্ছে থাকলেও কোথাও আর বার হওয়া হয়নি। বিকেলে চাকর এসে খবর দিলে একটি মেয়ে দেখা করতে এসেছে।

এই হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে একটি মেয়ে। প্রথমটা সত্যিই একটু বিমূঢ় হয়ে গেছিলাম। চাকরের সঙ্গে করুণা যখন ঘরে এসে ঢুকলো তখনও আমার মুখের বিস্ময় নিশ্চয় অত্যন্ত স্পষ্ট।

চাকর চলে যাবা পর করুণা কাছে এগিয়ে এসে বললে— “খুব আশ্চর্য হয়েছো না?”

“তা একটু হয়েছি, কিন্তু তুমি যে একেবারে ভিজে গেছে!”— আমি সত্যই ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।

করুণা কাছের একটা চেয়ারে বসে বললে— “বৃষ্টিতে বেরুলে ভিজতে হয়, তোমার ব্যস্ত হতে হবে না।”

তারপর হেসে উঠে বললে—”ব্যস্ত হয়ে করবেই বা কি! তোমাদের এ নারী বিবর্জিত রাজ্যে মেয়েদের পোশাক পাবে কোথায়? সখের থিয়েটার পার্টি তো নিশ্চয়ই তোমাদের নেই!”

একটু ভেবে বললাম—”ওপরে দশ নম্বরে একজনেরা আছেন— স্বামী-স্ত্রী!”

করুণা আবার আসলো—”তাঁদের কাছে শাড়ি ব্লাউজ চাইতে যাবে? কি বলে চাইবে?”

হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বললে—”তার চেয়ে ভিজে কাপড়েই আমি বেশ আছি। আমার অসুখ করবে না, ভয় নেই।”

অগত্যা তার পাশে গিয়ে বসলাম। আমি কোনো প্রশ্ন করবার আগেই সে আবার বললে—”ভাবছো, এমনভাবে এখানে আসার মানে কি? কেমন?”

এবারও কোনো উত্তর দিলাম না। করুণা খানিকক্ষণের জন্যে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মনে হলো। তারপর সম্পূর্ণ রূপান্তর। এই দুর্বার আবেগ সে এতক্ষণ জোর করে ধরে রেখেছিল বুঝলাম।।

একেবারে আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ব্যাকুল স্বরে বললো— “আমায় পাটনায় নিয়ে যাচ্ছে। মামা কাল চিঠি দিয়েছেন।”

বুঝতে কিছু পারলাম না এমন নয়। তবুও বেদনাময় সত্যটা যতক্ষণ সম্ভব অস্বীকার করে বললাম-”তোমাদের কলেজের তো ছুটি হচ্ছে?”

করুণা আরো ব্যাকুল স্বরে বললে—” না না, তা নয়। তুমি বুঝতে পারছে না। এখানে আমায় আর রাখবে না; এই যাওয়া আমার শেষ!”।

তার ঠাণ্ডা একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। হ্যাঁ, বেদনা সেদিন আমার হৃদয়েও ছিলো, কিন্তু করুণার উদ্বেল আবেগের তুলনায় সে বুঝি কিছু নয়! আমার ভালোবাসার মধ্যে সে উদ্দামতা ছিলো না যা ভাগ্যের বাধার বিরুদ্ধে উদ্ধত বিদ্রোহ করতে পারে।

কিন্তু করুণা খানিক বাদে অশ্রুসজল মুখ তুলে দৃঢ়স্বরে বললে—”আমি যাবো, কিছুতেই যাবো না। কেন যাবো?”

কি উত্তর একথার দেবো ভেবে পেলাম না। মনের গভীরতায় হয়তো সেইদিনই তার এ বিদ্রোহে আমার সায় ছিলো না। তখনই আমি জানতাম যে এ বিদ্রোহ নিষ্ফল।

কথাটা একটু ঘুরিয়ে দেবার ষ্টোয় বললাম-”তুমি যা মনে করছে তা তো নাও হতে পারে করুণা; তুমি হয়তো মিছিমিছি ভয় পাচ্ছো।”

করুণা আবার অস্থির হয়ে উঠলো—”না না, আমি জানি; জোর করে তাঁরা আমায় সেখানে বন্দী করে রাখতে চান। তাদের ধারণা এ-সব ছেলেমানুষী সারাবার তাই অব্যর্থ ওষুধ।”

করুণা একটু তিক্ত হাসি হাসলো।

তারপর বললে—”আমি কলেজে যাবার নাম করে বেরিয়ে এসেছি। এখানে এসে তোমায় অসুবিধায় ফেলবার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু না এসে যে উপায় নেই, পিসিমার বাড়িতে তোমার যাওয়া তো প্রায় বন্ধ হয়েছে। সেখানে এসব কথা তোমায় জানাতেও পারতাম না।”

একটু থেমে করুণা আবার অস্থির হয়ে উঠলো আবেগে—”সত্যি কি আমায় নিয়ে যাবো জোর করে! কিছুই আমরা করতে পারবো না?”

সেদিন কি আশ্বাস, কি সান্ত্বনা দিয়ে করুণাকে তার পিসিমার বাড়ি রেখে এসেছিলাম, তার বিবরণের এখানে প্রয়োজন নেই, কিন্তু মনে যত বড়োই ব্যথা পেয়ে থাকি না, কিছুই তারপর করতে পারিনি এটা ঠিক।

করুণাকে তার মামারা জোর করে কিনা জানি না তারপর পাটনায় নিয়ে গেছে; যাবার আগে দেখা করবার সুযোগও মেলেনি আমাদের।

নিমন্ত্রিত অবশ্য হইনি, কিন্তু একদিন কোথা থেকে করুণার বিয়ে হয়ে যাওয়ার সংবাদও কানে এসেছে। নির্লিপ্ত নির্বিকার মনে সে-সংবাদ শুনেছি এমন কথা বলতে পারবো না, কিন্তু আজ বিশ্লেষণ করে দেখে বুঝতে পারি এসংবাদ পাবার পর কয়েকটি দিন ও রাত যে আমার কাছে হতাশায় ধূসর হয়ে গেছে, তা প্রধানতঃ করুণার দুঃখের কথা ভেবে। ভালোবেসে না পাওয়ার ব্যর্থতা সেদিন নিজের দিক দিয়ে নয়, করুণার দিক দিয়েই উপলব্ধি করেছি, এবং সেই উপলব্ধির বেদনায় নিজের

আত্মপ্রসাদ কিছু মেশানো ছিলো কিনা তা বোঝবার শক্তি তখন ছিলো না।

করুণার স্মৃতি যখন ম্লান হয়ে এসেছে তখনও মনের কোন গোপন কোণে এ বিশ্বাস বুঝি ছিলো যে, আমি ভুললেও সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না!

সে-বিশ্বাসে রূঢ় আঘাত পাওয়ার পরই মনের যে বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া শুরু হলো তাতে নিজের কাছেই নিজে কেমন একটু লজ্জিত বোধ করলাম, কিন্তু তবু আত্মসংযম করতে পারলাম না।

করুণা খানিক বাদে যখন আমার ঘরে এলো তখন আমার আচরণে ও কথায় একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন চেষ্টা করলে হয়তো সেও লক্ষ্য করতে পারতো।

করুণা খাবার প্লেটটার দিকে চেয়ে বললে—”একি! কিছুই যে খাওনি!”

পাঞ্জাবির বোম আঁটতে আঁটতে তার দিকে ফিরে চাইলাম; একটু হেসে বললাম-”লৌকিকতার বদলে লৌকিকতাই করতে হয় যে, দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো cট সাফ করে ফেললে তুমি ভাবতে কি?”

“তুমি এখনো সেই এক কথা ধরে বসে আছো!”–করুণার স্বর একটু যেন ক্ষুণ্ণ।

“এক কথা ধরে বসে থাকা আমার একটা দুর্বলতা করুণা, এখনও এটা শোধরালো না।”—আমার স্বর বেশ গাঢ়।

করুণা অন্যদিকে ফিরে খাবার প্লেটটা সরিয়ে রাখছিলো, তার মুখ দেখতে পেলাম না। কিন্তু যে উত্তর সে দিলে তাতে সহজ কৌতুক ছাড়া আর কিছুই আভাস নেই।

“আর ঘ দুর্বলতা তাহলে শুধরে ফেলেছ!”—আমার দিকে ফিরে করুণা আবার বললে—”একি, এরই মধ্যে বেরুচ্ছো নাকি?”

“হাঁ, গাড়িটার কতদূর কি হলো একবার দেখতে তো হয়!”

“তুমি দেখলেই তো সেটা তাড়াতাড়ি মেরামত হয়ে যাবে না। উনি তো খোঁজ নিয়ে আসবেন বলেছেন। ওঁর ফিরতে আর দেরি নেই। তোমায় থাকতেই বলে গেছে।”

“সুতরাং ততক্ষণ তোমার সঙ্গে বসে গল্প করতে বলেছেন?”— হেসে বলবার চেষ্টা করলাম।

সকৌতুক মুখভঙ্গি করে করুণা বললে—”তা করতে পারো।”

আমার স্বর আপনা থেকে তখন বুঝি গাঢ় হয়ে এসেছে—”অনায়াসে বলে ফেললে যে করুণা!”

“এমন কি একটা কঠিন কথা সে অনায়াসে বলা যায় না?”করুণার মুখে একাধারে হাসি ও বিস্ময়।

“এমন কিছু কঠিন নয় করুণা? সত্যি বলছো? আমার সঙ্গে একা বসে গল্প করতে তোমার ভয় করে না? আমার যে নিজেকে এখনো ভয় করে।”

“তোমার মাথাটি বেশ খারাপ হয়েছে দেখছি।”–বলে হেসে আমায় বেশ একটু অপ্রস্তুত করে করুণা এবার বেরিয়ে গেলো। দরজার কাছ থেকে ফিরে আবার বললে—”তুমি কিন্তু যেও না, আমি এখুনি আসছি।”

কিন্তু অনেকক্ষণ করুণা তারপর আর আসে না। ঘরের ভেতর পায়চারি করে বেড়াতে বেড়াতে মনের মধ্যে কী একটা জ্বালা অনুভব করি। সেটা আমার নিজের না করুণার বিরুদ্ধে বোঝা শক্ত। হয়তো সেটা নিয়তির বিরুদ্ধে।

কী দরকার ছিলো এমন করে আবার তার সঙ্গে দেখা হবার! দেখা হওয়াটা দৈরে আয়োজিত পরিহাস ছাড়া আর কি?

ক-দিন ছুটি পেয়ে মোটরে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কাল রাত্রে এই শহরের মাঝখানে এসে যখন তার কল হঠাৎ বিগড়ে গেছিলো তখন জঙ্গলের পথে না হয়ে একটা ভদ্রগোছের শহরের মধ্যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদই দিয়েছিলাম। ভবিষ্যতটা তখন জানতে পারলে বোধহয় জঙ্গলের পথটাই শ্রেয়ঃ মনে করতাম।

একে রাত্রিকাল, তায় অচেনা শহর। ডাকবাংলো ও স্টেশনের ওয়েটিংরুম থেকে দরিদ্রতম হোটেলে পর্যন্ত টাঙ্গা করে ঘুরে আশ্রয় না পেয়ে শেষে, যে কারখানাতে মোটর মেরামত করতে দিয়েছিলাম, সেখানেই ফিরে গেছিলাম হতাশ হয়ে। সেখানেই বিমলবাবুর সঙ্গে পরিচয়। কাছাকাছি একটা কয়লার খনিতে তিনি কাজ করেন। সেখানকার কি প্রয়োজনে একারখানায় এসেছিলেন। প্রবাসে বিপন্ন বাঙালীর সাহায্যে তিনি নিজে থেকেই অগ্রসর হয়ে তার বাড়িতে রাত্রি কাটাবার প্রস্তাব করেছিলেন। সামান্য একটু আপত্তি হয়তো করেছিলাম, কিন্তু তিনি তা শোনেননি।

শহরের নির্জন এক প্রান্তে বিমলবাবুর বাড়ি। সেখানে পৌঁছে দেখা গেছিলো সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে বিমলবাবু বলেছিলেন–“আজ আমার আবার কথা ছিল ন কিনা! চাকর ব্যাটারা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে!”

খানিকক্ষণ পরে একটি মহিলাই লণ্ঠন হাতে এসে বাইরের দরজা খুলে নিদ্রাজড়িত স্বরে বলেছিলেন—”বড় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তুমি যে বলে গেছিলে আজ আসবে না!”

বিমলবাবু হেসে বলেছিলেন—”ব্বাতে একটা পরোপকারের পুণ্য ছিলো, তাই বোধহয় আসার সুবিধে হয়ে গেল। আমি না এলে এই ভদ্রলোক একটু বিপদেই পড়তেন বোধহয় অজানা শহরে!”

করুণা এইবার আমায় দেখতে পেয়েছিল। মাথায় ঘোমটা দিয়ে সরে যেতে গিয়ে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

বিমলবাবু তখনও বলে চলেছেন—”তুমি চাকরগুলোকে ডেকে দাও, বাইরের ঘরটা খুলে একটা বিছানা ঠিক করে দিক। ভদ্রলোকের একটু কষ্ট হবে–”

হঠাৎ তাকে করুণার কথায় সবিস্ময়ে থেমে যেতে হয়েছে। করুণা হেসে বলেছে–“বিদেশ-বিভূঁয়ে একটু কষ্ট হলেই বা ভদ্রলোকের!”

বিমলবাবু অবাক হয়ে আমাদের দুজনের মুখের দিকে চেঁচিয়ে ওঠেন—”তার মানে! এঁকে তুমি চেনো নাকি!”

“তা একটু চিনি বৈকি!”— করুণা হেসে উঠেছে।

“কী আশ্চর্য!”

“আশ্চর্যটা কিরে! তোমার অচেনা বলে আমার চেনা হতে নেই! তোমরা সঙ্গে তো মাত্র তিন বছর বিয়ে হয়েছে, তার আগে কুড়ি বছর আমি সলিটারি সেলে ছিলাম মনে করো!”

বিমলবাবু হেসে ফেলে বলেছেন—”কিন্তু ভদ্রলোককে বাইরে ঠাণ্ডায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের দাম্পত্য জীবনের নমুনাটা নাই দেখালে।”

করুণা গম্ভীর হবার ভান করে বলেছে—”ও আমি শুধু ঝগড়া করি এই তুমি বোঝাতে চাও!”

এবার একটা কিছু বলা উচিত বলেই হাদারচেষ্টা করে কথা বলেছি—”ব্যবসাই পেশা বিমলবাবু, নমুনা দেখে আমি ভুলি না।”

এতদিন বাদে করুণার প্রথম আলাপের ধরনে তখনই মনে কোথায় আমার একটা খটকা লেগেছে।

.

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন নিজেই বেরিয়ে পড়বে কি না ভাবছি তখন রুশা এলো। সাজ-পোশাকের পরিবর্তন দেখে যা বলতে যাচ্ছিলাম নিজে থেকেই তার উত্তর দিয়ে সে বললে—”একটু বাইরে যেতে হবে। আসবে আমার সঙ্গে?”

চাদরটা আলনা থেকে তুলে নিয়ে বললাম—”শুধু আদেশের অপেক্ষা। কিন্তু কোথায় যাচ্ছো?”

“বাজার করতে।”–বলে করুণা হাসলে।

“বাজার করতে।”—অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

“আমি তো প্রায়ই যাই।” সে হেসে বললে—”এখানে ‘চেঞ্জার’ ছাড়া বাসিন্দাদের মেয়েরা বড়ো একটা নিজেরা বাজারে যান না বটে, কিন্তু আমি ও-সব মানি না; উনি না থাকলে আমি নিজেই চাকর নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।”

“কিন্তু বিমলবাবু তো আজ আছেন!”

“ও, তোমায় বুঝি বলা হয়নি! উনি খবর পাঠিয়েছেন আজ আসতে পারবেন না, হঠাৎ বিশেষ জরুরি কাজে আটকে পড়েছেন।”

করুণা বেশ সহজভাবেই কথাটা বলে গেলো। কিন্তু আমি রাস্তার মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম-”তা হলে?”

“তা হলে আর ভাবনা কিসের! উনি না থাকলে কি তোমার যত্ন হবে না!”

করুণার চোখে মুখে কৌতুকের দুষ্টু হাসি!

“তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করলে আমায় একাই এগিয়ে যেতে হবে।”

অগত্যা নীরবে তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হলো। এদিকের পথটা বেশ নির্জন। দূরে দূরে দু-একটা বাড়ি। তারও অনেকগুলি খালি পড়ে আছে। রাস্তায় লোক নেই বললেই হয়।

খানিকদূর নীরবে চলার পর প্রশ্ন না করে পারলাম না—”বিমলবাবু আজ রাত্রে ফিরবেন তো?”

“বোধহয় না। এখন দু-চার দিন হয়তো সেখানে থাকতে হবে।”

আবার নীরবে অনেকটা পথ পার হয়ে গেলাম। করুণা কয়েকবার আমার দিকে ফিরে তাকাবার পর হেসে বললে—”কি ভাবছো অতো গম্ভীরভাবে?”

“ভাবছি আজই আমায় চলে যেতে হবে।”

“তোমার গাড়ি তো আজকের মধ্যে মেরামত হয়ে উঠবে না।”

“গাড়ি এরা পরে পাঠিয়ে দেবেখন। আমি ট্রেনেই যাবো।”

“এত ব্যস্ত কেন? তোমার এখানে ভয় কিসের?”

রাস্তার মাঝে আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম-”বলেছি তো ভয় আমার নিজেকে। নিজেকে আমি বিশ্বাস করি না।”

করুণা এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলো—”না-ই বা করলে, তাতে কারুর তো কোনো ক্ষতি নেই!”

না, এ বুঝি আর সওয়া যায় না। হঠাৎ সমস্ত সংযম হারিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললাম–”ক্ষতি যদি তোমারই হয়…”

করুণা হাত ছাড়িয়ে নিলো না। কিন্তু পরিহাসের হাসিতে আমার সমস্ত আবেগকে নিষ্ঠুরভাবে হাকা করে দিয়ে বললে-” কেমন করে হবে? আমি তো নিজেকে বিশ্বাস করি!”

করুণার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম—”সে বিশ্বাস এখনো কি ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে না করুণা? সমস্ত নোঙর ছিঁড়ে তোমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ঢেউ কি আসতে পারে না?”

করুণার চোখে সেই দুর্বোধ সকৌতুক হাসি—”কি জানি, পরীক্ষা অবশ্য হয়নি।”

তারপর কি বলতাম ঠিক জানি না, কিন্তু রাস্তা এবার জনবহুল হয়ে এসছে। বাধ্য হয়েই চুপ করে গেলাম।

সকালবেলা বাইরে বার হবার পোশাকে করুণার একরূপ দেখেছিলাম। দুপুরবেলা সোড়শোপচার আহারের আয়োজনের আসনের সামনে বসে তার আর একরূপ দেখলাম। একটি সাদা সেমিজের ওপর লাল চওড়া কস্তাপাড় শাড়ি পরে আধ-ঘোমটার পাশ দিয়ে ভিজে এলোচুল পিঠে এলিয়ে সে কাছে এসে বসলো। এমন আশ্চর্য তাকে কোনেদিন লাগেনি।

পাখাটা নাড়তে নাড়তে হেসে সে বললে-”কি দেখছো? কখন দেখোনি নাকি!”

“মনে হচ্ছে সত্যি কখনও দেখিনি!”

“তা হতে পারে!”–বলে সে অদ্ভুতভাবে হাসলো, তারপর জিজ্ঞাসা মলে—”আচ্ছা, আমার বাজার করা দেখে কি ভাবছিলে বলো তো?”

“এই কথাই ভাবছিলাম যে তুমি আমার কাছে একটা নতুন আবিষ্কার!”

“তাই নাকি, কিন্তু, দোহাই, বেচারা কলম্বাসের দাবিটুকু উড়িয়ে দিও না।”

“কলম্বাসেরও আগেকার দাবি যদি থাকে?”

“দাবি থাকলেও দলিল নেই তো!”–নিজের রসিকতায় করুণা নিজেই হেসে মাত করে দিলে।

নিঃশব্দে অনেকক্ষণ খেয়ে যাবার পর বললাম—”দলিলের দাম সকলের কাছে নেই! ও তুচ্ছ জিনিস অনায়াসে পুড়িয়ে ফেলা যায়।”

এবার করুণা হাসলো না। আমার মুখের দিকে খানিক অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থেকে—”তোমায় মিষ্টি দেওয়া হয়নি,” বলে হঠাৎ উঠে গেলো।

তারপর মিষ্টি করুণা নিয়ে এলো না, নিয়ে এলো ঠাকুর।

কিন্তু খানিক বাদে ঘরে সে নিজেই পান নিয়ে এলো এবং হঠাৎ বলে বসলো–”তুমি আজ সন্ধ্যের গাড়িতেই তাহলে যাচ্ছো?”

সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। আমারই মনের ভুল, না তার মুখে একটা অস্ফুট অস্থিরতার ছায়া?

বললাম—”বেশ, তাই যাবো।”

“বেশ তাই যাবো মানে? আমি যেন তোমায় জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি তো তোমায় থাকতেই বলছি, তুমি নিজেই তো যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলে তখন।”

গলার ঝাঁঝটা এবার লুকোবার নয়।

হেসে বললাম—”আমি কি তোমায় দোষ দিচ্চি? আমার সত্যিই না গেলে নয়।”

একটু যেন লজ্জিত হয়ে করুণা হাসবার চেষ্টা করে বললে—”তা জানি, এমন জায়গায় তোমার মন টেকে? কিন্তু শোনো, সন্ধ্যায় ঐ একটি ছাড়া আর গাড়ি নেই তা জানো তো? ঠিক সাড়ে ছটায়, মনে থাকে যেন।”

গাড়ির সময় আমার মনে রাখবার প্রয়োজন ছিলো না। বিকেল না হতেই জিনিসপত্র বাঁধিয়ে, আমার মোটরের কারখানায় খবর দিতে পাঠিয়ে, স্টেশনে যাবার গাড়ি ডাকিয়ে করুণা নিজেই সব বন্দোবস্ত করে ফেললে এবং স্টেশনে যাবার পনেরো মিনিটের পথ যেতে পাছে কোনো গোলমাল হয় বলে এক ঘণ্টা আগে আমায়—গাড়িতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো।

এতক্ষণ আমার সঙ্গে বিশেষ কিছু বলবার অবসর তার মেলেনি।

বাড়ি থেকে টাঙ্গায় ওঠবার সময় সে কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললে—”তুমি আমায় কি ভাবছে কে জানে! যেন তোমায় বিদেয় করতে পারলেই বাঁচি মনে হচ্ছে, না?”

“সেইটুকু ভেবেই যা কিছু সান্ত্বনা!”

করুণ হেসে উঠলো—”সান্ত্বনাটা এতো সস্তা হলে আর সত্যিকার কিছু মেলে!” টাঙ্গাওয়ালা গাড়ি চালানোর শব্দে তার হাসির রেশ মিলিয়ে গেলো।

.

এ-গল্পের শেষ ঐখানেই হলে ভালো হতো, কিন্তু তা হলো কই!

স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখনও ট্রেনের অনেক দেরি। ওয়েটিংরুমে জিনিসপত্র রেখে এদিক-ওদিক অকারণে ঘুরে বেড়িয়েও সময় কাটাতে না পেরে তখন বই-এর স্টলে এসে দাঁড়িয়ে কি কেনা যায় ভাবছি। হঠাৎ পাশে চোখ পড়ায় চমকে উঠলাম।

“একি! করুণা, তুমি এখানে?”

ম্লান একটু হেসে বললে–“এই এলাম!”

স্টেশনের শেডের আবছা আলোর দরুন, না সত্যিই করুণাকে কেমন দুর্বল দেখাচ্ছে।

স্টল থেকে একটু সরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—”আমি ঠিক বুঝতে পারছি না করুণা, হঠাৎ স্টেশনে আসার মানে?”

করুণা আবার হাসলো, তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললে—”দলিল পুড়িয়ে দিয়ে এলাম।”

খানিকক্ষণ সত্যিই কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে বিমুঢ়ভাবে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ব্যাকুলভাবে বললাম—”কি বলছে করুণা!”

“খুব অসম্ভব কি কিছু বলছি? ব নোঙর ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মতো ঢেউ কি আসে না কখনো?” করুণার স্বর ক্রমশ যেন গাঢ় হয়ে উঠলো।

আমার বুকের একেবারে কাছে এগিয়ে এসে চোখের দিকে চোখ তুলে সে বললে—”তুমি আমায় নিয়ে যেতে পারো না? যাবে না নিয়ে, বলো?”

অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়লাম—”আমি…তোমায় নিয়ে…”

“কোথায় যাবে ভাবছো? যেখানে খুশি!”

কোনো কথা এবার আর মুখ দিয়ে বেরুলো না। মনের ভেতর শুধু একটা অস্থির আলোড়ন অনুভব করছি।

“তোমায় অনেক অসুবিধা, অনেক লাঞ্ছনা সইতে হবে জানি, কিন্তু আমিও তো তারই জন্যে প্রস্তুত হয়ে সমস্ত লজ্জা, নিন্দা মাথায় নিয়ে এসেছি!”

করুণা কারভাবে মুখের দিকে চেয়ে আছে। কী বলবো? কী এখন বলতে পারি! নির্বোধের মতো আমিই তার রুদ্ধ বন্যার বাঁধ খুলে দিয়েছি, এখন তাকে কেমন করে ফিরিয়ে দেবো?

“কিন্তু ব কথা তুমি বোধ হয় ভালো করে ভেবে দেখোনি, করুণা। যে ঝড় এবার উঠবে তা কি তুমি পারবে সইতে? তার সঙ্গে যুঝতে বুঝতে ক্লান্ত হয়ে হয়তো আমরা পরস্পরকেই একদিন ঘৃণা করতে শুরু করবো।”

করুণা তখনও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে—অত্যন্ত ধীরে ধীরে তার সমস্ত মুখ যেন বিদ্রপের হাসিতে ভরে উঠলো।

“তোমার মূল্যবান উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। আর একটু হলেই নোঙর উপড়ে গেছলো আর কি!” করুণা এবার সশব্দেই হেসে উঠলো।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। সমস্তই কি তবে আমাকে বিদ্রুপ করবার জন্যে অভিনয়!

করুণা সহজভাবে বললে–“যাও, ট্রেন আসবার ঘণ্টা পড়েছে। আমার। ট্রেনেরও বোধহয় দেরি নেই।”

“তোমার ট্রেন!”

“পিসিমারা কলকাতা থেকে আসছেন। তারা বাড়ি চেনেন না। উনিও নেই, তাই নিজেই এলাম নিয়ে যেতে। শুনে খুব হতাশ হলে বুঝি?”

কোনো কথা আর না বলে ও ধারের প্লাটফর্মে যাবার জন্যে ওভারব্রিজের দিকে অগ্রসর হলাম। করুণাকে শেষ যখন দেখতে পেলাম তখন স্টলের বইগুলোর দিকে সে ঝুঁকে পড়েছে।

সত্যিই পিসিমাদের নিয়ে যাবার জন্যে সে কি স্টেশনে এসেছিলো?

জীবনে কোনোদিন সে-কথা জানা যাবে না।

ভস্মশেষ

বারান্দার এদিকটা সরু। নীচে নামবার সিঁড়িরও খানিকটা ভেঙে পড়েছে। তবু সন্ধ্যের আগে এই দিকেই চেয়ারগুলো ও টেবিল পাতা হয়—এদিক থেকে দূরে পাহাড় আর নদীর খানিকটা দেখা যায় বলে।

কৈফিয়ৎটা নিরর্থক। পাহাড় আর নদী কেউ দেখে না আজকাল একদিন হয়ত সত্যিই সেই দেখাটা ছিল বড় কথা, এখন আর তার কোনো অর্থ নেই। যা ছিল আনন্দ তা আজ অর্থহীন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বারান্দায় এই চেয়ার পাতাটুকু থেকে এ বাড়ির অনেক কিছুর, আরো গভীর কিছুর পরিচয় হয়ত পাওয়া যেতে পারে। এই কাহিনী সেইজন্যেই লেখা।

সবার আগে জগদীশবাবু এসে বসেন। নীচু ইজি-চেয়ারটি তাঁর জন্যেই নির্দিষ্টা চেয়ারের দু’ধারের হাতলে সুপুষ্ট হাতদু’টি ও সামনের টুলে পা দু’টি রেখে নিশ্চিন্তে আরামে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকা তাঁর পরম বিলাস স্বেচ্ছায় পারতপক্ষে কথা তিনি বড় বলেন না। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছেন।

সুরমা একটু পরে আসেনা শাড়িতে প্রসাধনে আলুথালু ভাবা আলুথালু ভাব বুঝি প্রকৃতিতেও। এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন—’এর মধ্যেই ঘুমোলে নাকি?’

ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবু একটু নড়ে-চড়ে জানান তিনি ঘুমোন নি।

সে প্রশ্নের জবাবের জন্যে সুরমার অবশ্য কোনো আগ্রহ নেই। অভ্যাস মতই প্রশ্নটা করেন, তারপর বেতের মোড়াটিতে বসতে গিয়ে উঠে পড়ে হয়ত বলেন—’ওই যা, দোক্তার কৌটোটা ভুলে এলাম।’

জগদীশবাবু চক্ষুমুদ্রিত অবস্থাতেই বলেন—’ডাক না চাকরটাকো’

সুরমা আবার বসে পড়ে বলেন—’তাকে যে আবার বাজারে পাঠালামা যাও না গো তুমি একটু।’

ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবুর নড়া-চড়ার কোনো লক্ষণ না দেখে মনে হয় তিনি বোধ হয় শুনতে পান নি অন্তত ওঠবার আগ্রহ তাঁর নেই।

কিন্তু সত্যি জগদীশবাবু খানিক বাদে বিশেষ পরিশ্রমে ইজি-চেয়ার ছেড়ে উঠেছেন দেখা যায়। জগদীশবাবুর আরামপ্রিয়তা ও আলস্য যত বেশিই হোক স্ত্রীর স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্ন ও দৃষ্টি তার চেয়ে প্রখরা।

জগদীশবাবুকে কিন্তু কষ্ট করে আর যেতে হয় না। বারান্দার সিঁড়িতে ডাক্তারবাবুকে দেখতে পাওয়া যায়।

সুরমা বলেন—’থাক, তোমায় আর যেতে হবে না ডাক্তার, আমার দোক্তার কৌটোটা নিয়ে। এসে একেবারে ব’সো। বিছানার ওপরই বোধ হয় ফেলে এলাম আর ঘরের আলোটা বোধ হয় নিবিয়ে আসি নি। সেটা নিবিয়ে দিয়ে এসা’

আদেশ নয়, অনুরোধেরই মিষ্টতা আছে কণ্ঠস্বরে, কিন্তু সে মিষ্টতা খানিকটা যেন যান্ত্রিক।

মিষ্টতা সুরমার সব কিছুতেই এখনো বুঝি অনেকটা আছে—চেহারায়, কণ্ঠস্বরে, প্রকৃতিতে। বয়সের সঙ্গে শরীরের সে তীক্ষ্ণ রেখাগুলি দুর্বল হয়ে এলেও তাদের আভাস আলুথালু বেশ ও প্রসাধনের মধ্য দিয়েও পাওয়া যায়। সুরমার সৌন্দর্য এখনো একেবারে ইতিহাস হয়ে ওঠে নি। অবশ্য ইতিহাস তার আর একদিক দিয়ে আছে—কিন্তু সে কথা এখন নয়।

ডাক্তারবাবু ঘরের আলো নিবিয়ে, দোক্তার কৌটো নিয়ে এসে, টেবিলের ওধারে সুরমার সামনা-সামনি বসেন নদী ও পাহাড়ের দিকে পিছন ফিরে। নদী ও পাহাড়ের দিকে কোনদিনই তাঁর চাইবার আগ্রহ ছিল না। বরাবর তিনি এই আসনটিতে এইভাবেই বসে আসছেন।

সন্ধ্যার অস্পষ্টতাতেও ডাক্তারবাবুকে কেমন অপরিচ্ছন্ন মনে হয়, শুধু পোশাকে ও চেহারায় নয়, তাঁর মনেও যেন একটা ক্লান্ত ঔদাসীন্য আছে সব ব্যাপারে। পোশাকের ত্রুটিটাই অবশ্য সকলের আগে চোখে পড়ে ঢিলে রঙচটা পেন্টুলেনের ওপর গলাবন্ধ একটা কোট পরা। গলাটা কিন্তু বন্ধ হয়নি বোতামের অভাবে এই কোট পরেই সম্ভবত তিনি সারাদিন রুগী দেখে ফিরবেন। একধারের পকেট স্টেথিস্কোপের ভারেই বোধ হয় একটু ছিঁড়ে গেছে। গোটাকতক আলগা কাগজপত্র সেখান দিয়ে উঁকি দিয়ে আছে। মাথায় চুলের কিছু পারিপাট্যের চেষ্টা বোধ হয় সম্প্রতি হয়েছিল, কিন্তু সে নেহাৎ অবহেলারা

ডাক্তারবাবুর মুখের ক্লান্ত ঔদাসীন্যের রেখাগুলি শুধু তাঁর চোখের উজ্জ্বলতার দরুনই বুঝি খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে নি সমস্ত ঘুমন্ত নিষ্প্রাণ মানুষটির মধ্যে এই চোখ দুটিই যেন এখানে জেগে আছে পাহারায়। কে জানে কি তাদের আছে পাহারা দেবার

অনেকক্ষণ কোনো কথাই শোনা যায় না। সুরমার পানের বাটা সঙ্গে আছে এবং থাকে। তিনি সযত্নে পান সাজায় ব্যস্ত। জগদীশবাবু ইজি-চেয়ারে নিশ্চল ভাবে পড়ে আছেন। ডাক্তারবাবু নিজের হাতের নখগুলো বিশেষ মনোেযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সুরমার পান-সাজা শেষ হবার জন্যেই বোধ হয় অপেক্ষা করেন।

সুরমার পান-সাজা শেষ হয়। সেটি মুখে দিয়েও তিনি কিন্তু খানিকক্ষণ নীরবে সামনের দিকে চেয়ে বসে থাকেন। তারপরে হঠাৎ এক সময়ে জিজ্ঞেস করেন—’তোমার সে ফুলের চারা এল ডাক্তার?’

জগদীশবাবু চোখ বুজে বলেন—’সে চারা আর এসেছে! তার চেয়ে আকাশ-কুসুম চাইলে সহজে পেতে’

সুরমা হেসে ওঠেন। বলেন—’তুমি ডাক্তারকে অমন অকেজো মনে কর কেন বল দিকি! সেবার আমাদের জলের পাম্পটা ডাক্তার না ব্যবস্থা করলে হ’ত?’।

ইজি-চেয়ারের ভেতর থেকে ঘুমন্ত স্বরে শোনা যায়—’তা হত না বটে। অন্য কেউ ব্যবস্থা। করলে হয়ত পাম্পে সত্যিই জল উঠত।’

তিনজনেই এ রসিকতায় হাসেন এ বাড়ির এটি একটি পুরাতন পরিহাস। সুরমা বলেন—’সত্যি, তুমি কি করে ডাক্তারি কর তাই ভাবি! লোকে বিশ্বাস করে তোমার ওষুধ খায়?’

‘খাবে না কেন, একবার খেলে আর অবিশ্বাসের সময় পায় না ত।‘

সুরমা হাসতে হাসতে পানের বাটা খুলে জিভে একটু চুন লাগিয়ে বলেন—’তোমার বাপু। ডাক্তারের ওপর একটু গায়ের জ্বালা আছে। তুমি ওর কিছু ভালো দেখতে পাও না।’

‘সেটা ওঁর চোখের দোষ, অনেক ভালো জিনিসই উনি দেখতে পান না।’—ডাক্তারের মুখে এতক্ষণে কথা শোনা যায়।

সুরমা হেসে বলেন—’তা সত্যি চোখ বুজে থাকলে আর দেখবে কি করে।’

‘চোখ বুজে থাকি কি সাধে! চোখ খুলে থাকলে কবে একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যেত!’

সুরমা ও জগদীশবাবুর উচ্চ হাসির মাঝে ডাক্তারবাবুর নিস্তব্ধতাটা যেন একটু বিসদৃশ ঠেকে। সুরমার মুখের দিকে চেয়ে ডাক্তারের চোখে একটু বেদনার ছায়া এখনো দেখা যায় কি?

সুরমা হাসি থামিয়ে বলেন—’ওই যা, ভুলেই যাচ্ছিলাম, তোমায় এখন কিন্তু একবার উঠতে হবে ডাক্তার।’

‘এখনি? কেন?’

‘এখনি না উঠলে হবে না। দাদা কি-সব পার্সেল করেছেনা স্টেশনে কাল থেকে পড়ে আছে, —উনি একবার তবু সারাদিনে সময় করে যেতে পারলেন না। তোমায় এখন গিয়ে ছাড়িয়ে আনতেই হয়!’

ডাক্তারবাবু একটু ইতস্তত করে বলেন—’কাল সকালে গেলে হয় না?’

‘হয় না আবার! একমাস পরে গেলেও হয়! জিনিসগুলো খোয়া যাবার পর গেলে আরো ভালো। হয়। ‘সুরমার কণ্ঠে মিষ্টতার চেয়ে এবার ঝাঁঝটাই বেশ স্পষ্ট।

‘এক রাত্তিরেই খোয়া যাবে কেন?’—ডাক্তারবাবু একটু সঙ্কুচিতভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন।

সুরমা বেশ একটু উচ্চস্বরেই বলেন—’তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারি না বাপু! সোজাসুজি বলই না তার চেয়ে যে, পারবে না! তোমায় বলা-ই ঝকমারি হয়েছে আমার।’

ডাক্তারবাবু এবার অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে উঠে পড়েন,—’আমি কি যাব না বলেছি? ভাবছিলুম একটা রাত্তির বই ত না।’

‘রাতটা কাটিয়ে গেলেই বা তোমার কি এমন সুবিধে! এমন কিছু কাজ ত আর হাতে নেই, চুপ করে বসেই ত থাকতে।’

সে কথা মিথ্যে নয়। ডাক্তার শুধু চুপ করে বসে থাকতেই এখানে আসেনা চুপ করে বসে আছেন আজ বহু বৎসর ধরে।

ডাক্তার টুপিটা তুলে নিয়ে একবার তবু বলেন,—’আসুন না জগদীশবাবু আপনিও! গাড়িটা ত রয়েছে, একটু ঘুরে আসা হবে।’

জগদীশবাবুর আগে সুরমাই আপত্তি করেন—’বেশ কথা! আমি একলা বসে থাকি এখানে তাহলে!’

ডাক্তার একটু হেসে বলেন—’আরে! তুমিও এস না!’

‘তার চেয়ে বাড়ি-সুদ্ধ পাড়া-সুদ্ধ সবাই একটা পার্সেল আনতে গেলেই হয়! সত্যি তুমি দিন দিন যেন কি হচ্ছ!’

ডাক্তার আর কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।

‘দিন দিন কি যেন হয়ে যাচ্ছ!’ মোটরে চড়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে ডাক্তার সে কথা ভাবেন কি? না বোধ হয়। ভাবনা ও আবেগের উদ্বেল সাগর বহুদিন শান্ত নিথর হয়ে গেছে। সে সব দিন এখন আর বোধহয় মনেও পড়ে না। স্মৃতির সে সমস্ত পাতাও বুঝি অনেক তলায় চাপা পড়ে আছে। জীবনের একটি বাঁধা ছকে তিনি খাপ খেয়ে গেছেন সম্পূর্ণভাবে আগুন কবে। ভস্মশেষ রেখে একেবারে নিবে গেছে তা তিনি জানতেই পারেন নি।

আগুন একদিন সত্যিই জ্বলে উঠেছিল বইকি! কিন্তু সে যেন আর এক জনের কাহিনী, সে অমরেশকে তিনি শুধু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে এখন চিনতে পারেন। তার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ তাঁর নেই।

একদিন একটি ছেলে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে পরম দুঃসাহসভরে দাঁড়াতে দ্বিধা করে নি। মেয়েটি ভীতস্বরে বুঝি একবার বলেছিল, সুযোগ পেয়ে—’তুমি এখানে চলে এলে!’

‘আরে অনেক দূরে যেতে পারতাম!’

‘কিন্তু?–’

‘কিন্তু এঁরা কি ভাববেন মনে করছ? তার চেয়ে তুমি কি ভাবছ সেইটেই আমার কাছে বড় কথা।’

‘আমি ত…’, মেয়েটি নীরবে মাথা নীচু করেছিল।

অমরেশ তার মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলেছিল—’তোমার ভাববার সাহস পর্যন্ত নেই সুরমা!’

সুরমা মুখ তুলে মৃদুস্বরে বলেছিল—’না।’

‘সেই সাহস সৃষ্টি করতেই আমি এসেছি সুরমা। সেই সাহসের জন্যে আমি অপেক্ষা করব।’

সুরমা চুপ করে ছিল। অমরেশ আবার বলেছিল—’ভাবছ, কতদিন—এমন কতদিন অপেক্ষা করতে পারব? দরকার হলে চিরকালা কিন্তু তা বোধ হয় হবে না।’

জগদীশবাবু বুঝি সেই সময়ে ঘরে ঢুকেছিলেন। তাঁর চেহারায় এখনকার সঙ্গে তখনো বুঝি বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না। বেঁটে গোলগাল মানুষটি। শান্ত নিরীহ চেহারা। একেবারে নীচের ধাপ থেকে সংগ্রাম করে তিনি যে সাংসারিক সিদ্ধি বলতে লোকে যা বোঝে তাই লাভ করেছেন, তাঁর চেহারায় তার কোনো আভাস নেই। দেখলে মনে হয় ভাগ্য তাঁকে চিরদিন বুঝি অযাচিত অনুগ্রহ করেই এসেছে। সুরমা-সম্পর্কে সে কথা হয়ত মিথ্যাও নয়।

তিনি ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—’এখনও ট্রেনের জামা-কাপড় ছাড়েন নি? না না, এখন ছেড়ে দাও সুরমা। সারারাত ট্রেনের ধকল গেছে। স্নান করে খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিন আগে।’

অমরেশ হেসে বলেছিল,—’ছেড়ে না দেওয়ার অপরাধটা আমার—ওঁর নয়।’

জগদীশবাবু উচ্চস্বরে হেসেছিলেন। হাসলে তাঁকে এত কুৎসিত দেখায় অমরেশও ভাবতে পারে নি সুরমার পেছনে তাঁর এই হাস্য-বিকৃত মুখটা সে উপভোগ করেছিল বেদনাময় আনন্দে–

তারপরে উঠে পড়ে বলেছিল—’আচ্ছা এখন ওঠাই যাক।’

জগদীশবাবু সঙ্গে যেতে যেতে বলেছিলেন—’বড় অসময়ে এলেন অমরেশবাবু। এই দারুণ গ্রীষ্মে এখানে কিছু দেখতে পাবেন না। বাইরে বেরুনই দায়।’

‘সেটা দুর্ভাগ্য নাও হতে পারে!’ জগদীশবাবুর বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে আবার বলেছিল—’তা ছাড়া গ্রীষ্ম ত একদিন শেষ হবে।’

‘তখন আপনাকে পাচ্ছি কোথায়!’ জগদীশবাবুর স্বরে বুঝি একটু সন্দেহের রেশ ছিল।

‘পাবেন বইকি। হয়ত বড় বেশি পাবেনা’

অমরেশ ডাক্তার মিথ্যে বলেনি। সত্যই একদিন এই ধূলিমলিন দরিদ্র শহরের একটি রাস্তার ধারে অমরেশ ডাক্তারের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেল।

জগদীশবাবু বলেছিলেন—’বিলিতি ডিগ্রির খরচ উঠবে না যে ডাক্তার! এ জঙ্গলের দেশে আমাদের মত কাঠুরের পোষায় বলে কি তোমার পোষাবে?’

অমরেশ ডাক্তার হেসে বলেছিল—’কাঠের কারবার আর ডাক্তারি ছাড়া আর কি পোষাবার কিছুই নেই?’

অমরেশ ডাক্তারকে রোগীর ঘরে দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক, জগদীশবাবুর বাড়ির সরু বারান্দাটিতে প্রতিদিন তারপর দেখা গেছে।

‘চেয়ারটা ঘুরিয়ে বোস ডাক্তার।’—জগদীশবাবু বলেছেন।

‘কেন? আপনার ওই নদী আর পাহাড় দেখবার জন্যে? আপনার ট্রেডমার্ক পড়ে ওর সব দাম নষ্ট হয়ে গেছে।’

‘মড়া কেটে কেটে মনটাও তোমার মরে গেছে ডাক্তার!’

জগদীশবাবু তারপরেই আবার জিজ্ঞেস করেছেন অবাক হয়ে—’উঠলে কেন সুরমা?’

‘আসছি।’—বলে সুরমা মুখ নীচু করে ভেতরে চলে গেছে।

অমরেশ ডাক্তার অদ্ভুতভাবে হেসে বলেছে—’মেয়েরা কাটা-কাটির কথা সইতে পারে না, না জগদীশবাবু?’

জগদীশবাবু কোনো উত্তর দেন নি। গম্ভীর মুখে কি যেন তিনি ভাবছেন মনে হয়েছে।

অমরেশ ডাক্তার আবার বলেছে—’ওইটুকু ওদের করুণা!’

জগদীশবাবু গম্ভীরভাবে বলেছেন—’সেটুকু পাবারও সবাই যোগ্য নয়।’

ডাক্তারের আসা-যাওয়া গোড়ায় হয়ত এ বাড়ির উৎসাহ পায় নি। কিন্তু ক্রমে তা সয়ে গিয়েছে —সহজ হয়ে এসেছে জগদীশবাবুর কাছেও বুঝি।

‘কদিন আমায় জঙ্গলেই থাকতে হবে ডাক্তার। গুনতির সময়ে না থাকলে চলে না। দেখাশুনো কোরো। তোমায় অবশ্য বলতে হবে না।’

ডাক্তার হেসে বলেছে—’না, তা হবে না। আসতে বারণ করেও দেখতে পারেন!’

জগদীশবাবু হেসেছেন। সুরমাও হেসেছে, হাসলেই হয়ত তার মুখ লাল হয়ে ওঠো লাল হবার আর কোনো কারণ নেই বোধ হয়।

কিন্তু সুরমাই একদিন তীব্র স্বরে বলেছে—’আমি কিন্তু আর সইতে পারছি না!’

‘পারবে না-ই ত আশা করি।’

‘না না, তুমি এখান থেকে যাওা এমন করে নিজেকে ও আমাকে মেরে কি লাভ?’

‘বাঁচবার পথ ত খোলা আছে এখনো!’

‘সে পথ যখন আগে নেওয়া হয় নি…’

‘সে অপরাধ ত আমার নয় সুরমা তুমি তোমার নিজের মন জানতে না, আমি জানতাম না। সুযোগের মূল্যা ভাগ্যের নিষ্ঠুর রসিকতাকে তাই বলে মেনে নিতে হবে কেন!’

‘তুমি কি বলছ জান না! তা হয় না! তা হয় না!’ সুরমার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আবেগে।

‘অপরাধের কথা ভাবছ? অপরাধ করার চরম দামও যার জন্যে দেওয়া যায় এমন বড় জিনিস কি নেই?’

‘আমি বুঝতে পারি না। আমার ভয় হয়!’

‘বুঝতে পারবে, সেই প্রতীক্ষাতেই ত আছি।’

প্রতীক্ষা একদিন বুঝি সার্থক হল বলে মনে হয়েছে। জগদীশবাবুর কাঠের কারবারের জন্যে। জমা নেওয়া বিস্তীর্ণ জঙ্গল সেদিন তারা দেখতে গেছল। অরণ্যের রহস্যঘন আবেষ্টনে সারাদিন রাজসূয় চড়িভাতি’র উত্তেজনাতেই কেটেছে। বিকেলের দিকে সবাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিল।

অমরেশ ও সুরমা পথহীন অরণ্যে সকলের থেকে কেমন করে আলাদা হয়ে গেছে। আলাদা হওয়াটা হয়ত সম্পূর্ণ দৈবাৎ নয়, অমরেশেরও তাতে হয়ত হাত ছিল।

সুরমা খানিকক্ষণ বাদে বলেছে—’এ জঙ্গলে কিন্তু পথ হারাতে পারে!’

‘পথ জঙ্গলে ছাড়াও হারানো যায়!’

সুরমা একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলেছে—সব সময়ে তোমার এ ধরনের কথা ভালো লাগে না।’

‘কোথাও তোমার ব্যথা আছে বলেই ভালো লাগে না। নিজের কাছে তুমি ধরা দিতে চাও না বলেই এসব কথা তোমার অসহ্য।’

সুরমা নীরবে খানিক দূর এগিয়ে গেছে। অরণ্যের পশ্চাৎ-পটে তার দীর্ঘ সুঠাম দেহের গতিভঙ্গিতে বুঝি বনদেবীরই মহিমা ও মাধুর্য। সেটুকু উপভোগ করবার জন্যেই বুঝি খানিকক্ষণ নিঃশব্দে অমরেশ দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর কাছে গিয়ে বলেছে—’এ জঙ্গলে হারাবার বদলে পথ আমরা পেতেও পারি।’

সুরমা তবু নীরব।

হঠাৎ তার একটা হাত ধরে ফেলে অমরেশ বলেছে—’চুপ করে থেকো না সুরমা। বলল, আজ তোমার অটলতার গৌরব আর নেই—আছে শুধু দুর্বলতার লজ্জা। এ সম্বল নিয়ে চিরদিন বাঁচা যায় না, বাঁচা উচিত নয় সুরমা।’

সুরমা প্রায়-অস্পষ্ট স্বরে বলেছে,—’আমি কি করতে পারি বলো!’

একটা কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর পা দিয়ে অমরেশ বলেছে—’এই কাটা গাছটা দেখছ সুরমা! কাঠের কারবারে এর একটা দাম মিলেছে কিন্তু তার চেয়ে বড়, তার চেয়ে আসল দাম এর ছিল! তুমিও কারবারের কাঠ নও সুরমা, তুমি অরণ্যের।’

সুরমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অমরেশ আবার বলেছে,—’সহজ করে কথা আজ বলতে পারছি না বলে ক্ষমা কোরো সুরমা। মনের ভেতরেই আজ আমার সব জড়িয়ে গেছে।’

সুরমা অমরেশের আরো কাছে সরে এসেছে, বুকের ওপর মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে ধরা গলায় বলেছে—’তুমি আমায় সাহস দাও।’

কিন্তু চলে যাওয়া তাদের তখন হয়ে ওঠেনি। বাধা এসেছে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। জগদীশবাবু হঠাৎ অসুখে পড়েছেন—গুরুতর অসুখ সুরমা ও অমরেশ দিনরাত্রি বিনিদ্র হয়ে রোগ-শয্যার পাশে জেগেছে আর শান্তভাবে প্রতীক্ষা করেছে মুক্তিক্ষণের। আর বেশিদিন নয়। এই তাদের শেষ পরীক্ষা, নূতন জীবনের এই প্রথম মূল্যদানা।

জগদীশবাবু ভালো হয়ে উঠেছেন, তবু অপেক্ষা করতে হয়েছে, আর কিছুদিন, আর কয়েকটা দিন! ছোটখাট বাধা, ঘাটের নোঙর একেবারে তুলে ফেলতে সুরমার সামান্য একটু বিহ্বলতা এটুকু সময় তাকে দেওয়া যেতে পারে, নিজের ভেতর থেকে বল পাওয়ার সময়। অমরেশ কোথাও এতটুকু জোর খাটাতে চায় না, সব শিকড় আপনা থেকে আলগা হয়ে আসুক, সব বন্ধন। খুলে যাক। অসীম তার ধৈর্য

অমরেশ ডাক্তার অপেক্ষা করেছে কিছু দিন—অনেক দিন অপেক্ষা করেছে। বড় বেশিদিন অপেক্ষা করেছে।

ধীরে ধীরে কখন আগুন গিয়েছে নিবো কখন আর-বছরের পাপড়ির মত সে স্নান শুকনো বিবর্ণ হয়ে গেছে, তারা সবাই বিবর্ণ হয়ে গেছে। বিবর্ণ আর সুলভ আর সাধারণ অভ্যাসের ছাঁচে তারা বদ্ধ হয়ে গেছে, জীর্ণ মলিন হয়ে গেছে সংসারের ধূলায়। সবচেয়ে মলিন বুঝি ডাক্তার, সবচেয়ে মলিন আর ক্লান্ত। আগুন তার মধ্যে অমন লেলিহান হয়ে জ্বলেছিল বলেই সবার আগে তার সব পুড়ে ছাই হয়েছে। ডাক্তার তার নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে এখানে রোজ বসে, নদী ও পাহাড়ের দিকে পিছন ফিরো কিন্তু সে শুধু অভ্যাস ডাক্তার স্টেশনে পার্সেল খালাস করতে ছোটে, সে শুধু দুর্বল আজ্ঞাবাহিত।

Exit mobile version