জগদীশবাবু সঙ্গে যেতে যেতে বলেছিলেন—’বড় অসময়ে এলেন অমরেশবাবু। এই দারুণ গ্রীষ্মে এখানে কিছু দেখতে পাবেন না। বাইরে বেরুনই দায়।’
‘সেটা দুর্ভাগ্য নাও হতে পারে!’ জগদীশবাবুর বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে আবার বলেছিল—’তা ছাড়া গ্রীষ্ম ত একদিন শেষ হবে।’
‘তখন আপনাকে পাচ্ছি কোথায়!’ জগদীশবাবুর স্বরে বুঝি একটু সন্দেহের রেশ ছিল।
‘পাবেন বইকি। হয়ত বড় বেশি পাবেনা’
অমরেশ ডাক্তার মিথ্যে বলেনি। সত্যই একদিন এই ধূলিমলিন দরিদ্র শহরের একটি রাস্তার ধারে অমরেশ ডাক্তারের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেল।
জগদীশবাবু বলেছিলেন—’বিলিতি ডিগ্রির খরচ উঠবে না যে ডাক্তার! এ জঙ্গলের দেশে আমাদের মত কাঠুরের পোষায় বলে কি তোমার পোষাবে?’
অমরেশ ডাক্তার হেসে বলেছিল—’কাঠের কারবার আর ডাক্তারি ছাড়া আর কি পোষাবার কিছুই নেই?’
অমরেশ ডাক্তারকে রোগীর ঘরে দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক, জগদীশবাবুর বাড়ির সরু বারান্দাটিতে প্রতিদিন তারপর দেখা গেছে।
‘চেয়ারটা ঘুরিয়ে বোস ডাক্তার।’—জগদীশবাবু বলেছেন।
‘কেন? আপনার ওই নদী আর পাহাড় দেখবার জন্যে? আপনার ট্রেডমার্ক পড়ে ওর সব দাম নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘মড়া কেটে কেটে মনটাও তোমার মরে গেছে ডাক্তার!’
জগদীশবাবু তারপরেই আবার জিজ্ঞেস করেছেন অবাক হয়ে—’উঠলে কেন সুরমা?’
‘আসছি।’—বলে সুরমা মুখ নীচু করে ভেতরে চলে গেছে।
অমরেশ ডাক্তার অদ্ভুতভাবে হেসে বলেছে—’মেয়েরা কাটা-কাটির কথা সইতে পারে না, না জগদীশবাবু?’
জগদীশবাবু কোনো উত্তর দেন নি। গম্ভীর মুখে কি যেন তিনি ভাবছেন মনে হয়েছে।
অমরেশ ডাক্তার আবার বলেছে—’ওইটুকু ওদের করুণা!’
জগদীশবাবু গম্ভীরভাবে বলেছেন—’সেটুকু পাবারও সবাই যোগ্য নয়।’
ডাক্তারের আসা-যাওয়া গোড়ায় হয়ত এ বাড়ির উৎসাহ পায় নি। কিন্তু ক্রমে তা সয়ে গিয়েছে —সহজ হয়ে এসেছে জগদীশবাবুর কাছেও বুঝি।
‘কদিন আমায় জঙ্গলেই থাকতে হবে ডাক্তার। গুনতির সময়ে না থাকলে চলে না। দেখাশুনো কোরো। তোমায় অবশ্য বলতে হবে না।’
ডাক্তার হেসে বলেছে—’না, তা হবে না। আসতে বারণ করেও দেখতে পারেন!’
জগদীশবাবু হেসেছেন। সুরমাও হেসেছে, হাসলেই হয়ত তার মুখ লাল হয়ে ওঠো লাল হবার আর কোনো কারণ নেই বোধ হয়।
কিন্তু সুরমাই একদিন তীব্র স্বরে বলেছে—’আমি কিন্তু আর সইতে পারছি না!’
‘পারবে না-ই ত আশা করি।’
‘না না, তুমি এখান থেকে যাওা এমন করে নিজেকে ও আমাকে মেরে কি লাভ?’
‘বাঁচবার পথ ত খোলা আছে এখনো!’
‘সে পথ যখন আগে নেওয়া হয় নি…’
‘সে অপরাধ ত আমার নয় সুরমা তুমি তোমার নিজের মন জানতে না, আমি জানতাম না। সুযোগের মূল্যা ভাগ্যের নিষ্ঠুর রসিকতাকে তাই বলে মেনে নিতে হবে কেন!’
‘তুমি কি বলছ জান না! তা হয় না! তা হয় না!’ সুরমার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আবেগে।
‘অপরাধের কথা ভাবছ? অপরাধ করার চরম দামও যার জন্যে দেওয়া যায় এমন বড় জিনিস কি নেই?’
‘আমি বুঝতে পারি না। আমার ভয় হয়!’
‘বুঝতে পারবে, সেই প্রতীক্ষাতেই ত আছি।’
প্রতীক্ষা একদিন বুঝি সার্থক হল বলে মনে হয়েছে। জগদীশবাবুর কাঠের কারবারের জন্যে। জমা নেওয়া বিস্তীর্ণ জঙ্গল সেদিন তারা দেখতে গেছল। অরণ্যের রহস্যঘন আবেষ্টনে সারাদিন রাজসূয় চড়িভাতি’র উত্তেজনাতেই কেটেছে। বিকেলের দিকে সবাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিল।
অমরেশ ও সুরমা পথহীন অরণ্যে সকলের থেকে কেমন করে আলাদা হয়ে গেছে। আলাদা হওয়াটা হয়ত সম্পূর্ণ দৈবাৎ নয়, অমরেশেরও তাতে হয়ত হাত ছিল।
সুরমা খানিকক্ষণ বাদে বলেছে—’এ জঙ্গলে কিন্তু পথ হারাতে পারে!’
‘পথ জঙ্গলে ছাড়াও হারানো যায়!’
সুরমা একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলেছে—সব সময়ে তোমার এ ধরনের কথা ভালো লাগে না।’
‘কোথাও তোমার ব্যথা আছে বলেই ভালো লাগে না। নিজের কাছে তুমি ধরা দিতে চাও না বলেই এসব কথা তোমার অসহ্য।’
সুরমা নীরবে খানিক দূর এগিয়ে গেছে। অরণ্যের পশ্চাৎ-পটে তার দীর্ঘ সুঠাম দেহের গতিভঙ্গিতে বুঝি বনদেবীরই মহিমা ও মাধুর্য। সেটুকু উপভোগ করবার জন্যেই বুঝি খানিকক্ষণ নিঃশব্দে অমরেশ দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর কাছে গিয়ে বলেছে—’এ জঙ্গলে হারাবার বদলে পথ আমরা পেতেও পারি।’
সুরমা তবু নীরব।
হঠাৎ তার একটা হাত ধরে ফেলে অমরেশ বলেছে—’চুপ করে থেকো না সুরমা। বলল, আজ তোমার অটলতার গৌরব আর নেই—আছে শুধু দুর্বলতার লজ্জা। এ সম্বল নিয়ে চিরদিন বাঁচা যায় না, বাঁচা উচিত নয় সুরমা।’
সুরমা প্রায়-অস্পষ্ট স্বরে বলেছে,—’আমি কি করতে পারি বলো!’
একটা কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর পা দিয়ে অমরেশ বলেছে—’এই কাটা গাছটা দেখছ সুরমা! কাঠের কারবারে এর একটা দাম মিলেছে কিন্তু তার চেয়ে বড়, তার চেয়ে আসল দাম এর ছিল! তুমিও কারবারের কাঠ নও সুরমা, তুমি অরণ্যের।’
সুরমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অমরেশ আবার বলেছে,—’সহজ করে কথা আজ বলতে পারছি না বলে ক্ষমা কোরো সুরমা। মনের ভেতরেই আজ আমার সব জড়িয়ে গেছে।’
সুরমা অমরেশের আরো কাছে সরে এসেছে, বুকের ওপর মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে ধরা গলায় বলেছে—’তুমি আমায় সাহস দাও।’
কিন্তু চলে যাওয়া তাদের তখন হয়ে ওঠেনি। বাধা এসেছে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। জগদীশবাবু হঠাৎ অসুখে পড়েছেন—গুরুতর অসুখ সুরমা ও অমরেশ দিনরাত্রি বিনিদ্র হয়ে রোগ-শয্যার পাশে জেগেছে আর শান্তভাবে প্রতীক্ষা করেছে মুক্তিক্ষণের। আর বেশিদিন নয়। এই তাদের শেষ পরীক্ষা, নূতন জীবনের এই প্রথম মূল্যদানা।