তিনজনেই এ রসিকতায় হাসেন এ বাড়ির এটি একটি পুরাতন পরিহাস। সুরমা বলেন—’সত্যি, তুমি কি করে ডাক্তারি কর তাই ভাবি! লোকে বিশ্বাস করে তোমার ওষুধ খায়?’
‘খাবে না কেন, একবার খেলে আর অবিশ্বাসের সময় পায় না ত।‘
সুরমা হাসতে হাসতে পানের বাটা খুলে জিভে একটু চুন লাগিয়ে বলেন—’তোমার বাপু। ডাক্তারের ওপর একটু গায়ের জ্বালা আছে। তুমি ওর কিছু ভালো দেখতে পাও না।’
‘সেটা ওঁর চোখের দোষ, অনেক ভালো জিনিসই উনি দেখতে পান না।’—ডাক্তারের মুখে এতক্ষণে কথা শোনা যায়।
সুরমা হেসে বলেন—’তা সত্যি চোখ বুজে থাকলে আর দেখবে কি করে।’
‘চোখ বুজে থাকি কি সাধে! চোখ খুলে থাকলে কবে একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যেত!’
সুরমা ও জগদীশবাবুর উচ্চ হাসির মাঝে ডাক্তারবাবুর নিস্তব্ধতাটা যেন একটু বিসদৃশ ঠেকে। সুরমার মুখের দিকে চেয়ে ডাক্তারের চোখে একটু বেদনার ছায়া এখনো দেখা যায় কি?
সুরমা হাসি থামিয়ে বলেন—’ওই যা, ভুলেই যাচ্ছিলাম, তোমায় এখন কিন্তু একবার উঠতে হবে ডাক্তার।’
‘এখনি? কেন?’
‘এখনি না উঠলে হবে না। দাদা কি-সব পার্সেল করেছেনা স্টেশনে কাল থেকে পড়ে আছে, —উনি একবার তবু সারাদিনে সময় করে যেতে পারলেন না। তোমায় এখন গিয়ে ছাড়িয়ে আনতেই হয়!’
ডাক্তারবাবু একটু ইতস্তত করে বলেন—’কাল সকালে গেলে হয় না?’
‘হয় না আবার! একমাস পরে গেলেও হয়! জিনিসগুলো খোয়া যাবার পর গেলে আরো ভালো। হয়। ‘সুরমার কণ্ঠে মিষ্টতার চেয়ে এবার ঝাঁঝটাই বেশ স্পষ্ট।
‘এক রাত্তিরেই খোয়া যাবে কেন?’—ডাক্তারবাবু একটু সঙ্কুচিতভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন।
সুরমা বেশ একটু উচ্চস্বরেই বলেন—’তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারি না বাপু! সোজাসুজি বলই না তার চেয়ে যে, পারবে না! তোমায় বলা-ই ঝকমারি হয়েছে আমার।’
ডাক্তারবাবু এবার অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে উঠে পড়েন,—’আমি কি যাব না বলেছি? ভাবছিলুম একটা রাত্তির বই ত না।’
‘রাতটা কাটিয়ে গেলেই বা তোমার কি এমন সুবিধে! এমন কিছু কাজ ত আর হাতে নেই, চুপ করে বসেই ত থাকতে।’
সে কথা মিথ্যে নয়। ডাক্তার শুধু চুপ করে বসে থাকতেই এখানে আসেনা চুপ করে বসে আছেন আজ বহু বৎসর ধরে।
ডাক্তার টুপিটা তুলে নিয়ে একবার তবু বলেন,—’আসুন না জগদীশবাবু আপনিও! গাড়িটা ত রয়েছে, একটু ঘুরে আসা হবে।’
জগদীশবাবুর আগে সুরমাই আপত্তি করেন—’বেশ কথা! আমি একলা বসে থাকি এখানে তাহলে!’
ডাক্তার একটু হেসে বলেন—’আরে! তুমিও এস না!’
‘তার চেয়ে বাড়ি-সুদ্ধ পাড়া-সুদ্ধ সবাই একটা পার্সেল আনতে গেলেই হয়! সত্যি তুমি দিন দিন যেন কি হচ্ছ!’
ডাক্তার আর কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।
‘দিন দিন কি যেন হয়ে যাচ্ছ!’ মোটরে চড়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে ডাক্তার সে কথা ভাবেন কি? না বোধ হয়। ভাবনা ও আবেগের উদ্বেল সাগর বহুদিন শান্ত নিথর হয়ে গেছে। সে সব দিন এখন আর বোধহয় মনেও পড়ে না। স্মৃতির সে সমস্ত পাতাও বুঝি অনেক তলায় চাপা পড়ে আছে। জীবনের একটি বাঁধা ছকে তিনি খাপ খেয়ে গেছেন সম্পূর্ণভাবে আগুন কবে। ভস্মশেষ রেখে একেবারে নিবে গেছে তা তিনি জানতেই পারেন নি।
আগুন একদিন সত্যিই জ্বলে উঠেছিল বইকি! কিন্তু সে যেন আর এক জনের কাহিনী, সে অমরেশকে তিনি শুধু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে এখন চিনতে পারেন। তার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ তাঁর নেই।
একদিন একটি ছেলে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে পরম দুঃসাহসভরে দাঁড়াতে দ্বিধা করে নি। মেয়েটি ভীতস্বরে বুঝি একবার বলেছিল, সুযোগ পেয়ে—’তুমি এখানে চলে এলে!’
‘আরে অনেক দূরে যেতে পারতাম!’
‘কিন্তু?–’
‘কিন্তু এঁরা কি ভাববেন মনে করছ? তার চেয়ে তুমি কি ভাবছ সেইটেই আমার কাছে বড় কথা।’
‘আমি ত…’, মেয়েটি নীরবে মাথা নীচু করেছিল।
অমরেশ তার মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলেছিল—’তোমার ভাববার সাহস পর্যন্ত নেই সুরমা!’
সুরমা মুখ তুলে মৃদুস্বরে বলেছিল—’না।’
‘সেই সাহস সৃষ্টি করতেই আমি এসেছি সুরমা। সেই সাহসের জন্যে আমি অপেক্ষা করব।’
সুরমা চুপ করে ছিল। অমরেশ আবার বলেছিল—’ভাবছ, কতদিন—এমন কতদিন অপেক্ষা করতে পারব? দরকার হলে চিরকালা কিন্তু তা বোধ হয় হবে না।’
জগদীশবাবু বুঝি সেই সময়ে ঘরে ঢুকেছিলেন। তাঁর চেহারায় এখনকার সঙ্গে তখনো বুঝি বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না। বেঁটে গোলগাল মানুষটি। শান্ত নিরীহ চেহারা। একেবারে নীচের ধাপ থেকে সংগ্রাম করে তিনি যে সাংসারিক সিদ্ধি বলতে লোকে যা বোঝে তাই লাভ করেছেন, তাঁর চেহারায় তার কোনো আভাস নেই। দেখলে মনে হয় ভাগ্য তাঁকে চিরদিন বুঝি অযাচিত অনুগ্রহ করেই এসেছে। সুরমা-সম্পর্কে সে কথা হয়ত মিথ্যাও নয়।
তিনি ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—’এখনও ট্রেনের জামা-কাপড় ছাড়েন নি? না না, এখন ছেড়ে দাও সুরমা। সারারাত ট্রেনের ধকল গেছে। স্নান করে খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিন আগে।’
অমরেশ হেসে বলেছিল,—’ছেড়ে না দেওয়ার অপরাধটা আমার—ওঁর নয়।’
জগদীশবাবু উচ্চস্বরে হেসেছিলেন। হাসলে তাঁকে এত কুৎসিত দেখায় অমরেশও ভাবতে পারে নি সুরমার পেছনে তাঁর এই হাস্য-বিকৃত মুখটা সে উপভোগ করেছিল বেদনাময় আনন্দে–
তারপরে উঠে পড়ে বলেছিল—’আচ্ছা এখন ওঠাই যাক।’