সত্যিই পিসিমাদের নিয়ে যাবার জন্যে সে কি স্টেশনে এসেছিলো?
জীবনে কোনোদিন সে-কথা জানা যাবে না।
ভস্মশেষ
বারান্দার এদিকটা সরু। নীচে নামবার সিঁড়িরও খানিকটা ভেঙে পড়েছে। তবু সন্ধ্যের আগে এই দিকেই চেয়ারগুলো ও টেবিল পাতা হয়—এদিক থেকে দূরে পাহাড় আর নদীর খানিকটা দেখা যায় বলে।
কৈফিয়ৎটা নিরর্থক। পাহাড় আর নদী কেউ দেখে না আজকাল একদিন হয়ত সত্যিই সেই দেখাটা ছিল বড় কথা, এখন আর তার কোনো অর্থ নেই। যা ছিল আনন্দ তা আজ অর্থহীন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বারান্দায় এই চেয়ার পাতাটুকু থেকে এ বাড়ির অনেক কিছুর, আরো গভীর কিছুর পরিচয় হয়ত পাওয়া যেতে পারে। এই কাহিনী সেইজন্যেই লেখা।
সবার আগে জগদীশবাবু এসে বসেন। নীচু ইজি-চেয়ারটি তাঁর জন্যেই নির্দিষ্টা চেয়ারের দু’ধারের হাতলে সুপুষ্ট হাতদু’টি ও সামনের টুলে পা দু’টি রেখে নিশ্চিন্তে আরামে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকা তাঁর পরম বিলাস স্বেচ্ছায় পারতপক্ষে কথা তিনি বড় বলেন না। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সুরমা একটু পরে আসেনা শাড়িতে প্রসাধনে আলুথালু ভাবা আলুথালু ভাব বুঝি প্রকৃতিতেও। এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন—’এর মধ্যেই ঘুমোলে নাকি?’
ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবু একটু নড়ে-চড়ে জানান তিনি ঘুমোন নি।
সে প্রশ্নের জবাবের জন্যে সুরমার অবশ্য কোনো আগ্রহ নেই। অভ্যাস মতই প্রশ্নটা করেন, তারপর বেতের মোড়াটিতে বসতে গিয়ে উঠে পড়ে হয়ত বলেন—’ওই যা, দোক্তার কৌটোটা ভুলে এলাম।’
জগদীশবাবু চক্ষুমুদ্রিত অবস্থাতেই বলেন—’ডাক না চাকরটাকো’
সুরমা আবার বসে পড়ে বলেন—’তাকে যে আবার বাজারে পাঠালামা যাও না গো তুমি একটু।’
ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবুর নড়া-চড়ার কোনো লক্ষণ না দেখে মনে হয় তিনি বোধ হয় শুনতে পান নি অন্তত ওঠবার আগ্রহ তাঁর নেই।
কিন্তু সত্যি জগদীশবাবু খানিক বাদে বিশেষ পরিশ্রমে ইজি-চেয়ার ছেড়ে উঠেছেন দেখা যায়। জগদীশবাবুর আরামপ্রিয়তা ও আলস্য যত বেশিই হোক স্ত্রীর স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্ন ও দৃষ্টি তার চেয়ে প্রখরা।
জগদীশবাবুকে কিন্তু কষ্ট করে আর যেতে হয় না। বারান্দার সিঁড়িতে ডাক্তারবাবুকে দেখতে পাওয়া যায়।
সুরমা বলেন—’থাক, তোমায় আর যেতে হবে না ডাক্তার, আমার দোক্তার কৌটোটা নিয়ে। এসে একেবারে ব’সো। বিছানার ওপরই বোধ হয় ফেলে এলাম আর ঘরের আলোটা বোধ হয় নিবিয়ে আসি নি। সেটা নিবিয়ে দিয়ে এসা’
আদেশ নয়, অনুরোধেরই মিষ্টতা আছে কণ্ঠস্বরে, কিন্তু সে মিষ্টতা খানিকটা যেন যান্ত্রিক।
মিষ্টতা সুরমার সব কিছুতেই এখনো বুঝি অনেকটা আছে—চেহারায়, কণ্ঠস্বরে, প্রকৃতিতে। বয়সের সঙ্গে শরীরের সে তীক্ষ্ণ রেখাগুলি দুর্বল হয়ে এলেও তাদের আভাস আলুথালু বেশ ও প্রসাধনের মধ্য দিয়েও পাওয়া যায়। সুরমার সৌন্দর্য এখনো একেবারে ইতিহাস হয়ে ওঠে নি। অবশ্য ইতিহাস তার আর একদিক দিয়ে আছে—কিন্তু সে কথা এখন নয়।
ডাক্তারবাবু ঘরের আলো নিবিয়ে, দোক্তার কৌটো নিয়ে এসে, টেবিলের ওধারে সুরমার সামনা-সামনি বসেন নদী ও পাহাড়ের দিকে পিছন ফিরে। নদী ও পাহাড়ের দিকে কোনদিনই তাঁর চাইবার আগ্রহ ছিল না। বরাবর তিনি এই আসনটিতে এইভাবেই বসে আসছেন।
সন্ধ্যার অস্পষ্টতাতেও ডাক্তারবাবুকে কেমন অপরিচ্ছন্ন মনে হয়, শুধু পোশাকে ও চেহারায় নয়, তাঁর মনেও যেন একটা ক্লান্ত ঔদাসীন্য আছে সব ব্যাপারে। পোশাকের ত্রুটিটাই অবশ্য সকলের আগে চোখে পড়ে ঢিলে রঙচটা পেন্টুলেনের ওপর গলাবন্ধ একটা কোট পরা। গলাটা কিন্তু বন্ধ হয়নি বোতামের অভাবে এই কোট পরেই সম্ভবত তিনি সারাদিন রুগী দেখে ফিরবেন। একধারের পকেট স্টেথিস্কোপের ভারেই বোধ হয় একটু ছিঁড়ে গেছে। গোটাকতক আলগা কাগজপত্র সেখান দিয়ে উঁকি দিয়ে আছে। মাথায় চুলের কিছু পারিপাট্যের চেষ্টা বোধ হয় সম্প্রতি হয়েছিল, কিন্তু সে নেহাৎ অবহেলারা
ডাক্তারবাবুর মুখের ক্লান্ত ঔদাসীন্যের রেখাগুলি শুধু তাঁর চোখের উজ্জ্বলতার দরুনই বুঝি খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে নি সমস্ত ঘুমন্ত নিষ্প্রাণ মানুষটির মধ্যে এই চোখ দুটিই যেন এখানে জেগে আছে পাহারায়। কে জানে কি তাদের আছে পাহারা দেবার
অনেকক্ষণ কোনো কথাই শোনা যায় না। সুরমার পানের বাটা সঙ্গে আছে এবং থাকে। তিনি সযত্নে পান সাজায় ব্যস্ত। জগদীশবাবু ইজি-চেয়ারে নিশ্চল ভাবে পড়ে আছেন। ডাক্তারবাবু নিজের হাতের নখগুলো বিশেষ মনোেযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সুরমার পান-সাজা শেষ হবার জন্যেই বোধ হয় অপেক্ষা করেন।
সুরমার পান-সাজা শেষ হয়। সেটি মুখে দিয়েও তিনি কিন্তু খানিকক্ষণ নীরবে সামনের দিকে চেয়ে বসে থাকেন। তারপরে হঠাৎ এক সময়ে জিজ্ঞেস করেন—’তোমার সে ফুলের চারা এল ডাক্তার?’
জগদীশবাবু চোখ বুজে বলেন—’সে চারা আর এসেছে! তার চেয়ে আকাশ-কুসুম চাইলে সহজে পেতে’
সুরমা হেসে ওঠেন। বলেন—’তুমি ডাক্তারকে অমন অকেজো মনে কর কেন বল দিকি! সেবার আমাদের জলের পাম্পটা ডাক্তার না ব্যবস্থা করলে হ’ত?’।
ইজি-চেয়ারের ভেতর থেকে ঘুমন্ত স্বরে শোনা যায়—’তা হত না বটে। অন্য কেউ ব্যবস্থা। করলে হয়ত পাম্পে সত্যিই জল উঠত।’