“মনে হচ্ছে সত্যি কখনও দেখিনি!”
“তা হতে পারে!”–বলে সে অদ্ভুতভাবে হাসলো, তারপর জিজ্ঞাসা মলে—”আচ্ছা, আমার বাজার করা দেখে কি ভাবছিলে বলো তো?”
“এই কথাই ভাবছিলাম যে তুমি আমার কাছে একটা নতুন আবিষ্কার!”
“তাই নাকি, কিন্তু, দোহাই, বেচারা কলম্বাসের দাবিটুকু উড়িয়ে দিও না।”
“কলম্বাসেরও আগেকার দাবি যদি থাকে?”
“দাবি থাকলেও দলিল নেই তো!”–নিজের রসিকতায় করুণা নিজেই হেসে মাত করে দিলে।
নিঃশব্দে অনেকক্ষণ খেয়ে যাবার পর বললাম—”দলিলের দাম সকলের কাছে নেই! ও তুচ্ছ জিনিস অনায়াসে পুড়িয়ে ফেলা যায়।”
এবার করুণা হাসলো না। আমার মুখের দিকে খানিক অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থেকে—”তোমায় মিষ্টি দেওয়া হয়নি,” বলে হঠাৎ উঠে গেলো।
তারপর মিষ্টি করুণা নিয়ে এলো না, নিয়ে এলো ঠাকুর।
কিন্তু খানিক বাদে ঘরে সে নিজেই পান নিয়ে এলো এবং হঠাৎ বলে বসলো–”তুমি আজ সন্ধ্যের গাড়িতেই তাহলে যাচ্ছো?”
সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। আমারই মনের ভুল, না তার মুখে একটা অস্ফুট অস্থিরতার ছায়া?
বললাম—”বেশ, তাই যাবো।”
“বেশ তাই যাবো মানে? আমি যেন তোমায় জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি তো তোমায় থাকতেই বলছি, তুমি নিজেই তো যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলে তখন।”
গলার ঝাঁঝটা এবার লুকোবার নয়।
হেসে বললাম—”আমি কি তোমায় দোষ দিচ্চি? আমার সত্যিই না গেলে নয়।”
একটু যেন লজ্জিত হয়ে করুণা হাসবার চেষ্টা করে বললে—”তা জানি, এমন জায়গায় তোমার মন টেকে? কিন্তু শোনো, সন্ধ্যায় ঐ একটি ছাড়া আর গাড়ি নেই তা জানো তো? ঠিক সাড়ে ছটায়, মনে থাকে যেন।”
গাড়ির সময় আমার মনে রাখবার প্রয়োজন ছিলো না। বিকেল না হতেই জিনিসপত্র বাঁধিয়ে, আমার মোটরের কারখানায় খবর দিতে পাঠিয়ে, স্টেশনে যাবার গাড়ি ডাকিয়ে করুণা নিজেই সব বন্দোবস্ত করে ফেললে এবং স্টেশনে যাবার পনেরো মিনিটের পথ যেতে পাছে কোনো গোলমাল হয় বলে এক ঘণ্টা আগে আমায়—গাড়িতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো।
এতক্ষণ আমার সঙ্গে বিশেষ কিছু বলবার অবসর তার মেলেনি।
বাড়ি থেকে টাঙ্গায় ওঠবার সময় সে কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললে—”তুমি আমায় কি ভাবছে কে জানে! যেন তোমায় বিদেয় করতে পারলেই বাঁচি মনে হচ্ছে, না?”
“সেইটুকু ভেবেই যা কিছু সান্ত্বনা!”
করুণ হেসে উঠলো—”সান্ত্বনাটা এতো সস্তা হলে আর সত্যিকার কিছু মেলে!” টাঙ্গাওয়ালা গাড়ি চালানোর শব্দে তার হাসির রেশ মিলিয়ে গেলো।
.
এ-গল্পের শেষ ঐখানেই হলে ভালো হতো, কিন্তু তা হলো কই!
স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখনও ট্রেনের অনেক দেরি। ওয়েটিংরুমে জিনিসপত্র রেখে এদিক-ওদিক অকারণে ঘুরে বেড়িয়েও সময় কাটাতে না পেরে তখন বই-এর স্টলে এসে দাঁড়িয়ে কি কেনা যায় ভাবছি। হঠাৎ পাশে চোখ পড়ায় চমকে উঠলাম।
“একি! করুণা, তুমি এখানে?”
ম্লান একটু হেসে বললে–“এই এলাম!”
স্টেশনের শেডের আবছা আলোর দরুন, না সত্যিই করুণাকে কেমন দুর্বল দেখাচ্ছে।
স্টল থেকে একটু সরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—”আমি ঠিক বুঝতে পারছি না করুণা, হঠাৎ স্টেশনে আসার মানে?”
করুণা আবার হাসলো, তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললে—”দলিল পুড়িয়ে দিয়ে এলাম।”
খানিকক্ষণ সত্যিই কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে বিমুঢ়ভাবে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ব্যাকুলভাবে বললাম—”কি বলছে করুণা!”
“খুব অসম্ভব কি কিছু বলছি? ব নোঙর ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মতো ঢেউ কি আসে না কখনো?” করুণার স্বর ক্রমশ যেন গাঢ় হয়ে উঠলো।
আমার বুকের একেবারে কাছে এগিয়ে এসে চোখের দিকে চোখ তুলে সে বললে—”তুমি আমায় নিয়ে যেতে পারো না? যাবে না নিয়ে, বলো?”
অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়লাম—”আমি…তোমায় নিয়ে…”
“কোথায় যাবে ভাবছো? যেখানে খুশি!”
কোনো কথা এবার আর মুখ দিয়ে বেরুলো না। মনের ভেতর শুধু একটা অস্থির আলোড়ন অনুভব করছি।
“তোমায় অনেক অসুবিধা, অনেক লাঞ্ছনা সইতে হবে জানি, কিন্তু আমিও তো তারই জন্যে প্রস্তুত হয়ে সমস্ত লজ্জা, নিন্দা মাথায় নিয়ে এসেছি!”
করুণা কারভাবে মুখের দিকে চেয়ে আছে। কী বলবো? কী এখন বলতে পারি! নির্বোধের মতো আমিই তার রুদ্ধ বন্যার বাঁধ খুলে দিয়েছি, এখন তাকে কেমন করে ফিরিয়ে দেবো?
“কিন্তু ব কথা তুমি বোধ হয় ভালো করে ভেবে দেখোনি, করুণা। যে ঝড় এবার উঠবে তা কি তুমি পারবে সইতে? তার সঙ্গে যুঝতে বুঝতে ক্লান্ত হয়ে হয়তো আমরা পরস্পরকেই একদিন ঘৃণা করতে শুরু করবো।”
করুণা তখনও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে—অত্যন্ত ধীরে ধীরে তার সমস্ত মুখ যেন বিদ্রপের হাসিতে ভরে উঠলো।
“তোমার মূল্যবান উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। আর একটু হলেই নোঙর উপড়ে গেছলো আর কি!” করুণা এবার সশব্দেই হেসে উঠলো।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। সমস্তই কি তবে আমাকে বিদ্রুপ করবার জন্যে অভিনয়!
করুণা সহজভাবে বললে–“যাও, ট্রেন আসবার ঘণ্টা পড়েছে। আমার। ট্রেনেরও বোধহয় দেরি নেই।”
“তোমার ট্রেন!”
“পিসিমারা কলকাতা থেকে আসছেন। তারা বাড়ি চেনেন না। উনিও নেই, তাই নিজেই এলাম নিয়ে যেতে। শুনে খুব হতাশ হলে বুঝি?”
কোনো কথা আর না বলে ও ধারের প্লাটফর্মে যাবার জন্যে ওভারব্রিজের দিকে অগ্রসর হলাম। করুণাকে শেষ যখন দেখতে পেলাম তখন স্টলের বইগুলোর দিকে সে ঝুঁকে পড়েছে।