শহরের নির্জন এক প্রান্তে বিমলবাবুর বাড়ি। সেখানে পৌঁছে দেখা গেছিলো সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে বিমলবাবু বলেছিলেন–“আজ আমার আবার কথা ছিল ন কিনা! চাকর ব্যাটারা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে!”
খানিকক্ষণ পরে একটি মহিলাই লণ্ঠন হাতে এসে বাইরের দরজা খুলে নিদ্রাজড়িত স্বরে বলেছিলেন—”বড় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তুমি যে বলে গেছিলে আজ আসবে না!”
বিমলবাবু হেসে বলেছিলেন—”ব্বাতে একটা পরোপকারের পুণ্য ছিলো, তাই বোধহয় আসার সুবিধে হয়ে গেল। আমি না এলে এই ভদ্রলোক একটু বিপদেই পড়তেন বোধহয় অজানা শহরে!”
করুণা এইবার আমায় দেখতে পেয়েছিল। মাথায় ঘোমটা দিয়ে সরে যেতে গিয়ে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
বিমলবাবু তখনও বলে চলেছেন—”তুমি চাকরগুলোকে ডেকে দাও, বাইরের ঘরটা খুলে একটা বিছানা ঠিক করে দিক। ভদ্রলোকের একটু কষ্ট হবে–”
হঠাৎ তাকে করুণার কথায় সবিস্ময়ে থেমে যেতে হয়েছে। করুণা হেসে বলেছে–“বিদেশ-বিভূঁয়ে একটু কষ্ট হলেই বা ভদ্রলোকের!”
বিমলবাবু অবাক হয়ে আমাদের দুজনের মুখের দিকে চেঁচিয়ে ওঠেন—”তার মানে! এঁকে তুমি চেনো নাকি!”
“তা একটু চিনি বৈকি!”— করুণা হেসে উঠেছে।
“কী আশ্চর্য!”
“আশ্চর্যটা কিরে! তোমার অচেনা বলে আমার চেনা হতে নেই! তোমরা সঙ্গে তো মাত্র তিন বছর বিয়ে হয়েছে, তার আগে কুড়ি বছর আমি সলিটারি সেলে ছিলাম মনে করো!”
বিমলবাবু হেসে ফেলে বলেছেন—”কিন্তু ভদ্রলোককে বাইরে ঠাণ্ডায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের দাম্পত্য জীবনের নমুনাটা নাই দেখালে।”
করুণা গম্ভীর হবার ভান করে বলেছে—”ও আমি শুধু ঝগড়া করি এই তুমি বোঝাতে চাও!”
এবার একটা কিছু বলা উচিত বলেই হাদারচেষ্টা করে কথা বলেছি—”ব্যবসাই পেশা বিমলবাবু, নমুনা দেখে আমি ভুলি না।”
এতদিন বাদে করুণার প্রথম আলাপের ধরনে তখনই মনে কোথায় আমার একটা খটকা লেগেছে।
.
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন নিজেই বেরিয়ে পড়বে কি না ভাবছি তখন রুশা এলো। সাজ-পোশাকের পরিবর্তন দেখে যা বলতে যাচ্ছিলাম নিজে থেকেই তার উত্তর দিয়ে সে বললে—”একটু বাইরে যেতে হবে। আসবে আমার সঙ্গে?”
চাদরটা আলনা থেকে তুলে নিয়ে বললাম—”শুধু আদেশের অপেক্ষা। কিন্তু কোথায় যাচ্ছো?”
“বাজার করতে।”–বলে করুণা হাসলে।
“বাজার করতে।”—অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
“আমি তো প্রায়ই যাই।” সে হেসে বললে—”এখানে ‘চেঞ্জার’ ছাড়া বাসিন্দাদের মেয়েরা বড়ো একটা নিজেরা বাজারে যান না বটে, কিন্তু আমি ও-সব মানি না; উনি না থাকলে আমি নিজেই চাকর নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।”
“কিন্তু বিমলবাবু তো আজ আছেন!”
“ও, তোমায় বুঝি বলা হয়নি! উনি খবর পাঠিয়েছেন আজ আসতে পারবেন না, হঠাৎ বিশেষ জরুরি কাজে আটকে পড়েছেন।”
করুণা বেশ সহজভাবেই কথাটা বলে গেলো। কিন্তু আমি রাস্তার মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম-”তা হলে?”
“তা হলে আর ভাবনা কিসের! উনি না থাকলে কি তোমার যত্ন হবে না!”
করুণার চোখে মুখে কৌতুকের দুষ্টু হাসি!
“তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করলে আমায় একাই এগিয়ে যেতে হবে।”
অগত্যা নীরবে তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হলো। এদিকের পথটা বেশ নির্জন। দূরে দূরে দু-একটা বাড়ি। তারও অনেকগুলি খালি পড়ে আছে। রাস্তায় লোক নেই বললেই হয়।
খানিকদূর নীরবে চলার পর প্রশ্ন না করে পারলাম না—”বিমলবাবু আজ রাত্রে ফিরবেন তো?”
“বোধহয় না। এখন দু-চার দিন হয়তো সেখানে থাকতে হবে।”
আবার নীরবে অনেকটা পথ পার হয়ে গেলাম। করুণা কয়েকবার আমার দিকে ফিরে তাকাবার পর হেসে বললে—”কি ভাবছো অতো গম্ভীরভাবে?”
“ভাবছি আজই আমায় চলে যেতে হবে।”
“তোমার গাড়ি তো আজকের মধ্যে মেরামত হয়ে উঠবে না।”
“গাড়ি এরা পরে পাঠিয়ে দেবেখন। আমি ট্রেনেই যাবো।”
“এত ব্যস্ত কেন? তোমার এখানে ভয় কিসের?”
রাস্তার মাঝে আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম-”বলেছি তো ভয় আমার নিজেকে। নিজেকে আমি বিশ্বাস করি না।”
করুণা এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলো—”না-ই বা করলে, তাতে কারুর তো কোনো ক্ষতি নেই!”
না, এ বুঝি আর সওয়া যায় না। হঠাৎ সমস্ত সংযম হারিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললাম–”ক্ষতি যদি তোমারই হয়…”
করুণা হাত ছাড়িয়ে নিলো না। কিন্তু পরিহাসের হাসিতে আমার সমস্ত আবেগকে নিষ্ঠুরভাবে হাকা করে দিয়ে বললে-” কেমন করে হবে? আমি তো নিজেকে বিশ্বাস করি!”
করুণার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম—”সে বিশ্বাস এখনো কি ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে না করুণা? সমস্ত নোঙর ছিঁড়ে তোমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ঢেউ কি আসতে পারে না?”
করুণার চোখে সেই দুর্বোধ সকৌতুক হাসি—”কি জানি, পরীক্ষা অবশ্য হয়নি।”
তারপর কি বলতাম ঠিক জানি না, কিন্তু রাস্তা এবার জনবহুল হয়ে এসছে। বাধ্য হয়েই চুপ করে গেলাম।
সকালবেলা বাইরে বার হবার পোশাকে করুণার একরূপ দেখেছিলাম। দুপুরবেলা সোড়শোপচার আহারের আয়োজনের আসনের সামনে বসে তার আর একরূপ দেখলাম। একটি সাদা সেমিজের ওপর লাল চওড়া কস্তাপাড় শাড়ি পরে আধ-ঘোমটার পাশ দিয়ে ভিজে এলোচুল পিঠে এলিয়ে সে কাছে এসে বসলো। এমন আশ্চর্য তাকে কোনেদিন লাগেনি।
পাখাটা নাড়তে নাড়তে হেসে সে বললে-”কি দেখছো? কখন দেখোনি নাকি!”