করুণা আবার অস্থির হয়ে উঠলো—”না না, আমি জানি; জোর করে তাঁরা আমায় সেখানে বন্দী করে রাখতে চান। তাদের ধারণা এ-সব ছেলেমানুষী সারাবার তাই অব্যর্থ ওষুধ।”
করুণা একটু তিক্ত হাসি হাসলো।
তারপর বললে—”আমি কলেজে যাবার নাম করে বেরিয়ে এসেছি। এখানে এসে তোমায় অসুবিধায় ফেলবার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু না এসে যে উপায় নেই, পিসিমার বাড়িতে তোমার যাওয়া তো প্রায় বন্ধ হয়েছে। সেখানে এসব কথা তোমায় জানাতেও পারতাম না।”
একটু থেমে করুণা আবার অস্থির হয়ে উঠলো আবেগে—”সত্যি কি আমায় নিয়ে যাবো জোর করে! কিছুই আমরা করতে পারবো না?”
সেদিন কি আশ্বাস, কি সান্ত্বনা দিয়ে করুণাকে তার পিসিমার বাড়ি রেখে এসেছিলাম, তার বিবরণের এখানে প্রয়োজন নেই, কিন্তু মনে যত বড়োই ব্যথা পেয়ে থাকি না, কিছুই তারপর করতে পারিনি এটা ঠিক।
করুণাকে তার মামারা জোর করে কিনা জানি না তারপর পাটনায় নিয়ে গেছে; যাবার আগে দেখা করবার সুযোগও মেলেনি আমাদের।
নিমন্ত্রিত অবশ্য হইনি, কিন্তু একদিন কোথা থেকে করুণার বিয়ে হয়ে যাওয়ার সংবাদও কানে এসেছে। নির্লিপ্ত নির্বিকার মনে সে-সংবাদ শুনেছি এমন কথা বলতে পারবো না, কিন্তু আজ বিশ্লেষণ করে দেখে বুঝতে পারি এসংবাদ পাবার পর কয়েকটি দিন ও রাত যে আমার কাছে হতাশায় ধূসর হয়ে গেছে, তা প্রধানতঃ করুণার দুঃখের কথা ভেবে। ভালোবেসে না পাওয়ার ব্যর্থতা সেদিন নিজের দিক দিয়ে নয়, করুণার দিক দিয়েই উপলব্ধি করেছি, এবং সেই উপলব্ধির বেদনায় নিজের
আত্মপ্রসাদ কিছু মেশানো ছিলো কিনা তা বোঝবার শক্তি তখন ছিলো না।
করুণার স্মৃতি যখন ম্লান হয়ে এসেছে তখনও মনের কোন গোপন কোণে এ বিশ্বাস বুঝি ছিলো যে, আমি ভুললেও সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না!
সে-বিশ্বাসে রূঢ় আঘাত পাওয়ার পরই মনের যে বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া শুরু হলো তাতে নিজের কাছেই নিজে কেমন একটু লজ্জিত বোধ করলাম, কিন্তু তবু আত্মসংযম করতে পারলাম না।
করুণা খানিক বাদে যখন আমার ঘরে এলো তখন আমার আচরণে ও কথায় একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন চেষ্টা করলে হয়তো সেও লক্ষ্য করতে পারতো।
করুণা খাবার প্লেটটার দিকে চেয়ে বললে—”একি! কিছুই যে খাওনি!”
পাঞ্জাবির বোম আঁটতে আঁটতে তার দিকে ফিরে চাইলাম; একটু হেসে বললাম-”লৌকিকতার বদলে লৌকিকতাই করতে হয় যে, দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো cট সাফ করে ফেললে তুমি ভাবতে কি?”
“তুমি এখনো সেই এক কথা ধরে বসে আছো!”–করুণার স্বর একটু যেন ক্ষুণ্ণ।
“এক কথা ধরে বসে থাকা আমার একটা দুর্বলতা করুণা, এখনও এটা শোধরালো না।”—আমার স্বর বেশ গাঢ়।
করুণা অন্যদিকে ফিরে খাবার প্লেটটা সরিয়ে রাখছিলো, তার মুখ দেখতে পেলাম না। কিন্তু যে উত্তর সে দিলে তাতে সহজ কৌতুক ছাড়া আর কিছুই আভাস নেই।
“আর ঘ দুর্বলতা তাহলে শুধরে ফেলেছ!”—আমার দিকে ফিরে করুণা আবার বললে—”একি, এরই মধ্যে বেরুচ্ছো নাকি?”
“হাঁ, গাড়িটার কতদূর কি হলো একবার দেখতে তো হয়!”
“তুমি দেখলেই তো সেটা তাড়াতাড়ি মেরামত হয়ে যাবে না। উনি তো খোঁজ নিয়ে আসবেন বলেছেন। ওঁর ফিরতে আর দেরি নেই। তোমায় থাকতেই বলে গেছে।”
“সুতরাং ততক্ষণ তোমার সঙ্গে বসে গল্প করতে বলেছেন?”— হেসে বলবার চেষ্টা করলাম।
সকৌতুক মুখভঙ্গি করে করুণা বললে—”তা করতে পারো।”
আমার স্বর আপনা থেকে তখন বুঝি গাঢ় হয়ে এসেছে—”অনায়াসে বলে ফেললে যে করুণা!”
“এমন কি একটা কঠিন কথা সে অনায়াসে বলা যায় না?”করুণার মুখে একাধারে হাসি ও বিস্ময়।
“এমন কিছু কঠিন নয় করুণা? সত্যি বলছো? আমার সঙ্গে একা বসে গল্প করতে তোমার ভয় করে না? আমার যে নিজেকে এখনো ভয় করে।”
“তোমার মাথাটি বেশ খারাপ হয়েছে দেখছি।”–বলে হেসে আমায় বেশ একটু অপ্রস্তুত করে করুণা এবার বেরিয়ে গেলো। দরজার কাছ থেকে ফিরে আবার বললে—”তুমি কিন্তু যেও না, আমি এখুনি আসছি।”
কিন্তু অনেকক্ষণ করুণা তারপর আর আসে না। ঘরের ভেতর পায়চারি করে বেড়াতে বেড়াতে মনের মধ্যে কী একটা জ্বালা অনুভব করি। সেটা আমার নিজের না করুণার বিরুদ্ধে বোঝা শক্ত। হয়তো সেটা নিয়তির বিরুদ্ধে।
কী দরকার ছিলো এমন করে আবার তার সঙ্গে দেখা হবার! দেখা হওয়াটা দৈরে আয়োজিত পরিহাস ছাড়া আর কি?
ক-দিন ছুটি পেয়ে মোটরে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কাল রাত্রে এই শহরের মাঝখানে এসে যখন তার কল হঠাৎ বিগড়ে গেছিলো তখন জঙ্গলের পথে না হয়ে একটা ভদ্রগোছের শহরের মধ্যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদই দিয়েছিলাম। ভবিষ্যতটা তখন জানতে পারলে বোধহয় জঙ্গলের পথটাই শ্রেয়ঃ মনে করতাম।
একে রাত্রিকাল, তায় অচেনা শহর। ডাকবাংলো ও স্টেশনের ওয়েটিংরুম থেকে দরিদ্রতম হোটেলে পর্যন্ত টাঙ্গা করে ঘুরে আশ্রয় না পেয়ে শেষে, যে কারখানাতে মোটর মেরামত করতে দিয়েছিলাম, সেখানেই ফিরে গেছিলাম হতাশ হয়ে। সেখানেই বিমলবাবুর সঙ্গে পরিচয়। কাছাকাছি একটা কয়লার খনিতে তিনি কাজ করেন। সেখানকার কি প্রয়োজনে একারখানায় এসেছিলেন। প্রবাসে বিপন্ন বাঙালীর সাহায্যে তিনি নিজে থেকেই অগ্রসর হয়ে তার বাড়িতে রাত্রি কাটাবার প্রস্তাব করেছিলেন। সামান্য একটু আপত্তি হয়তো করেছিলাম, কিন্তু তিনি তা শোনেননি।