- বইয়ের নামঃ প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ প্রেমেন্দ্র মিত্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
জনৈক কাপুরুষের কাহিনী – প্রেমেন্দ্র মিত্র
সকালবেলা করুণা নিজ হাতে চা নিয়ে এলো।
চায়ের আনুষঙ্গিকের বহর দেখে না হেসে পারলাম না, বললাম—”তোমাদের এদেশী জলহাওয়া ভালো হতে পারে, কিন্তু আমার জীর্ণ করবার ক্ষমতাটা এখনো স্বদেশী আছে—এই দুদিনে তার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।”
উত্তরে শুধু একটু হেসে প্লেটগুলো টেবিলের ওপর সাজিয়ে করুণা চলে যাবার উপক্রম করতে আবার ডেকে বললাম-”তুমি কি আমার সঙ্গে লৌকিকতা শুরু করে দিলে নাকি? বিমলবাবু লৌকিকতা করলে নাহয় বুঝতাম, কিন্তু-”কথার মাঝখানেই করুণা বললে—”বিমলবাবুর হয়েই যদি করি— দোষ আছে কি?”–তারপর হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
চায়ের পেয়ালা সামনে ঠাণ্ডা হতে লাগলো। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।
না, করুণার ব্যবহারটা মোটেই ভালো লাগছে না, একথা নিজের মনের কাছেও স্বীকার করতে আর বাধা নেই।
করুণা নাটকীয় একটা কিছু করে বসবে তা অবশ্য আশা করিনি। আশা কেন, সেটা রীতিমতো আশঙ্কার বিষয়ই ছিলো। গোড়ায় তার সহজ স্বাভাবিকতায় তাই বুঝি আশ্বস্তই বোধ করেছি। কিন্তু মনের কোনো গোপন কোণে আহত অহংকার তারপর ধীরে ধীরে সাড়া দিতে শুরু করেছে। মনে হয়েছে, এতটা হবার বুঝি দরকার ছিলো না। সূর্য অস্ত গেছে যা কিন্তু তার বিলম্বিত রঙ পশ্চিমের মেঘে একটু লেগে থাকলে ক্ষতি কি ছিল!
নাটকীয় না হয়ে করুণা অতিমাত্রায় কঠিন ও সংযত হয়ে উঠলে বুঝি সবচেয়ে খুশি হতাম। ধরা দেবার ভয়ে তার সেই সযত্ন সাবধানতায় আমার আত্মাভিমান সবচেয়ে বোধহয় তৃপ্ত হত।
কিন্তু করুণা নাটকীয় উচ্ছাস বা কঠিন ঔদাসীন্য—দুই-এর কোনো দিক দিয়েই গেলো না।
তাতে আমার কিছু আসে যায় না, অনায়াসে এই কথাই ভাবতে পারতাম। এবং তাই ভাবাই ছিলো উচিত। সত্যি করুণার সঙ্গে দেখা হবার কোনো আশা বা আকাঙ্ক্ষা আমার তো ছিলো না। তার সঙ্গে দেখা হবার কথাও নয়। বিশাল পৃথিবীর জনতায়। এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে আমরা হারিয়ে গেছিলাম যে কোনো দিন আবার পরপ্রকে খুঁজে পাওয়াই ছিলো অভাবিত।
কিন্তু সেই অভাবিত ব্যাপার যখন ঘটলো তখন দেখলাম, করুণাকে অনায়াসে ভুলে গেছি যখন মনে করেছি তখনও সে আমায় ভুলতে পারে না—মনের এ গোপন গর্বটুকু ত্যাগ করতে পারিনি।
এ রকম একটা গর্ব থাকা খুব অস্বাভাবিক বোধহয় নয়।
সে-সব দিনের কথা একেবারে ভোলা তো যায় না! বিশেষ করে সেই একটি বিকেল। সারাদিন বাইরে অবিশ্রান্তভাবেই বৃষ্টি পড়েছে, ইচ্ছে থাকলেও কোথাও আর বার হওয়া হয়নি। বিকেলে চাকর এসে খবর দিলে একটি মেয়ে দেখা করতে এসেছে।
এই হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে একটি মেয়ে। প্রথমটা সত্যিই একটু বিমূঢ় হয়ে গেছিলাম। চাকরের সঙ্গে করুণা যখন ঘরে এসে ঢুকলো তখনও আমার মুখের বিস্ময় নিশ্চয় অত্যন্ত স্পষ্ট।
চাকর চলে যাবা পর করুণা কাছে এগিয়ে এসে বললে— “খুব আশ্চর্য হয়েছো না?”
“তা একটু হয়েছি, কিন্তু তুমি যে একেবারে ভিজে গেছে!”— আমি সত্যই ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।
করুণা কাছের একটা চেয়ারে বসে বললে— “বৃষ্টিতে বেরুলে ভিজতে হয়, তোমার ব্যস্ত হতে হবে না।”
তারপর হেসে উঠে বললে—”ব্যস্ত হয়ে করবেই বা কি! তোমাদের এ নারী বিবর্জিত রাজ্যে মেয়েদের পোশাক পাবে কোথায়? সখের থিয়েটার পার্টি তো নিশ্চয়ই তোমাদের নেই!”
একটু ভেবে বললাম—”ওপরে দশ নম্বরে একজনেরা আছেন— স্বামী-স্ত্রী!”
করুণা আবার আসলো—”তাঁদের কাছে শাড়ি ব্লাউজ চাইতে যাবে? কি বলে চাইবে?”
হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বললে—”তার চেয়ে ভিজে কাপড়েই আমি বেশ আছি। আমার অসুখ করবে না, ভয় নেই।”
অগত্যা তার পাশে গিয়ে বসলাম। আমি কোনো প্রশ্ন করবার আগেই সে আবার বললে—”ভাবছো, এমনভাবে এখানে আসার মানে কি? কেমন?”
এবারও কোনো উত্তর দিলাম না। করুণা খানিকক্ষণের জন্যে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মনে হলো। তারপর সম্পূর্ণ রূপান্তর। এই দুর্বার আবেগ সে এতক্ষণ জোর করে ধরে রেখেছিল বুঝলাম।।
একেবারে আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ব্যাকুল স্বরে বললো— “আমায় পাটনায় নিয়ে যাচ্ছে। মামা কাল চিঠি দিয়েছেন।”
বুঝতে কিছু পারলাম না এমন নয়। তবুও বেদনাময় সত্যটা যতক্ষণ সম্ভব অস্বীকার করে বললাম-”তোমাদের কলেজের তো ছুটি হচ্ছে?”
করুণা আরো ব্যাকুল স্বরে বললে—” না না, তা নয়। তুমি বুঝতে পারছে না। এখানে আমায় আর রাখবে না; এই যাওয়া আমার শেষ!”।
তার ঠাণ্ডা একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। হ্যাঁ, বেদনা সেদিন আমার হৃদয়েও ছিলো, কিন্তু করুণার উদ্বেল আবেগের তুলনায় সে বুঝি কিছু নয়! আমার ভালোবাসার মধ্যে সে উদ্দামতা ছিলো না যা ভাগ্যের বাধার বিরুদ্ধে উদ্ধত বিদ্রোহ করতে পারে।
কিন্তু করুণা খানিক বাদে অশ্রুসজল মুখ তুলে দৃঢ়স্বরে বললে—”আমি যাবো, কিছুতেই যাবো না। কেন যাবো?”
কি উত্তর একথার দেবো ভেবে পেলাম না। মনের গভীরতায় হয়তো সেইদিনই তার এ বিদ্রোহে আমার সায় ছিলো না। তখনই আমি জানতাম যে এ বিদ্রোহ নিষ্ফল।
কথাটা একটু ঘুরিয়ে দেবার ষ্টোয় বললাম-”তুমি যা মনে করছে তা তো নাও হতে পারে করুণা; তুমি হয়তো মিছিমিছি ভয় পাচ্ছো।”