Site icon BnBoi.Com

ডুগডুগির আসর – প্রশান্ত মৃধা

ডুগডুগির আসর - প্রশান্ত মৃধা

০১. মোসলেম উদ্দিন পোশাকে সবচেয়ে ধোপদুরস্ত

মোসলেম উদ্দিন পোশাকে সবচেয়ে ধোপদুরস্ত। তা তো তাকে হতেই হবে, কাপড় ধোয়ার পাউডার বিক্রেতা বলে কথা। লন্ড্রিতে থোয়া ইস্তিরি করা ক্রিজ তোলা সাদা জামা আর ঈষৎ পরিষ্কার নীলাভ লুঙ্গি না-পরে উপায় আছে, কেউ কিনবে তার পাউডার!

এই যে সকাল দশটা নাগাদ মোসলেম উদ্দিন কোর্ট চত্বরে এল, যেন মঞ্চে এক প্রবীণ অভিনেতার প্রবেশ। সিনেমায় এমন হলে দর্শকরা ক্লাপ দেয়, নায়কের উদ্দেশে চোখা ডায়লগ ছাড়লে শিস দেয় কেউ, মঞ্চে থাকলে বড়ো চোখে ঘাড় উঁচু করে দেখে। কিন্তু মোসলেম উদ্দিনের উদ্দেশে এখন ঘটবে না। এক পায়ে কবে কোন আদ্যিকালের পলিও নিয়ে ল্যাংচে একখানা ছোট্ট লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটার শুরু। উকিল মোক্তার পেশকার নাজির এমনকি মুনসেফ ম্যাজিস্ট্রেট ডিসি এসপির সামনে ভিড়ের ভিতর দিয়ে যতই ধোপদুরস্ত হয়ে মোসলেম হেঁটে আসুক না কেন, চত্বরের মেহগনি আর মেঘনিশ গাছটার নীচে এসে আসর জমানোর আগে তার একটিও ক্লাপ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কে দেবে এখন হাতে তালি। সবাই সামনের মজমায় বিভোর! যদিও সে জমায়েতের সবারই এখন হাত মুঠ-ছাড়া। মুঠ করা যাবে না, পকেটে হাত দেয়া বারণ, লুঙ্গির কোচড়েও না। ওই মজমাঅলার অনুরোধ, হাত দেয়া যাবে না হোলে আর গালে!

ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে মোসলেম উদ্দিন মেঘনিশ গাছটার নীচের দিকে যায়। সে এসেছে উত্তর দিকের রেজিস্ট্রি অফিসের ছোটো ঘরটার কাছে থেকে। তারপর মূল কোর্ট বিল্ডিঙে পিছনের বার কাউন্সিলের পাশের ছোটো মাঠে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানছিল। সঙ্গে পোটলা-পুটলিভরতি জিনিসপত্র আরও আগে মেঘনিশ গাছের নীচে রেখে গেছে। সেখানেই প্রতিদিন সকালে রাখে। সে একলা না, সাপ খেলার বাকসো, মহাশংকর তেল বিক্রেতার জিনিসপত্র, একশ এক পদের ধন্বন্তরি গাছ-গাছড়া, ওই পাশের নীচু বটতলার বই বিক্রেতাও এখানে রাখে তাদের জিনিস। শুধু বানর খেলা দেখানো আজগর কখনও বানর দুটোকে এখানে বাঁধে না। তা সে বাঁধে ওই ট্রেজারির কাঁটাতারের পাশের ছোটো কুল গাছের কাণ্ডে। ওখানেই ও দুটো ভালো থাকে। এখানে গাছের গুঁড়ি মোটা, আজগরের বানরের গলার চেইন অত বড়ো না, তাছাড়া গুছিয়ে রাখা এসব জিনিসপত্রের পাশে বানর দুটোকে রাখলে বাঁদরামির অন্ত থাকবে না। ইদানীং মর্দাটার পিঠের লোম কমতে শুরু করেছে, সেখানে বাঁদরামির জন্যে দু-ঘা দিতে আজগরের আজকাল কষ্ট হয়। শত হলেও অবলা প্রাণী, তার পেটের ভাত জোগায়।

মোসলেম উদ্দিন বার কাউন্সিলের কোনায় নীচু চিলতে কোর্ট বিল্ডিঙের দিকে যাওয়া ছাউনি দেওয়া সরু পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে চত্বরের সামনে খেয়াল করল। এখনও লোক সমাগম কম। আকাশ পরিষ্কার। যদিও একটু গুমোট ভাব আছে। দক্ষিণে নিম্নচাপ-টাপ হল না তো? তা হতে পারে। কাল সন্ধ্যা থেকেই বাতাস কেমন যেন একটু আটকানো আটকানো। কিন্তু সন্ধ্যার পর পরই আকাশে তারা উঠলে সে বুঝেছিল, দক্ষিণে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেনি। যদিও তখন নারকেল গাছের পাতায় পাতায় বাতাস খেলে যাচ্ছিল, এমনভাবে যেন নারকেল গাছের পাতাগুলো পরস্পরের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে শব্দ করছে। সে শব্দ শুনতে ভালো লাগে মোসলেমের। হাতে তখন তার ছোট্ট বাজারের থলি। সে নাগেরবাজার থেকে হেঁটে মুনিগঞ্জের দিকে রওনা দিয়েছে। আকাশে ঝুঁকে ঝকে তারা, অথচ গাছের পাতায় বাতাস। সেই বাতাস কোনওভাবেই নীচের মাটিতে আসছে না। রাহাতের মোড়ের পরে কোর্ট এলাকা তারপর পোস্টাপিস ও থানা ছাড়িয়ে মেইন রোড ধরে লাশকাটা ঘরের সামনে আসলে, তখন ডান দিকে নদীর কূল থেকে বাতাস তার গায়ে এসে লেগেছিল। এতটা পথ তাহলে বাতাস ছিল আকাশে। নাকি লাশকাটা ঘরের কাছেই বাতাস নীচু হয়ে এসেছে?

তবে যাই ঘটুক, ওই বাতাস গায়ে লাগামাত্র মোসলেম উদ্দিন একবার পাশের বাড়িটার সীমানায় পাশাপাশি লাগোয়া দুটো নারকেল গাছের পাতায় তাকায়। সে গাছের পাতা স্থির! অথচ তার গায়ে বাতাস। লাঠিটা ধীরে ঠুকে ঠুকে হাঁটে সে।

মুহূর্তে, অনেক দিন আগে একবার বাদোখালি গ্রামের ভিতর দিয়ে তার বড়ো বোনের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা মনে পড়ে মোসলেম উদ্দিনের। অল্প বয়েস। দলবেঁধে যাচ্ছিল তারা। হঠাৎ এমন বাতাসে পাশের নাকি কোনও এক শ্মশান থেকে একখানা সাদা কাপড় উড়ে যেতে দেখেছে তাদের একজন। ভর সন্ধ্যায়, ওই সাদা কাপড় নাকি ভূতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাকি সবাই দৌড়ে সামনের দিকে যায়। কিন্তু মোসলেমের হাতে ছোট্টো লাঠি, সে পা ল্যাংচে এগোয়। দেশ তখন কেবল ভাগ হয়েছে। এদিকের গ্রামগুলোয় একের পর এক হিন্দু বাড়ি। পাশেই শ্মশান। সেখান থেকে অমন এক খণ্ড কাপড় উড়তেই পারে। কিন্তু সেই কাপড় খণ্ডকে ভূতের কারবার ভেবে ভয়ে বাকি সবাই মোসলেমকে ফেলে ওভাবে এগিয়ে যাবে! গিয়েছিল। সে হাতের লাঠিসহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সাদা কাপড়খানার উড়ে যাওয়া দেখেছে। এমনকি তার মনে হয়েছিল, ওখানা শ্মশানে পড়ে থাকা কোনও বুড়ো মানুষের কাপড়, ওর সঙ্গে ভূতের কোনও সম্পর্ক নেই। আর এই যে তার জন্যে দাঁড়াল না কেউ, সবাই দৌড়ে গেল, সে বুঝল, এই শরীরে সারাটা জীবন মোসলেম একা। এমন তার আগেও মনে হয়েছে, ওই দিন আবার মনে হয়। তখন আশেপাশে নারকেল গাছগুলোর মাথায় ছিল অমন বাতাসের দোলা, কিন্তু ওই কাপড়খানা যখন উড়ে যাচ্ছিল তখন তার যে গায়ে বাতাস লেগেছিল, মোসলেমের মনে হয়েছে, বাতাস আসলেই নীচু হয়ে আসছে। কিন্তু যতই নীচু হয়ে আসুক, নারকেলের পাতার সেই জড়াজড়ি করা শব্দটা বহুদিন তার কান থেকে যায়নি।

গতকাল আবার লাশকাটা ঘরের সামনে সেই বাতাস তার গায়ে লাগলে মোসলেমের বহুদিনের আগের কথা মনে পড়ে। সঙ্গে কেউ নেই। সে একা। হাতে সম্বল লাঠিখানা। এখনও তাই। একটি পা ল্যাংচে মোসলেম চলে, তার এই লুলা পা-খানাই তার সাথি। বুকে সাহস থাকতে হবে, সে জেনেছিল। ওই সাদা কাপড়খানা দেখে সে উলটে পড়লে তো আর তার বাঁচন ছিল না। ওই মুহূর্তে মোসলেমের মনে হয়েছে, এই শহর, শহরের কংক্রিটের রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে সে, এখন তার সেদিনের কথা মনে পড়ছে কেন? সেই সাদা কাপড়, শ্মশান, দল বেঁধে বড়ো বোনের বাড়ি যাওয়া, সেখান থেকে সন্ধ্যা উৎরে ফিরে আসা।

পরদিন সকালে বোনটা মরেছিল। তার মানে ওই সাদা কাপড়খানা ছিল অমঙ্গলের। সঙ্গীরা কেউ যদিও সে-কথা বলেনি পরদিন। এখন মনেও নেই, কেন সে সেদিন বড়ো বোনের বাড়িতে গিয়েছিল? মা বলেছিল, পোয়াটেক মাইল দূরে ওই বাড়িতে গিয়ে বোনটারে দেখে আসতে। নাকি হা-ডু-ডু খেলা শেষ হলে, কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোসলেম বারইখালি গ্রামের সবার সঙ্গে সেদিকে রওনা দিয়েছিল। বিকেলে মায়ের বলা কথাটা মনে পড়েছিল সেই সন্ধ্যায়। সে সব কোনওকিছু আজ আর মনে নেই। তবে গতকাল সন্ধ্যায় তার সেই স্মৃতি জড়াজড়ি করে হামলে পড়লে, নাগেরবাজার থেকে পৌনে এক মাইল পথ হেঁটে প্রায় পুরানো বাজারের কাছে আসতে আসতে তার সত্যি মন খারাপ হয়। লাশকাটা ঘর, বোনটার স্মৃতি, আরও কত কী! সামনে মুনিগঞ্জ পর্যন্ত আরও প্রায় আধা মাইল পথ। মোসলেমকে বাসায় পৌঁছতে হবে। মালোপাড়ার কোল ঘেঁষে বাসা। সেখানে পৌঁছে আজকের মতন জিরোবে। একটা দিন গেল। আলেকজান প্যাকেটগুলো ঠিক। মতো করেছে কি না? ছেলেগুলো একটাও আর কাছে থাকে না। একজন বাড়ির জায়গা বেচে গেল সৌদি, এখন খোঁজ নেই। আর-এট্টা যশোরে কোথায় যেন মেকানিকের কাজ করে, মোসলেম মানুষকে বলে, সে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তার পরেরটা খুলনায় আজম খান কমার্স কলেজে পড়ে।

এসব প্রায় সকলের জানা কথা। কোর্ট চত্বরে মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গের বাকি ক্যানভাসাররা প্রায় সবাই তার সম্পর্কে জানে। কিন্তু কাল সন্ধ্যা থেকে তার কেন মনটা খারাপ, আজ কেন একবারও মেঘনিশ গাছ তলায় আসতে ইচ্ছে করছে না তার, তা তারা জানবে কোত্থেকে?

মোসলেম বার কাউন্সিলের থেকে কোর্টের বিল্ডিংয়ে যাবার সরু পথ ধরে এগিয়ে, চত্বরের সামনের ফাঁকা জায়গাটা দেখে আবার ফিরে এসে এসব ভাবে। চারদিকে মানুষে ভরে গেছে। চত্বরেও মানুষ। যদিও আজ হাটবার নয়, তাও শহরে এত লোক, নিশ্চয় কোনও বিশেষ মামলা আজ কোর্টে উঠবে। তা যাই উঠুক সেসব কোনওকিছুই জানার প্রয়োজন নেই তার। এই চত্বরে কাপড় ধোয়া পাউডারের ক্যানভাস করতে করতে জীবনটা পার করে দিল সে, কিন্তু কোনও দিনও কোনও কারণে কোর্টের বারান্দায় উঠেছে? না, কোনওদিন সেখানে ওঠার কোনও প্রয়োজন তার পড়েনি। আর তার মতন মানুষ, কোর্টে কোন কেস উঠল আর উঠল না, কোথায় কী হল আর হল না, তা জানার কোনও দরকার আছে? আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর দিয়ে দরকার কী? কিন্তু মোসলেম উদ্দিন যতই আদার ব্যাপারি হোক আর যাই হোক, তারও তো মন খারাপ হতে পারে? হয়তো হয়েছে আগেও। কাল সন্ধ্যা রাত্তির থেকে বড়ো বোনটার কথা মনে পড়েছে। তারপর নারকেল গাছের পাতার বাতাস, সেই সঙ্গে ওই বোনের কথা, এখন যদি একবার সে আবার গাছগুলোর আগায় তাকায়, তাতে অসুবিধা কী?

কিন্তু এই চিলতে সরু পথটুকু দিয়ে আকাশের কোনও অংশই দেখা যায় না। গাছের পাতাও না। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পিছনে এক সারিতে গোটা পাঁচেক নারকেল গাছ, মাঝারি আকারের গাছগুলোর কাণ্ড দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পাতা দোল খাচ্ছে কি না তা দেখা যায় না।

ওখান থেকে বামে এলে পিছনের চত্বর, বারে যাদের কাজ সেখানে তাদের আনাগোনা, ডানে নামলেই মেইন রোড। উলটো দিকে একটা স’-মিল। একটু এগোলে আর-একটা। পরেই নদী। স’-মি দুটোর মাঝখানে কয়েকটা ওষুধের দোকান। সামনে এগোলে বাঁয়ে ডাক বাংলো তারপর বাগেরহাট স্কুলের দিক থেকে আসা রাস্তা ফেলে পোস্টাপিস। আবার, পিছনে একটু গেলেই লঞ্চঘাট বায়ে, ডানে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠ আর উলটো দিকে ডিসি অফিস। মোসলেম উদ্দিন ওই চিলতে ছাউনি দেয়া পথের প্রায় শেষ মাথার পরে ডানে মেইন রোডে আসে। স’-মিল দুটো ছাড়িয়ে আলমের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। ভিতরে ভিড়, বাইরেও মানুষ মন্দ না। আইজকে সারা শহরের হলটা কী? শহরে আজ এত মানুষ কেন? এত মানুষ দেখলে এখন আর মোসলেম চোখের কোনা খুশিতে ঝিলিক মারে না। আগে মারত। ভাবত, এত মানুষ! আলেকজান মাত্তর কয় প্যাকেট গুড়া সাবান বানাইচে, তাতে কুলোবে নানে। সব তার ক্যানভাসের গুণে এক ধাক্কায় বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু পরে বুঝেছে, খদ্দের-কাস্টমারও ওই আকাশের মতন, যত গর্জে কোনও কালেই তত বর্ষে না। চত্বরে মানুষ যতই থাক প্যাকেট তার ফুরবে না।

তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে ওসব কথা ভেবে এখন আর কোনও লাভ নেই। এখনও কেউ ক্যানভাস শুরুও করেনি, প্রায়ই দিন মোসলেম উদ্দিনই সাধারণত সবার আগে ক্যানভাস শুরু করে। তারপর অন্যরা। দুপুর গড়িয়ে যেতে যেতে মোসলেম কোনও কোনওদিন দ্বিতীয় বার। তার সঙ্গে তো কোনও টক্কর নেই কারও। যেমন, কোনও টক্কর নেই বইঅলা বারিক বুড়োর সঙ্গে কারও। সে ওই বট গাছটার নীচে নীলচে পলিথিনের ছাউনি আর মাটিতে একখানা বড়োসড়ো ছালার চট পেতে বসে থাকবে তো থাকবে।

মোসলেম উদ্দিন যেদিন দ্বিতীয় বার ক্যানভাস শুরু করে, তখন হয়তো ট্রেজারির দিকে ফাঁকা জায়গায় তিন ফলকের খেলাসহ চলে ছোটোখাটো সার্কাসের আসর অথবা বানর খেলা। ঝিবুতপালা অর্থাৎ ছোটো ছেলেরাই সেখানে বেশি যায়। আবার উলটোও হয়, সে তখন ট্রেজারির দিকে কুলগাছের কাছে তার ক্যানভাস শুরু করেছে আর কোর্ট বিল্ডিংয়ের প্রায় সামনে তখন বড়োসড়ো মজমা মিলিয়েছে কেউ। ধ্বজভঙ্গের ওষুধ কিংবা মহাশংকর তেল কিংবা শক্তিবর্ধক গাছ-গাছরা মাথার খুলি এইসমস্তর গুণাগুণ বর্ণনা করছে ওপারের আকিল সিকদার।

আলমকে এক কাপ চা দিতে বলে, লাঠিখানা চায়ের দোকানের বাইরের দেয়ালে রেখে, মোসলেম দেওয়াল ধরে দাঁড়ায়। এমনিতে দাঁড়াতে পারে সে, কিন্তু ডান হাঁটুতে ভর রেখে অনেকখানিক নীচু হয়ে যেতে হয়। এখন সেভাবে দাঁড়ানো যাবে না। মাজায় কি তার একেবারে বল নেই। একখানা পা লুলা কিন্তু এই কোমরের জোরে লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে প্রায় খাড়া হয়ে হেঁটেই কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন। কিন্তু এখন এত মানুষের ভিতরে দেয়াল ধরে এক পায়ে একটু খাড়া হয়ে না দাঁড়ালে চলে?

চা খেতে খেতে মোসলেম চারদিকে তাকায়। এটা অবশ্য তার অনেকদিনের অভ্যেস। চা খাওয়ার সময়, যদি চায়ের দোকানের ভিতরে না-ঢোকে তাহলে চারধারে গিজগিজে মানুষের মুখ দেখতে তার ভালো লাগে। এখানে কাটিয়ে দিল এতটা কাল, স্বাধীনতারও আগে প্রায় বছর পনেরো আর এই দিকেও তো সতের বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। দিন যে কীভাবে যায়। আজকাল সকালে নদীতে গোসল করে, ছোটো আয়নাখানার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোসলেম দেখতে পায় সামনে ও মাঝখানে, দুই পাশে কত চুল যে পাতলা হয়ে গেছে। এখন সামনে চুল আছে তবে পাতলা, আঁচড়ালে প্রায় মাথার চাড়ার সঙ্গে শুয়ে থাকে। তা দেখতে দেখতে মোসলেমের মনে হয়, আর কত দিন তো কম হল না। এই গলার উপর দিয়ে পেটে ভাত। এই গলা চালায় জগৎ-সংসার। শরীরও কম ধকল সইল না। এখনও যে মাথায় চুল আছে এই বেশি।

সেকথা মনে করে মোসলেম চায়ের ছোট্ট গ্লাস সামনের চা বানানোর টেবিলের উপর রেখে, আলত করে মাথার চুলে হাত ঘষে। পকেটের ছোটো ডায়েরির ভিতর থেকে টাকা বের করে। আবার সে টাকা ডায়েরির ভিতরেই রেখে দেয়। জামার পাশের পকেটে হাত দিয়ে পঞ্চাশ পয়সার একটা রেজগি বের করে চায়ের ছোট্টো গেলাসটার পাশে রাখে। তারপর আবার মাথায় হাত ডলে। এটাও মোসলেমের বহুদিনের অভ্যাস। এই আলত হাত ঘষার কায়দাটা অন্ধকারে দেখলেও, এটা যে মোসলেম তা যে চেনে সে সনাক্ত করতে পারবে। দেয়াল থেকে লাঠি নেওয়ার আগে বুক পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ায়। তারপর রাস্তা পার হয়ে বার কাউন্সিলের সামনে আসে।

এ সময়, এই সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ মোসলেমের মনে হয়, এত রোদ অনেক দিনের ভিতরে সকালবেলা ওঠেনি। রোদ উঠুক। রোদ উঠলে দিন ভালো। সঙ্গে সঙ্গে এও ভাবে, যদি এইভাবে রোদ চেতে, তাহলে চত্বরে কোনও মানুষ থাকবে? যদিও মোসলেম সকালের খেপেই ক্যানভাস শুরু করবে মেহগনি গাছটার কাছে। গাছটা চত্বরের দক্ষিণ কোণে। মেইন রোড ঘেঁষে একটা বড়ো মেঘনিশ গাছ আছে, সে গাছের ছায়া প্রায় সারাটা চত্বর জুড়ে। কিন্তু এমন রোদ হলে দুপুরের পর পর আর দ্বিতীয়বার আর ক্যানভাস করা হবে না।

বার কাউন্সিলের সরু পথের পর বিল্ডিঙের পিছনের চত্বর হয়ে সোজা রেজিস্ট্রি অফিসের কোনায় এসে মোসলেম একটা বিড়ি জ্বালায়। পাশের ট্রাফিক ব্যারাকের সামনে সার্জেন্ট মোটর সাইকেল স্টার্ট দিচ্ছে। মোসলেম বিড়িটা তালুতে গোঁজে। সার্জেন্ট ক্লাবের সামনে গতি কমিয়ে জেলখানার দিকে গেলে সে শোনে, দুই ট্রাফিক পুলিশ প্যান্টে জামা ইন করতে করতে সার্জেন্টকে নিয়ে বেশ রসালো কথা বলছে। তা ওই আলতাফ সার্জেন্টকে নিয়ে শহরে কিছু রসালো কথা প্রচলিত আছে বইকি! মোসলেম উদ্দিনের মতন প্রায় কোনও খোঁজ খবর না-রাখা মানুষের কানে যখন আসে, তখন সে সব কথা কিছুটা হলেও সত্যি। শহরের কোন বাড়িতে তার যাতায়াত। শহরের কে কে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার পরে, নতুন করে তাদের সঙ্গে খায়খাতির শুরু করেছে এই সার্জেন্ট, সে সব সংবাদের কিছু কিছু তারও কানে আসে। কার মেয়ে কার সঙ্গে চলে গিয়েছিল, কাটাখালি না কোথা থেকে মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে এই সার্জেন্ট উদ্ধার করে এনেছে। তারপর থেকে সেই মেয়েকেই কখনও কখনও আলতাফের মোটর সাইকেলের পিছনে ঘুরতে দেখা গেছে, সে সব খবর যতই উড়ো হোক আর ঠিকই হোক মোসলেমের কানে আসে। এখন এই দুই ট্রাফিক আর নতুন কী বলছে। মোসলেম বরং বিড়বিড় করতে করতে কোর্ট বিল্ডিং আর ট্রেজারির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে কোর্ট চত্বরের দিকে যায়, সুযোগ পালি তোমরাও কম পারো না!

মোসলেম উদ্দিনের বিড়ি টানা শেষ। চা খাওয়ার পর পর একটা বিড়ি জ্বালানো ও আয়েস করে টানার এই অভ্যেস তার দীর্ঘদিনের। আজকাল বিড়ি টানা কমেছে, কিন্তু এখনও সকালে মজমা মিলানোর আগে এক কাপ চা খেয়ে তারপর একটা বিড়ি টেনে অতি ধীর পায়ে কোর্ট চত্বরের মেহগনি তলার দিকে তার আগমন যেন কোনও প্রবীণ অভিনেতার মঞ্চে সদর্প আবির্ভাব। জীবনে। যাত্রাপালা একেবারে কম দেখেনি সে। মুনিগঞ্জে নদীর ওপর চরগাঁয়ে যাত্রা আগে হত, এখনও হয়, তবে আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। কেউ জানতে চাইলে, মোসলেম এক নিশ্বাসে অনেকগুলো পালার নাম বলতেও পারবে। জীবনে ওই সাধ কোনওদিন পূরণ হবে না, হলও না, হওয়ার নয়। এমন লুলো মানুষকে স্টেজে উঠাবে কোন অধিকারী? তবু একবার লুলো এক ভিখারির ভূমিকায় সে গ্রামের অ্যামেচার যাত্রা পালায় অভিনয় করেছিল।

প্রায় সেই ভঙ্গিতে, এখন আর লুলো ভিখিরি নয়, কিন্তু যেন মঞ্চে উঠছে এমন ভঙ্গিতে মোসলেম উদ্দিন কোর্ট চত্বরের দক্ষিণে, কোর্ট বিল্ডিং আর ডিসি অফিসের মাঝখান দিয়ে যাওয়া রাস্তায় পাশের মেহগনি গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। একটু হাঁফ ছাড়ে। চারদিকে দেখে। যা রোদ চেতেছে! যদিও চত্বরে পুবের বড় মেগনিশ গাছটার ছায়া। পাশের আকৃতিতে কিছুটা ছোটো মেগনিশ গাছের নীচে বই সাজিয়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বারিক বুড়ো। বুড়ো কেন? মোসলেম সত্যি জানে না। বারিকের বয়েস তার চেয়ে কত আর বেশি হবে, কিন্তু ওই আজগর কি সুকুমার সবাই তাকে পিছনে বারিক বুড়ো বলেই ডাকে। সামনে বলে বারিকদা। এমনকি আজগরের সঙ্গে যে রঙ্গ করতে করতে লঞ্চঘাটের দিকে ভাতের হোটেলে যায়, কী যেন নাম, মোসলেম তার নাম হাতড়ায়। মনেও পড়ে, জরিনা। জরিনাও যখন বারিকের সামনে এসে বসে, ডাকে বইঅলা বারিকদাদা। কিন্তু পিছনে ঠিকই বারিক বুড়ো। তা বারিকের বড়োসড়ো পেটের সাইজ আর চুলের রঙ মিলিয়ে একটু বুড়োই লাগে। আর কী ভাব! চোখ দুটো প্রায় খোলেই না। কিন্তু দেখে নাকি সবই। একেবারে পেট ফুলিয়ে বসে থাকে, কোনওদিকে চাওয়া চাইয়ি নেই। সুকুমার বলে, ‘সাক্ষাৎ ভোলানাথ শিব ঠাকুর। জরিনা তাই শুনে একদিন বলেছিল, ‘একদিন সামনে ওয়ার দুম্নারে আইনে দিলি পারো! তহোন দেইহেনে নড়বেনে। বেটা মানুষ, মাইয়ে মানুষ পালি সব জায়গা নইড়ে ওঠে!’ অবশ্য মোসলেম তখন তার গাম্ভীর্যপূর্ণভাব ঠিকই রাখে, এসব মেয়েকে বেশি পাত্তা দিতে হয় না। সোজা বাংলায় বাজারি মাইয়ে। চান্স পালিই কোলে উঠে বসপে। পুরুষ মানুষ নিয়ে কোনও অস্বস্তি নেই, সে আল দুধ গজাতি গজাতি ভাইঙে গেছে। ফলে, মোসলেমকে বলতে হয়, ‘বাদ দে, বাড়িঘর নেই। কোথায় কোথায় থাহে। বিয়ে করল না কোনওদিন। ছওয়াল মাইয়ের প্রশ্ন নেই। এখন তারে তুই আবার বিয়ে দিতিচিস!’

কথা এগোয়। জরিনা বলে, ‘ও কাকা, কইয়ে দেহেন, কলিই বিয়ে বসপে।‘

‘তুই কইচিস?’

‘চান্স পালি তো? তয় সুকুমারদা কইল—’

‘কী কয়?’

‘হাসে। তয়, আজগরদার সাতে খায়খাতির ভালো।‘

‘আজগরের সাতে তো তোরও খায়খাতির ভালো, তুই করিচিস আজগররে বিয়ে?’

‘হয়, খাইয়ে কাজ নেই। ওই চেটের বান্দরচোদা পদের সাতে বিয়েয় বসপানি! আপনি আর মানুষ পালেন না?’

‘কেন, তুই থাহিস না আজগরের সাতে?’

‘কইচে কেডা আপনারে? ওই সুকুমারদা?’

সুকুমার এখানে আছে। তখন বিকেল। সবার জিরানোর সময়। কোর্ট চত্বরে একটু একটু করে স্থবিরতা আসছে। অথবা, একটি কর্মক্লান্ত দিন এই কিছুক্ষণের ভিতরে শেষ হবে। ঘেরা দেয়া ডিসি অফিসের পুবদিকে মেইন রোড লাগোয়া টাইপিস্টদের বড়ো একচালা ঘরের সামনে বসে এই আলাপ। কিছুক্ষণ পরই, সন্ধ্যা লাগতেই এ আসর ভাঙবে। সুকুমার তার বাক্স-পোটলা গুছিয়ে আশেপাশে গিয়েছিল, এখন আবার এল। তখন মোসলেম উদ্দিন বলছে, ‘সুকুমারের কতি হবে কী জন্যি, আমরা দেইহে কিছু বুঝি না? চোখ নেই আমাগে?’

সুকুমার জানতে চায়, ‘কী হয়েছে?’

মোসলেম উদ্দিন বলে, ‘হবে আর কী? এ সুকুমার, ক’দেহি, জরিনা থাহে না ওই আজগরের সাথে?’

জরিনা সুকুমারের দিকে তাকায়, সুকুমার জরিনার দিকে। অবশ্য জরিনার চোখের তারায় কোনও বাড়তি কাপন দেখা গেল না। সুকুমার যা ইচ্ছে তাই বলুক। যদি মোসলেমের কথায় সায়ও দেয়, তাতে তার কিছুই আসে যায় না। কিন্তু জরিনার কেন যেন মনে হয়, সুকুমার হয়তো কোনও কারণে সেকথা বলবে না। কিন্তু জরিনার ঈষৎ সলজ্জ মুখের দিকে তাকিয়ে মোসলেম উদ্দিন যা বলেছিল যেন প্রায় তাই বলল সুকুমার, ‘ওই আর কি মোসলেমদা, বোঝেন তো সবই!’

‘তালি, এ ছেমড়ি, তুই যে কলি ওই আজগররে তুই বিয়ে করবি না!’

‘একসাতে থাহি তাতে হইচে কী সেই জন্যি বান্দর নাচানোরে বিয়ে করতি হবে?’

‘কী ফাও কথা কইস?’ মোসলেমের আপাত মার্জিত রুচিতে একটু খোঁচা লাগে। এসব মেয়ের সঙ্গে এই জন্যেই তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কথা নেই বার্তা নেই, কথায় কথায় মুখ খারাপ! কোন সময় কী কয় তারও যেন কোনও ঠিক নেই। আজ আছে আজগরের সাথে, কাল যদি সুকুমারের সাথে দেখে রাত্তিরে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পরশু যদি সাপের খেলা আর গাছগাছড়া বেচা ইব্রাহিম শেখের সঙ্গে লঞ্চঘাটের কোনও হোটেলে ঘুমায় তাতেও-বা কী?

জরিনার এ কথায় অন্য সময় হলে মোসলেম উদ্দিনের মেজাজ খিচে যেত। সুকুমার অথবা অন্য যে কেউ কাছে থাকলে বলত, ‘মার এই ছেমড়িরে কানপাটি জড়াইয়ে ঠাটাইয়ে একখান চড়।‘ এখন তা না বলার কারণ অবশ্য আজগর। আজগরের কাছে তার দরকার। আজগর বানর দুটো নিয়ে নদীর পাড়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরলে মোসলেম তার প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বাজারের দিকে যাবে। আলেকজান বলেছিল পাউডার বানানোর জিনিসপত্রে টান পড়েছে। সেগুলো কিনে কিছু কাঁচা বাজার-সদাইও করতে হবে। প্রতিদিন প্রায় এক কাজ। সেকথা ভাবতে মোসলেমের আর ভালো লাগে না। মনে হয়, এ জীবন এই রকম টানতে টানতে যেতে হবে। সুকুমারের মতন যদি গানের গলা থাকত, তাহলে গলা ছেড়ে দিয়ে গাইতে পারত, ‘এই জীবন তো একদিন চলতে চলতেই থেমে যাবে। কেউ তো জানে না, শেষ কোথায় হবে!’ সত্যি এই দুনিয়াদারির শেষই-বা কোথায়, রোজ কেয়ামতের দিনই-বা কেমন? তা যদি জানা যেত। কিন্তু সেকথা জেনে মোসলেমের লাভটা কী? সেদিন পর্যন্ত এই দুনিয়ায় আছে নাকি সে? আলেকজানকে সঙ্গে নিয়ে এই জীবনটাকে যদি কোনওমতো বাকি কয়টা কাটিয়ে যেতে পারে, তাতেই তার চলে।

মেহগনি গাছের নীচে পেটলার পাশে বসে মোসলেম উদ্দিন আবার চারদিকে তাকাল। বারিকের বই লাছা শেষ। এবার বারিক চুপচাপ মেঘনিশ গাছটায় হেলান দিয়ে বসে থাকবে। মোসলেম একটু সামনে এগিয়ে বোচকটা রাখল। দিন কয়েক আগে একটা অল্প বয়েসি ছেলে এসেছিল। মাথাভরতি চুল। দাড়ি গোঁফ তেমন গজায়নি, গজাবে গজাবে। দারুণ সুন্দর গান গায়। লালন ফকিরের গান অথবা ভাওয়াইয়া কি ভাটিয়ালি। সুকুমারের সঙ্গে ট্রেনে চেপে এসেছে। সারা গায়ে মশার কামড়ের দাগ। কিন্তু সুকুমার তার খেলা দেখানোর আগে তাকে পাশের ওই বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে মেঘনিশ গাছের তলায় গান গাইতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আহা, কী গায় সে ছেলে! মোসলেম তখন বারিকের দোকানের পাশে দাঁড়ানো। মুখে মাথায় কড়া রোদ। তাতে কী? ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ধরতেই ভিড়। তারপর গাইল একখানা সিনেমার গান, ‘তুমি কি দেখেছো কভু, জীবনের পরাজয়’। একেবারে যেন আবদুল জব্বার। ছেলেটির নাম মনে করার চেষ্টা করে মোসলেম, কোনওভাবেই মনে পড়ে না। মাত্র তো ওই কয়দিনের দেখা, তাও হয়ে গেল বছর কয়েক, সেবার এরশাদ এসেছিল মহকুমা থেকে জেলা করতে। তখন এটা ছিল এসডিও অফিস। মোসলেম বছরের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। সে হিসেব মেলেও, কিন্তু ছেলেটির নাম কোনওভাবেই তার মনে আসে না। তাহলে অমন গান গাওয়া, কয়েক দিনের জন্যে দেখা সেই ছেলেটির নাম সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে বসে আছে। আজকাল এমন হয়, নিশ্চয়ই বয়স হচ্ছে।

মোসলেম ভাবে, এখন রোদ চড়ার আগে সেই ছেলেটিকে যদি একটু সামনে এগিয়ে, গাছের এই ছায়া আর রোদ্দুর মেলানো চত্বরে একখানা গান গাইতে দাঁড় করিয়ে দেয়া যেত, তাহলে তাকে আর কষ্ট করে মজমা মেলাতে হত না। রোদ তাপ আলো ছায়া গাছের পাতায় রোদের ঝিলিক, সকল কিছুর ভিতরে মোসলেম এখন কল্পনায় সেই ছেলেটিকে চত্বরে গান গাইতে দেখে। অথবা, সেই কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ক্যানভাসের প্রস্তুতি নেয়। যেন, ছেলেটি ওই সুর ধরছে, এই যে গাইছে : এ মালিকে জাহান, আমি বড়ো অসহায়, আজ দু-ফোঁটা পানি তরে বুক ফেটে যায়। কোন ছবির গান? মোসলেমের মনে নেই। ফকির মজনু শাহ? হতে পারে। তবে মনে আছে লাইট হল সিনেমায় সে আর আলেকজান ইভিনিং শোতে ছবিটা দেখেছিল। আজ আর সেকথা মনে করতে ইচ্ছে করছে না। ওই ছেলেটার মুখ মনে পড়ছে না। আজগর অথবা বারিক নিশ্চয়ই নামটা মনে করতে পারবে। কোনও কিছু স্মরণ না-এলে সে এই বয়সেও একবার একবার মাথা চুলকায়। তা করল, তারপর হাত বোলাল মুখের সঙ্গে মিশিয়ে ছাঁটা দাড়িতে।

এরপর কয়েক কদম সামনে এগিয়ে মোসলেম পোটলাটা রাখল। মনে মনে বহুদিন আগে এখানে এক ক্যানভাসারের বলা সেই কথা কটা আওড়াল, কিন্তু শব্দ করে বলল না। সে আওড়া, আজ এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এইখানে এই প্রান্তরে শুভ্রতার খোঁজে আপনাদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি। এটুকুই বলেই সেই লোক এরপর প্রায় বরিশালের উচ্চারণে কথা বলতে শুরু করত। দাঁতের মাজন বিক্রেতা ছিল লোকটা। মোসলেম আজও জানে না, কেন শুরুতে সে অমন করে কথা বলত। মোসলেম জানত, লোকটার বাড়ি মোড়েলগঞ্জ; ওখানকার লোকজন প্রায় বরিশালের ধরনে। কথা বলে। যাই বলুক, লোকটির শুরুতে বলা ওই বইয়ের ভাষায় কথাগুলো তার ভালো লেগেছিল। তাই আজও মনে আছে। নিজেও পরে এক-আধবার চেষ্টা করেছে ওভাবে শুরুতে বলতে, কিন্তু পারেনি। তাছাড়া পরে ভেবেছে, ওভাবে কথা বলে তার লাভ কী? কিন্তু লাভ হোক কি লোকসান, যাই ঘটুক, ওই কথাগুলো এখনও কখনও কখনও আসর শুরু করার আগে তার মনে পড়ে। এইমাত্র আর একবার মনে পড়ল। সেই লোকটার নামও সে ভুলে গেছে, নিশ্চয়ই বারিকের মনে আছে, ওর সঙ্গে বেশ খাতির ছিল। বারিকের কাছ থেকে বই নিত। পড়া হয়ে গেলে একদিন দুইদিন বাদে ফেরত দিয়ে দিত। বারিক বসেছে বই বেচার জন্যে, কিন্তু ওই লোকটিকে একখানা দুইখানা বই পড়তে দিতে বারিকের কখনও আপত্তি ছিল না।

পোটলাটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে কি মানুষ জমে? তখন কিছুক্ষণ বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয় একলা কোন প্রান্তরে মানুষজনের অপেক্ষায় বসে আছে। অথচ দেখো চারধারে এত মানুষ। ওই যে বয়েসি উকিলরা যাচ্ছে। মোসলেম তাদের কারও কারও নামও জানে। এমনকি শহরে কার কোথায় বাড়িঘর তাও জানা আছে তার। তাদের পিছন পিছন মহুরিরা। ওইদিকে কোর্টের লোকজনও আছে। জজ সাহেবের জন্যে অপেক্ষা। আজ কোন কোন কেসের তারিখ সেই অনুযায়ী মানুষজন এসেছে। জজ সাহেব খাস কামরায় নাকি এজলাসে, তাও এখান থেকে বোঝা যায়। আর সে এই একটা পোটলা নিয়ে এখন প্রায় একাকী বসে আছে। বারিক একইভাবে চোখ বন্ধ করে বসে। বারিকের দোকানের সামনে কেউ নেই। অথচ চত্বরে কত মানুষ, একজন মানুষ কি বারিকের সামনে। থাকতে পারত না। মোসলেমের মনে হয়, একবার ডাকবে নাকি আজগরকে। বান্দর নাচানোর ডুগডুগিটা বাজিয়ে মুখে যে ‘আউ-আউ-আউ’ করে, তাতে নিশ্চয়ই বেশ বড়োসড়ো একটা জমায়েত হয়ে যেত। কিন্তু আজগরকে কোথায় পায়। ট্রেজারির কাঁটাতার ঘেরা দেয়া সীমানার বাইরে কুলগাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ আগে বানর দুটো বেঁধে রেখে কোথায় সে যেন গেছে। যাবে আর কই? নিশ্চয়ই ওই দিকের টাইপিস্টের ঘরের পাশে খাড়া সবেদা গাছটার নীচে জরিনার সাথে বসে আছে। না না, তাও-বা কী করে হয়, এখন কোর্টের এই ভরার সময়, টাইপিস্টদের ঘরের দিকে লোকজন আসে যায়, এখন ওই গাছের নীচে জরিনার সঙ্গে রঙ্গ করার সুযোগ পাবে? মোসলেম সেদিকে দেখতে মাথা ঘোরায়। না, বারিক বইয়ের দোকানের উপরে ছাউনি দিয়েছে, ফলে ওই দিকে নজর এখান থেকে আটকে যাচ্ছে।

মোসলেম আর দেরি করল না। জানে কিছুক্ষণের ভিতর ওই পাশে আসর বসাবে ইব্রাহিম শেখ। আর নয় সুকুমারও আসতে পারে। তার এই জায়গায় বানর নাচাতে আজগরেরও আসার সময় হয়ে গেল। ফলে, তাকে শুরু করতে হয়। মোসলেম উদ্দিন, ‘আসেন আসেন আসেন-’ বলে একটু গলা তুলে হাঁক দিল। ছোট্ট ডুগডুগিটা বাজাল। যদিও এমনিতে মোসলেম কখনওই এইভাবে গলা তোলে না। তার আসর আসলেই একটু নীচু গলায়। কিছুক্ষণ পরেই তাই হবে, মানুষ জমলে মোসলেমের গলাটা নীচু হয়ে আসবে। কিন্তু জমার আগে তো তাতে হাঁক দিতেই হবে। তাছাড়া সে জানে, সে কী বেচে। সে তো খেলা দেখায় না। গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ বর্ণনা করে না। ধ্বজভঙ্গ একশিরা স্বপ্ন দোষের তাবিজ দেয় না। পির খানজাহানের দরগার মাদুলি বিক্রি করে না। দড়ি কি ছুরির খেলা দেখায় না। সাপে কাটলে কীভাবে মানুষকে বাঁচাতে হবে তাও শেখায় না। ফলে, এসে বসলেই তাকে ঘিরে মানুষ আসবে তাই-বা সে ভাবে কী করে। মোসলেমের কথার এমন কী গুণ যে নীচু স্বরে কথা আর টপাটপ তার সব পাউডারের প্যাকেট বিক্রি হয়ে যাবে?

কিন্তু মোসলেম জানুক কি না জানুক, তার কথায় কিছু গুণ তো আছেই। আর পাঁচ কি দশ জন ক্যানভাসারের মতন সে নিশ্চয়ই না। মোসলেম হয়তো তা জানে না, কিন্তু অন্য মানুষ তো তাকেই দেখেই বোঝে, মোসলেমের সঙ্গে তাদের তফাক্টা কোথায়। আছে এই কোর্ট চত্বরে এইরকম সাদা ইস্তিরি করা কাপড় পরা আর কোনও মানুষ, যার গায়ে জামাটা দেখলেই মনে হবে যেন ভদ্দরলোক! কেউ যদি না বলে, তাহলে বোঝার কোনও উপায় আছে, এই লোকটি কোর্টের সামনের এক ক্যানভাসার।

মোসলেম আবার ডাক দিল। না বলা ভালো, একটু গলা তুলে হাঁক দিল। আজ তার কী হয়েছে কে জানে। সেই নাম মনে না-থাকা লোকটির মতন গলায় বলল, ‘আসেন এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, কিছু শুভ্রতার খোঁজে এইখানে এই কোর্ট চত্বরে। আমার কাছে।’

মোসলেমের সামনে, ডাইনে-বামে একজন দুইজন দাঁড়িয়ে গেল। মোসলেম জানে এই বৃত্ত কী করে বড়ো করতে হয়!

০২. আদালত চত্বরে

০৩. সন্ধ্যা উৎরে যাওয়া রাতে

অথচ, সন্ধ্যা উৎরে যাওয়া রাতে, এখন যদি কেউ আজগর আর সুকুমারকে দেখে তাহলে কোনওভাবে সে ভাবতেই পারবে না, দুপুরে এই দুইজনের কী কাজিয়াটাই না হয়েছে!

লঞ্চঘাট ছাড়িয়ে নদীর কূল ধরে কাঁচা রাস্তায় বাজারের দিকে এগিয়ে গেলে, একটা দোকানের পাশে আজগরের ঝুপড়ি। যদিও আজগর বলে বাসা, জরিনা বলে খোঁয়াড় আর মানুষ বলে খুপড়ি। তা যে যাই বলুকু, বানর নাচিয়ে আজগর যা আয় রোজগার করে, এরচেয়ে ভালো একটু মাথা গোঁজার ঠাই সে কী করে জোটাবে। বললেই হল? জীবনটা কোর্টের চত্বরে চত্বরে, লঞ্চঘাটে, রেল স্টেশনে বান্দরে পাছায় লাঠির কুরুত দিয়ে কাটিয়ে দিল। এই জীবনে কোনওদিনও চালের তলায় মাথা দিল না, মেয়েমানুষ প্রায় গায়ের কাছে ঘেঁষতে দিল না। দিলেও দুই দিন বাদে নাকি কান্নার সুর তুলে যে ঘরের চালের নীচে মাথা দিতে চাবে, এই কাজে আজগরের প্রবল আপত্তি। এমনকি এই যে জরিনা তার সঙ্গে আছে, আছে থাকুক, কাল যদি গায়ের রং কালো, দাঁত নেই, দলা দেয়া চুল, বানরনাচানো আজগরকে তার ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে মন চায়, চলে যাক। যেখানে খুশি, যেদিকে দুচোখ যায়, যাক। আজগর বাধা দেবে না।

জরিনা ওই কোর্ট চত্বর থেকে একদিন রঙ্গ করতে করতে আজগরের সঙ্গেই সন্ধ্যার পরে থাকবে, দুঃখে প্রাণ কান্দে–এইসমস্ত বলে ওই ঝুপড়ির সামনে এলে আজগর বলেছিল, আচো থাহো। যদি কোনওদিন চইলগা যাইতে মন চায় চইলগা যাবা। কিন্তু কয়দিন থাইয়া ওই ঘর করার বাসনা চোদাবা না।

জরিনাও কি কম যায়। প্রায় লাফ দিয়ে উঠেছিল, কথার কী ছিরি! জীবনে পুরুষ মানষির মুহি এইরাম কতা শুনি নেই। তোমার কাছে আইচে কেডা ঘর করার বাসনা চোদাতি?

হু, হইচে। আইচো তো পিছন পিছান। এমনি মানষির ধারে কও বান্দর নাচাইয়ে খাই নিজের পেট চলে না। আইসকা হাজির হইচো!

আইচি তার হইচে কী, থাকতি দিলি থাকলাম। না দিলি চইলে যাব।

হয় যাইও, যেহানদে আইচো সেইহানে—

কোহানদে আইচি?

আজগরের যেখান দিয়ে আইচো এই কথার ইঙ্গিত জরিনা সহসাই ধরতে পারে। এই যেখান মানে কোন কোন জায়গা তা তার জানা আছে। কিন্তু তখন সে তা জানতে চায়নি। জানতে চাওয়া অপ্রয়োজনীয়। এই যে ওই কথা বলে আজগর বিড়বিড় করল, হয়তো সেই জায়গাগুলোর নামও বলেছে, এর কোনওটাই এখন জরিনার শোনার প্রয়োজন নেই। সে জানতে চায় না। শুধু বলল, থাকতিচে কেডা? ভালো না লাগলি তোমার সাতে কেন রাজপ্রসাদেও মানষি বেশিদিন থাকতি পারে না। থাকপো না, জ্বালাব না, যেরম আইচি এইরম একদিন চইলে যাব। এই দুনিয়ায় থাহার জায়গা আর মানষির কোনও অভাব নেই।

হয়, বারো ঘাট মাড়ানো মানষির থাহার জায়গার কোনওদিন অভাব হইচে?

ফাও কতা কইয়ে না। নিজে কয় ঘাট মাড়ানো?

এসব কথা এমনই। চলতেই থাকে। এ কখনও যেন শেষ হয় না। আগেও হয়নি, এখনও হবে। কিন্তু সেদিন জরিনা আজগরের ওই ছোট্ট ঘরখানির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ওই কথা। বাদর দুটোকে পাশে একটা একচালা টিনের ছাউনির নীচে রেখে, সেখানে শিকলে তালা আটকাতে আটকাতে আরও কথা হয়। কিন্তু আজগরের মতন মানুষেরও মনে ধরেছিল জরিনার ওই একটা কথাই, ভালো না লাগলি মানুষ রাজবাড়িতেও বেশি দিন থাকতি পারে না।

বাঁদর বেঁধে এবার ঝুপড়ির দরজা খুলছে আজগর। সেখানে তালা দেয় না। তালা দেয়ার মতন কিছু নেই। তার সম্পদ বলতে ওই বানর। নিজের ঝুপড়ি ঘরে আর আছেটা কী। একটা লম্ফ আছে, তাও বেশির ভাগ রাতে জ্বালানো লাগে না। একপাশে একখানা লুঙ্গি, প্রায় বোতাম ছাড়া আর একটা জামা। আর, আর প্রায় কিছুই নেই। সেই ঘরের দরোজার সামনের ঠেঙাটা সাটাতে সরাতে আজগর বলেছিল, তাইলে আমারে ভালো লাগে?

অন্ধকার, জরিনার মুখোনা দেয়া যায় না। সেখানে কোনও লজ্জার রেখা পড়ল কি না, তাও বোঝা গেল না। তবে জরিনা আজগরের প্রশ্নের উত্তরে বলে, যা একবার কইচি তো কইচি আর কওয়ার কিছু নেই!

এই কথা কয়দিন আগের? এমন আম পাকা গরমের বেশি আগে তো নয়। তবে, কোর্ট চত্বরের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর তখন ফুল! সেই চত্তির মাসে, আজগরের সঙ্গে জরিনার ওই কথা হয়েছিল! এখনও গরম আছে, জল কাদা বৃষ্টির দিন আসেনি, চৈতা গরমের ভাব এখনও টের পাওয়া যায়।

তবে, সুকুমার আর ঝিলিকের এখানে আসার কারণও জরিনা। এখন এই চারজন আজগরের ওই ঝুপড়ির কাছে, নদীর পাড়ের মাটির রাস্তার উপর বসে আছে, সবটাই জরিনার কারণে। আজগর জরিনার কায়দা-কৌশল কিছুই বোঝে না। এমনকি জানেও না যে, এই যে মেয়েটা ঝিলিক তার সঙ্গে সুকুমারের সম্পর্ক কী। জরিনা তাকে চেনে কীভাবে। সহজ একটা সমাধান অবশ্য আছে, ভিতরে ভিতরে সেই হিসেব করেও রেখেছে, যেমন বলেছিল একদিন স্পষ্ট করে না হলেও প্রায় বিড়বিড়িয়ে। কোন জায়গাদা না কোন জায়গাদা। এই কোন জায়গা আজগর চেনে। এই শহরে ওই জায়গাটা লাইট হলের পিছনে অথবা রেল স্টেশনের কাছ থেকে ধরলে, উত্তর দিকের পুরনো কাপড়ের কলের পাশের পচা পুকুর ফেলে। তারপর মোংলার আছে বানিয়াশান্তা। খুলনায় ভৈরবের ঘাট, যশোরে বাইরে মন্দির। সব জায়গায় আজগর গেছে। ওখানকার মেয়েদের তার চেনা আছে। আর মুখে না বললেও আজগরের মনে হয়, এই দুটোই ওইরম কোনও জায়গা থেকেই এসেছে। দুইজনই আগে থেকে পরস্পরকে চেনে। এখন এই জায়গায় এসে আবার খায়খাতির। আছে কোন বদ মতলবে কে জানে। যেমন, ইব্রাহিমের বছর দুই আগে এইরকম এক মেয়ের জন্যে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা সে আজও পোশাতে পারেনি।

অবশ্য, জরিনা কিংবা ঝিলিককে নিয়ে যাই ভাবুক, এসব আজগরের নিজের ভাবনা। এই ভাবনার তো একটা জিনিস আজগরের কাছে স্পষ্ট, সে এখনও জরিনাকে বিশ্বাস করে না। মনে হয় ভিতরে ভিতরে তার কোনও অনিষ্ট সাধনের মতলবে আছে ওই মেয়ে। কিন্তু উপরে যত রাজ্যের পিরিতি!

যাক, আজগর মানুষটাই হয়তো এমন। অল্পে খেপে। চটা বাতিকের। মাথায় সব সময় যেন বায়ু চড়ে থাকে। সেজন্যে কখনও কখনও কথা পুরোটা শোনার আগে খেপে যায়। আজ দুপুরের সুকুমারের সঙ্গে ঘটনাও তাই।

কিন্তু এখন নদীর কূল বেয়ে হাওয়া আসছে। আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ। কদিন বাদে পূর্ণিমা। নদীর ওপারের চরগাঁর আকাশ থেকে চাঁদা এখন প্রায় মাঝ নদীর উপরে। নদীতে জোয়ার। পানি ঢুকছে কুলকুলিয়ে। সে শব্দও যেন এখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে। লঞ্চঘাটটা স্থবির। পন্টুনে কোনও মানুষ নেই। সেখানে অন্ধকার। কাল সকালে যে লঞ্চগুলো ছেড়ে যাবে তা বাঁধা। বেশির ভাগই ছোটো লঞ্চ। ঢাকাগামী লঞ্চটা সন্ধ্যার পর-পরই ছেড়ে গেছে। কিছুক্ষণের ভিতরে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যাবে।

নাগেরবাজারের দিকে নদীর পাড় ধরে কিছুটা এগোলে হাফেজের রুটির দোকান। কিছুক্ষণ আগে সেখানেই বসেছিল সুকুমার আর ঝিলিক। জরিনাও গিয়েছিল রুটি কিনতে। এই দোকানের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। তবে আটাটা টেকা আর রুটি বানাতে গরম পানি ব্যবহার করে। রুটিগুলো নরম। রুটির সঙ্গে আখের পাটালি আর দয়াকলা (বিচিকলা) দেয়। গুড়ের দাম প্রায় সময়ই একই, তবে কলার দাম কেনার দাম বদলায়। এখানকার ক্রেতা বা একইসঙ্গে পাশের বেঞ্চিতে বসে খাওয়ার ভোক্তা প্রায় সবাই শ্রমজীবী। কেউ নদীর পাড়ের স-মিলে কাঠ চেরাই করে, কেউ কুড়ালে কাঠ ফাড়ে, কেউ রিকশা চালায়, কেউ লঞ্চঘাটের কুলি অথবা কেউ এই আজগর জরিনা আর সুকুমার ঝিলিকের মতো। আরও আছে, এখানে জরিনা বা ঝিলিক প্রায় পরজীবী। কিন্তু কোর্টচত্বরে সারাদিন ছালা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকা পাগল আছে, কখনও কখনও দিনে জাগে আর সারাটা রাত্তির কোর্ট চত্বর পাহারা দেয়া। সেই রহম বা রহমত পাগলও আসে এখানে।

যদিও এমন রুটির হোটেল আরও কয়েকটি আছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই সন্ধ্যা রাতে বন্ধ হয়ে যায়। এটাই এই লঞ্চঘাট আর কোর্ট চত্বর এলাকায় খোলা থাকে। মেইন রোডে ভাতের হোটেল আছে অনেকগুলো। আবাসিক হোটেলের পাশের গলিতে উঁকি মারলেও ভাতের হোটেলের রান্নার গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলোয় একবেলার ভাত খাওয়ার মতন পয়সা সব সময় তাদের কারও পকেটে থাকে না। তাছাড়া অনেকেই সকালে কোর্ট চত্বরে যাওয়ার আগে পেট ভরে ভাত খায়। সেই ভাতেই চলে সারাটা দিন। সন্ধ্যার মুখে একটু চা-মুড়ি যদি জোটে, তাও চাবায়।

সন্ধ্যার পর পর কোর্ট চত্বর ও এর আশপাশ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। বড়ো লাল দালানটায় তখন বাতি জ্বলে। সেই আলো এমন যে ওই ডিস্ট্রিক জজ বসার বিল্ডিঙেয়র বারান্দায়ও সেই আলোর আভা ভালোমতো যেন ঘুমাতে পারে না। লালচে মিটমিটে একটা বর্ণ ধারণ করে। ওদিক রাস্তায় আলো পড়ে না, সব গাছের পাতায় আটকে যায়। ডিসির বাড়ির গেটের দুই দিকের খাম্বায় আলো, সেখান থেকে ক্লাবের দিকে যেতে ডান পাশে ট্রাফিক ব্যারাকের বারান্দা অন্ধকার, শুকলাল সংগীত বিদ্যাপীঠ সন্ধ্যার পরে কেউ নেই। পাশে ক্লাবে উঠে যাওয়ার সিঁড়িতে আলো। সামনের জেলখানা পুকুরের পাশ দিয়ে ক্লাব চত্বরের ভিতরে টেনিস লনে আলো। সেই আলোতে পুকুরের জল চকচক করে। এক দিকে ফ্লাড লাইটের আলো গিয়ে লাগে পুকুরের ওপারের জেলখানা উঁচু দেয়ালের গায়ে। বামের হাতায় রেডক্রস ব্লিডিং ও সামনের স্বাধীনতা উদ্যানের ভিতরের যুবকেন্দ্রে রাত একটু বাড়লেও তরুণেরা খেলতে থাকে।

এই এলাকায় বাসাবাড়ি নেই। সন্ধ্যার পরে বাজারঘাটের সঙ্গেও কোনওপ্রকার সংযোগ নেই। মানুষজনই তো নেই। যেমন জেলখানার সামনে, স্বাধীনতা উদ্যানের পরে আদর্শ শিশু বিদ্যালয়। জেলখানার সামনের রাস্তা দিয়ে আবার মেইন রোডের দিকে হেঁটে গেলে, বাঁয়ে গার্লস স্কুল রোড, পরে অফিসার্স ক্লাব কিন্তু সামনে দেওয়াল নেই। পিছনে অন্ধকার। ক্লাব ভবনও নামমাত্র। এরপর আমলাপাড়ার দিকের রাস্তা। এদিকে গার্লস স্কুলের একটি গেট। অন্যদিকে বাগেরহাট স্কুলের ছোটো গেট। মূল রাস্তায় বাগেরহাট স্কুল, ডানে থানা তারপর সিভিল সার্জন অফিস। এটাই পুরনো হাসপাতাল। একটু এগিয়ে রাস্তা মিলেছে মেইন রোডের সঙ্গে। সেখানে লাশ কাটার ঘর।

এমন একটা এলাকায় সন্ধ্যার পরে কোনও কোনও ছিন্নমূল গৃহহীন মানুষের পদচারণায় দোষ কী। তারা তো সকাল হলে আর থাকে না। যেমন স্বাধীনতা উদ্যানের বেঞ্চিগুলোয় ও রেড ক্রিসেন্ট ভবনের বারান্দায় কেউ ঘুমায়। কেউ না আসুক রহমত পাগল প্রায় দিন রাতে এখানে আসবে। এই ছোট্ট শহরে ভাসমান হিসেবে আবির্ভূত কেউ কেউ রাত কাটাবে এই স্বাধীনতা উদ্যানে। পাশেই পার্কের পুকুর। তার উলটো দিকে মহিলা সমিতির বিল্ডিং, সামনে পিছনে অনেকখানিক ফাঁকা জায়গা, সেখানেও থাকে কোনও ছিন্নমূল। ওই বিল্ডিংয়ের এক কোনায় দেয়াল ঘেষে কেয়ারটেকারের একচালা। এদিকে ডিসির বাড়ি-লাগোয়া ট্রাফিক ব্যারাকের রান্নাঘর। সেখানেও সন্ধ্যার কিছু পরে আর আলো দেখা যায় কই? এই পুরো এলাকা সন্ধ্যার পর থেকেই আধো আলো আধো অন্ধকারে। লাইট পোস্টের আলোও যেন গাছের পাতার সঙ্গে মাখামাখি করে আবছা অন্ধকার হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে।

জরিনা রুটি কিনতে গিয়েছিল। একটু পরে হয়তো আজগরই যেত তার সঙ্গে। কিন্তু জরিনা মনে করে, আজগর যেত না। দুপুরবেলার ঘটনার পর থেকে আজগর একটু মন-মরা। যদিও ঠিক ওই সময়ে হয়তো তার মন মরা ভাবটা তেমন ছিল না। বানর দুটোর খাওয়ার জন্যে পয়সা জোটাতে হবে। ইব্রাহিম শেখের মজমা শেষ হলেই সে তাড়াতাড়ি ওই প্রায় ভাঙে ভাঙে আসরে গিয়ে ডুগডুগি বাজাতে থাকে। তার আগে ট্রেজারির সীমানায় কুলগাছে বাঁধা বানর দুটোকে নিয়ে এসে বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছে ইব্রাহিমের আসরে। ইব্রাহিমের মজমা তখন প্রায় শেষের দিকে।

বারিক বুড়োর তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে জরিনা মুখ টিপে হাসে। চোখের আড়ে একবার আজগরের দিকে তাকায়। চোখ টেপে। আজগর বোঝে জরিনা এই চোখ টেপা দিয়ে কী বোঝাতে চায়। আজগর মাথা নাড়ান, অর্থাৎ নিষেধ করে।

আজগর একটু কোনার দিকে। বারিকের সোজাসুজি ছিল জরিনা। তখন জরিনা উঠে আজগরের কাছে আসে। বলে, ক্যান?

আজগর জানায়, কী? মনে করছো বুড়ায় ঘুমায়? উঁহু, সব দেহে। কতবার আমরা পরীক্ষা কইরগা দেকচি, সব দেহে–ওইরম চক্ষু বোঝা থাকলে হইচে কী?

তাই নাকি? জরিনা অবাক। হাত সাফাইয়ের অভ্যাস আছে তার। কাজটা একেবারে খারাপ পারে না সে, আজগর জানে। কয়েকদিন আগে জরিনার কাপড় কাঁচার সাবান আজগর গায়ে ঘষে নাইতে লাগলে, সে বলেছিল আইনে দেবানে। সত্যি পরদিন বিকালে জরিনা একখানা কসকো সাবান নিয়ে হাজির। আজগর জানতে চেয়েছিল, পাইলা কী কইরে? জরিনার সোজা উত্তর, বাজারে এক দোকানে কী ভিড়। সাবান দেকতি দেকতি একখান টেকে গুইজে নিয়ে চইলে আসলাম। আজগর হেসেছে, এইসব করো! ধরা খাইল এহেবারে চুইদে দেবে। মাইনষের তা না কইয়া আনো, দাম না দিয়ে! এতেও জরিনার উত্তর, হুঁ, ওইসব মাহাজোনগো কত আছে। অত বড়ো বড়ো দোকান, ওই জায়গায় দে আমার মতন মানুষ একখান সাবান নিলি কী হয়?

ফলে, জরিনার এখনকার তাই নাকির উত্তর একটু গলা নামিয়ে আজগর বলল, তা ছাড়া কী? এইহানে কী সব বই আছে, সেতে চোদাচুদি লেহা থাহে, সেগুলোর একখানে হাত দিলিই বুড়ো চোখ খুলে তাকায়।

জরিনা আজগরের কথায় একটু যেন লজ্জা পায়। কিন্তু তার জানা আছে এমন কথা সে আগেও শুনেছে। এমনকি বই সাজানোর সময় বাঁধা বইগুলোর ভিতরে পুরুষ মহিলার ছবি দেয়া অমন বই দুই-একখানা দেখেওছে সে। কিন্তু ওই বইয়ের ভিতরে কীভাবে ওই কথা লেখা থাকে, ছাপা অক্ষরে ওইসব কথা কীভাবে লেখে শিক্ষিত মানুষ, কোনওভাবেই জরিনা ভেবে পায় না।

এই সময়ে, ওই ঈষৎ হাসিমুখের জরিনার কাছে কথাটা জানতে চেয়েছিল আজগর। তাছাড়া কথা ঘুরানোরও সময়। আশেপাশে কেউ তাদের কথা শুনে ফেললে কী ভাববে? জরিনার যা মুখ, দেখা গেল বারিক বুড়োকে জিজ্ঞাসাই করে বসল, কোন বইতে ওইসব লেখা আছে। তার একখানা তার চাই, তারপর খুঁজে বের করবে কে তাকে সেই বই পড়ে শোনাতে পারে। এই ভেবে আজগর বলল, ওই জরি, তুমি ওই ছেমড়িরে চেনো কী বিলে?

জরিনা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইল, কোন ছেমড়িরে?”

বারিকের দোকানের বইয়ের সামনে থেকে জরিনাকে সরানোর জন্যে আজগর এবার উলটো দিকে ইব্রাহিমের মজমার দিকে চেয়ে থাকল। জানে, জরিনা এবার তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এদিকেই তাকাবে। আজগর বলল, ওই যে সুকুমারের সাথে গেল।

ও, ওই ঝিলিকরে? আর কইয়ে না, ওরে না চেনে কেডা? আমার সাথে কয়দিন আগে রেল স্টেশনে দেহা হইল। কোনও বিষয় নিজের মতো করে বুঝিয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকলে জরিনা তখন দ্রুত কথা বলে। কোন দিক থেকে কী বলে তার প্রায় ঠিক থাকে না।

কবে দেহা হইল? কতদিন আগে? আজগর বুঝতে চায় আসলে জরিনার সঙ্গে কখনও ওই মেয়েটির আগে দেখা হয়েছে, নাকি আদৌ দেখা হয়নি, নাকি তারা পূর্ব পরিচিত। কিন্তু আজগরের মনে হল, একথা এখন আর জিজ্ঞাসা না-করাই ভালো। ইব্রাহিমের শেষ। এখন মানুষজনের ভিড় ফেটে যাওয়ার আগেই তাকে চত্বরে ঢুকতে হবে। একটা বানর তার হাতে ধরা। অন্যটা দড়ি খুব খাটো করে বারিকের পাশের গাছটার পাশে একটা কংক্রিটের খণ্ডের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। একসঙ্গে থাকলে মারামারি করে, কখনও হুটোপুটি করে, তাতে শক্তি ক্ষয় হয়, বানরের খিদে লাগে। সেই সকালে দুটো কলা খেতে দিয়েছিল, তারপর আর কিছুই খেতে দিতে পারেনি। আজগর জানে, বানর দুটোর খিদে লেগেছে। কিন্তু এখন কিছুই দেয়ার মতো তার হাতে নেই। এমনকি একটু আগে একটা বিড়ি সে চেয়ে খেয়েছে মোসলেমের কাছ থেকে। আজগর জরিনাকে ঝিলিকের বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না। এখনই তার ইব্রাহিমের ওই জায়গায় গিয়ে বানরের মজমা মিলানো দরকার। জরিনা বারিকের দোকানের এক কোনায় বসে। আজগর সামনে এগিয়ে যায়। জরিনা এখন বসে বসে দেখবে আজগর কীভাবে বান্দরনাচানো আসর জমায়।

এই বানর দুটোকে নিয়ে একটু আগে ইব্রাহিমের বসা জায়গায় বসল আজগর। দুটো বানরই তার কাছে, বাম হাতের দড়িতে গোটানো। ডান হাতে ডুগডুগি। ছন্দ মিলিয়ে ডুগডুগি বাজায় সে। আর মুখে বলে, এই ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া তুড়া! আসেন আসেন, আইচে ল্যাঙেড়া পাহাড় থেকে এক বানর বুড়াবুড়ি। আপনাগো খেলা দেখাবে।

আশ্চর্য এতক্ষণ ইব্রাহিম শেখের মজমায় বাচ্চারা, এক্ষেত্রে বালক-কিশোর, প্রায় কেউ ছিলই। শহরের স্কুল সব খোলা। চাইলেই ওই বয়েসের বালকরা এখানে থাকতে পারে না। কিন্তু আজগর ওখানে যাওয়ার পরে, বার দুই ডুগডুগি বাজিয়ে তার সঙ্গী এই বানর দুটোর গুণকীর্তন করতে করতে ওই বয়েসি কয়েকজন এসে হাজির হয়েছে। এখন হয়তো স্কুলে টিফিনের সময়। অথবা তারা স্কুল পালিয়েছে। এমনিতে বোঝা যেত না। কিন্তু কারও পরনে সাদা শার্ট নেভি-ব্লু প্যান্ট, কারও পরনে উপরে সাদা নীচেও সাদা, কারও পরনে উপরে কমলা নীচে কোনও ঠিক নেই। অর্থাৎ এরা সরকারি স্কুল, টাউন স্কুল আর আমলাপাড়া স্কুলের ছাত্র। আজগর তাদের দেখেই বুঝতে পারে। এ বাদে স্কুলের পোশাক না-পরাও দুই-চারজন আছে। এরা কেউই তার বানর খেলা দেখে টাকা-পয়সা দেবে না। কিন্তু হাততালি দেবে। আজগর খেলা দেখাবে, সেই খেলা দেখাতে তালিরও তো দরকার আছে। ফাও তালি দেয়ার লোক সে পাচ্ছে কোথায়?

জরিনা একইভাবে বসে থাকে। আজগরের কাণ্ড দেখে। আজগর বড়ো ছোটো জোয়ান বুড়ো, কোর্টের কাজে অথবা এমনি ঘুরতে আসা এই মজমায় সামিল সব ধরনের লোকের চোখ নিরিখ করে। মুখের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে বানর-ধরা দড়ির হাত থেকে সরিয়ে বৃত্ত বড় করে। মাথার চার দিক থেকে দড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসে, সঙ্গে বানরটাও তার চারপাশে সেভাবে ঘুরে আসে। আজগরের বৃত্ত বড়ো হয়। স্কুলে-পড়া ছেলেদের দিকে তাকিয়ে সে বলে, দেখি, বাচ্চালোগ তালিয়া বাজাও। বলে হাসে। তালি বাজে। আজগর তাদের মুখের দিকে তাকায়। জানে, এই যারা তালি বাজাচ্ছে, এদের কারও কারও সঙ্গে পথ চলতে দেখা হলে জানতে চাবে, ভালো আছেন? আজগর জানে, তারা তার খেলা দেখেছে। এমনকি কখনও কখনও এমনও হয়, আজগরকে লক্ষ্য করে পথ চলদে তারা নীচু গলায় একে অন্যকে বলে, এই যে ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া-তুড়া যায়!… বুড়া এখন বুড়িকে আদর করবে! শুনে, আজগর তখন হাসে। কিন্তু এখন কী সেই হাসি হাসা যায়।

বরং, আজগর জানায়, খেলা দেখবেন, হা করে থাকবেন না। সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল থেকে এসেছে এই অবলা জানোয়ার। আজ আপনাদের কাছে খেলা দেখাবে। কী দেখাবি না? বলেই একটা বানরকে সে খোঁচা মারল। বানরটা এই কথার সঙ্গে সঙ্গে একটু সামনের দিকে এগোল আর হাত নাড়াল। আজগরের বানর। পারেও, জরিনা দেখে আর ভাবে।

এরপর, খেলা শুরু। এই বুড়া, তুই এই আসরের সবাইকে সালাম দে–কুর্নিশ কর। বানরটা তাই করে। এই দেখেন, বানর আপনাদের সালাম-আদাব দিয়েছে, আপনারা হাততালি দেন, বাচ্চালোক তালিয়া বাজাও। এবার বুড়ো, দই বিক্রি করতে বের হবে। হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে দিল আজগর। বানরটা সেই লাঠিটা ঘাড়ে নিয়ে চারদিকে এক চক্কর ঘুরে এল। এদিকে বুড়ি তখন রান্না করছে। বুড়ো বাড়ি ফিরলে খেতে দেবে। আজগর ধারাভাষ্য দিয়ে চলে। বানর দুটো একের পর এক তাই করে। আজগর জানায় খাওয়া দাওয়া শেষ, এবার বুড়ো বুড়িকে আদর করবে। মাদি বানরটা তখন বসে থাকা মর্দা বানরের কোলের ভিতর গিয়ে বসে। মর্দাটা মাদিটার গায়ে মাথায় হাত বোলায়। এরপর আজগরের ভাষ্য মতো মাদিটা মর্দাটার মাথার উকুন বেছে দেয়।

এরপর আজগর তাদের ডাকে। তারা কাছে আসতে আসতে বলে, এবার এ দুটো ভদ্দরলোক হবে। বুড়া জামা কাপড় পরবে। বলে পাশের মলিন ঝোলা থেকে একটা ছোট্টো স্কার্ট মতন বের করে, সেটাই বুড়ার প্যান্ট। বুড়ো অর্থাৎ মর্দা বানরের শরীরের নীচের দিকে তা পেচিয়ে দিলে, সেটা এখন ভদ্দরলোক সেজে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। এই দৃশ্যটা আনন্দদায়ক, মর্দা বানর পোশাক পরে, কোমর দুলিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। বালকরা হাততালি দেয়। ভিড়ের কারণ বারিকের দোকানের সামনে বসা জরিনা কিছুই দেখতে পারছে না, কিন্তু তখন সেই সোজা ভিড়টা যেন একটু পাতলা, সেখান থেকে একটি বানরের এমন করসৎ জরিনা দেখে। সেও হাতে তালি দেয়। সেই তালিতে বারিক বুড়োর তন্দ্রা টোটে অথবা কিছু একটা ঘটেছে বুঝে বারেক চোখ খোলে। চোখটা একটু কচলে নিয়ে তাকায়, দেখে কিছুই ঘটেনি। আজগরের বান্দর নাচানো দেখে জরিনা খুশিতে হাততালি দিয়েছে। তাতে বারিক যেন একটু নাখোশ, যা, ওই জায়গায় যাইয়ে দেখ।

জরিনা বারিকের দিকে তাকায়, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, ও কা?

সেয়া দিয়ে তোর কাজ কী?

জরিনা একটু আগে আজগরের সঙ্গে তার বিষয়টা মিলিয়ে নিতে চায়। তাহলে বারিক বুড়োও ঘুমায়। তাহলে আজগর যে বলল, কোনওভাবে বুড়োর বই হাতসাফাই করা যায় না? জরিনার হিসেব মেলে না। সে আবারও বারিকের দিকে তাকায়। বলে, ভুল হইয়ে গেইচে। কিন্তু কাকা, ওই জায়গায় বিটি মানুষ হইয়ে অত বেটাগো মদ্যি যাইয়ে বান্দর খেলা দেখা যায়?

বারিক তা শুনেছে অথবা শোনেনি। আবারও তার চোখে তন্দ্রা।

এদিকে জরিনার সামনের সেই ভিড় আবার জমেছে। সে দেখতে পায় না কিছুই। তার একটু পিছনে, বারিকের দোকানের পর ছোট্ট ড্রেনের কোনায় ছোট্ট একটা বক্স মতো যন্ত্র নিয়ে বসা দিলদার। এই যন্ত্র নাকি বাত ছাড়ায়। সে সেখান থেকে বারিককে বলে, কাকা, আমার এই যন্তরটা থাকল, এট্টু ঘুইরে আসি। দেইহেন।

জরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে দিলদারকে দেখল, । হইছে, ওইয়ে দিয়ে মানষি আইজকাল বাত ছুটোতি আসপে নানে, পুলিশে পিটোইয়ে সব বাত ছুটোইয়ে দিতিচে।

সমস্যা নেই, কেউরে না-পালি তারপর তোর বাত ছুটোবানি। দেহিস–তুই ধরবি আর যন্তরডা এমন ঘুল্লি ঘুরব, তুই এহেবারে তিড়িং বিড়িং নাচতি থাকপি!

হইচে, ধইরে দেকপানি তোমার ওই বালের যন্তর, দেহি নাচি কীরাম?

হয়। তুমি তো আজগরের যন্তর ধইরে নাচতিচো!

জরিনা যেন একটু লজ্জা পেল। সে উলটো দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যেতে থাকা দিলদারকে দেখে। দিলদারের চোখের ভাষা বুঝতে চায়। দিলদার ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে। কিন্তু এখন আর কিছু বলল না। যেন, যা বলার জরিনার উদ্দেশ্যে বলেই ফেলেছে। তাছাড়া বারিক বুড়ো কাছেই। সে চোখ নাচিয়ে বলে, কী?

জরিনা দাঁড়ায়, কী? ধীর পায়ে এগিয়ে দিলদারের কাছে যায়।

দিলদার এইবার গলা নামিয়ে বলে, কী? কলাম তো, ওই আজগরের যন্তর ধরিচো তো ধরিচো, ওইয়ে ধইরে তিড়িং বিড়িং নাচতিচো, আমার তা এট্টু ধরলি পারি?

ধরবানে, ধরবানে, ধইরে দেকপানে তুমি নাচাও কীরাম

আজগরের চাইয়ে খারাপ নাচানো নানে–আইসো!

উভয়ের চোখে দারুণ ভাষা খেলে। দিলদার কথায় জরিনাকে আটকাতে চেয়েছিল, কিন্তু জরিনা এতটা সহজে তার ইঙ্গিত বুঝবে ভাবেনি। ফলে, আর কিছু না-বলে দিলদার বলে, এহোন বইসে থাহো, আজগরের প্রায় শেষ। আবার দেহা হবেনে। এট্টু লঞ্চঘাটের দিকদে ঘুইরে আসি।

লঞ্চঘাট কী?

খাব। আলতাফের দোকানে—

আমারে খাওয়াইনে একদিন। আলতাফের ওইহেনে দেখি মাংস রান্দে—

আচ্ছা। কলাম তো যন্তর ধরলি নাচ দেখপো আর খাব।

জরিনা দিলদারের কথায় ইঙ্গিত পুরোপুরি বুঝল। তাকাল চারদিকে। কেউ শোনেনি তো। বারিক বুড়োর চোখ বন্ধ, কিন্তু কান নিশ্চয়ই ভোলা।

জরিনা চোখ ঘুরিয়ে জমায়েতে আনে। আজগরের বানর নাচানো প্রায় শেষ দিকে। কয়েকদিন ধরে দেখতে দেখতে জরিনা তা বুঝতে পারে। আজগর জানাল, বুড়া এখন হাই জাম্প দেবে। বলে লাঠিটা উঁচু করে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ধরল। লাঠিটার উপর দিয়ে মর্দা বানরটা এক লাফে এপাশ থেকে ওপাশ পার হয়ে চলে গেল। হয়তো আজগরের বলার ভিতরেই কায়দাটা আছে, এই বানর জোড়া এতদিন ধরে শুনতে শুনতে তা বুঝে গেছে। আবার এই যে তার হাতের লাঠিটা, এই লাঠিই তো কখনও কখনও বাঁদরদের পিঠে আছড়ে পড়ে! এখন লাঠিটা সে এমন ভাবে উঁচু করে ধরে যেন মর্দা বানরটা দেখেই বুঝতে পারে তাকে কী বলা হচ্ছে। কী চাই। লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। প্রতিবারই সফলতার সঙ্গে লাফিয়ে পার হয়। তবে, আজকাল আগের তুলনায় একটু কম উঁচুতে লাঠিটা ধরে আজগর। আগের মতন আর প্রায় আড়াই হাত মতন উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে না, আজগরের ভাষায়, এই ল্যাঙ্গেরা পাহাড়ের বুড়া-তুড়া। কে জানে কেন এইসব বলে সে, এই বলে ল্যাঙ্গেরা পাহাড়ের বুড়া, কিন্তু সঙ্গে জানায় সুন্দরবন থেকে আনা এই বানর। সুন্দরবনে পাহাড় আসবে কোথা থেকে, সে-কথা কেউ কখনও প্রশ্ন করে না।

জরিনা চেয়ে চেয়ে আজগরকে দেখে। আজগর খেলার এই শেষ দিকে, তার মজমায় হাজির সবার উদ্দেশে জানিয়েছে, যে যা পারে যেন এই বানর দুটোর খাওয়ার জন্যে দেয়। বানর দুটোর রশিতেও ঢিলে দিয়েছে আজগর। তারা পায়ের উপর ভর দিয়ে চারদিকে সবার কাছে হাত পাতছে। কেউই বলতে গেলে এক টাকা দেয়নি। সবই রেজগি। কেউ ছুঁড়ে দেয়, কেউ দেয় বানরের হাতে। বানর তাই এনে আজগরের সামনে রাখে। আবার যায়। সেই স্কুল-পালানো ছেলেরা এতক্ষণে চলে গেছে। কোর্ট মসজিদ রোডের মসজিদে জোহরের আজান হয়েছে কিছু আগে, নামাজিরাও চলে গেছে, টাকা বা পয়সা দিয়ে দর্শকরা পাতলা হতে থাকলে, সেই চত্বরে এখন এই জায়গায় আছে একমাত্র আজগর আর তার দুটো বানর। পাশে তার মলিন অপরিষ্কার পুটলিটা। আর আজগর বরাবর সোজা পিছনে বারিকের দোকানের পাশে দাঁড়ানো জরিনা।

আজগর সব গুছিয়ে নিয়ে জরিনার কাছে যায়। জরিনা আজগরের দিকে চেয়ে হাসে। মাথায় আজগর আর জরিনা প্রায় সমান, সেই দিক দিয়ে আজগর খাটোই জরিনা তুলনায় লম্বা। ফলে, সরাসরি পরস্পরের চোখে চাইতে পারে। বানর দুটো আজগরের হাতে দড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। কিছুটা ক্লান্ত। তাই তাদের স্বাভাবিক বাঁদরামি নেই। আজগর টাইপিস্টদের বড়ো ঘরটার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলে বানরদের বাধে তারপর জরিনাকে সেখানে দাঁড়াতে বলে মেইন রোডের দিকে যায়। সেখান থেকে চারটে কলা কিনে আনে। বানরদের দেয়। কলা খেতে খেতে বানররা চাঙা হয়, আজগর বোঝে। তা জরিনাও কিছুটা বুঝতে পারে। যখন মর্দা বানরটা দ্বিতীয় কলাটা খাওয়া হলে খোসাটা একটু দূরে ছুঁড়ে মারে আর তারচেয়ে আকৃতিতে ছোটো মাদি বানরটার কাছ থেকে সেটার না খাওয়া কলার অর্ধেক নিতে ছোটাছুটি করে।

জরিনা বলে, এই শুরু হইচে তোমার বান্দরের বাদরামি—

আমার বান্দর আর কত ভালো হবে। তয় অন্য মানুষও বান্দর কোম না!

কেন হইচে কী? দেখলাম দিলদারের সাথে হাইসে কতা কইলা!

জরিনা দ্রুত চকিতে তার চোখ আজগরের চোখে রাখে। হয়তো বলত, কইচি তা হইকে কী? এমনিতে তো এমন কত কত সোমায় কই। কিন্তু এখন তা বলল না, আজগরের চোখের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, এইরে তুমি বান্দরামি কও? তা ইব্রাহিম ভাইর সাতে তো কতো কতা কই!

না, বেশ ঢলতিলি! এটা অবশ্য আজগর দেখেনি, এমনিতেই আওয়াজ দিল। শুনবে জরিনা কী বলে?

কোতায়? দেখলা কোতায় ঢলতিলাম—

ও। মনে হল।

নিজে বান্দর নাচাতি নাচাতি ওই দুই চোহে বান্দরামতি ছাড়া আর কিছু দেহো না, না?

এই সময় বানরদের কলার সঙ্গে নিজের জন্যে কিনে আনা বিড়ি ধরিয়ে আজগর কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে। জরিনা ভেবেছিল এখনই হয়তো আজগর লঞ্চঘাটের দিকে যাবে। বানর দুটোকে নিজের ঝুপড়ির পাশে বেঁধে রেখে কোথাও ভাত খেতে যাবে। যাবে আর কোথায়, নিশ্চয় রাহাত হোটেলের গলি ধরে নদীর কূলের ভাতের হোটেল। লঞ্চঘাটের পাশের নদীর কূল ধরেও যাওয়া যায়। আজগরের ঝুপড়ির পরে আর কতটুকুই-বা পথ। কিন্তু একটু এগোলে একটা ড্রেন নেমেছে। ড্রেনের পাশের মাটি সরে যাওয়ায় এখন তা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া কষ্টকর। কিন্তু এখন কী আজগরের সেইসমস্ত কোনও চিন্তা আছে? বরং, আজগর তার কাছে উলটো খবর জানতে চায়, এই জরি, সুকুমার খেলা দেহাবে না?

কী জানি?

ইব্রাহিম গেইচে পর আর আসে নাই?

না। এদিক আর তো দেকলাম না।

গেল দেহি তোর সেই পরিচিত ছেমড়ির সাতে? কী যেন নাম ওই ছেমড়ির?

ওই ছেমড়ির নাম দিয়ে তোমার দরকার কী? সুকুমারদা আর এদিক আসিনি। ওই যে বারিক বুড়ো মেয়ার গাছতলায় তার খেলার জিনিসপাতি।

আজগর সেদিকে তাকায়। সত্যি, সঙ্গে সঙ্গে আজগরের মনটা একটু খারাপ হয়। ছেমড়ার সাতে হোন না-বাধালিই হইত। আইজের খেপ গেল। যদিও এখন কোর্ট চত্বরে মানুষজন তেমন নেই। তাছাড়া সুকুমারের আয় রোজগার বেশ ভালো। একদিনের খেপ না দিলে কিছুই হবে। দেখা গেল, বিকাল হতে না-হতে ছুটল রেল লাইনের দিকে। কিন্তু রেল নিয়ে কী সমস্ত ঝামেলা হচ্ছে। আজগরের মতন মানুষ তা সব অবশ্য জানেও না।

আজগর বিড়ি ছুঁড়ে জরিনাকে বলল, চল, যাই। খাওয়া লাগবে। পেট পুজো করি। পেটে দুটো দেখার জন্যিই এত কিছু!

জরিনা হাসে। এইবার না বান্দরনাচানো আজগর আসল কথায় আইচে। একটু আগে তার ভান দেখে জরিনার মনে হচ্ছিল আজ যেন আর খাবেই না। হাওয়া খেয়ে আজকের দিন পার করে দেবে।

লঞ্চঘাট ফেলে ঝুপড়ির দিকে যেতে যেতে আজগর আবার একই কথা বলে, খুব তো রঙ্গ ওই দিলদারের সাতে, যাইতি তার সাতে খাইতে!

জরিনা আবার এক ঝটকায় আজগরের চোখে চোখ রাখে। না-সেখানে এখন আলাদা কোনও ইঙ্গিত নেই। ক্লান্ত চোখ। এবার ক্যানভাস করে এসে লোকটা এক গ্লাস পানিও খায়নি। এখন খাবে। বান্দর দুটো বেঁধে আজগর ঘরের দরজা খুলে ঘটি বের করে। পানি প্রায় তলানিতে। সেটুকু চুমুক দিয়ে খায়। হাতের ফাঁকা ঘটিটা জরিনাকে দেয়। জরিনা যেন খাওয়ার পরে এই ঘটিভরতি পানি আনে হোটেলের পিছনের চাপকল থেকে। ওই কলের পানি খুব ঠান্ডা, নোনা ভাব কম আর পাতলাও। পানি যে পাতলা আর ঘন (আয়রন বেশি) ওই কলের পানি খাওয়ার পর আজগর বুঝেছে। কোর্টের কোনায় ওই ট্রাফিক পুলিশদের ব্যারাকের সামনে একটা চাপকল আছে, সেখানকার পানি মাঝে মাঝে খায় আজগর, খুব ঘন সেই পানি। পরে শুনেছে, আয়রন না কী বলে, ওই পানিতে তাই খুব বেশি।

দুপুরে খেয়ে এসে ঝুপড়িতে শুয়ে পড়তে পড়তে আজগর আবার ঘটিতে চুমুক দিয়ে পানি খায়। জরিনা বলে, এইভাবে চুমুক দিয়ে পানি খালি সেই ঘটির পানি আবার মানষির খাতি ইচ্ছা করে। আর তোমার দাঁতের ঝা ছিরি, মুখের চার পাশের যে অবস্থা। দাড়ি মোচ।

খালি খাও, না খালি নিজের জন্যি ঘটি এট্টা কি না নিয়া আসো।

খালি খোটা দাও। তুমি খোটা না-দিয়ে কোনও কতা কতি পারো না, না?

না, পারি না।

ঝুপড়ির দরজা খেলা। আজগর ভিতরের দিকে পা-দিয়ে শুয়ে পড়েছে। জরিনা মাথার কাছে বসা। আজগর বলে, জরিনা সুন্দরী, এবার মাথার চুল কয়ডা এট্টু টাইনে দাও।

তোমার ওই খোটা দেয়া এট্টু বাদ দাও।

হইচে। পান খাইয়া ঠোঁট তো এহেবারে রাঙা লাল!

হইচে আর অত পিরিত দেহানো লাগবে না।

কেন হইচে কী?

ফাও কতা কইয়ে না। সামনে লঞ্চঘাট। দিন দুপুর। এই রাস্তা দিয়ে মানুষজন হাইটে যায়। বান্দরের সাতে থাইহে থাইহে তোমারও বান্দরামতিতে পাইচে এই বুড়ো বয়সে।

তোমারে কইচে। আজগর আবার বুড়ো হলো কবে? খালি কয়ডা দাঁত পড়িছে তাও পোকে খাইয়ে।

হয় বুজিছি, নিজেরে আরও কচি খোকা বানান লাগবে না।

কেডা বানায় কচি খোকা?বলে আজগর জরিনাকে ঝুপড়ির ভিতরের দিকে ঢুকতে বলে। আজগর ভিতরের দিকে মাথা দেয়া একখানা ভাঙা তক্তপোশ, তার মাথায় একটা বালিশ। সেইদিকে মাথা দিয়ে জরিনা আজগরের দিকে আসতেই আজগর ভিতর থেকে দরজা আটকায়। জরিনা বোঝে, আজগর এখন কী করবে।

শুধু একবার বলে, এই দিনে দুপুরে দরজা দেও। পেটের ভাতও হজম হল না!

পেটের হাত একটু ঝাঁকি-ঝুঁকি খাইলে এমনেই হজম হইয়া যাবে।

জরিনা হাসে। হাসিতে শব্দ হয়। কিন্তু খিলখিল ভাবটা নেই। বরং, হাসির সঙ্গে মুখে-ঠোঁটে জড়ানো কথা। তার পরনের শাড়িখানা আজগরের অবুঝ টানে ও চাপে কুচকে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় সে খুলে ফেলে। অথবা, হতে পারে উলটো দিকে খোলা পাল্লা, যা টানলেও লাগে না, সেখানে শাড়িখানা দিয়ে দেওয়া। ঝুপড়ি তাতে একটু অন্ধকারও হল। এতে জরিনার লাজশরমও যেন উধাও। সে একবার আজগরকে বোঝাবে, এই দুপুরে একবেলা ভাত খাইয়ে এখানে তারে এনে এ কোন রঙ্গ!

ফলে, জরিনার কারণে আজগর ঘুমে তলায়। ওই চোখ দুটোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, কতকাল যেন লোকটা ঠিকঠাক ঘুমায় না। প্রায়শ এই দুপুরের দিকে এখানে জরিনাকে নিয়ে আসে। কোনও কোনওদিন রাতেও থাকে জরিনা। সেই সব রাতে, রাত একটু গম্ভীর হলেই আজগর ঘুমে তলায়। তখন জরিনা পাশে আছে অন্য কেউ বোঝা যায় না। তারপর জরিনা জানে, হঠাৎ মাঝরাতে লোকটা ঘুম ভেঙে ঝুপড়ির দরজা কোনওমতে চেপে দিয়ে লঞ্চঘাটে চলে যাবে। পন্টুনে বসে থাকবে। হয়তো ঘাটে বাঁধা কোনও একখানা লঞ্চের উপরেও উঠে বসে থাকতে পারে। পশ্চিম আকাশে ঢলে-পড়া চাঁদের আলো নদীর জলে। দূরে শহরের কোনও বাড়ির আলো এখান থেকে। চোখে পড়ে। ট্রেজারির ঘণ্টা রাত্তির জানান দেয়। উঁচু পাঁচতলা রাহাত হোটেলের উপরের কোনও একটি রুমে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে তাকিয়ে জরিনার মনে হয় আজগর আসলেই অন্ধকারে বসে আছে। সেও যেন অনেকখানিক অন্ধকার পথ সাঁতরে এখানে এসেছে। পন্টুনের কেয়ারটেকার লোকটা একবার জেগেছিল, কিন্তু আজগরকে দেখে সঙ্গের ছোটো রুমটায় আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে, জরিনাকে দেখলে হয়তো খ্যাকখ্যাক করত। একদিন করেছিল। বলেছিল, এই রাইতে আজগরের সাতে এই জায়গায় কী? যা করার আজগরের খুপড়িতে যাইয়ে কর।

ব্যাটার কথার কী ছিরি! সব তাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখলেই ওই এক কথা। মানষির যেন ওই কাজ ছাড়া আর কোনও কাজে ধারে আসার কোনও কারণ নেই। খালি ফাও কথা। যদি জানত এই জায়গায় কেন?

তা আলি নামের ওই লোক জানবে কী করে। জানে জরিনা। এই গরমে রাত একটু গম্ভীর হলে আজগর তার খুপড়িতে ঘুমাতে যায়। জরিনাও এক পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এতক্ষণ নদীর কূলে ওইভাবে বসেছিল যেন এই ঘুম আনার জন্যে। প্রায় চারদিন আটকা, মাথার কাছে ছোট্ট একটা কপাট, এমন বদ্ধ ঘরে মানুষ ঘুমাতে পারে। কিন্তু রাতের ওই বাতাসে চারদিক জুড়িয়ে আসলে আজগর শুয়ে পড়েই ঘুমিয়ে যায়। জরিনা চোখ খুলে এটা-ওটা ভাবে। আজগরের শুয়ে পড়ামাত্রই ঘুম। জরিনার ঘুম আসে দেরিতে। কিন্তু একবার এলে আর ভাঙে না। তাছাড়া আজগরের এই ঝুপড়িতে সে ঘুমায় একটু ভয়ে ভয়ে। শত হলে আজগর পরপুরুষ। যত আপনারাই হোক, যতই এই কয়দিনের জন্যে এক সাথে থাকুক আপনার বলে ভাববার কোনও উপায় আছে। কিন্তু পাশে ঘুমালে সেই মানুষটাকে বড়ো আপনার মনে হয় জরিনার। ঘণ্টায় ঘন্টায় ঘুম ভাঙে। মাঝেমধ্যে কোনওদিন উঠে নদীর কূলে পেচ্ছাপ করতে যায়। এসে ঘটিটা ধরে চুমুক দিয়ে পানি খায়। জরিনা ঘুমের ঘোরে তা টের পায়। কোনওদিন ওই যে পেচ্ছাপ করতে ওঠে, তারপর এসে আর ঘুমায় না। জরিনা ঘুমিয়ে থাকে। কখনও এই ছোট্ট তক্তপোশে একটু পাশ ফিরলে টের পায়, পাশে আজগর নেই।

একদিন এমন হলে অন্ধকারে জরিনা চোখ খুলে জেগে থাকে। তার গাঢ় ঘুম, একবার কেটে গেলে আবার আসতে সময় লাগে। কিন্তু এই করে সময় কেটে যায়। জরিনার চোখ আবার ঘুমে জুড়িয়ে আসে। কিন্তু আজগর না আসা পর্যন্ত আর সে ঘুমাবে না। কিন্তু চাইলেও কী তা হয়। কোনও কোনও দিন সে আজগরকে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে চায়, কোনও দিন আজগর তাকে নিঃস্ব করে দেয়, একেবারে তখন আর তার শরীরে কোনও বল ভরসা থাকে না। এই নিঃস্ব করে দেয়ার কায়দাটা বুড়ো বেটা ভালোই জানে। এত মানুষ তার শরীরের উপর দিয়ে আসল গেল, এত দেখল, কিন্তু আজগর যেমন বান্দর নাচায়, একইভাবে আজগর তার নিজের শরীরটাকেও ওই বান্দরের মতোই চঞ্চল করে তোলে আর জরিনার শরীর যেন সুন্দরবনের গেওয়া গাছ, যার ডালে ডালে আজগর বান্দরের মতন বেয়ে বেয়ে চলছে। তখন জরিনা ওই সমুদ্রের তীরে হারিয়ে যায়, তার সারাটা গায়ে এসে কোত্থেকে বাতাস লাগে, সারাটা শরীরে অনেকগুলো ফাঁকা, সেখানে হু-হু  বাতাস ঢুকছে! আজগর সেখানে সেই বাতাসের ভিতরে তার শরীরটাকে আরও হালকা করে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে।

আজ রাতেও তাই ঘটেছিল। তারপর জরিনার চোখ জুড়ে ঘুম। কিন্তু আজগর বাইরে, নদীর কূল গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে থাকে। এরপর জরিনা গেলে পাশের দোকানের বেঞ্চিখানা টেনে এনে দুইজন কাছাকাছি বসে। নদীতে জোয়ার আসছে। অমাবশ্যার গোন। চারদিক বড়ো বেশি অন্ধকার। হঠাৎ হঠাৎ একটি দুটি মশা এসে উড়ে পায়ে বসে। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে। তাদের আলাপের যাতে কোনও পরিবর্তন ঘটে না। তারপর এক সময়, আজগরের মনে হয়, সত্যি রাত গম্ভীর হয়েছে, শরীর ক্লান্ত, যতই ঘুম না-আসুক এখন ঘুমাতে হবে। সকালেই বানর দুটো জেগে খিদেয় ছটফট করবে। সে সময় হতে তেমন বেশি বাকি নেই।

কিন্তু সেই ঘুম আজগর ঘুমাল কোথায়? কিছুক্ষণ বাদে পেচ্ছাপ করতে উঠে গেল, যদিও ঘুমাতে আসার আগে নদীর কূলে পেচ্ছাপ করে এসে ঘুমিয়েছিল। জরিনাও তখন আজগরের দেখাদেখি একটু তফাতে গাঢ় অন্ধকারে গিয়ে বসেছিল। তারপর অভ্যাস মতন, প্রায় কোনও কথা না বলে আজগরের শুয়ে পড়া। পায়ের দিকে বেড়ানো দরজাটা আধ ভেজানো। জরিনার এতে ভয় করে। কিন্তু সেকথা আজগরকে বলে আগে ধমকও খেয়েছে। বলেছে এই জায়গায় চোররাও আজগরের এই ঘর চেনে, এই জায়গায় নেই কিছু, এই দিক আসপে না কেউ। দিনে সারাদিন প্রায় উদলাই থাকে, কেউ আসে না। এহোনও আসপে না। তা সত্যি, আজগরের যত চিন্তা তার ওই বানর দুটো নিয়ে।

হঠাৎ ঘুম ভাঙলে জরিনা টের পায় আজগর পাশে নেই। চারধার বড়ো নিকষ অন্ধকার। নিশ্চয়ই শহরে কারেন্ট চলে গেছে। লঞ্চঘাটের কোনার লাইটটাও জ্বলছে না। নাকি কদম আলি সেই লাইটটা বন্ধ করে রেখেছে।

জরিনা আজগরকে খোঁজে। কোথায় যেতে পারে তার জানা আছে। নিশ্চয় লঞ্চঘাটের পন্টুনে বসে আছে। অথবা ঘাটে বাঁধা কোনও লঞ্চে। একা–পানির দিকে তাকিয়ে! অন্ধকারে লোকটা পানিতে কী দেখে!

জরিনা যা ভেবেছিল তাই। পন্টুনে নেই আজগর, সে দুই দিকেই দেখে এসেছে। উঠেই সামনের দিকটা দেখাই যায়। দক্ষিণ দিকে গেলে সেখান থেকে দেখা যায়, আজগরের ঝুপড়ি ঘর। কোথায় গেল? সাত-আটটা লঞ্চ বাঁধা। মূলত দুটো লঞ্চ আর গোটা পাঁচেক ট্রলার। সবকটায় উঠে দেখা সম্ভব না। লঞ্চে মানুষ ঘুমায়, এই অন্ধকারে, সেখানে জরিনার ওঠা ঠিক হবে?

জরিনা পন্টুনের উত্তর কোনায় আসে। ভাটার পানি নামছে। সেখানে পানি আটকে কুল কুল শব্দ। জরিনা টের পায় যেন এই শব্দের সঙ্গে মিলে আছে কান্নার শব্দ। পাশের ছোটো ট্রলারটার উপরে হাঁটুমুড়ে বসে আছে আজগর।

জরিনা কাছে যায়। আজগরের চুলে বিলি কাটে। আজগর মাথা তোলে না। চুলে ওই আঙুল পড়তেই বুঝেছে এই হাত জরিনার! জরিনা আজগরের আরও কাছে এসে বসে। জানতে চায়, কী হইছে তোমার?

আজগর গলা নামিয়ে হু-হু করে। ডানে বামে মাথা নাড়ে। কোনও কথা বলে না।

জরিনা বোঝে, আজগর মদ গিলেছে! কিন্তু কখন? ঘুম থেকে উঠে। পেল কোথায়। যদি এখন সেকথা সে জানতে চায়ও না। আজগর মাঝে মধ্যে কর্মকার পট্টির পিছনের দোকান থেকে সালসার ছোটো বোতল আনে, সে জানে। সন্ধ্যায় খাওয়ার আগে গলায় ঢালে, রাত্রেও। কিন্তু আজ এই জিনিস আনল কখন আর পেল কোথায়? জরিনা তা জানতে না-চেয়ে শুধু কান্নার কারণ জানতে চায়। বড়ো অদ্ভূত এই কান্না। অন্ধকার চরাচরে মিশে যাচ্ছে কান্নার সুর।

জরিনা গলা নামিয়ে জানতে চায়, কান্দো কেন? হইল কী?

আজগর আবারও হু-হু করে। দুদিকে মাথা নাড়ে। প্রায় মাসখানেক আগে সেদিন পয়লা আজগরের কান্নার কারণ জানতে পারে জরিনা।

০৪. লঞ্চঘাট থেকে নদীর কূল ধরে

লঞ্চঘাট থেকে নদীর কূল ধরে নাগের বাজারের দিকে এগোলে, মাঝামাঝি জায়গায় হাফেজ আর লালির রুটির দোকান। লালি হাফিজের বউ। সেখানে রুটি কিনতে এসেছে জরিনা। আজগর সঙ্গে আসেনি। আজগর যে আসবে না, জরিনা জানত। দুপুরের পর থেকে জরিনার সঙ্গে ওই সমস্ত করে, তারপর লোকটা লম্বা ঘুম দিল। জরিনা বেশিক্ষণ ঘুমায় পর থেকে অথবা জরিনার ঘুম আসেনি। সে উঠে সুকুমার আর ঝিলিককে খুঁজেছে। তখন জরিনার আসলে কোনও কাজ ছিল না। সে জানে, অমন সব করার পরে আজগর প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাবে। তাছাড়া সুকুমারের সঙ্গে ওই ঝগড়ার আজগরের মনটা খারাপ। একেবার ঘুমে তলিয়ে গেলে, উঠে যদি মনটা ভালো হয়, একটু ফুরফুরা আজগরকে দেখতে তখন তারও ভালো লাগবে। শুধু শুধু মেজাজ করে তার সঙ্গে কথা বলবে না। সন্ধ্যার দিকে এক কাপ চা খেয়ে তারপর কিছুক্ষণ নদীর কূলে হাওয়া বাতাস খাবে।

কিন্তু তার আগে দীর্ঘ সময় জরিনার। এমন গরমের দিনে বিকালে একটু বাতাস চাললেও পারে। একবার নদীর এপার ওপারের নারকেল গাছের পাতাগুলোয় বাতাসের নাচন দেখেছিল। তখন জরিনার মনে হয়েছিল, এই যে বাতাস চালাল, এবার দুনিয়াদারি ঠান্ডা হবে। কিন্তু কোথায় কী? একটু বাদেই আর নেই। একটা নারকেল গাছের পাতাও কাঁপল না। অল্প অল্প হলেও একটাও মেঘনিশ গাছের থেকে ঝরে পড়ল না পাতা। নদীর পানিতে কোনও তরঙ্গ বয়ে গেল না। বরং, দুপুরের শেষ দিকে তাপ যেন আরও বাড়ল। বিকাল পর্যন্ত সেই তাপ। তার ভিতরে আজগর ওই ঝুপড়ি ভেঁস ভেঁস করে ঘুমায়। এদিকে জরিনা কাপড়-চোপড় একটু গুছিয়ে পরে, চুলটা একটু গুছিয়ে এক প্যাঁচে খোঁপা করে লঞ্চঘাটের পন্টুনের ওপর আসে। মনে আশা, এই নদীর কূল ধরে ডাক বাংলো ঘাট দিয়ে ঢুকে পুরো কোর্ট চত্বর আর ক্লাব আর আশেপাশে সুকুমার আর ঝিলিককে খুঁজে আসবে।

জরিনা জানে, বিকালে কোর্ট চত্বর ফাঁকা। অফিস আদালতে তখন মানুষের আর কাজ কী? তবে ডিসি অফিসে আলো জ্বলে, সেখানে বড়ো বড়ো সাহেবরা কত পদের মিটিং করে। সেই সোজা কোর্ট মসজিদ রোডের দোকানে তখন মানুষ, আরও এগোলে কাজী নজরুল ইসলাম রোড কি কাপুড়ে পট্টিতেও মানুষজন তখন গিজগিজ। ওই কাজী নজরুল ইসলাম রোডে পড়ে বাঁয়ের হাতায় আবার মেইন রোড। ওটাই রাহাতের মোড়, লঞ্চঘাটের একেবারে লাগোয়া। জরিনা এই পথটুকু ঘুরে আসবে ঠিক করে। রাহাতের মোড় থেকে হোটেলের পাশের গলি ধরে আবার যাবে নদীর কূলে। যাওয়ার আগে ওই ভাতের হোটেল। এমনকি একবার লঞ্চঘাটে আলতাফের ভাতের হোটেলেও যেতে পারে। কিন্তু আলতাফের চোখ বড়ো খারাপ, শালার কথাও খারাপ। মাছের মাথা খাইয়ে যাতি কয়! তাকে বলেছে, একদিন আসতে, হোটেলের দোতলায় নিয়ে পাশে বসিয়ে কাতলার মাথা খাওয়াবে। শালা, কাতলার মাথা খাওয়াবে না সস্তা মেইড মাছের তা জানে কেডা?

থাক, আজগরকে ঘুমন্ত রেখে আগে লঞ্চঘাটের পন্টুনে এসে জরিনা দেখে, সব লঞ্চ ছেড়ে গেছে, শুধু ঢাকার লঞ্চখানা বাঁধা। আর যেসব লঞ্চ ফিরে আসবে, সেগুলোও আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা। কদম আলি পন্টুনের এক কোনায় বসে বড়ালিতে গুলসা টেংরা ধরছে। এই ভাটির গোনে টেংরা বাঁধবেই। আগে জরিনার এসব ভালোই হিসেব থাকত। আজকাল কখন কোন গোন যায়, কী হয় না হয়, ওপার চরগার মাঠে জোগার গোনে মাছ ওঠে কি ওঠে না–সেসব কোনও কিছুই তার মাথায় থাকে না। অথবা, এসব জরিনা মাথায় রাখার প্রয়োজনবোধও করে না। দরকার কী? তবু, ওই কদম আলির কাছে থেকে বড়শি নিয়ে একদিন দুইদিন কি সেও বড়শি বায়নি। এখনও চাইলে বাইতে পারে। বড়শি চাইলেই কদম আলি বলবে, যা ওইদিক, ওপাশে দেখে উপরের দিক আর একটা বড়শি আছে। আইসে বা। তয় মাছ নিয়ে বাজারে যাতি পারবি না, আমারে দিয়ে যাবি। তোগে চাউল চুলো নেই, মাছ দিয়ে করবিডা কী?

হুঁ, সারাবেলা বড়শি বাইয়ে, মাছ দিয়ে যাও ওনারে! জরিনা ভাবে। কিন্তু কদম আলির কথাও তো সত্যি, জরিনার চাল-চুলো নেই। চাল-চুলো নেই আজগরেরও। কদম আলির সংসার আছে। সে কি আর তাদের মতন। ঘাটের কেয়ারটেকার। সরকারি চাকরি। পুরোন বাজারে বাসা তার। লঞ্চ না থাকলে, যাত্রী না আসলে এই সময়ে তার কাজ কী? তখন পন্টুনে বসে বড়শি বায়। এমনকি নদীর একেবারে কুলে শ্যাওড়া গাছ, গোলপাতা গাছের তলায়ও টেংরা ধরে। কখনও এক সঙ্গে দুটো বড়শিতে মাছ ধরে কদম। তখনও জরিনা পাশে গিয়ে দাঁড়ালে বলে, কী মাছ ধরবি? তারপর জানায় কোথায় আরও বড়শি আছে।

এখন কদম আলির কাছে ভিড়ল না জরিনা। কদমের উলটো দিকের পন্টুনের একবার চোখ দিল, তারপর বের হয়ে এল লঞ্চঘাট থেকে। জরিনার একবারও মনে হল না, ঘাটে বাঁধা ঢাকার লঞ্চেও তো থাকতে পারে সুকুমার আর ঝিলিক। মনে না হওয়ার কারণও আছে। এই সময়ে কোনওভাবেই তাদের ঢাকার লঞ্চে উঠে বসে থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই।

লঞ্চঘাট থেকে বেরিয়ে, নদীর পাড় ধরে জরিনা ডাকবাংলো ঘাটের দিকে গেল। সেই পথে, যে পথ তার কল্পনায় ছিল যে, ডাকবাংলো ঘাট হয়ে সে যাবে কোর্টের দিকে। এইসমস্ত জায়গা, সবখানেই খুঁজবে তাদের। জরিনার বারবার মনে হয়েছে, আজ দুপুরে আজগর সুকুমারের সাথে কাজটা তেমন ভালো করেনি। এজন্যে জরিনা একটু হলেও মোসলেমকেও দোষ দেয়। বয়স্ক মানুষ মোসলেম, তার উচিত ছিল ঘটনাটার ওই জায়গায় একটা ভালো ফয়সালা করে দেয়া। তা করল না। আবার, সুকুমারও ওই সময় ওইভাবে রাগ দেখিয়ে চলে না-গেলেও পারত।

যাই হোক, যা ঘটার ঘটে গেছে। জরিনা এর একটা ফয়সালা চায়। সুকুমার মানুষটা খারাপ না। খেলা দেখিয়ে পেট চালায়। সেই মানুষটার সঙ্গে খালি খালি আজগর এমন করবে কেন? তাছাড়া এই জায়গায় এসেছে বেশিদিন হয়নি, আবার কবে চলে যায়, কয়দিনের জন্যে এই জায়গায় এক-একজন আসে, কিন্তু আজগর বান্দরঅলা তো বহুদিন ধরে এই জায়গায়, সে এইরম না করলেও পারত!

এসব ভাবে। যদিও জরিনার মনের তলানিতে ঘটনাটি একটু অন্য। সে কারণ, ওই ঝিলিক। জরিনা জানে না, ঝিলিকের সঙ্গে সুকুমারের সম্পর্ক কী? কিন্তু ঝিলিককে চেনে সে। ভালো মতোই চেনে। যদিও এখনও সুকুমারের সঙ্গে ঝিলিক থেকে থাকে, তাহলে অনেকদিন বাদে তাদের আবার এক জায়গায় দেখা হবে। দুপুরে বলতে গেলে এক পলক দেখেছিল, কোর্টের কোনার ওই হোটেলে, সেখানে ঢুকতে ঢুকতেই বেরিয়ে এসেছিল জরিনা। ঝিলিকের সঙ্গে ভালোমতো কথাও হয়নি। তাছাড়া জরিনা ওই হোটেলে প্রায় ঢোকেও না, যদি উকিল পেশকার মহুরিরা তাকে বের করে দেয়। একদিন এক উড়ে মালি আর তার বউ ঢুকেছিল, তাই নিয়ে দোকান মালিকের কী গালমন্দ, জরিনা তখন কাছেই দাঁড়িয়ে। তখন ঝিলিককে দেখে সে ঢুকেও ছিল, মোসলেম একটু এগিয়ে, কিন্তু ওই এক পলকের দেখার সেই মুহূর্তে টাইপিস্টদের বড়ো একচালা ঘরখানার সামইে তো চলছিল আজগর আর সুকুমারের কাজিয়া। তখন কি সে জানত, একটু বাদে ঝিলিক এসে সুকুমারের পাশে দাঁড়াবে আর তার প্রায় পরক্ষণেই তারা দুজন ওই জায়গা ছেড়ে হাঁটা দেবে।

তবে, এখন এমন না যে ঝিলিককে জরিনার দরকার। কিন্তু কতদিন বাদে দেখা। ভালোমন্দ কয়ডা কথা কইত। সেই যে মূলঘর স্টেশনে একবার দেখা, তারপর আর কতদিন দেখা নেই। কোথায় ছিল এতকাল জরিনা ঝিলিকের সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই অতীতকে ভেবে নিতে পারে। ভেবে নিতে পারে, সেই দুর্যোগের দিন ঝিলিক আর তার স্বামী তাকে কীভাবে যাত্রাপুর পৌঁছে দিয়েছিল। আজকের একটা ছোটো বাঁধাবাধিতে সেই কথাগুলো আবার মনে করা হল না। কিন্তু মনে করবে কী করে, জরিনা কি জানত ঝিলিক চেনে সুকুমাররে, আর ওই জায়গায় ঝিলিক আসা মাত্রই সুকুমার ওইভাবে রওনা দেবে রাগ হয়ে। আর তারা সবাই, এমনকি মোসলেমও, অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে তাই দেখবে। দেখেছে ভালো কথা, একবারও সুকুমারকে ডাক দেবে না? আহা, এতদিন বাদে দেখা ঝিলিকের সঙ্গে, ভালোমন্দ কয়ডা কথাও বলা হল না!

ডাক বাংলোর পরে লাইব্রেরি বিল্ডিং রেখে বাঁয়ের সুরু রাস্তা ধরে জরিনা উকিল বারের মাঠের দিকে আসে। রেজিস্ট্রি অফিসের ছোট্ট লাল দালান আর ডানে ট্রাফিক ব্যারাক ফেলে, ক্লাব আর জেলখানার দিকে এগোয়। ট্রেজারির ঘণ্টায় পর পর ছয়টা বাড়ি পড়ল, তাতে জরিনার এইসমস্ত ভাবনায় খানিকক্ষণের জন্যে ছেদ পড়ে। আলো ধরে এসেছে। আরও একটা দিন শেষ! একটু বাদেই সন্ধ্যা হবে। যদিও এই কোর্ট চত্বরে আর পার্ক এলাকায় সন্ধ্যাটা সারা শহরের চেয়ে অনেক ভালো বোঝা যায়। কোর্ট চত্বরের চারদিকে বড়ো বড়ো গাছ। আছে কৃষ্ণচূড়া, শিরীষ, মেঘনিশ আর মেহগনি। বট বা অশখও কয়েকটা। অনেক উঁচু। নারকেল গাছ কোথাও কোথাও প্রায় লাইন ধরে। একমাত্র মেহগনি বাদে সব গাছেই পাখি। নীচের পথ, পিচ ও কংক্রিটের রাস্তা–সবই পাখির গুয়ে প্রায় তলানো। পথচারী হাঁটে সেই গুয়ের দাগ দেখে। সন্ধ্যার আগে আগে প্রতিদিন নদীর ওপার থেকে পাখিরা ফেরে। কিচির মিচির কলকাকলিতে পুরো এলাকা মুখর।

জরিনা হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারল, সেটা এখনও শুরু হয়নি। তার মানে আরও কিছুক্ষণ সময় আছে সুকুমারকে খোঁজার। কিন্তু আজগর যদি এতক্ষণে উঠে থাকে। যদি উঠে থাকে উঠবে। কাজ কী? দরকারে একলা একলা চা খাবে। যদি মনে হয়, জরিনার জন্যে তার বার চাওয়ার দরকার আছে, তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। জরিনা এখনই তো ফিরবে। যাবে কোথায়? আছে কোনও জায়গায় দুই চোখ যেদিকে যায় চলে যাওয়ার?

এদিকে জরিনাই-বা আর যাবে কত দূর। সামনে স্বাধীনতা উদ্যান, আগেকার পার্ক, এখানে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। রেড ক্রিসেন্টের বারান্দার একপাশে সে এই পার্কের স্থায়ী বাসিন্দা বেঙ্গাকে বসে থাকতে দেখে। তার কাছে জানতে চায়, বেজি কোথায়? জানতে চেয়ে বোঝে এখনই জরিনার একটা দবড়ানি খাওয়া লাগবে। বেঙ্গার যেমন একটা নাম আছে, হাত পা বাঁকা বলে, আশেপাশের ছেলে ছোঁকড়ারা ডাকে বেঙ্গা, সেই থেকে বেঙ্গার সঙ্গী বেঙ্গি। কিন্তু বেঙ্গির নাম যে সুফিয়া এটা মনে থাকে না জরিনারও। সবাই ডাকে ওই নামে, এখন তাই ডাকল সেও।

বেঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে খেলার মাঠে তাকাল। ওই ছেলেরা কেউ শুনল কি না! তারপর জরিনার দিকে চেয়ে হাসল। তার মানে ওই ছেলেরা শুনলে তাকে হয়তো বলত, ওই তো তোমার নাম বেঙ্গা, সবাই ডাকে, শুধু আমরা ডাকলেই দোষ?

এই ছোট্টো পার্কটার রাত্রিকালীন একচ্ছত্র সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী এই বেঙ্গা-বেঙ্গি। পুকুরের পাশের বেঞ্চির নীচে আছে চুলো, তার সঙ্গে থাল গেলাস। বৃষ্টি বাদলার দিনে রান্না চাপায় রেড ক্রিসেন্টের ওই দিকের কোনার বারান্দায়। অন্য সময় খোলা আকাশে। খাওয়ার জন্যে পাশের ট্রাফিক ব্যারাকের চাপ কলের পানি। নাওয়ার জন্যে পার্কের পুকুর। পায়খানা রাত্রের বেলা এক কোনা কানাচিতে করে নিলেই হল, এত দালান। আবার পুকুরে তেলাপিয়া আছে, বেঙ্গি তাই ধরে। নদীতে বড়শি বাইলেও মাছ পাওয়া যায়।

যেমন, এখন বেঙ্গি উলটো দিকের জেলখানার পুকুরে তেলাপিয়া ধরছে। উলটো দিকের জেলখানার গার্ডরা কেউ গালমন্দ করলেই খ্যামা দেবে। আবার এই দুজনকে কেউ কিছু বলে না। যা বলার বলে, ওই রহমত পাগলা, যদি কখনও রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় ঘুমাতে আসে। বেঙ্গা বেঙ্গি অবশ্য বৃষ্টি না হলে খোলা আকাশের নীচে ঘুমায়, পুকুরের পাড়ের বেঞ্চিতে। যাতে লাভ এই, কেউ যদি কেউরে সঙ্গে নিয়ে আসে, বেঙ্গা বেঙ্গিরেও দুই-একটা টাকা সাধে। তারা টাকা আর চেয়ে পেলে একটা বিড়ি কি সিগারেট নিয়ে রেড ক্রিসেন্টের বারান্দায় আসে। তখন তারা পাহারাদার।

জরিনার এসব জানা আছে। আজগর বলেছে। আজগরের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক আধবার জরিনা এসেছেও কারও সঙ্গে। আজগর খাওয়ায়, রাখে, কিন্তু আজগরেরও টানাটানি, বান্দর নাচিয়ে আর কয় পয়সা। তাছাড়া একটু পান খেতে কি চুলে তেল দিতে যে পয়সা লাগে সেই পয়সার জন্যে সবসময় আজগরের কাছে হাত পাতা যায়?

আবার বেঙ্গা-বেঙ্গির এও জানা এসব কথা কারুকে বলা যায় না। বলা যাবে না। বললেই লোকসান। মাঝেমধ্যে ভদ্দরলোকের বাড়ির ছেলেপুলেরা আসে, তাদের দেখভাল করা কর্তব্য। দিনের বেলা তারাই যদি এসে তাদের তুলে দেয়, তাহলে তারা থাকবে কোথায়?

বেঙ্গা জানাল, বেঙ্গি ওই পুকুরে মাছ ধরে।

বেঙ্গির সারা শরীর স্পষ্ট। সেখানে দিন শেষের অন্ধকার একটুও নেই। কারণ, বেঙ্গি ক্লাব বিল্ডিংয়ের দিকে পিঠ দিয়ে আর সেখানে পাশের টেনিস লনের ফ্লাড লাইটের আলো। শহরে যত অন্ধকার থাক, ওই জায়গাটুকু খুব আলোকিত। সেখানে বিকেল থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত লন টেনিস খেলা হয়। সে আলোয় বেঙ্গির পিঠে আলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেঙ্গিকে পুকুরের পাড়ে দেখে জরিনা তাকে বলে, যাই। দুইজন মানষিরে খুঁজদি আইলাম, পালাম না। আর একদিন দিনেমানে আসপানে।

বেঙ্গা হাসে, না, রাত্তিরেও আইসানে, আমরা তো আছি।

কেউ শুনলে এই কথার ভিতরে কোনও ইঙ্গিত আছে কি না কোনওভাবে বুঝতেও পারবে না। জরিনাও তাই হাসল।

ফিরত পথে, ফাঁকা কোর্ট চত্বর। কিন্তু পাখির ডাকে এখন কান ভারি। একটি দিন শেষ হয়ে আসছে। একদিন এমন সন্ধ্যায় মূলঘর স্টেশনে তার সঙ্গে ঝিলিকের দেখা হয়েছিল।

সেই দেখা হওয়াটাকে আকস্মিক বলা যাবে না। যেন ওই ঘটনাটাই এমন যে, ঝিলিক আর তার স্বামীর সঙ্গে জরিনার দেখা হয়েই যেত। আরও তো কত মানুষ। জরিনা খুলনা থেকে আসছিল। যাত্রাপুর। এক ঝুমুর দলে তখন জরিনা থাকে। যাত্রাপুরে তখন লাটফলার রথের মেলা চলে। জরিনা ঝুমুর গান জানে না। কোনও গানই জানে না। তার গলায় কোনও দিনও গান নেই। একেবারে কর্কশ। এমনকি এই গলায় কোনওদিন তাকে কেউ ভালোমতো একটু মধুর করে কথা কইতেও যেন শোনেনি। যদিও অতটা কর্কশ তার গলা তাও জরিনার মনে হয় না। সেই ঝুমুর দলে গানের মেয়েদের সাহায্য করে। সাজায় কখনও। এই কাজটা ভালো পারে জরিনা। আর, সে-দলের মালিক বললে কোনও মানুষের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘণ্টা চুক্তিতে যায়। এমনকি এই দলেও কোনও কোনও মানুষ আসত, কয়েকদিন থাকত। মালিকের নির্দেশমতো জরিনা তাদের সঙ্গেও শুয়েছে। এটা ওসব দলে স্বাভাবিক ঘটনা। তাছাড়া জরিনা তখন যাবেই-বা কোথায়।

কিন্তু সে রূপসা গিয়েছিল দিন তিনেক আগে। আগে থাকতেই জানত লাউফলায় এত তারিখ থেকে ঝুমুর দল যাবে। মালিক তাকে আগেই বলেছিল। সেবার অবশ্য এই লাউফলা রথের মেলাতেই জরিনা প্রথম আজগরকে দেখেছিল। তখন আলাপ পরিচয় সেভাবে হয়নি। কিন্তু প্রথম দিনের দেখা আর আলাপ পরিচয় প্রায় না-হওয়া সেই আজগরের সঙ্গে জরিনা এইভাবে জড়িয়ে যাবে, তাকি সে কোনও দিনও কোনওভাবে জানত। তবে, সেও ঝিলিকের সঙ্গে মূলঘর স্টেশনে দেখা হওয়ার পরের বছরের ঘটনা।

রূপসা থেকে ট্রেনে যাত্রাপুরের উদ্দেশে রওনা দিয়ে, মূলঘর ক্রসিঙে আসতে জরিনা শোনে ট্রেন আর যাবে না। খানজাহানপুরে লাইনে সমস্যা হয়েছে বৃষ্টিতে। অথচ মাঝখানে স্টেশন ওই একটাই, খানজাহানপুর। খানজাহানপুরের পরেই যাত্রাপুর। তাও ট্রেন খানজাহানপুর পর্যন্ত গেলেও হত, পরের পথটুকু সন্ধ্যাসন্ধি সে যাত্রাপুরে পৌঁছতে পারত। কিন্তু এখান থেকে যাওয়া সম্ভব না। বৃষ্টি বাদলার দিন। রূপসা থেকে ট্রেনে ওঠার সময়ই প্রবল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রওনা দিয়েছিল। মানুষ বলে, রথের মেলার সময় বৃষ্টি হবেই। তা বৃষ্টি হবে ভালো কথা, আষাঢ় মাসে তো বৃষ্টি হবেই, কিন্তু সেই বৃষ্টি এমন হওয়া লাগে যে ট্রেন চলতে পারবে না লাইন দিয়ে।

আসলে, বৃষ্টি একটা কারণ হয়তো, তবে খানজাহানপুরে ট্রেন লাইনেও সমস্যা হয়েছে। মূলঘর স্টেশনে লোকে লোকারণ্য। ছয় বগিতে উপচানো মানুষ নিয়ে চলছিল ট্রেন, অনেকের গন্তব্য যাত্রাপুর। অবশ্য এই সন্ধ্যার মুখে কয়জনই-বা যাবে যাত্রাপুর। তখন জরিনার খেয়াল হয়, কাল শুক্রবার, ছুটির দিন, খুলনায় অফিস করা মানুষজন সব বাগেরহাটে যাচ্ছিল এই বিকালের ট্রেনে।

মূলঘর স্টেশনে নেমে জরিনা পরিচিত কাউকে খোঁজে। এত মানুষ কিন্তু জরিনার পরিচিত আশেপাশে তখন একজন মানুষও নেই। ট্রেনটা উলটো দিকে কিছুদূর গিয়ে দাঁড়ায়। স্টেশন বৃষ্টি কমলে ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায়। জরিনা একবার নেমে রাস্তায় গিয়েছিল। ভ্যান পাওয়া যায় একটু পর পর। কিন্তু সবাই বাগেরহাটে যাবে। তাছাড়া জরিনা যে ভ্যানে যাবে, তখন সেই পয়সাও তার কাছে নেই, সুযোগ পেয়ে ভ্যানঅলা ভাড়া বাড়িয়েছে। এক ভ্যানে চারজন করে যাচ্ছে, সেখানে জরিনা একা-একটা মেয়ে মানুষ, রাস্তায় গিয়েও তার যাওয়ার সুযোগ হল না। একদিকে আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। তখনও যে দিন অবশিষ্ট আছে, তাই এতক্ষণ তো প্রায় বোঝাই যাচ্ছিল না, এখন আবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসায় চারদিক আরও অন্ধকার হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে স্টেশনে লোক কমেছে। প্ল্যাটফর্মে লোকজন যা ছিল তারা সব ছাউনির নীচে, টিকেট ঘরের সামনে। তার এক কোনায় জরিনা এসে দাঁড়ায়। তার পাশে তখন বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়ানো ঝিলিক। কথায় বোঝা যায় পাশের লোকটা তার স্বামী। কোলের বাচ্চাটা ঘুমিয়ে। কোলে নেয়ার তুলনায় বেশ বড়োসড়ো। জরিনা তাদের দেখে। ঝিলিকের কপালের সিঁদুর বৃষ্টিতে ধুয়ে কিছুটা লেপ্টে গেছে। ঝিলিকের স্বামী জরিনা তাদের কাছে দাঁড়ানো দেখেই কপাল কোঁচকায়। জরিনা সেটা লক্ষ করে। হয়তো দিন হলে, চারদিক একটা অন্ধকার না হয়ে আসলে ঝিলিকের স্বামীর ওই অস্বস্তি জরিনা আরও ভালো বুঝতে পারত।

জরিনাও লোকটার দিকে চোখ বড়ো করে চাইল। ঘরের বউঝির কাছে জরিনার মতো মেয়ে মানুষ ভিড়লেই, এসব লোকের চোখ ছোটো হয়ে আসে, কিন্তু সুযোগ পাইলেই যে গায়ে হাত দেয়, চোখ টেপে কখনও গাও টেপে, তাও তার জানা আছে। এই লোকটিও তাই। জরিনা এসব পাত্তা দেয় না। এমন মানুষ তার অনেক দেখা আছে। কিন্তু বৃষ্টির ছাঁটের কারণেই তো সে তাদের একটু কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। না হয় এই জায়গায় দাঁড়ানোর তার কোনও দরকার ছিল?

কিন্তু এসব উলটে ঝিলিক তার সঙ্গে কথা কয় নরম গলায়। তার আগে সে তার স্বামীকে বলে ছেলেটাকে একটু কোলে নেওয়ার জন্যে। হাত দুটো ব্যথায় প্রায় বিষ হয়ে গেছে। আর পারছে না। তারপর গলা নামিয়ে জরিনার কাছে জানতে চায়, সে কোথায় যাচ্ছিল।

জরিনা তা বলল। ঝিলিক জানাল, তারাও যাবে যাত্রাপুর, তবে লাউফলা রথের মেলায় নয়, বিষ্ণুপর। সেখানে ঝিলিকের নন্দেজামাই বাড়ি, সে-বাড়িতে কাল ননদের ছেলের মুখেভাতের অনুষ্ঠান। এখন এই বর্ষায়, ট্রেনের এমন অবস্থা হল! তারা যদি না যেতে পারে, তাহলে কি সারারাত এই জায়গায় থাকতে হবে।

এরপর তাদের এই যাওয়া নিয়ে আরও কথা হয়। এমনকি কে কোথায় থাকে, তার স্বামী কী করে এইসব নিয়েও, স্বাভাবিক যে সমস্ত কথা তাদের ভিতর হতে পারে। জরিনা তখনও ঝিলিকের নাম জানে না, ঝিলিকও জানে না জরিনার নাম। কিন্তু পরস্পরের কথা চলতে থাকে। ঝিলিকের স্বামী পাশে ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনে। জরিনার কেন যেন একবার একবার মনে হয়, মেয়েটার স্বামীটা একটু গোয়ার আর বলদা কিসিমের। আবার তাও খানিক বাদে তাদের কোনও কথার ভিতরে কথা বললে আর মনে হয় না। আবার, কিছুক্ষণ পরে জরিনার এও মনে হয়, তার সঙ্গে যে কথা বলছে ঝিলিক, তাও পছন্দ করছে না ঝিলিকের স্বামী! ঝিলিক এরপর জানতে চাইল, লাউফলায় সে কোথায় যাবে? জরিনা জানিয়েছে, সে লাউফলা রথের মেলাতেই যাবে। এক ঝুমুর দল এই মেলার কয়দিন থাকবে সে। কথাটা যেন শুনে ফেলে ঝিলিকের স্বামী। যদিও তেমন নীচু গলায় জরিনা বলেনি। জরিনার দিকে তাকাল ঝিলিকের স্বামী। তবে, ঝুমুর দলে থাকা আর অন্যান্য বিষয়ে কিছুই যেন বোঝেনি ঝিলিক। সে জানে, ঝুমুর একপ্রকার গানের দল।

এ সময় বৃষ্টি একটু ধরে আসে। প্রায় নেই, যদিও থাকে তা গাছের পাতার পানি। প্ল্যাটফর্মের থেকে বাইরের রাস্তার দু-পাশই গাছ ছাওয়া। এখান থেকে বৃষ্টি কী পরিমাণে পড়ছে তা বোঝা যায় না, বৃষ্টি থেমে গেলেও, গাছের পাতার পানি পড়ায় মনে হয় এখনও বৃষ্টি আছে। তবু, প্ল্যাটফর্মের চালের টিন থেকে পানি প্রায় পড়ছে না দেখে ঝিলিকের মনে হল, এখন তার স্বামী রাস্তায় গিয়ে ভ্যান ডাকতে পারে। ঝিলিক তার স্বামীকে একটু নীচু গলায় তাই বলল, এহোন যাবা নাকি, বৃষ্টি মনে কয় ছ্যাঁক দেবে। দেহো, এট্টা ভ্যানট্যান পাও নাকি।

দেহি। ঝিলিকের স্বামী বলে, আর-এট্টু ছ্যাঁক দিক।

দেহি না। সন্ধ্যা হইয়ে আইচি–এট্টু পর চাইরদিক অন্ধকার হইয়ে যাবে। পথ তো এহেবারে কম না। আমরা দুইজন মাইয়ে মানুষ, জরিনার দিকে ইঙ্গিত করল, এই দিদিও যাবে আমাগো সাতে। যাও। মানুষ কম না, চালিই ভ্যান পাবা নানে।

প্ল্যাটফর্মের টিমটিমে আলো জ্বলছে। এরপর রাতে আর মাত্র দুটে ট্রেন আসত দুই দিক থেকে। তা আর আসবে না। ভিড় দ্রুত পাতলা হচ্ছে। যারা এরপরের স্টেশনে যেত তারা হাঁটা শুরু করেছে। আবার উলটো দিকের যেসব যাত্রী খানজাহানপুর থেকে এই ফকিরহাট মূলঘরে আসত, সেসব ভ্যানের কোনও কোনওটা এতক্ষণে প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে দাঁড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই দুই দিকের সব স্টেশনেই এ খবর পৌঁছে গেছে, রেল লাইনে সমস্যা। ঝিলিকের স্বামী সে-সবের কিছু বুঝতে পারছে কি না কে জানে?

তবে লোকটা এবার একটু গা-ঝাড়া দিল। ছেলেটাকে ঝিলিকের কোলে দিয়ে নেমে গেল প্ল্যাটফর্ম থেকে। নেমে যেতে যেতে একবার তাকাল ফিরে ঝিলিকের দিকে। ঝিলিক তাতে হাসল, কেন জানি মনডা খারাপ!

জরিনা জানতে চাইল, কেন, হইচে কী?

যে নন্দেজামাইর বাড়ি যাচ্ছি, তারে মেটে চোখে দেকতি পারে না। কবে জানি আমার ছোটো ননদের হাত ধইরে টান দিল, তখন আমার বিয়ে হইনি, সেইর পরদে ওই লোকের বাড়িঘরে আর যায় না। এবার আমার ননদ আইসে কইয়ে গেইচে। কন সেই মোল্লাহাট পর্যন্ত গেইচে নিমতন্ন। করতি, ছেলের মুখেভাত, না গেলি দেখি হয়? উনি এই দেশে বড়ো মামা!

মুখেভাত বিষয়টা জরিনা বোঝে, কিন্তু তার সঙ্গে বড়ো মামার যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়টা তার জানা নেই। কিন্তু তার কথায় বুঝল, এই অনুষ্ঠানে তার স্বামীকে ঝিলিকই নিয়ে যাচ্ছে।

ঝিলিক এবার বিড়বিড় করল, এহোন ভ্যান কি পাবেনে? জানে কেডা!

পাবে। এহোনও তো রাত্তির হইনেই। তাছাড়া ভ্যানঅলারও জাইনে গেইচে—

হয়, পালি হয়।

আপনাগো পাইয়ে আমার খুব উপকার হল। কী উপকার তা কইয়ে বুঝোতি পারব না।

কী হল, আবার? আপনি একলা মানুষ, একভাবে না একভাবে কইলে যাতি পারতেন। ভিজদি ভিজদি গেলি তো এতক্ষণ ভ্যানে উইঠে প্রায় পৌঁছোইয়ে যাতেন।

তা যাতাম। কিন্তু কী কব–আমার ধারে আছে মোটে দুই টাকা–এইয়ে দিয়ে ভ্যানে নেত নাকি আমারে! যদিও জরিনা জানে, কথাটা সে ঠিক বলেনি। তার কাছে আরও চার টাকা, মোট ছয় টাকা আছে। সব এক টাকার নোট। ট্রেনে সে টিকেট কাটেনি। কখনওই কাটে না।

মোটে দুই টাকা নিয়ে বাড়িদে বাইরোইচেন? ঝিলিক একটু সন্দেহের চোখে জরিনার দিকে তাকায়। এমনিক তার জিজ্ঞাসার ভিতরে আছে অবিশ্বাস।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জরিনা কথাটা অন্য দিকে নিয়ে গেল, আমার আবার বাড়িঘর আছে নিকি?

এবার ওই আধো অন্ধকারে ঝিলিকের তার দিকে তাকানোটা বদলে গেল। সেখানে জরিনা কোথার মানুষ কেমন মানুষ তা যেমন, একইসঙ্গে যেন কিছু করুণাও। হয়তো একই সময়ে জানতেও চাইত কোথায় তার বাড়িঘর অথবা বাপের বাড়ি, আর বিয়ে-থা এইসমস্ত কিছু হয়েছে কি না। তখনই ঝিলিকের স্বামী তাদের ডাকে। দুই থাক সিঁড়ি ঝিলিক ছেলেটাকে কোলে নিয়ে নামে, তারপর তার স্বামী এসে ছেলেটাকে কোলে নেয়। নীচের দিকে বাকি আরও দুটো সিঁড়ি নামতে নামতে ঝিলিক জরিনাকে বলে, চলেন–

ঝিলিক খেয়াল করেছে, সে নামার সময় জরিনা দাঁড়িয়েছিল। তার স্বামী হয়তো শুধুই ঝিলিককে ডেকেছে। জরিনা তখনও নিজের সংকট কাটাতে পারেনি। জানে না, তারা তাকে সঙ্গে নেবে কি না?

তারপর ঝিরিঝির বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জরিনা ঝিলিক ও তার স্বামীর সঙ্গে ভ্যানে ওঠে।

তাহলে, জরিনা কখন জেনেছিল তার নাম ঝিলিক। ক্লাবের কাছে থেকে প্রায় একইরকম আধো অন্ধকারে, লঞ্চঘাটের নদীর পাড় পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে জরিনা মনে করতে পারে না, সে কখন জেনেছিল তার নাম ঝিলিক। আজ মোসলেমের সঙ্গে কোর্ট চত্বরে ঢুকতেই দেখেছিল, মোসলেমকে বলেও ছিল, তারপর ওই যে সুকুমারের সঙ্গে এসে যখন ওদিকে চলে গেল, তখন তো তার দেখার কোনও ভুল ছিল না। তাহলে, নামটা জানল কখন?

সেটা এখন মনে না করলেও চলবে। এই জীবনে কত পদের মানুষের সঙ্গে দেখা, কত মানুষের সঙ্গে কত পদের রঙ্গ তামাশা, এক ঘণ্টা আধ ঘণ্টায়ও দেখা, সেখানে ভ্যানে প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তায় সে একজনের সঙ্গে আলাপে তার নামটা কখন জেনেছিল, তাই মনে রাখতে হবে? নামটা যে মনে আছে এই বেশি। না, নামটা মনে থাকবে। ওই বাদলার দিনে তার কত উপকার করেছিল। যাত্রাপুর পর্যন্ত আসতে আসতে প্রায় রাত। তারপর স্টেশনের কাছে নেমে প্রায় পৌনে এক মাইল পথ হেঁটে লাউফলা।

লঞ্চঘাটের গলিতে ঢুকতে ঢুকতে জরিনার মনে পড়ে, না সে কখনও নাম বলেনি। বার দুই তার নাম ধরে ডেকেছিল তার স্বামী, তাই নামটা এখনও তার মনে আছে। এমনকি সেই ঘুম ঘুম বাচ্চা ছেলেটাকে দুইবার মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকেছিল, ভরত; তাও আরও কিছুক্ষণ ভেবে জরিনা মনে করতে পারে। গোলমতো মুখ ছেলেটার, মুখোনায় কত মায়া! কোলে নিয়ে চুমু খেতে মন চায়। ভ্যানে ওই বাচ্চা ছেলের পা তার গায়ে লাগলে, সে পায়ে হাত বুলিয়েছিল।

আজ এখানে, হঠাৎ সেই ঝিলিক! একলা, সুকুমারের সঙ্গে কী! কোনও কেসের জন্যে মোল্লারহাট থেকে এসেছে? সুকুমারের বাড়ি মোল্লারহাট? জরিনা জানে না কিছুই। চলে গেছে নাকি দুপুরের পরের ট্রেনে?

নদীর পাড়ে আজগরের ঝুপড়ির কাছে এসে জরিনা দেখে, আজগর দরজার সামনে একখানা ভাঙা টুলে বসে অনবরত কাশছে! লোকটার গলায় সমস্যা হল না তো। এই কাশির দমকটা কয়দিন বাদে বাদেই পেয়ে বসে। আজও বসেছে। পকেটে পয়সা আছে, নাকি? থাকলে এই কাশির দমক কমাতে যাবে কামারপট্টির পিছনে। সেখান থেকে শালসার বোতল ভরে এনে নদীর কূলে অথবা পন্টুনে বসে গলায় ঢালবে। তাতে নাকি কাশির দমক কমে।

জরিনা ওই অবস্থায় আজগরকে বসা দেখে ভাবে, যা থাকে কপালে আজ তাকে কোনওভাবে কর্মকারপট্টির দিকে যেতে দেবে না। নেশার পয়সা নাকি ভূতে জোগায়। যেভাবেই জোগাক, যাই ঘটুক আজ আজগরকে সে আটকাবেই। নাকি জরিনাকে দেখে ইচ্ছে করে এই কাশির দমকটা তুলেছে, যাতে শালসার বোতল ভরে মাল আনতে ওদিকে যেতে পারে।

জরিনা একটু খেঁকিয়ে জানতে চায়, কী হইচে তোমার, কাশো কী জন্যি?

আজগর কোনও উত্তর দিল না। মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে যেভাবে বসেছিল, সেভাবেই বসে থাকল। জরিনা যে কিছু জিজ্ঞাসা করেছে, তাও যেন এখন তার কাছে যেন পাত্তা দেওয়ার মতো নয়। তাকে কাশতে দেখলে জরিনা গলা অমন কর্কশ করে, আজগরের জানা আছে।

আজগর উত্তর না-দিলেও উঠে গেল। জরিনা নদীর কূলের কাঁচা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। আজগর যেন জরিনাকে দেখেইনি। সোজা হেঁটে একটা দোকান থেকে এক ঠোঙা মুড়ি আর চারটে কলা কিনে নিয়ে এল। ঝুপড়ির সামনে আসার আগে দুটো কলা দিয়ে এল বাঁদর দুটোকে। পাশে ঢালল কিছু মুড়ি। তারপর ঝুপড়ির সামনে আসতে আসতে জরিনাকে বলল, খাবা? খাইলে নেও। বসে পড়ে একটা কলা ছালতে লাগল, বাকিটা পাশে রাখল। ঠোঙা থেকে মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে, কলায় কামড় দিয়ে আবার জরিনাকে বলল, কী কই, কতা গায় লাগে না?

জরিনা একটু অবাক হল। একটু আগে তাহলে লোকটাকে গালমন্দ করছিল কেন? তার জানা আছে, মাতালের স্বভাব তো কোনওকালে যায় না। সব সময়ই বলে এসেছে, কাশির দমক থামানোয় ওই জিনিস হল একেবারে ওষুধ! আইজ ওই ওষুধ খাবে না। নাকি এখন এই কলা-মুড়ি খেয়ে একটু বাদে হেলে দুলে যাবে কর্মকার পট্টির দিকে?

নিজের কলাটা ছুলতে ছুলতে জরিনা আজগরকে বলে, জানো, ওই যে সুকুমারের সাথে যে বিটিরে দেকলাম, তারে আমি চিনি!

সে তো তোর চোখ দেইকা তখন বুজজি!

কিন্তু সে সুকুমারের চেনে কী কইরে?

তোগো মতন মাইয়েগো মানুষ চিনতি সময় লাগে নাকি?

সব সময় এক কতা। আমাগো মতন মাইয়ে মানুষ। কী আমাগো এট্টা দুধ বেশি গজাইচে নিকি?

সেয়া গজাইলেও মন্দ হইত না। বাইর কইরগা মাইনষেরা দেহাইয়া বেড়াইতে পারতি!

খালি ফাও কতা যত। তোমার তা খাতিও আমার ঘেন্না করে!

তাইলে খাইস না।

এবার জরিনা একটু এগিয়ে এল। গলাও একটু নামিয়েছে, কেন, খালি ফাও কতা কও কেন?

অন্ধকারে আজগর জরিনার দিকে চায়। এই খোটা দেয়া কথা বলার পরও তো ঢঙ করা কমে। কত রঙ্গ জানে যে জরিনা।

জরিনা বলে, কীভাবে চিনি সেয়া শোনবা না?

শোনবানে। তুই কি তারে খুঁজদি গেচেলি? পাইচো?

না, পাই নেই।

তালি চুপচাপ বইসে থাক। সুকুমারের পাইলে সব জানতি পারবি–

তা পারব। তয়, একবার ফকিরহাট স্টেশনদে একসাথে ভ্যানে আইলাম। সাতে ঝিলিকের স্বামী আর ছল। ঝিলিক হিন্দু, মাথায় এই জায়গায় সিন্দুর দেয়া, হাতে শাখা। কী বৃষ্টি সেদিন! কোন জায়গায় জানি টেরেন পইড়ে গেইল লাইনেদ-

বোঝলাম তো। সুকুমারের পাইলে সব জানতে পারবি!

জরিনা যতই উৎসাহের সঙ্গে বলুক, কোনওভাবেই বুঝতে পারছে না, কেন আজগর তার কথার গুরুত্ব দিচ্ছে না। এতদিন পরে দেখা। কী সমাচার। গেরস্ত ঘরের বউ, কেন এই জায়গায়?

তা অবশ্য এর কিছুক্ষণ বাদেই জানতে পারে জরিনা। ততক্ষণে আজগরের কাশির দমক কমেছে। আজগর ঝুপড়ির দরজায় বসে ঝিমায় যেন। জরিনার দিকে খেয়াল নেই, এমনকি রাতে কী খাবে, কোথায় খাবে তা নিয়েও ভাবনা নেই। আজগর এ রকম ঝিম মেরে থাকার বিষয়টা জরিনা কিছুটা হলেও বোঝে। আসলে, তলে তলে ধান্দা, ভাবছে যাবে নাকি একবার কর্মকারপট্টির দিকে। যদিও আজ আজগর সেই দিকে যেতে পা বাড়ালে জরিনা ঠিক করে রেখেছে, সে বাধা দেবে। কিন্তু আজগর কিছুই বলছে না। ঢাকার লঞ্চটায় আলো জ্বলে গেছে। আর হয়তো কিছুক্ষণ বাদে ছাড়বে। লঞ্চঘাট কিছুটা আলোকিত। জরিনা আর আজগর বসে আছে অন্ধকারে। জরিনা ভাবে, লোকটার কাছে জানতে চাবে নাকি তার ধান্দা কী? এমন মেরে বসে আছে কেন? যদিও সে জানে, আজগর কখনও কখনও এ রকম ঝিম মেরে বসে থাকে। এখনও তাই বসে আছে। নাকি সে এখান থেকে সরলেই যাবে ওই শালসার বোতলের খোঁজে।

জরিনা এবার জানতে চায়, কী? রাত্তিরে খাওয়া-টাওয়া লাগবে না? নাকি সারা রাত্তির এই জায়গায় বইসে মশা মারবা?

আজগর পয়লা চুপ করে থাকে। আবার কাশে। সে বোঝাতে পারছে না, কোনওভাবেই শরীরটা ভালো লাগছে না তার। অন্ধকারে একবার জরিনার দিকে মুখ তুলে চেয়ে হাসল। তারপর জরিনার কথা ঘুরিয়ে দিতেই যেন বলল, আইজ আমারে এহেবারে কাবু বানাইয়ে দেলা।

হইচে–বুড়ো হাড়ে কত সাধ তোমার! কিন্তু এহোন ওই কতা কলি পেট ভরবে না। খাইয়ে ঘুম দেও আবার!

যাও তয়। ওই লালির দোকানদে রুটি নিয়ে আসো। সাতে লাচড়া আইগো।

আনবানে। তুমিও চলো।

আমি যাইতে পারলে তোরে যাইতে কই?

আমি রুটি আনতি গেলিই তুমি শালসা টানতি যাবা!

না, যাব নানে।

আজগর জরিনাকে রুটি আনতে টাকা দেয়। জরিনার তাও কেন যেন মনে হয়, সে নদীর কূল ধরে নাগের বাজারের দিকে এগোলেই আজগর এ জায়গা থেকে উঠে যাবে। অন্যদিন আজগর গেছে যাক, আজগর ওইসমস্ত খেয়ে কাঁদে, তাও সে জানে। কিন্তু আজ যেন না যায়। ও জিনিস জীবনে বেশ কবার জরিনাও খেয়েছে। খেতে মন্দ লাগে না। আজগরের সঙ্গেও খেয়েছে। মনটা খুলে যায়। একলা একলা তখন জীবনের কত কথা কইতে সাধ জাগে। কিন্তু এই গরমে? এই গরমে খাইলে আর উপায় থাকবে না। কাপড়-চোপড় খুলে বসে থাকতে হবে। পুরুষ মানুষ তবু খালি গায়ে নদীর কূলে হাওয়া খেতে পারে। তার মতন মেয়েছেলে?

আজগর রুটি আনতে উঠবে না বুঝে জরিনা বলে, তালি নদীতে এটা ডুব দিয়ে আসো। সেই সহালে নাইচো, তারপর আর নাওনি–সারাদিন যে গরম গেল!

আজগর নীচু গলায় বলল, তুমি নাবা না?

রুটি কিনে আইনে। তুমি তালি ওঠো। যাও, নাইয়ে আসো–দেইহেহানে তারপর শরীলডা ভালো লাগবে। আর কাশপা নানে-

কথাটা মন্দ বলেনি জরিনা। তা যাবে। হাঁটু মোড়া থেকে কাতরানো শব্দ করে আজগর উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে কোথায় গামছা, কোথায় কী? লম্ফে নেই কেরোসিন। আনার দরকারও নেই। জরিনা দাঁড়িয়ে থাকে। আজগর জানে, সে নাইতে ডাকবাংলো ঘাটের দিকে না যাওয়া পর্যন্ত জরিনা দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝুপড়িতে হাতাতে হাতাতে আজগর গামছা পায়। জামাটা খুলে দরজায় ঝুলিয়ে রাখে। তারপর খালি গায়ে ডাকবাংলো ঘাটের দিকে রওনা দেয়। যাবার সময় গলায় বেশ দরদ দিয়ে বলে, যাও তয়। এই দেহো আমি নাইতে যাইতেচি।

জরিনা বলে, যাও। বলে জরিনার বেশ ভালো লাগল। যতই কোক, গালমন্দ করুক, লোকটা কথাও শোনে। তা শোনে। মনে কত দুঃখ নিয়ে আজ এই বান্দর নাচাইয়ে খায়। সেই দুঃখের কথা কেউরে কয় না। কখনও কখনও জরিনাকেও না। শুধু পেটে শালসার বোতলের পানি পড়লেই মুখ খুলে যায়।

হাফেজের রুটির দোকান একটু এগোলেই। সেখানে পৌঁছে জরিনা দেখে নদীর কূলে দাঁড়িয়ে আছে সুকুর আর ঝিলিক!

আজগর ফিরে এসে দেখে জরিনার সঙ্গে বসে আছে তারা।

০৫. কোর্টের সামনের ক্যানভাসার

এই কোর্টের সামনের ক্যানভাসারদের ভিতরে একটু উলটো ধাঁচের মানুষ ইব্রাহিম শেখ। জামা কাপড়ে আলাদা, আচরণেও। এমনকি চেহারা সুরতেও একটু ভিন্ন কিসিমের। যদিও মানুষটা বেচে ধ্বজভঙ্গের তেল আর মানুষ আটকে রাখার জন্যে শেখায় সাপে কাটলে সেই রোগীকে কীভাবে সুস্থ করতে হবে।

ইব্রাহিম শেখের পরনে থাকে বেলবটম প্যান্ট, ফুলহাতার এক রঙা শার্ট, পায়ে কালো চকচকে অক্সফোর্ড জুতো। সেই শার্ট সাধারণত সাদা অথবা একটু নীলচে। এখন অবশ্য বেলবটম প্যান্টের যুগ বা হুজুগ দুটোই গেছে। রাজ্জাক পরে না, আলমগীর পরে না, সোহেল রানাও পরে না, জাফর ইকবালের তো পরার প্রশ্নই ওঠে না। ইব্রাহিম উচ্চতায় বেশ, প্রায় ছ-ফুটের কাছাকাছি, তাই তার পোশাকে অনুকরণ একটু নায়ক আলমগীরের দিকে। যদিও, এখন নয়া আর পুরোনো ভদ্দরলোকরা সবাই প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাফারিতেই অনুসরণ করে। কিন্তু ইব্রাহিম তলে তলে এরশাদকে দেখতে পারে না। কেন পারে না, কেউ জানে না। তার সহযাত্রী ক্যানভাসারদের কারও এরশাদই হোক আর জিয়াই হোক কিছুই আসে যায় না। এ বিষয়ে তারা কিছু তেমন বোঝেও না। একমাত্র ব্যতিক্রম মোসলেম উদ্দিন। মোসলেম জিয়া-এরশাদের নামই শুনতে পারে না। তাদের এক জন প্রেসিডেন্ট ছিলেন অন্য জন প্রেসিডেন্ট আছেন, এসব কথা বললে সে বলে, শেখসাব বাইচে থাকলি এইসব চৌকিদার-দফাদার-লাঠিয়ালগো কোনও খোঁজ থাকত না। তার ডাকে মানুষ যুদ্ধে গেইচে। এই কথায় অবশ্য ইব্রাহিমই সমর্থন জানায়। যদিও ইব্রাহিম কি সুকুমার সবই তার হাঁটুর বয়েসি, শেখসাবের রাজনীতির কিছুই তাদের জানা নেই। জানার যদি কিছু জানে আজগর। আর বারিক, সারাটা জীবন সে ওই চোখ জোড়া অমন তন্দ্রায় তালিয়ে দিয়ে কাটিয়ে দিল। এর মাঝে বছর সতের আগে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার ওই তন্দ্রায় মনে হয়, তখন সারাটা সময় সে এই বটগাছের নীচে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে।

ইব্রাহিম অবশ্য এসব কথা একমাত্র মোসলেম ছাড়া কখনও কাউকে বলেনি। একটু নিজের মতো থাকা মানুষ। আয় রোজগার ভালো। সেটা যে ভালো তা তার পোশাক দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তুইব্রাহিম শেখ মানুষটা একটু আলাদা বটে। সেটা আজগর জানে, জানে অন্যরাও।

যদিও ইব্রাহিম মজমা মেলায় মঘা ওষুধের। কোর্ট চত্বরে কি এখানে আগত মানুষজন। যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধকে মঘা ওষুধ বলে। এমনকি ইব্রাহিম যত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভাব নিয়ে চলুক না কেন, একটু দূর থেকে হেঁটে যেতে লাগলে, তাকে কেউ কেউ হাত তুলে দেখায় : ওই যে মঘা যায়। ইব্রাহিম কখনও কখনও তা শোনে, মাথার বাবড়ি দুলিয়ে পারলে চকিতে সেদিকে তাকায়, বুঝলে পারলে যে বলছে তাকে দেখে, না চিনতে পারলে একটু মচকি হাসে। লম্বা একাহারা মানুষের ভিতরে হয়তো একটা বিনয়ী ভাব থাকে, ইব্রাহিমের ভিতরে সেটা আছে। কোনওপ্রকার অসন্তোষ নেই তার আচরণে, এমনকি নেই স্বভাবে কোনও খিটিমিটি ভাব। এমনিতে গলা উঁচু করে প্রায় কথাই বলে না, সাধারণ গলার স্বরও একটু চাপা, কিন্তু আসরে দাঁড়ালে কে বলবে এই ইব্রাহিমের গলায় এত জোর। কোত্থেকে সে গলা কাঁপিয়ে এইভাবে কথা বলতে পারছে। তার তেল দেওয়া বাবড়ি চুলের এই দোলানিতে চটক যে কোত্থেকে আসে!

গতকাল, গত পরশু আর তারও আগের দিন, এই চত্বরে মজমা মিলেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কারওই লাভের লাভ তেমন হয়নি। অথচ লোক সমাগমে কোনও কমতি নেই। ট্রেন নিয়ে একটা ঝামেলা চলছে, তাতে গোটা শহর উত্তাল। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাগেরহাট-রূপসা রেল লাইনের ট্রেন তুলে নেবে। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেন দরবার করবেটা কে? শহরের অনেকেই সরকারি দল করে। তারা তো এ নিয়ে কোনও কথা বলবে না। ওদিকে যারা এখনকার বিরোধী দল, তারাই শহরের রাজনীতিতে ভারি, কিন্তু ট্রেন নিয়ে আন্দোলনে তাদের অনেকের নামেই কেস হয়েছে। ওদিকে কলেজের ছেলেরা কোনওভাবেই এই ট্রেন তুলে নিতে দেবে না। ট্রেন উঠে গেলে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। এই নিয়ে আন্দোলন। কোর্ট চত্বরে বারবার ছাত্ররা আসে মিছিল নিয়ে, ডিসির কাছে স্মারকলিপি দেয়। ফলে, চত্বরে লোক সমাগম হয়, কিন্তু ক্যানভাসারদের আসর কোনওভাবেই জমে না।

জমবে কীভাবে? এই কোর্টের উকিলদের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বড়ো উকিলদের কেউই সরকারি দল করেন না। ট্রেন নিয়ে ছাত্রদের এই আন্দোলন খুবই যৌক্তিক। কলেজে একটা স্টেশন আছে, সেই সামন্তসেনা-বাহিরদিয়া-মূলঘর-ফকিরহাট থেকে ছাত্ররা যে পড়তে আসে তা তো এই ট্রেন লাইন ধরেই। মূলঘরের এদিকে পরে খানজাহানপুর-যাত্রাপুর-ষাটগম্বুজ এলাকার মানুষজন আর ছাত্রছাত্রী সবাই শহরে আসে এই রেললাইন ধরে। আর, ইব্রাহিম হোক আর আজগর হোক, হোক সুকুমার কি মোসলেম উদ্দিন, এমনকি দিলদার–কে আছে যে জীবনে একবার আধবার রেল স্টেশনে মজমা মিলায়নি। তাছাড়া রেলগাড়ি চলে সারাটা বছর, কোন দিন কামাই নেই, বিরতি নেই, কিন্তু কোর্টও তো বন্ধ থাকে। তখন তাদের একমাত্র সহায় রেল লাইন, রেল স্টেশন। ওই জায়গায় গিজগিজে মানুষ, এই আসে এই যায়, কারও তাড়া আছে কারও নেই। একটু খোলা জায়গা পেলে তখন হাউশ মিটিয়ে ক্যানভাস করা যায়।

কিন্তু এর ভিতরে তো এই কথাও শোনা যায়, এই রেল লাইন তুলে দেয়ার পিছনে বাস মালিকদের একটা ভূমিকা আছে। তারা চায় না এই রূপসা-বাগেরহাট লাইনে আর ট্রেন চলুক। ট্রেনে বেশির ভাগ মানুষ মাগনা যায়। টিকিট কাটা লাগে না। ফলে বাসে কোনও মানুষ ওঠে না।

বাসের রাস্তা আগে ট্রেন লাইনের প্রায় পাশ দিয়েই ছিল। এখন পিরোজপুর মোংলা রোডের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন রাস্তা হয়েছে। এই রাস্তার নাম মানুষের মুখে, সিএন্ডবি রোড। সে-রাস্তা অনেক বড়ো। এদিকে দড়াটানা ঘাটে ফেরি, পার হয়ে পিরোজপুর যেতে হয়, ওদিকে রাস্তা মিলেছে মোংলা-খুলনা অথবা মোংলা রূপসা রোডের কাটা খালিতে। মোংলা-খুলনার রাস্তা আরও সুন্দর।

এসব কথা যেমন শহরবাসীর জানা আছে, জানা আছে এই কোর্টের এলাকার মানুষজনদের। এও জানা আছে, এই ট্রেনের পিছনে সরকার আর ভর্তুকি দিতে পারছে না, তখন কলেজের ছাত্ররা এক-দুই দিন ট্রেনের টাকা তুলে দেখিয়েছে, সরকার চাইলে কত টাকা তুলতে পারে।

কিন্তু তারপরও সবার মনে হচ্ছে, ট্রেনটা থাকবে না। এরশাদের এবার ট্রেনটা উঠিয়েই নিয়ে যাবে। এ প্রায় একশ বছরের এই রেলপথ তখন একলা একলা শুয়ে থাকবে। যতদূর চোখ যায়, শুধু তখন সমান্তরাল এক জোড়া রেল লাইন শুয়ে আছে। আর এ-ও শোনা যায়, একদিন এই কোর্ট চত্বরও এখানে থাকবে না। তাও চলে যাবে ওই সিএন্ডবি রাস্তার কাছে, চলে যাবে কোর্টের পাশের এই জেলখানাও। তখন এই কোর্ট চত্বর আর ওই জেলখানা তখন শুধুই দালান, এই এলাকা তখন সারাটা দিনমান খা খা করবে।

এই খা খা করার কথাটা অবশ্য মোসলেম উদ্দিন বলে। সঙ্গে এও যোগ করে, সেদিন এমন দিন আসবে, কোর্টের সামনে এই ক্যানভাস শোনার লোকই থাকবে না। আর, ওই যে জায়গায় কোর্ট হবে সেখানে তো ধানক্ষেত, এত সুন্দর মানুষ চলাচল বাজার, লঞ্চঘাট, এইসমস্তর জায়গা সেখানে কী করে হবে।

এসব বলতে বলতে মোসলেম উদ্দিন তার হালকা দাড়িঅলা মুখোনা বিষণ্ণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে, ভালোই হবে, ততদিন সে বাঁচবে না, বাঁচলেও ক্যানভাস করার বয়েস থাকবে না, তাই ওইসব কোনও কিছুই তাকে দেখতে হবে না।

কিন্তু এ কথায় ইব্রাহিম হোক আর সুকুমার হোক তারা দমকে কেন? এখনও তাদের কাছে জীবিকা মানে কোর্টের সামনে এই ক্যানভাস। যদিও সুকুমার জানে, সে যে সব খেলা দেখাতে জানে, কোনও সার্কাসের দল তাকে ডাকলে চলে যাবে। যেতে সে চায়, কিন্তু সার্কাস চলে সেই শীতকালের দিকে। বাকি সময় হাতে কাজ না থাকলে সে খাবে কী? তারে সারা বছরের খোরাকি দিয়ে কোনো সার্কাস পার্টি রাখবে না। ফলে, এইরকম কোর্টের সামনে খেলা দেখিয়েই তাকে চলতে হবে। তবে, খুলনায় থাকতে সুকুমারের আয় রোজগার আরও ভালো ছিল, সঙ্গে একটা ছেলে ছিল, তাকে আঁকার ভিতরে ভরে খেলা দেখাতে পারত, এমনকি মজমা ভালো হলে কখনও কখনও দেখাত ছুরি মারার একটা খেলা। চত্বরে রক্ত, মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত। একটু পরে অক্ষত ছেলেটি বের হয়ে আসত ঝাঁকার নীচ থেকে। পয়সা ঢালত পাবলিক। এখন সুকুমারকে দেখাতে হয়, হাতের কারসাজি, সে একজনেরই খেলা; কখনও কখনও ভিড়ের থেকে সে কাউকে ডেকে নেয়।

মোসলেম উদ্দিন ইব্রাহিম আর সুকুমারের সঙ্গে বসেছিল বারিকের বইয়ের দোকানের পাশে, বড়ো অশত্থ গাছটার নীচে। এখানে একপ্রকার আড্ডা জমেই। বারিকের বেচাকেনা কম, তার আশেপাশে প্রায় সবাই ক্যানভাসের পোটলা-পুটলি মালপত্তর রাখে। কেউ রাখে একটু তফাতে, এমন জায়গায় যেন তাও বারিকের চোখের আয়ত্তে। চোখের আয়ত্তে না-রাখলেও তো কোনও সমস্যা নেই, ওগুলো এমন না যে কেউ নিয়ে যাবে। নিলে যারা চেনা জানা, তাদের মতন এখানকারই মানুষ, তারাই নেবে। বাইরে লোক, যারা এই আসছে যাচ্ছে–এগুলোয় কোনও ভাবেই হাত দেবে না। তাদের প্রয়োজন যেমন নেই। তাছাড়া, একটু দূরত্ব থাকলেও এইসব ক্যানভাসারের প্রতি তাদের প্রত্যেকেরই একপ্রকার জড়তা আছে। কেউ কেউ কাছেপিঠের গ্রাম-গাঁ থেকে আসে। শোনে এই কোর্টের সামনে পকেটমার টাউট বাটপার বেশ্যার দালাল থেকে শুরু করে জমির দালালসহ উকিল মুহুরি কি জজর সঙ্গে যোগাযোগ করারও লোকজন থাকে। কেউ জানে, এইখানে আসলেই পকেট উজাড় হয়। কেউ জানে, এইখানে আসলে পকেট কাটাও যায়। মজমা-আসরে ক্যানভাসের সময় ক্যানভাসাররা তা বলেও। হঠাৎ হঠাৎ আসরে সবাইকে সাবধান করে দিতে তারা বলে, পকেট সাবধান। শুধু আজগর একটু কায়ন্দা করে বলে, পাকেট সাবধান। আজগর কেন পাকেট বলে, সেই জানে। যদিও মোসলেম আজগরের এই পার্কেট বলা নিয়ে সবাইকে জানায়, কোন এক উড়ে মালি নাকি আজগরকে বলেছিল, পাকেটে নেই টাকা কেমনে যাব ঢাকা। তারপর থেকে আজগর বলে, পাকেট! অথচ তারা জানে, তারা এটা বলে মানুষকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে। ওদিকে, আসরে উপস্থিত গ্রাম-গার মানুষজন মনে করে, আসলে পকেটমারদের সঙ্গে এই ক্যানভাসারদের যোগাযোগ আছে, তাদের এই আসরে সবাই যখন মশগুল তখন তাদের পকেট থেকে পয়সা হাতায় পকেটমাররা। কিন্তু এতই যদি যোগাযোগ থাকবে, তাহলে মোসলেম এই কয়দিন আগে এক পকেটমারকে ধরে থানায় নিয়ে গেল কেন?

বারিকের নীল পলিথিন লাছা বইয়ের দোকানের ছাউনিও নীল, সূর্যের আলোয় নীচে নীলচে ছায়া পড়েছে। মোসলেম বারিকের দোকানের পাশে বসে একটা বিড়ি ধরাতেই ইব্রাহিম বলল, বড়দা, আইজকে মানুষজন আছে, কিন্তু পাবলিক নেই।

সুকুমার হাসল, আপনি কথা জানেন ভালোই, ইব্রাহিম ভাই!

কথা বেচেই খাই। কিন্তু তোমার মতন কলেজে যাওয়ার সুযোগ হলি আর এট্টু কথা জানতাম–

মোসলেম বারিকের কাছে কিছু-একটা জানতে চাইলে, সে সময় ইব্রাহিম ওই কথাটা বলে। এবার মোসলেম তার কাছে জানতে চায়, পাবলিক নেই, মানুষ আছে? তোমার কথা তো কিছু বুঝদি পারি না!

কী যে কন, মানুষ মানে মানুষ, এই যে গিজগিজ করতিচে মানুষ কিন্তু আমাগো মজমা শোনার কোনও পাবলিক নেই।

ও-ও, কথাটা যেন মোসলেমের জন্যে একটু দূরবর্তী। বুঝেছেও, কিন্তু একটু সরু চোখে সে ইব্রাহিমের দিকে তাকাল, আরে ট্রেন নিয়ে শহরে কত কিছু হইয়ে যাতিচে। ছাত্ররা কহোন মিছিল নিয়ে আসে। আমলিগ-বিএমপির কতজন নেতার নামে নাকি অ্যারেস্টের অর্ডার হবে। ছাত্রগো কারে কারে আটকাইচে–

সে তো জানি।

তালি? কোর্টে মানুষ আসে, কিন্তু এই সব মানুষের কেস নিয়ে ভিড়, তার মদ্যি আমাগো এইয়ে শুনতি আসতিচে কেডা। তিনদিন আগে তোমার ভাবিরে পাউডারের প্যাকেট বানানোর মাল মশলা কিনে দিচি। চলে কোনও মাল? নতুন মাল আনাই লাগে না।

সুকুমার বারিককে বলে, ও বড়ো ভাই, নাকি কাকা, কী যে ডাকিলাম ঠিক নেই? তার এই ডাকে বারিক তার প্রায় সব সময় মুদে থাকা চোখটা একটু মেলে সুকুমারসহ সবাইকে দেখে। সুকুমার সেই সুযোগে বলে, আপনার এই বই মানষি কেনে?

ইব্রাহিম বলে, কেন কেনবে না? কত মানষি কেনে। এই জায়গায় দাঁড়ালে দেখা যায়। তাছাড়া না কিনলি কাকা এইরাম বই সাজাইয়ে রাখে?

সুকুমার একে একে বইগুলো দেখে। নাম পড়ে। একটার উপর একটা থাকে থাকে সাজানো বই। প্রায় সবগুলোই পাতলা পাতলা। এই ধরনের বই সে বাড়িতে দেখেছে। উপরে লেখকের ছবি। শরৎচন্দ্রের চন্দ্রনাথ, দেবদাস, দত্তা। তারপর ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের চিতা বহ্নিমান, শাপমোচন, আছে বিষাদ সিন্ধু। আর চাষাবাদ নিয়ে কিছু বই। এইসব বইয়ের পাশে ও নীচে আছে। একটু অন্য ধরনের বই, সুকুমার জানে। তবে, এরপাশে বশীকরণ বিদ্যা আর জাদু শিক্ষার বই দেখে সে হাসে।

সুকুমার বলে, এই দেখি বশীকরণ করার বই। এই বই কিনলি আর মাইয়ে মানুষ পটাতি কোনও সমস্যা হবে না।

সুকুমারের একথা শুনে ইব্রাহিম তার দিকে তাকায়। তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঘুরিয়ে দেয়। মোসলেম উদ্দিনের দিকে। যেন ইব্রাহিম চায়, সুকুমারের এই কথা শুনে মোসলেম কিছু বলুক। মোসলেম তাই বললও, ও বই তোমার দেকতি হবে না। ও বিদ্যা তুমি এমনিতেই খারাপ জানো না।

কথাটা সুকুমার গায়ে মাখল না। মুহূর্তে ঝিলিককে মনে পড়ল তার। ঝিলিক কাল চলে গেছে মোড়েলগঞ্জ। বলে গেছে, দুই-তিন দিন বাদে আবার আসবে। দুই দিন তার সঙ্গে ছিল। তাই মোসলেম উদ্দিন এখন ওই কথা বলল। কিন্তু যদি জানত, ঝিলিক কেন এসেছিল, আবার কোথায় গেছে, আবার কেন আসবে, আর তার কী হয়? এটা সত্যি ঝিলিককে সুকুমারের সঙ্গে দেখা গেছে, কিন্তু সুকুমার কারও সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়নি। এখানে ওই পরিচয় টরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনও বালাই নেই, তবু একটা মেয়ে মানুষ তার সঙ্গে, কিছু একটা তো তার হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু তাও না, সুকুমার কারও সঙ্গে ঝিলিকের কোনও যোগাযোগ যেন হতে দেয়নি। শুধু জরিনা আগেই চিনত ঝিলিককে, একদিন তার দেখা হয়েছিল, সে-ই ঝিলিককে দেখে কথা বলেছিল, তারা দুজন দীর্ঘক্ষণ বসেছিল নদীর কূলে। কাছেপিঠে তখন আজগর আর সুকুমারও ছিল, কিন্তু সেকথা এখন। এখানে জানানোর কী দরকার। যদি জরিনার কাছে থেকে তারা কিছু জানতে পারে তো জানবে। যদি আবার আসে তো দেখবে। সুকুমার এখন ওকথা মনে করতে চায় না। তবে, ঝিলিকের মুখোনা তার মনে পড়ল আবার। সে অবশ্য অনেক কারণে।

ইব্রাহিম বলল, এই যে জাদু শিক্ষা, সুকুমার তোমার লাগবে? বারিক কাকার কাছে কী সমস্ত বই আছে দেখিচো!

সুকুমার বলল, ওই বইয়ে কী আছে তাও আমার জানা আছে, কন আপনারা?

মোসলেম আবার বলে, জানা তো আছেই। জানা না-থাকলি তুমি জাদু দেখাও কী কইরে!

সুকুমার হা-হা শব্দে হাসে। হাসলে ছেলেটা বেশ দেখায়। বারিক তার তন্দ্রা ভেঙে সুকুমারের মুখোনা দেখল।

ইব্রাহিম তার হাসির কারণ জানতে চাইল, কেন কী হইছে?

এত লেখা, একখানা ছুরি দিয়ে জবা ফুল কাটার পরে, তারপর সেই ছুরি দিয়ে লেবু কাটলি লাল রং বের হয়!

কেন খাটে না? বের হয় না?

আরে অল্প এট্টু লাল হয় লেবুর রসে! ওই বই পইড়ে জাদু দেখলি আর মাইর মাটিতে পড়বে নানে।

এসব বলতে বলতে তারা লক্ষ করে দোকানে তখন কোনও খদ্দের আছে কি না? খদ্দের থাকলে তারা অবশ্য এমন কথা বলত না। এখন এই তিন জন বাদে বারিকে দোকানের সামনে কেউ নেই। থাকতে পারত, সাধারণত কোনও মজমা না-থাকলে দুই চারজন বই হাতানো খদ্দের বারিকের দোকানে থাকে। তাদের কেউ কেউ কখনও কখনও দুই-একখানা বই কেনে। এমনকি একসঙ্গে চার পাঁচখানা বইও কেউ কেনে। তবে বারিকের সহযোগীরা যেমন জানে, বারিক তো তেমন জানেই, কেউ কেউ আছে বারিকের দোকানের আশেপাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করে। সামনে বসে। বই হাতায়। শরৎচন্দ্রের দেবদাস হাতে নেয়, সঙ্গীকে বলে, এর কাহিনি। বুলবুলের দেবদাসে অভিনয় দেখেছে। পাশের জন হয়তো জানায়, সেও দেখেছে, তবে তার কোন আত্মীয় আছে ইন্ডিয়ায়, সেই আত্মীয় বলেছে, দেবদাস দিলীপকুমার আর সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছে, সেটি হিন্দি। প্রথমজন তখন বলে, কখনও ইন্ডিয়ায় গেলে সে দেখবে। দ্বিতীয়জন জানায়, সে বহুত পুরোনো বই। এখানে বই অর্থাৎ ছায়াছবি। তাদের হাতে দেবদাস, সেটাও বই, আবার বুলবুল আহমেদ ও কবরী আর দিলীপকুমার ও সুচিত্রা কেন অভিনীত দেবদাস ছায়াছবিও বই। অন্যজন তখন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের শাপমোচন বইখানার উপরের পাতলা কাগজের প্রচ্ছদে দুই রঙা সুচিত্র-উত্তমের ছবি দেখিয়ে বলে ওই যে সুচিত্রা সেন। কিনবি নাকি শাপমোচন? প্রথমজন ডাইনে-বামে মাথা নাড়ে। কিনবে না।

এতেই অবশ্য বারিক বুঝে যায়, এই দুজন কী বই খুঁজছে। হয়তো তারা একখানা শাপমোচন কি এরপরে নৌকাডুবি বা অগ্নিবীণা উলটাতে উলটাতে এইসমস্ত বইয়ের তলা থেকে তার একখানা আবিষ্কার করে নেয়। সেখানে অবশ্য একসঙ্গে একখানা দুইখানাই থাকে। এমনকি প্রচ্ছদে তেমন রগরগে ছবিও থাকে না। প্রত্যেকটাই পিনমারা। চাইলে এই জায়গায় বসে পড়াও যায় না। যদি পিনমারা না-থাকত, তাহলে বারিক জানে এ জায়গাতেই চলত ওই বই পড়া। এক একজন পড়তে পড়তে প্রায় সাবাড় করে ফেলত। এখানে বসে পড়তে পড়তে উত্তেজিত হত। লুঙ্গির মাঝখানে উঁচু হয়ে যেত। ওই গ্রাহকের চোখ মুখ কিছুটা লালচে, মুখ থমথমে আর কিছুটা ভারি বারিকের এ সবই জানা আছে। তারপর পড়তে থাকা তাদের কারও কারও লুঙ্গি হয়তো কিছুটা ভিজেও যেত। কেউ বা উঠে আশেপাশে কোনও গলি খুঁজে নিত, যেখাতে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরের এই উত্তেজনার ভার দমন করা যায়।

সে সুযোগ রাখেনি বারিক। কেউই রাখে না। এখানে বারিক বয়স্ক, তাও কখনও কখনও এসব বইয়ের কিছুটা উলটে পালটে দেখেছে। তখন তারই ভিতরে ভিতরে কেমন করে, আর এসব নওজোয়ান ছেলেদের। তারা উপরের ছবি দেখতে দেখতে, কখনও কখনও পিনের পাশ যে প্রায় ছুটিয়ে ফেলে, তাও তার জানা আছে। তাই ওই বই কেউ হাতে নিলে বারিকের আধ বোঝা চোখখানা স্পষ্ট হয়। এমনকি স্কুলেপড়া ছেলেরা কখনও ওই বইয়ে হাত দিলে চোখটা আরও বড়ো করে খুলে সে ডানে-বামে মাথা নাড়ে।

কিন্তু এতদিনের অভিজ্ঞতায় বারিক জানে, কারা এই বই কিনবে আর কারা শুধু ওই বই হাতাবে। সে দেখেই ভাবভঙ্গি বুঝতে পারে। ওই যে যেমন, যারা শাপমোচন হাতিয়েছে, কিন্তু কিনবে না। নাড়তে নাড়তে নিজেদের ভিতরে কথা বলার ভঙ্গিতে বারিক বুঝত পারে, এরা নেবে। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দাম বলল, দশ টাকা। দশ টাকা একটু বেশি যদিও। বারিক জানে, এই বইয়ের পাইকার তারে এগুলো আড়াই টাকা দরে দিয়ে গেছে। বইয়ের গায়ে দাম লেখা আছে, বারো টাকা মাত্র। কিন্তু বারিক পাঁচ টাকা কি ছয় টাকায় ছেড়ে দেবে। সে জানে এরা কিনবে। এখনই দরদাম করতে শুরু করবে। কী বলবে, আরও আছে? থাকলি দেখান। বারিক তখন একজনকে তার কাছে আসতে বলবে। তারপর উপরে রাতের রজনীগন্ধা, তারপর মায়ামৃগ তারপর হয়তো আনোয়ারার তলে এই রকম বইয়ের আরও দুটো কপি তাদের দিকে দেবে। এইটুকু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কোর্ট চত্বরে পুলিশ, পুলিশের সেপাই আর টিকটিকির অভাব নেই। কেউ কেউ বলে, ওই রহম পাগলও পুলিশের লোক। যদিও তা কোনওভাবে সত্যি নয়। রহম কোনও গোয়েন্দা হতে পারে না। তবে, রহম একদিন তাকে আর মোসলেমকে বলেছিল, তার সঙ্গে এইখানে বছর খানেকের জন্যে যে আর একজন পাগল এসে জুটেছিল, সে গোয়েন্দা। রহম দেখেছে, সেই লোক একা একা রাতের অন্ধকারে কোর্ট বিল্ডিংয়ের ওই টেমি বারে আলোয় কী সব লিখত। তারপর রাত থাকতেই ফেলে দিয়ে আসত পোস্টাফিসের লাল বাক্সে। রহমকে পুলিশরা কখনও কখনও ফাও কথা বলেছে, কিন্তু সেই লোককে কখনওই কিছু বলেনি। যদিও বারিক-মোসলেম মনে করে, এই সবই রহমের বানানো গল্প। সেই সময়ে রহমের মাথা একটু সুস্থ। এতদিনের পরে নিজের কল্পনার কিছু কিছু সবাইকে বলতে শুরু করেছে। সে মনে করেছে, সেই পাগল গোয়েন্দা, সরকারের লোক–এইসব বললে সবাই রহমকে কিছুটা হলেও পাত্তা দেবে।

লুকিয়ে বই দেখানো, তারপর সেই বই পুরনো খবরের কাগজে মুড়িয়ে গ্রাহকের হাতে গছিয়ে দিয়ে বারিক আবার চোখ বোজে। মনে মনে ভাবে, এসব বইয়ের গ্রাহকই তার ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখবে, পেটে ভাত দেবে। ওইসব নোভেল তো শহরের বইয়ের দোকানেও পাওয়া যায়। তাই, বেলা একটু গুটিয়ে আসলে, বারিকের আধবোজা চোখ জোড়া একটু যেন খোলে। সে জানে, এখন যারা আজকের মতো কোর্টের কাজ সারল, কিন্তু সব কাজ সারা হয় নি, কোনো হোটেলে থেকে যাবে, তাদের কেউ কেউ তার দোকানে আসবে। কোনও কোনও দিন বেশ কজন আসে। তখন দোকান প্রায় গোটানোর সময়। বারিক জানে, তারা কিনবে। সে দাম একটু কমিয়ে বলে। যদিও বারিক এরপর আরও কল্পনা করে, ভাবির সঙ্গে মধুর রাত পড়তে পড়তে সেই লোকটি নির্জন হোটেল রুমে কোন কল্পনায় তলিয়ে যাবে। সেখানে কী ঘটতে পারে, তাও যেন তার জানা আছে।

কিন্তু এখন যখন সুকুমার ছোঁকরা তার সহজ জাদু শিক্ষার বইখানা নিয়ে ওই কথা বলল, তাতে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল মোসলেম আর ইব্রাহিম, সেই হাসি বারিককেও একটু ছুঁয়ে গেল। বারিক জানে কথাটা কিছু ভুল বলেনি সুকুমার। ও ছোঁকরা খেলাঅলা, জাদু কিছু জানে, এইসমস্ত বই কম বেশি হাতিয়ে দেখেছে।

ওই হাসির দমকের ভিতরে ইব্রাহিম জানতে চায় এই বই কেনে কারা?

বারিক নীচু গলায় মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে, ওগুলো বেশির ভাগ স্কুল কলেজের ছেলেপেলেরাই কেনে? আর কেনবে কারা?

বড়ো মানুষরা কেউ কেনে না?

কেনে, কেউ কেউ কিনে বাড়িঘরে যাইয়ে কোনও কোনও সময় মনে হয় বেয়াই-বেয়ানগো খেলা দেখায়!

ও কা, সে খবর আপনি জানলেন কোয়ানদে? তারপর সুকুমারের উদ্দেশ্যে বলে, দেখিচো, কাকারে যেরাম ভাবিলাম সেরম না। রস আছে কতায়।

মোসলেম উদ্দিন তার সমবয়েসি বারিকের উদ্দেশ্যে একটা হাঁকমতন দিল, এ বারিক, পোলাপান কী কতিচে? ওরা জানে তোমার রস? বলে, বারিকের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসলে মোসলেমকে সুন্দর দেখায়। দাঁতগুলো তার খুব সুন্দর। চকচকে। সাধারণ লোকটা হাসে না, কিন্তু এই যে হাসল, হেসে বারিককে আরও জিজ্ঞেস করল, ওরা জানে খেড় কারে কয়? মানুষের কথা দিয়ে কী কইরে হাসাতি হয়?

সেয়া জানবে কোহানদে। কাইলকের ছলপল। খালি শিখিছে খেইল দেহাতি। আর এক একজন নিয়ে ঘুইরে বেড়াতি।

হয়। একেবারে।

তাদের কথায় ইব্রাহিম আর সুকুমার যেন একটু পাশে পড়ে গেল। যাক, এই দুজন মানুষের কথা শুনতে তাদের খারাপ লাগছে না। যদিও বারিকের জন্য সেকথা আর এগোয় না। বারিক মোসলেমকে বলে, আইজকে এই জায়গায় বইসে কাটাইয়ে দেবা? নাকি মজমাটা মিলোব?

মিলোব তো বারিক। মজমা মিলোনোর জন্যিই তো আইচি। থলির ডুগডুগি না বাজালি পেটও চলে না, কানেও ভালো লাগে না, কিন্তু আইজকে মানুষজনের কায়দা দেখিচো? ওই ইব্রাহিমের কথাই ঠিক, মানুষ আছে, পাবলিক নেই।

হয়। তয় তোমাগো চোখ আছে। বারিক বলে, দেইহে বুঝদি পারো, কী অবস্থা চলতিচে। আমি এই জায়গায় তালগাছের মতন বইসে থাইহে থাইহে অত বুঝদিও পারি না। কিন্তু আইজকে বুঝদিচি, মানুষের এদিকে কোনও খেয়াল নেই।

কিন্তু কিছু করারও নেই। রেল উইঠে যাবে। ছাত্ররা আন্দোলন করতিচে। কয়জনের অ্যারেস্ট করিচে। আইজ মনে হয় জামিনের তারিখ পড়বে।

শোনলাম হক আর মোজাম্মেল উকিল সাহেবগোও অ্যারেস্ট করতি পারে।

আমিও শুনিচি।

তা কী আইজ এই জায়গায় বইসে থাকপা তোমরা?”

হয়, সেইয়ে থাহি।

মোসলেম উদ্দিন পায়ের কাছে রাখা লাঠিটা হাতে নেয়। কিন্তু উঠে দাঁড়ায় না। ঘাড় ঘুরিয়ে ইব্রাহিম আর পিছনে সুকুমারের উদ্দেশে বলে, কী তোমরা যাবা এহোন, না আমি যাব?

ইব্রাহিম বলে, বেলা বাইরে গেইচে! আজগর ভাই যাবে না? তারে তো দেকতিচি না।

বারিক তাদের কথায় ঢোকে, হয়, আইজকে মাইনষে দেকপেনে বান্দর খেলা? খাইয়ে তো কোনও কাজ নেই।

ভুল বলেনি বারিক। মোসলেম তাকে সমর্থন দিল, তুমি দেহি এইসবও বোঝে। ঠিকই কইচো। আজগর সেইয়ে বুঝদি পাইরে দিছে ডুব।

না না, ডুব দিনি, ডুব দিনি শরীর খারাপ। আর নয় ওই জরিনার সাথে লঞ্চঘাটে বইসে রইচে। বারিক অনুমান জানায়।

ইব্রাহিম বলে, তালি কী করবেন?

এরপর সিদ্ধান্ত হল, আগে মোসলেম যাবে। তারপর ইব্রাহিম। সুকুমার খেলা দেখাবে না। তার মন ভালো নেই। সে আলতাফের হোটেলের দিকে যাবে। অথবা, একবার দেখে আসবে আজগরকে। আবার তার যেতেও ইচ্ছে করছে না। আজগরকে দেখতে গেলেই জরিনা জিগগেশ করবে, ঝিলিক কেন চলে গেল? কারণ বললে জানতে চাবে, সে কেন চলে যেতে দিল? কিন্তু ও বিষয়ে কথা বলতে সত্যি ভালো লাগে না সুকুমারের। সুকুমার সে-কথা ভেবে এখনই গেল না।

এদিকে এইসমস্ত বলতে বলতে বেলা গড়িয়েছে। মোসলেম তার ঝোলাটা নিয়ে চত্বরের মাঝখানে গিয়ে বসল। তখন ইব্রাহিমের মনে হয়, আজও রোদ উঠেছে ভালোই। সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে গেছে তাও অনেকক্ষণ, কিন্তু আজ মানুষের ঢলের কারণে বেলা যে এতটা হয়েছে তা বুঝতে পারেনি, নাকি তারা বসে আছে অশত্থ গাছটার নীচে। এই গাছের ছায়ায় রোদ বোঝা যায় না, তাপ বোঝা যায় না, সেই জন্যেই হয়তো সারাটা বেলা ওখানে বসে বসে বারিক ওভাবে ঝিমায়। এই গাছের তলে সত্যি চোখ জুড়িয়ে আসে। এমনভাবে জুড়িয়ে আসে যে উঠে আর কাজে যেতে মন চায় না। চত্বরে যে রোদ, বুঝবে মোসলেমকা! কিন্তু সে-কথা ভাবতে ভাবতে ইব্রাহিমের মনে হয়, একটু বাদেই তো তাকেও যেতে হবে ওখানে। তখন সূর্য থাকবে একেবারে চান্দির ওপর। তখন কি ইব্রাহিমের গলা দিয়ে স্বর বের হবে।

মোসলেম উদ্দিন তার ঝোলা থেকে ডুগডুগি বের করে বাজাতে শুরু করে। গলা থেকে বের করে এক অদ্ভুত স্বর। তাতে তার কাছে কিছু মানুষ ঘিরে দাঁড়ায়। দেখে ইব্রাহিমের মনে হয়, ট্রেন নিয়ে যাই হোক, কোর্টে তা নিয়ে যতই উত্তেজনা থাক, কিছু মানুষ এই চত্বরে আসে ঘুরতে, তাদের কোনও কাজ নেই। তাদের কয়েকজন তো মোসলেম কাকার আসরে আসবে। কিন্তু সেটুকু ভেবেই তার মনে হয়, তারা আসলেই-বা কী? তারা কি আর ওই পাউডার কিনবে। যারা কেনার পাবলিক, তারা যদি না আসে। ইব্রাহিমও উঠে সুকুমারের পাশে দাঁড়ায়। তারপর গলা নামিয়ে, একটু যেন বিষণ্ণ সুকুমারের কাছে জানতে চাইল, ভাইতি যাবা নাকি এট্টু চা খাতি?

সুকুমার হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না, তবে ডানে-বামে মাথা ঝকাল। একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গি। মাথা নাড়ানোটাও স্পষ্ট নয়। ইব্রাহিম বুঝল না। ইব্রাহিম যে বোঝেনি, সেটা বুঝেই সুকুমার বলল, যাওয়া যায়। কিন্তু আইজকে সব দোকানে যেরাম ভিড়!

চলো, যাইয়ে দেখি। এই সোজা এট্টা দোকান আছে নদীর পাড়ে।

এই সোজা দোকানটায় যেতে হবে লঞ্চঘাটের আগের গলি দিয়ে। মেইন রোডে সেখানে দুই পাশে বড়ো বড়ো ফার্মেসি। মাঝখানে গলিটা। গলি ধরে এগোলে মাথায় নদীর পাড়। তার আগে একটা ছোটো চায়ের দোকান আছে। পাশে একটা পানের দোকানও। ইব্রাহিম পান খায়, সুকুমার খায় না। ওই দোকানের পান ইব্রাহিমের পছন্দ। সুকুমার অবশ্য তা জানে না।

রওনা দেবে ঠিক সেই সময়ে সুকুমার বলল, আপনি যান, আমার যাতি ইচ্ছে করতিছে না।

ইব্রাহিম বিস্ময়ের সঙ্গে সুকুমারের মুখের দিকে তাকায়। এই মানুষটাকে বোঝাই যায় না। তবু সে বলল, চলো, চলো, তাড়াতাড়ি চইলে আসপো। এই দেহো না কী রোদ্দুর! এক গ্লাস পানি খাইয়ে, এক কাপ চা খাইয়ে, এট্টা পান মুখে না-দিয়ে আমি আইজ আসর জমাতি পারব না।

সুকুমার আর কোনও কথা না-বলে ইব্রাহিমের সঙ্গে যায়। পাশ থেকে বারিক বলে, পান আমার জন্যি এটা আনিস। অবাক করা ঘটনা এই, একটু পরে, সুকুমার ইব্রাহিমের সঙ্গে ফিরেও আসে এই অশখতলায়। পানটা সেই-ই বারিককে দেয়। ততক্ষণে মোসলেমের আসর প্রায় শেষ। সে প্যাকেট দিচ্ছে সবার হাতে। এদের কেউ নেবে, কেউ নেবে না। যারা নেবে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মোসলেম আসর গোটাবে। ইব্রাহিমের ঢুকতে হবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আজকের এই অল্প জমায়েত, মোসলেমেরটা ভাঙতে ভাঙতে যদি মানুষ চলে যায়। সে তার পোটলা পাশে রাখা বাক্সটা নিয়ে মোসলেমের জমায়েতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আবার ফিরে আসে। গাছতলায় আর-একটা বাকসো দেখিয়ে সুকুমারকে বলে, এইডে থাকল, লাগবে নানে। লাগলি পরে নেবানে।

মোসলেমের শেষ। সে চলে আসবে। লাঠিটায় ভর দিয়ে সে যতটা পারে ঘাড় উঁচু করে। তার একটু পিছনেই দাঁড়ানো ইব্রাহিম। ইব্রাহিম বুঝেছে মোসলেম তাকেই খুঁজছে। মোসলেম তাকে দেখে, তারপর অশত্থ গাছটার নীচে চলে আসে। ইব্রাহিম ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে ঢুকে পড়ে।

মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে একটু মাথা নীচু করে আসে। ডানে বামে মাথা নাড়ায়। বোঝা গেল, জমেনি। সুকুমারকে দেখে অবাক, ছেলেটা এখানে দাঁড়িয়ে! জানতে চায়, তুমি যাওনি? সুকুমার উত্তর দেয়ার আগেই আরও বলে, অবস্থা ভালো না। ইব্রাহিমের কথাই ঠিক–আইজকে মানুষ আছে পাবলিক নেই।

সুকুমার বলতে যাচ্ছিল কেন সে যায়নি। তার আগে অশত্থ গাছের পাশের রাস্তার এক দল ছেলের ভিতর থেকে একজন মোসলেমের উদ্দেশে একজন বলে, ও কা, একা নাকি?”

মোসলেম ভ্যাবাচেকা খায়। তাকে এই কথা বলে কে খেপাচ্ছে। সে দেখতে পারেনি। কথাটা বলে ওই ভিড় থেকে তাকায়নি কেউ। এমন ভাব তাদের ভিতর থেকে কেউ কিছু বলেনি। মোসলেম তাকিয়ে থাকল। তারপর বিড়বিড় করল, জাউড়ো ছওয়াল পয়াল যতো!

বারিকের কানা ঠিক খাড়া। সে বলে, উত্তর দিয়ে দেতা, না একা না, তোর মাও আছে সাথে।

বলে, বারিক আর মোসলেম দুজনই হাসে। যদিও সে হাসিতে সুকুমার যোগ দিতে পারে না। সে বিষয়টা বোঝেইনি। শহুরে ছেলেদের কাণ্ড। কিন্তু ভিতরে নিশ্চয়ই কোনও একটা বিষয় আছে। সেই বিষয়টা সুকুমার বুঝল না। এমনকি তখনই, মোসলেম আবার জানতে চাইল, কী-ই গেলা না?

সুকুমার বলল, না। দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে এট্টু ইব্রাহিমের মজমা দেখি।

এই জায়গায় দাঁড়াইয়ে? এ জায়গায় দাঁড়ায়ে কিছু শোনাও যাবে নানে, দেখাও যাবে নানে।

কী যে রোদ্দুর!

তালি এট্টু আগোয়ে দাঁড়াও। আর নয় আমার সাতে চা খাতি চলো।

না, চা খাইচি এট্টু আগে। আমি আর ইব্রাহিম।

আচ্ছা। তালি সামনে আগাইয়ে যাইয়ে দেহে। গাছের ছায়া তো ওই যে, পেরায় ইব্রাহিমের মজমা পর্যন্ত ছায়া চইলে গেইচে।

মোসলেম চলে যায়। আজ আর সে হয়তো আসবে না। কেননা, যাইরে বারিকও বলল এই সঙ্গে। গরমে লোকটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। বোচকা হাতে ল্যাংচে হাঁটতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়। সুকুমারের মনে হয়, মোসলেম কাকার সঙ্গে গেলে হত, রিকশায় ওঠার আগ পর্যন্ত টেনে দিতে পারত বোচকাটা। কিন্তু গেল না।

এদিকে ইব্রাহিম ডুগডুগি বাজিয়ে কী সমস্ত বলেছে। মোসলেমের সঙ্গে কথা বলায়, আর গাছের প্রায় গোড়ায় থাকায় কিছু শুনতে পায়নি সুকুমার। কিন্তু একটু এগিয়ে এসে সব শুনতে পারছে। ইব্রাহিম বেশ ফাজিল আছে। একটা গান গাইল। সেই গানের সঙ্গে বেলবটম প্যান্টের কোমর দুলিয়ে বৃত্তের এমাথা ওমাথা নৃত্য করে দেখাল। এ ভুবনে যাকে আমি চেয়েছি, আঁখি বলে তার দেখা পেয়েছি এই পর্যন্ত গেয়ে এপাশ থেকে গেল ওপাশে। তারপর সে-পাশ থেকে, এবার সুকুমার আরও স্পষ্ট দেখতে পেল, কালো জুতো জোড়ায় মাটি ঠুকতে ঠুকতে, ও একই সঙ্গে কোমর দোলাতে দোলাতে গাইল বাকি অংশ, সে আমায় আজ কথা দিয়েছে, সে আমায় সে আমায় সে আমায়–

দারুণ! সুকুমারের হাসি পায়। এখানে আসার পর থেকে সে একদিনও ইব্রাহিমের ক্যানভাস দেখেনি। সুযোগ হয়নি। শুনেছে যেমন কথা বলে, একই সঙ্গে ক্যানভাসও করে দারুণ। ইব্রাহিম শেখের আসর। সুকুমারের তো আর কথা দিয়ে মানুষ তেমন ভিড়াতে হয় না, সে দেখায় খেলা। কিন্তু ইব্রাহিমের কাজ কথা নিয়ে। শুনেছে কথায় চিড়ে ভেজে, ইব্রাহিমের কথায় তা ভিজতে বাধ্য।

এরপর ইব্রাহিম বসে পড়ল। সুকুমার ইব্রাহিমকে দেখতে পায় না। আবার ইব্রাহিমের বসা জায়গার কাছে মানুষ একটু ফাঁকা হলে দেখতে পায়। সুকুমারের মনে হয়, কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যে রোদ! তার ইচ্ছে করছে না। এই দোটানায় একটু বাদে সুকুমার ইব্রাহিম শেখের আসরের শ্রোতাদের একজন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ইব্রাহিম দেখে তাকে। সুকুমার দাঁড়িয়েছে সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে। তাকে দেখে কথার ছরবার ভিতরে ইব্রাহিম একটু হাসল। তারপরই, আবার যেন আগের মানুষ।

ডুগডুগি বাজাল। বলল, পকেট সাবধান। একথা শুনতে শুনতে নিজেকে নিয়ে ভাববেন। ভাববেন এই জীবনের কোনও দাম আপনার কাছে আছে কি না। এর ভিতরে পকেটটা রাখবেন সাবধানে। আমার কথা শোনতে শোনতে গাল এমন হা করে রাখলেন যেন, সেই গালে মাছি ঢুকে গলার ভিতরে গিয়ে পৌঁছলে আপনি টের পাবেন। সেই ফাঁকে পকেটমার আপনার পকেট থেকে নিয়ে যাবে টাকা। আপনি এক অর্থশূন্য মানুষ। বলেন আপনারা অর্থশূন্য মানুষের জীবনের কোনও দাম আছে?

সমবেত জনতা ইব্রাহিমের মজমায় জুড়ে গেছে। তারা না বলল! সুকুমারের মনে হল, এদের মুখ দিয়ে মাছি ঢুকে গেলেও টের পাবে না। এমনকি কেউ কেউ ওই না এর সঙ্গে ইব্রাহিমের কথায় যে হেসেছিল, সেই হাসির মুখও আর যেন বন্ধ করল না!

ইব্রাহিম আবার কথা ধরে। সেই অর্থশূন্যতা দিয়েই শুরু। এই জীবনে রাজাধিরাজ হোক, বাদশা-সম্রাট হোক, জজ ব্যারিস্টার উকিল মোক্তার পেশকার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সওদাগর মহাজন যেই হোন না কেন, যদি অর্থ না থাকে তাহলে সে পথের ভিখিরি। ওসব মানুষ তখন তার মতো এই ক্যানভাসও হতে পারবে না। আজ সে সব মানুষের সামনে এসেছে, এই তাদের সামনে এসেছে, এই জীবনে টাকা পয়সা সব হাতের ময়লা, জীবনটাকে যদি তার অর্থহীন করে না তুলতে চায়, তাহলে আসতে হবে এই এখানে, এই ইব্রাহিমের কাছে। সেটা কেন?

ইব্রাহিম তাও জানায়। মানুষকে কথা দিয়ে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা তার, সুকুমার শুনতে শুনতে বুঝতে পারে। ইব্রাহিম এখন জীবনকে কোন কাজে অর্থপূর্ণ করা যায়, সেই দিকে যাবে। কিন্তু সেদিকে গেল না। আবার হাসানোর জন্যে কথা সহসা অন্য দিকে নিল। তখন সুকুমার চারপাশে তাকাল। তার মানে এখন জমায়েত তেমন ভালো হয়নি। আসল কথায় যাওয়ার আগে তার আরও মানুষ দরকার।

মানুষ আমরা, বাঁচার জন্যে খাই। খায় না এমন মানুষ আছে? রিগান খায়, রাজীব গান্ধি খায়, এরশাদ খায়, এই কোর্টের জজ সাহেব খায়, ডিসি সাহেব খায়, এসপি সাহেব খায়, এমপি মিনিস্টাররা খায়–আমি খাই আপনি খায়, মা-জননীরা খান! জন্মাইয়া খাই মায়ের দুধ। সবাই খাইয়া খাইয়া জীবনটা কাটায়। যে খায় না, সে বাঁচে না। সবাই জানেন। খাইলে পেটে খাবার জমে। খাবার হজম হয়। সেই খাবার আমাদের মল দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। আর যার ঠিকমতো বের হয় না, খারাপ খাবার খায় তার পেটে হয় গুড়ো কৃমি। ফিতা কৃমি। লতা কৃমি। গরুর পেটে হয় হাতখানেক বড়ো কৃমি। দেখেছেন, যদি না দেখেন তাহইলে পশু হাসপাতালে যাইয়া দেখপেন। দেখেন তো খালি গরুর ওই একটা জিনিস, ষাড়ের এত বড়ো এক জোড়া হোল! আর কী! ওই বড় বাড়া দেইখইে জীবন কাটাই আমরা।

ইব্রাহিমের আসর জমে গেছে। চারদিকে নীরবতা। কোর্ট চত্বরে যত কোলাহলই থাক, এই হাত দশ-পনেরোর একটা গোল জায়গায় এখন সবার চোখ ইব্রাহিমের দিকে। সুকুমারেরও বিস্ময় বাড়ে।

গরুর পেটে যেমন বড়ো কৃমি। আপনার পেটেও কৃমি। সেই কৃমি আপনাকে বসতে দেয় না, হাঁটতে দেয় না, শুইতে দেয় না, খাইতে দেয় না, নাইতে দেয় না। আর বলব? আরও বলার দরকার নেই। আর কী কী করতে দেয় না, আপনারা ভালো জানেন। এমন ভাবে আপনার পাছায় খোঁটায়, আপনি পাছায় খোঁচান আর ড্যান্স দেন। যেন আপনি মিঠুন চক্রবর্তী, আই অ্যাম এ ডিসকো ড্যান্সার, জিন্দেগি মেরা গানা। হাতে মাইক্রোফোন ধরার ভঙ্গি করে ইব্রাহিম মিঠুনের ভঙ্গিতে গানটা গেয়ে দেখাল। পুরো আসর জুড়ে হাসি। সুকুমার আরও বিস্মিত! আর, এবার যে আসল কথায় যাবে ইব্রাহিম, তা বোঝা গেল, বলল, ছোটো বাচ্চা ছেলে যারা আছে তারা চলে যাও। দুই একটিকে দাবড়ানি দিল। কারও কোমরের একটু উপরে যাদের মাথা দেখা যাচ্ছিল, তাদের চলে যেতে বলল। তারপর, যাদের গোঁফের রেখা এখনও ওঠেনি, উঠবে উঠবে তাদের কয়েকজনকে।

এবার শুরু হল, ওই ডিসকো ড্যান্সারের জীবনেও নারী আছে। নারীর জীবনেও পুরুষ আছে। আপনি সম্রাট আকবর, আপনার নানা আলিবর্দি খান আর আপনি বড়োলাট কি জমিদার শিশির রায়চৌধুরী যাই হোন, আর হোন পথের ভিখিরি। যদি রাতের বেলা, আমার মা আপনার স্ত্রী–সেই মায়ের কাছে গিয়ে নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করতে না-পারেন, তাহলে এই জীবনের কোনও দাম নেই। একেবারে পরাজিত মানুষ। আলেকজান্ডার মারা গেছিলেন মশার কামড়ে অথচ সারা দুনিয়ার অর্ধেক তার ততদিন জয় করা সারা। এই রকম এই জিনিস পুরুষ মানুষ আপনি আপনার সঙ্গে আছে। সেটা যদি আপনার ক্ষমতা থাকে তাহলে তরবারি, ক্ষমতা না-থাকলে কিছুই না, ফুস একেবারে বেলুন। কিছুদিন আগে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, জার্মানিতে এক মহিলা তার স্বামীর ওই জিনিস কেটে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। কোর্টে কেস গেলে সে বলেছে, ইওর অনার যে জিনিস কাজে লাগে না, এই যেমন আপনার হাতের ওই কলমটা কাজ না-করলে তো আপনি ফেলে দেবেন, তাই তার ওই জিনিস আমার কোনও কাজে লাগত না, তাই ফেলে দিয়েছি। আদালত সেই মহিলাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে।

সমবেত মানুষের চোখে এবার বিস্ময়। ইব্রাহিম তাদের এক ধন্দে ফেলে দিয়েছে। এখন ইব্রাহিম তাদের যা বলবে, তাই তারা বিশ্বাস করবে ও শুনবে। এতক্ষণে সে যা বলার বলে জায়গামতন চলে এসেছে, কিন্তু একটি কথাও ফাজলামি করে বলছে না। এসব যারা বিক্রি করে, তাদের বেশির ভাগই কথা বলে অনেটাই ফাজলামি করে। ইব্রাহিম শেখ আসলেই মানুষটা একটু আলাদা। সুকুমার এই রোদের ভিতরে ইব্রাহিমকে মুখের একপাশের ঘাম মুছতে দেখে। তারপর খুবই ঠান্ডা গলায় ইব্রাহিম আবার আসরে ফেরে।

কেন হয় এই সব রোগ, আপনারা জানেন? মানুষ এসব রোগ নিয়ে জন্মায় না। বড়ো হওয়ার আগে এসব রোগ হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। মানুষ বড়ো হয় আর অসৎ সঙ্গে কুসঙ্গে পড়ে বাধায় বিভিন্ন যৌন রোগ। কেউ কেউ আবার লজ্জা পায়। রোগ হলে ডাক্তার কবিরাজের কাছে যায় না। আরে ভাই, শরীর আপনার, রোগ আপনার হবেই আর তার সমাধানও আপনাকে করতে হবে। লজ্জা পেলে চলে না। সাধু সেজে কোনও লাভ নেই। বাউল হবেন সঙ্গে বাউলানি, ফকির হবেন। সঙ্গে ফকিরানি, বৈষ্ণব হবেন সঙ্গে বৈষ্ণবী। যাবেন কোথায়, শরীরকে তো লাগবেই।

এই পর্যন্ত বলেই ইব্রাহিম একখানা বাউল গান গায় :

কত লোক জঙ্গলেতে যায়
স্বপ্নদোষ কি নেইকো তথায়?
নিজের মনের বাঘ যারে খায়
কে ঠেকায় তারে?

একটু আগের ডিসকো ড্যান্সারের গায়কের গলায় এ গান, এই ভর দুপুরবেলা! বিস্ময়ে সুকুমারের যেমন শেষ নেই। শেষ নেই যেন শ্রোতাদেরও। অথচ লোকটা অনেকেই মঘা বলে ডাকে। সুকুমারও তাই ভাবত।

কোথায় যাবেন, জঙ্গলে? সেখানেও আপনার সঙ্গে যাবে আপনার এই শরীর। ফলে, জঙ্গলে যাওয়ার দরকার নেই। যারা অতিরিক্ত হস্তমৈথুন, ঘন ঘন স্বপ্নদোষ, পতিতালয়ে গমন ও খারাপ মেয়েদের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশার ফলে সিফিলিস, গনোরিয়া বাধিয়েছেন, বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছেন, তারা আর ভয় পাবেন না। এমনকি যাদের ধ্বজভঙ্গ অর্থাৎ আগামোটা গোড়া চিকন, পুরুষাঙ্গ ছোট ও নিস্তেজ, স্ত্রী মিলনে অক্ষমতা, অল্পেই বীর্যপাত হয়, আমার মা আপনার স্ত্রীর কাছে যেতে ভয় পান, তাদের জন্যে এই ওষুধ। মাত্র এক বোতল খেয়ে দেখুন, এক বোতল। যদি কোনও কাজ না-হয় তাহলে এই কোর্ট চত্বরে আমি জুতোর মালা পরে ঘুরে বেড়াব।

সুকুমার সরে যায়। ইব্রাহিম তার পাশের বাক্সটায় হাত দিয়েছে, তাই দেখে সুকুমারের মনে পড়ে, ইব্রাহিম বারিকের গাছতলায় আর-একটা বাক্স রেখে এসেছিল। সুকুমার সেখানে যায়। ইব্রাহিম এখন তার গুরুর নাম বলছে, এই ওষুধ কোথায় সপ্তাহের কোন কোন বারে বানানো হয় তা জানাচ্ছে।

সুকুমার অশঙ্খতলায় গেলে বারিক বলে, কেমন শোনলা?

জব্বর!

ওইরাম, আমারে সেদিন এই জায়গায় দিলদার আসে সে কচ্ছিল, এই ছেমড়ার কোনও তুলনা হয় না।

হয়।

কিন্তু এর কিছুক্ষণের ভিতরে ইব্রাহিম চলে আসে। সুকুমার জানতে চায়, এত তাড়াতাড়ি!

কই নেই, মানুষ আছে পাবলিক নেই।

তাও তো মন্দ কলা না!

কই আর কলাম। আগে এট্টু সাপে কাটলি কী করতি হয়, তাই দেহাতাম, যাতে গাছগাছড়ার গুণাগুণ মানুষ বুঝতি পারে। সে সব কিছুই তো দেহালাম না।

তাও তুমি যা সুন্দর কও–ওই জঙ্গলে গাও গানডা!

ওডা ফকিরি গান, একবার যশোর স্টেশনে শুনিলাম, কুষ্টিয়ার এক ফকির গাইল। এই জায়গায় লাগাইয়ে দেলাম।

সেয়া তো দেখলাম—

চলো, লঞ্চঘাটের দিক যাই।

তুমি থাহো কোতায়?

ওই দড়াটানা ঘাট–ওই জায়গায় এক ছাপড়ায়। আমার মালপত্তর তো ট্রেনে আসে। ওই দিক থাকলিই সুবিধা। তুমি?

আপাতত লঞ্চঘাটে আলতাফের হোটেলে।

সুকুমার ইব্রাহিমের সঙ্গে এগোয় অপার মুগ্ধতা নিয়ে। কোর্ট চত্বর ছাড়তে ছাড়তে সে ইব্রাহিমকে বলে, চলো এবার তোমারে আমি চা-পান খাওয়াব–

ইব্রাহিমের আসরের পরে হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাওয়া কোর্ট চত্বর থেকে লঞ্চঘাটের দিকে তারা এগিয়ে গেল।

বারিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাই দেখে। তারপর আবার ঝিমায়।

০৬. শেষ বিকেলে ঝিলিক

শেষ বিকেলে ঝিলিক এসে হাজির। সুকুমার জানে আসতই,কিন্তু তা আরও দিন দুয়েক বাদে। আজই কেন? সুকুমার একই সঙ্গে অবাক ও বিরক্ত। গত তিন দিনে একবারও খেলা দেখাতে পারেনি। পরশু দিন গেছে আজগরের সঙ্গে রাগারাগিতে গতকাল কোর্টে তেমন কোনও লোকই ছিল না। লোক ছিল, ওই যে ইব্রাহিম মোসলেম উদ্দিনকে বলেছে একেবারে খাঁটি কথা। কোর্টে মানুষ আছে, পাবলিক নেই। সেই পাবলিক না-থাকা দশায়, ইব্রাহিম শেখের মতন ক্যানভাসারের আসরেই মানুষ হয় না, সেখানে সুকুমার খেলা দেখালে কে দেখে। খেলা তো দেখতে হয়, পাবলিক খেলা দেখে, পয়সা ফেকে। ইব্রাহিমের ওষুধ কিনে কল্পনা করতে করতে মনের সুখে বাড়ি যায়। এই ওষুধে কাজ হবে। এবার আর কোনও সমস্যা থাকবে না। গায়ে হাজার ঘোড়ার শক্তি কি ওই জিনিসটা এবার ঘোড়ার জিনিসের মতন বড়োসড়ো আর কার্যকর হবে। সেই ইব্রাহিমই ক্যানভাস থেকে ফিরে মুখোনা আমচুর করে রাখল। বলেছিল, এই ট্রেনের তুলে নেয়ার সমস্যাটা না গেলে কোর্টের পরিস্থিতি কোনওভাবেই ঠিক হবে। এমনকি দিলদারকে তার যন্ত্রটা নিয়ে বারিক কাকার দোকানের পাশে বসতে দেখেনি। এই কোনার দাঁত তোলার ডাক্তার সোলায়মান খান তার টেবিল নিয়ে শুধু বসেই ছিল। আজগর তার সামনে থেকে ঘুরে যেতে যেতে বলেছিল, কী দাঁতের ডাক্তার! সরকার টাউনের বড়ো বড়ো কুতুবগুলোর মাড়ির দাঁত যেভাবে ধইরগা টানতেচে, তোমার আর কষ্ট কইরগা দাঁত ফেলান লাগবে না। কে বলে আজগরের কথায় রস নেই। রস আছে ঠিকই, কিন্তু আজগর রসের কথাটাও এমন কাটখোট্টাভাবে বলে যে, সেই রসে আর কিছুই ভেজে না। এমনকি এসময় কান পরিষ্কার করা গোলাপ মিয়াকে তার ওই বাক্সটা সমেতও তেমন ঘুরতে দেখা যায়নি।

ফলে, এই পরিস্থিতিতে ঝিলিককে দেখে সুকুমারের চোখ একটু আকাশে উঠতেই পারে। কিন্তু ঝিলিক কি সে জন্যে দায়ী? সে কি এত কিছু জানে? যদিও ঝিলিকের আসার কথা ছিল আরও দুদিন বাদে, কিন্তু যে কাজে গেছে সেই কাজ যদি না হয়, তাহলে খালি খালি সেখানে আরও দিন দুয়েক থাকার দরকার কী? এই সবই হোগলাবুনিয়া থেকে লঞ্চে উঠতে উঠতে ঝিলিক যে ভাবেনি তা তো না। অত অবিবেচক মানুষ যেন তাকে সুকুমার না মনে করে। যদিও মনে করলেই-বা কী? সুকুমার মানুষটাও তো নিরুপায়। এই তিনদিন গেছে, তারও আগে যে আয় রোজগার তাও তো কম। এই শুকনার সময়ে যদি আয় রোজগার নাহয় তাহলে সামনে চলবে কেমনে। যদিও বর্ষাকালে রথের মেলার সময় দিন কয়েক তার যাবে ভালো। কিন্তু অমন ভরা বর্ষায়, পিচ্ছিল মাঠে তার খেলা দেখাতে কী কষ্ট হয়, তা যারা খেলে দেখে তাদের জানার কথা না। মানুষ খেলা দেখে আনন্দ পায়, কিন্তু খেলাঅলার কষ্ট কেউ দেখে না। আর সে সালাউদ্দিন না সালাম না আসলাম–বড়ো খেলোয়াড়, তাদের খেলা দেখতে হাজির লাখ লাখ মানুষ। টিকিট কাটো খেলা দেখে। আর সে কোন জায়গার কোনও দড়াবাজা, বাজিকর, তিন ফলকের খেলা দেখানো সুকুমার। যদি জয়দেব ছেলেটা থাকত, তা হলে হয়তো ঝকার তলে চাকু মারার খেলাটা দেখাতে পারত। ওই খেলাটা দেখলেই না পাবলিক কিছু পয়সা দেয়।

সুকুমার এসব ভাবত না, যদি তেঁকে কিছু থাকত। ঝিলিক কাল গেছে পরই ভেবেছিল, আজ চলে যাবে দড়টানা ঘাটের দিকে কোনও ছাপড়া হোটেলে। হোগলার বেড়া, গোলপাতার চাল, ভাড়া কম। খেলা দেখানোর ওই কিছু মালামাল মাথার কাছে রেখে রাত্তিরটা কাটিয়ে দিত। সকালে নদীতে স্নান করে পোটলা-পুটলি বোচকা-বুচকি নিয়ে রওনা দিত কোর্টের দিকে। শরীরের জুত থাকলে, ভেবে রেখেছিল সকালে রেল স্টেশনে কিছুক্ষণ খেলা দেখিয়ে, একটু বেলা উঠলেই চলে আসবে কোর্ট চত্বরে। কিন্তু সে সবই ভেস্তে গেল। ঝিলিককে নিয়ে তো ওই দড়াটানা ঘাটের দিকে যাওয়া যাবে না। ওদিকে বেশির ভাগই থাকে মাছের আড়তের খালাসিরা। সেখানে সুকুমারের সঙ্গে একটা মেয়ে। মেয়েমানুষ নিয়ে এই এক ঝামেলা, যে জায়গায় রাত সে জায়গায় কাতের কোনও উপায় নেই।

এদিকে ঝিলিকের ভাগ্যটাও ভালো। সুকুমার তখন লঞ্চঘাটের কাছেই ছিল, তাকে খুঁজতে হয়নি তার। আজগরের শরীরটা খারাপ। গায়ে গতকাল রাত থেকেই জ্বর জ্বর। আজ একবারই কোর্টের কাছে গিয়েছিল, বাঁদর দুটোকে নেয়নি। সে দুটো তার ঝুপড়ির উলটো পাশে যেখানে বাঁধা থাকে সেখানেই বাঁধা ছিল সারা দিন। দুপুরে রোদ চড়লে জরিনা ছায়ায় নিয়ে বেঁধেছে। বার দুয়েক খেতে দিয়েছে। পয়সা নেই, কলা মুড়ি আর একখানা দুই খানা আধ পোড়া রুটির বেশি কিছু দেয়ার উপায় জরিনার নেই। তাছাড়া জরিনা আজগরকে নিয়েই পারে না। কোত্থেকে একটা বালতি জোগাড় করে নদী থেকে পানি এনে আজগরের গা মাথা ধুইয়ে দিয়েছে। এক উড়ে মালিকে বলেছে, যদি পারে জেলখানার পুকুর থেকে যেন এক ভাড় পানি এনে দেয়। নদীর পানি নোনা। এই নোনা পানিতে জ্বরের রুগিরে থোয়ালে গায়ে সাদা খড়ি ওঠে। যদিও সে বলেছিল, নদীর পানিই ভালো। জরিনা যেন ভরা জোয়ারের পানি দিয়ে আজগরকে কাল নাইয়ে দেয়। কিন্তু প্রায় রাস্তার মেয়ে এই জরিনা, ঠিক ভরা জোয়ারের সময় কার বালতি কাল খালি পাবে, একটা বালতি জোটাতে পারবে কি না, তা সে নিজেই জানে না। তাছাড়া এই জায়গায় বাসাবাড়িও তেমন নেই। থাকলে আজগরের জন্যে এট্টু গরম ফেন আনতে পারত। ওই গরম গরম ফেন লবণ দিয়ে খাইয়ে দিলে আজগর একবেলায় চাঙা। তবে আলতাফকে বলে রেখেছে, আলতাফ দেবে। কিন্তু আলতাফ শালা আচ্ছা হারামি। ফেন আনার সময়ও সুযোগ পেলে দুটো খবিশ কথা বলবে।

এই সব প্রায় বিড়বিড়িয়ে সুকুমারকে জানিয়েছে জরিনা। দিন তিনে আগে এই লোকটার সঙ্গে আজগরের তর্কাতর্কি হয়েছে। তা নিয়ে কিছুক্ষণ দুজন দুই দিক, কিন্তু ঝিলিকের সঙ্গে সুকুমারকে দেখার পর জরিনার মনে হয়েছে, এই মানুষ খারাপ হতে পারে না।

ঝুপড়ির বাইরের দিকে মাথা দিয়ে আজগর তক্তপোশে শোয়া। সেখান থেকে বড়োজোর হাত আষ্টেক তফাতে নদীর পাড়ে বসেছিল জরিনা আর সুকুমার। কিছু আগে এসেছে সন্ন্যাসীর লঞ্চ, তারপর এসেছে ভাসার ওদিকের লঞ্চখানা। সকালে মোড়েলগঞ্জের লঞ্চে হোগলাবুনিয়া গিয়েছিল ঝিলিক। সে লঞ্চখানা তখনও ফিরে আসেনি। এমনকি সেই লঞ্চখানার জন্যে সুকুমার আর জরিনা এখানে বসেও নেই। সুকুমারের অবশ্যি একবার মনে হয়েছিল, ওই লঞ্চখানা তো এখনও ফিরল না। ফিরতি লঞ্চটা দেখলে সে মনে মনে ভেবে নিতে পারত, ঝিলিক ঠিকঠাক পৌঁছেছে।

আজগরের কপালের জলপট্টি বদলে দিয়ে এসে জরিনা সুকুমারকে বলে, জ্বর নামতিচে না, সুকুমার ভাই!

ঝিলিক আসার পর থেকে জরিনা সুকুমারকে সুকুমার ভাই ডাকে, এর আগে ডাকত সুকুমারদা। ঝিলিক জরিনার চেয়ে বয়েসে ছোটো, সুকুমারও ছোটো, তবে সুকুমার ঝিলিকের চেয়ে বয়েসে খুব ছোটো হবে না। সম্পর্কে সুকুমার ঝিলিকের দেবর, কিন্তু তারা সমবয়েসি। তাই, জরিনা সুকুমারকে এইভাবে ডাকে। কিন্তু সুকুমার জরিনাকে সাধারণত কিছুই ডাকে না। তবে কখনও কখনও ডাকে। জরিনাদি। আর ঝিলিক আসার পরে, এই দুইদিনে জরিনা খেয়াল করেছে, সুকুমার ঝিলিককে প্রায় কখনওই কিছুই ডাকে না। বউদি তো নাই, নাম ধরেও ডাকে না। কখনও কখনও ডাকে মেজো বউ, এর বেশি কিছু ডাকতে শোনেনি।

সুকুমার বলল, রাতটা দেখা যাক। নাকি সকালে একবার পুরনো হাসপাতালে নিয়ে গেলি হবেনে।

হয়। তয় মোসলেম কাকা সামনের ফার্মেসির দে ওষুধ কিনে দিচে।

খাইচে সে ওষুধ?

হু, ওই ওষুধ খালি এট্টু সমায়ের জন্যি জ্বর নামে, তারপর আবার ওঠে।

এই গরম দিয়ে ঠান্ডা লাগা জ্বর। তাছাড়া আজগর ভাইর গায়ে আছে কিছু নিয়ম কানুন কোনোতা কোনওদিনও মানিছে বলে মনে হয় না।

আরে নিয়ম মানলি কোনও মানষির শরীরের এই দশা হয়!

এ নিয়ে কথা এক সময় থামে। বিকেল সন্ধ্যার দিকে এগোয়। আজও তার কোনও ব্যতিক্রম নেই কোথাও। শুধু গাছের পাতায় বাতাসের দোলা একটু বেশি। নারকেল গাছের পাতায় বাতাস খেলছে শব্দ করে। সেই বাতাসে হঠাৎ একটু দূরে কোথাও একটা নারকেল পড়ে। কিন্তু এই বাতাস এমন নয় যে, কোনও গাছের ডাল তাতে ভাঙবে। কিন্তু এইটুকু বাতাসেও এখন জরিনার বুক কাঁপে। যদি বাতাস আসে জোরে, যদি তার সঙ্গে বৃষ্টি হয়, তাহলে মানুষটার জ্বর ছাড়বে না। হাতে টাকা নেই একটাও। আজ নয় মোসলেম কাকা ওষুধ কিনে দিয়ে গেছে, কিন্তু কাল সকালে যদি আজগরকে ডাক্তারের কাছে নিতে হয়, তাহলে রিকশা ভাড়া লাগবে, হাসপাতালে স্লিপ কাটতে হবে আর ডাক্তার সাহেব যে ওষুধপত্তর লিখবে, তাই কিনতে হবে। জরিনা জানে না, সে পয়সা পাবে কোথায়? এখন মানুষটার এই অবস্থা, সে তাকে ছেড়ে চলে যাবে? যাবে কোথায়? গেলে মানুষ কবে কী? এই কয়মাসে তো তারে এই লোকটাই টানছে। ভালো পাড়ক মন্দ পাডুক খাওয়াছে। আজ এই অবস্থা!

সুকুমারের সঙ্গে কথা শেষ হলে এইসমস্ত কথা জরিনাকে ঘিরে ধরে। ওদিকে সুকুমারের ঘটনাটা তার উলটো। ঝিলিক খুঁজে খুঁজে তার কাছে এসেছে। তাই যেন স্বাভাবিক। যাবে কোথায়? কিন্তু কেন এসেছে, কোত্থেকে এসেছে, সেকথা সুকুমারই-বা জনে জনে বলে বেড়ায় কী করে? ঝিলিক কি জানত, এই জায়গায় একদিন পথে দেখা হওয়া জরিনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। যদি জরিনার সঙ্গে দেখা না হত, তাহলে কীভাবে কেউ জানত সে সুকুমারের মামাতো ভাইয়ের বউ।

ভিতরে এত ঘটনা আছে, পরশু তার কিছু কিছু জরিনা ঝিলিকের কাছে শুনেছে, হয়তো। কিন্তু সে কথার কিছু আজ সারাদিনে একবারও জরিনা সুকুমারের কাছে জানতে চায়নি। মেয়েদের আলাদা কোনও হিসেব থাকে। অনুমানে তারা অনেক কিছুই বুঝতে পারে। তবে সুকুমার লক্ষ করেছে, ঝিলিকের সঙ্গে এবার দেখা হওয়ার পরে, আলাপের পরে জরিনার তার প্রতি আচরণ বদলে গেছে।

যেন, এইমাত্র সে কথাই বলল, দেখলা, সব লঞ্চ আসল, এহোনও মোড়েলগঞ্জের লঞ্চখান আসল না?

কী যে কও?

না, সেই লঞ্চখান আসলি বুঝদি পারতা সে ভালোমতো পৌঁছইছে নাকি, ও সুকুমার ভাই! সুকুমার হাসল, তোমার কতায় ভালোই রস আছে।

রস না রস, কথা এহেবারে রসগোল্লা। আর ফাও কতা কইয়ে না। কতায় রস থাকলি আর এই জায়গায় থাকতাম না।

আর ওইয়ে কইয়ে লাভ নেই। আইজ মরলি কাইল দুই দিন। আইজ এই জায়গায়, কাইল কোন জায়গায়, তার কোনও ঠিক আছে? এই যে টাউনের ছলপলরা কয় না, কী আছে জীবনে, আধসের আটার দাম নেই। ঠিকই কয়।

তা তো ঠিকই। দেখো, তুমি যার জন্যি লঞ্চের জন্যি বইসে আছে। দুই তিনদিন বাদে আবার আসপে, তার জীবনডা, গিরস্ত ঘরের বউ আইজকে তোমার সাথে পথে পথে!

এ সময় আজগর যেন ডাকল অথবা ডাকেনি। জরিনার মনে হল। হয়তো জরিনা ঝিলিকের হঠাৎ আসা নিয়ে এমন আরও কিছু বলত। উঠে গেল। হয়তো, এখনই আসবে। তবে ঝিলিকের হঠাৎ এখানে এইভাবে আসা সুকুমারের কাছেও বিস্ময়।

সুকুমার বলল, তা তো ঠিকই, জরিনাদি—

জীবন এইরাম, এই দেহো আইজ আমি কোতায়? কাইল কোতায় থাকপো জানে কেডা?

জরিনা আজগরের কাছে যেতে লাগলে সুকুমারও একটু যেন বিড়বিড় করে, ঠিকই কইচো–

সুকুমারের ঝিলিকের স্বামী ভক্তর মুখোনা চোখে ভাসে। বড়ো গোঁয়ার ভক্তদা। এই কাজ করতে পারল। ও মানুষ না। কিন্তু সুকুমার কেন, তার আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টির কেউ কি কোনওভাবে ভাবতে পেরেছে ভক্ত এই কাজ করবে? নিরীহ কিন্তু গোঁয়ার মানুষের পেটে তলায় তলায় কতপদের ধান্দা থাকে, তা যদি মানুষ বুঝত? কিন্তু মানুষ যে বুঝতে সেই সাধ্য কার? কবে কোন দিন কোন কাজে মোল্লারহাট থেকে ভক্ত গিয়েছিল মোড়েলগঞ্জের হোগলাবুনিয়ায়। সম্ভবত গোপালগঞ্জের পরবাসীদের সঙ্গে ধান কাটতে। আজ আর ভালো মনে নেই সুকুমারের। তখন সে এ জায়গায় ও জায়গায় ফুটবল খেলে বেড়ায়। কালেভদ্রে বাড়ি আসে। ফরিহাটের এক বাড়িতে থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন প্রাইভেট। ফুটবলই তার জীবনটা শেষ করবে, বলত সবাই। কিন্তু তার ফাঁকে যে একদিন সুকুমার মেট্রিকটা পাশ করতে পারবে তাও কেউ ভাবেনি। সুকুমারের চোখে তখন অন্য স্বপ্ন। এসব লেখাপড়া দিয়ে তার হবেটা কী? যদি খুলনায় এ-ডিবিশনে খেলতে পারে, তারপর সামনে ঢাকা লিগ। খুলনায় না-হলে ঢাকায় বি-ডিবিশনে এক দুই বছর খেলে তারপর নয় এ-ডিবিশনে কোনও ছোটো ক্লাবে খেলবে। ধীরে ধীরে বড়ো ক্লাবে। যদি সুযোগ হয়, তার ভাগ্য ফেরে।

যদিও তার ভাগ্য উলটো দিকে গেল। যা কোনওদিনও ভাবেনি সে, তাই ঘটল। প্র্যাকটিস ম্যাচে হাঁটুতে দারুণ চোট পেল। সুকুমার আজও বুঝে পায় না, বল নিয়ে ডিবলিং করতে করতে ওই ঘটনা কী করে ঘটল! একা একাই তো। পায়ে তার চমৎকার জাদু। সবাই বলত, বল সুকুমারের কথা শোনে। এক পায়ে একবার বল তুলতে পারলেই হত, আর তা কোনওভাবে নীচে পড়ত। ডান পা থেকে বাঁ পা, আবার ডান-বাম। সেখান থেকে হাঁটু ও ঊরু। এক উরু থেকে অন্য উরু। আবার পা। পা থেকে সোজা মাথায়। মাথার ওপর কিছুক্ষণ বল নাচানো। সেখান থেকে কখনও কখনও ঘাড়েও নিতে পারত, তবে ঘাড়ে নিলেই বল পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বেশিক্ষণ ঘাড়ে রাখত না। এমনকি কখনও কখনও ঘাড়ে নিতই না। মাথা থেকে আবার উরুতে। উরু থেকে পায়ে।

সেদিন মাঠে এ খেলা দেখাচ্ছিল না সুকুমার। এটা কখনও কখনও করে। তখন বল ডান পায়ের নীচে নিয়ে বুটের একটু চাপ দিয়ে বলটার নীচে বাম পায়ের একটা খোঁচা দিতে চেয়েছিল মাত্র। তাতেই জীবনে এত বড়ো সর্বনাশ! সুকুমার টান সামলাতে না পেরে ডান দিকে হাঁটু মুড়ে পড়ে যায়। পড়ে থাকে। আশেপাশের সবাই মনে করেছে পড়ে আছে। কোনও ব্যথাও পায়নি সে। হাঁটুর ভিতরে কোথাও কোনও জ্বালাও করে ওঠেনি। কিন্তু ওই পড়া থেকে তখন সুকুমার আর কোনওভাবেই উঠে দাঁড়াতে পারে না। সহখেলোয়াড়রা তোলে তাকে। তাদের ধরে দাঁড়ায়। ডান পায়ে কোনও জোর পায় না। পা-টা মাটিতে দিতে পারে না। এভাবে মাঠের কিনারায় আসে। সবাই ভাবে, এমন তো কতই হয়। রেস্ট নিলে ঠিক হবে। ব্যথা না কমলে ডাক্তার ওষুধ দেবে। কিন্তুসেই রেস্ট নেয়া যেন হয়ে গেল একেবারে সারাটা জীবনের জন্যে। বল পায়ে সুকুমার আর মাঠে দৌড়ায়নি। ডাক্তার দেখিয়ে কিছু পরীক্ষা এক্সরে এসবও করেছে, ডাক্তাররা বলেছিল, কোনও একটা জয়েন্টে একটা সমস্যা। এটা নাকি তার অনেক দিনের, এতদিন বোঝা যায়নি, এদেশে এসবের কোনও অপারেশন নেই, বিদেশে আছে। তবে তাতেও যে সে খেলতে পারবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।

নিশ্চয়তা থাকলেই-বা কী হত? সুকুমারের মতন প্লেয়ারকে বিদেশে পাঠাবে কে? তখন সুকুমার বাড়ি ফেরে। কিন্তু সেখানে বসে কে খাওয়ায়। বাপ নেই। ভাইয়েরা যার যার সংসারে। এক ভাই ভাগের ভিটার জমি বেচে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। বাকি দুজন কষ্টে থাকে। ভিটার ওইটুকু জমি ছাড়া বাপ আর কিছু রেখে যায়নি। স্থানীয় স্কুলের মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলে, সুকুমার দেখে। একদিন পায়ের কাছে বল আসলে, সে লুঙ্গিটা গুটিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বলটা পায়ে নিয়ে আবার আগের মতই নাচায়। বাঁ-পায়েই রাখে বেশি ভর। তখন সবাই তাকে খেলতে ডাকে। সুকুমার তাদের জানায়, মাঠে দৌড়ানোর মতো শক্তি তার ডান পায়ে নেই। ডান পায়ে এদিকে ওদিকে বল ডিবলিং করতে পারবে না। সেদিন গেছে। তবে সুকুমার এই ঘটনায় বুঝতে পারে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তার পা এখনও আগেরই সেই করসত দেখাতে পারে। ও কৌশল সে ভোলেনি।

একদিন তার মামাতো ভাই ভক্ত বউ নিয়ে এসে হাজির। এখন বউ নিয়ে নিজেদের বাড়ি যেতে পারেনি। সে সাহস নেই। গিয়েছিল মোড়েলগঞ্জের হোগলাবুনিয়ার ধান কাটার কাজে, সেখান থেকে নিয়ে এসেছে এই বউ, নাম ঝিলিক। সুকুমারের বড়ো ভাইরা ভক্তকে তাড়িয়ে দিল না, কিছুই বলল না বলতে গেলে। শত হলেও মামাতো ভাই, কোন দূর দেশ থেকে পছন্দ করে কনে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। ওদিকে ভক্তর হাত একেবারে খালি। এখানে ভক্তর হাতে কোনও কাজ নেই। ফলে, সুকুমার বুঝতে পারল কেন তারা দাদারা ভক্তদার এখানে আসা নিয়ে কোনও উচ্ছাস প্রকাশ করছে না। সুকুমারের মামা বাড়ির গ্রামও এ জায়গা থেকে কাছে, কিন্তু ভক্ত এখনই সেখানে যাবে না। প্রায় দিনই সুকুমারের দাদাদের বলে, তারা কেউ একজন যেন গিয়ে ভক্তর বাড়িতে বলে। কিন্তু প্রত্যেকেই তার মামাকে চেনে, তাদের ধারণা মামা ভক্তর এই বিয়ে মেনে নেবে না।

ঝিলিক দেখতে শুনতে ভালো। লক্ষ্মীপনা আছে মুখোনায়। এমন বউকে তাদের মামা কেন মেনে নেবে না, সুকুমার তাও বুঝে পায় না। সে তার বড়ো বউদিকে জিজ্ঞাসা করে, তারা তাকেই এ নিয়ে কিছুই বলে না। বরং বলে, দিন কয়েক থাক, তারপর মামা এক সময় মেনে নেবে। কিন্তু এই দিন কয়েক থাকাটাও তো সমস্যা। দুই ভাইয়ের মাথার ওপর সুকুমার, তারপর আরও এই দুইজন মানুষ। সুকুমার বুঝতে পারে ভাইদের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সুকুমার অসহায়।

তখন ঝিলিককে রেখে ভক্ত খুলনা শহরে চলে যায়। সেখানে তাদের এ দিকের পরিচিত একজন আছে, তার কাছে থেকে যদি কোনও কাজ জোটাতে পারে। কিন্তু কী কাজ জোটাবে তাও তো তার জানা নেই। এর ওপর গোয়ার্তুমি আছে ষোলো আনা। খুলনা যাওয়ার আগেও ঝিলিককে শুনিয়ে বলেছিল, তার জীবনটা এই ঝিলিকই বরবাদ করে দিয়েছে। কতবার নাকি বলেছে, ভালোমতো একটা কাজ জুটিয়ে একদিন তাকে নিয়ে আসবে। তা না। ঝিলিকের তখন খালি এক কথা, এই ফাল্গুনেই তার বাপ তাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। তখন ফিরে এসে আর তাকে পাবে না। অগত্যা, ঝিলিকের পিড়েপিড়েতেই নাকি এই দশা, এভাবে প্রায় এক কাপড়ে তাকে নিয়ে আসতে হয়েছে।

একদিন সন্ধ্যায় সুকুমারের বউদিরা ঝিলিককে স্থানীয় কালীখোলায় নিয়ে যায়। সঙ্গে ভক্ত আর সুকুমার। মা কালীর সামনে ঝিলিকের সিঁথিতে ভক্ত সিঁদুর পরিয়ে দেয়। বউদিরা ঝিলিকের হাতে পরায় শাখা। ব্যস, সুকুমারের ভক্তদার বউ ঝিলিক। এর দিন কয়েক বাদে ভক্ত খুলনায় যায়। ঝিলিক তাদের বাড়িতে। সুকুমারের বউদের সঙ্গে গৃহস্থালি কাজ করে। কাজে গুরুপনা আছে। একটু মোটা গলায় বরিশালের মানুষের মতন কথা কয় বলে তারা মাঝেমধ্যে হাসাহাসি করে। সুকুমার দেওর হিসেবে এই নিয়ে খেপায়। আর কখনও কখনও দুই জা বাদে ঝিলিকের মনের কথা বলার একমাত্র লোকই হয় এই সুকুমার। কখনও হয়তো ঝিলিক বলত, বোঝলা, তোমার দাদা এট্টা গোঁয়ার!

সুকুমার সেকথা শুনে মজা করত, গোঁয়ার না-হলি এইরম সুন্দরী নিয়ে ভাগা যায়!

হয়, হইচে, তুই যে আমারে কোতায় সুন্দরী দেহে! বউদি কী সুন্দর!

সুকুমারের বড়দার বউ দেখতে বেশ। সুকুমার তা জানে। কিন্তু ঝিলিকের রূপে কোথায় যেন একটা চটক আছে, সেকথা জানাতে ভোলে না সে, বড়ো বউদি হল শাবানা, তুমি সুচরিতা

হইছে। থাকতা শুনচি সারাদিন ফুটবল লইয়া, এয়ার মদ্যে এত বই দেকলা কহোন আর নায়িকাগো চেনো কী কইরে? আমি তো বই-ই দেখি নাই জীবনে। এক বাড়ি পোস্টার দেকচি।

যহোন খুলনায় খেলতি যাতাম, তখন কত বই দেহিচি–তারপর ঝিলিকের কাছে জানতে চায়, দেহোনি বউদি, তুমি কোনওদিন বই? তালি মেজদার সাতে এরপর খুলনা যাইয়ে দেইহো।

সে আসুক। খুলনায় কোনও কাজ জোটাতি পারে না পারে সেইয়া জানে কোড? তুই আছো বই দেহারা তালে।

এসব বলতে বলতে ঝিলিক কখনও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, এইরম বইসে থাইছে মাইনষের ঘাড়ের উপর আর কতদিন। আমারে সাথে কইরগা লইয়া গেলে আমি নয় এডা ওডা কাজ করতে পারতাম।

আমারও তো একই অবস্থা। দাদাগো ঘাড়ে বইসে খাই। আগে ফুটবল খেইলে, খেপে খোপে দুই পয়সা পাতাম, সেয়াও গেইচে–

চলো তয়, আমি আর তুমি খুলনা চইলগা যাই তোমার দাদার ধারে।

গেলিই কাজ দেবে কেডা?

তুমি না মেট্রিক পাস। ছোটো ছোটো ছেলেপেলেরে পড়াতা।

ওইয়ে মনে আছে নিকি? আমি হলাম যা পড়ি সেইয়ে একদিন মনে থাহে, পরদিন ভুইলে যাই। সব গোল গোল দেখি। ফুটবল ছাড়া জীবনে আর কিছু দেখিছি নিকি? পায়ে আমার একদিন কী হইয়ে গেল আর ফুটবলই খেলতি পারলাম না। ওই পড়ালেহা করিছি সেয়াও তো কত বছর। তার কোনও কিছু মনে নেই।

তবু কয়দিন দেকলি আবার পারবা। আমি তো প্রাইমারি ইস্কুলে কয়দিন গেচি, আমাগো যারা পড়াত সবাই মেট্রিক পাসও না, এলাকার দাদারা। ওইরম খুলনা যাইয়ে নয় তুমি কিছু বাচ্চাকাচ্চারে প্রাইভেট পড়াইলা। কী যাবা?

একদিন ভক্ত আসলে ঝিলিক তার কাছে কথাটা পাড়ে। তারপর সিদ্ধান্ত হয়, যদি আর মাস দুই মাসে সে ভালো কোনও কাজ জোটাতে না পারে তাহলে ঝিলিকের সঙ্গে সুকুমারও যাবে। এখনও মাথা গোঁজার কোনও ঠাই হয়নি। ধান কাটা মানুষ ভক্ত, এখন রূপসার কূলে এক গোলায় কাঠ ফাড়ার কাজ করে। সেখানেই রাতে ঘুমায়।

তারপর একদিন সুকুমারকে নিয়ে ঝিলিক খুলনা যায়। রূপসা ঘাটের কাছে এক ছাপড়ায় থাকে। ছাপড়াটা ছোটো। বাইরে একটা এক চালায় ঘুমায় সুকুমার। ভিতরে ভক্ত আর ঝিলিক। রাতে তাদের শরীর বিনিময়ের শব্দ সুকুমারের কানে যায়। সুকুমার তখন এপাশ ওপাশ করে। কোনও কোনও সকালে সেকথা ঝিলিককে একলা পেয়ে মনেও করিয়ে দেয় সুকুমার। ঝিলিক। হাসতে হাসতে বলে, গরানের চলা পিঠে ভাঙব!

হয়তো সুকুমার তাতে আরও একটু উসকায়, পিঠের কোন জায়গায়? এই বলে রোদে তার উদোম পিঠটা মেলে ধরে। নিজেই পিঠে হাত দিয়ে ঝিলিককে দেখায়, কও ও মাইজে বউ, কোন জায়গায়?

ঝিলিক সুকুমারের পিঠে আঙুল দিয়ে টিপেটিপে দেখায় এই জায়গায় এই জায়গায় এই জায়গায়। কিছুদিন আগেও দেড় ঘণ্টা ফুটবল মাঠে দৌড়ানো সুকুমারের পিঠের মাংস পেশিগুলো তাতে অদ্ভুত আসকারা পায়। সে ঘুরে ঝিলিককে দেখে। কিন্তু এর ভিতরেও সুকুমারের মনে থাকে এভাবে বসে খেলে, এই হাতও পিঠে কর্কশ হয়ে উঠবে। সুকুমার বলে, বইসে থাকতি থাকতি গায়ে একেবারে জড়ো হইয়ে গেলাম। কই এই কয়দিনেও একজনও ছাত্র পাইলাম না। জানো না তো, আমার ধারে পড়বে কেডা?

হবে। আসপে। এই জায়গায় মানুষজনরে তুমি কইচো, তোমার দাদা কইচে, আমি কইচি। আর নয় নাইট ইস্কুলে যাইয়ে পড়াবা। দেহা যাক।

যদিও ঝিলিকের এই কথার তুলনায় সুকুমার চালু। চোখ কান তুলনায় ভালোই খোলা। খুলনা শহরে বি-ডিবিশনে আগেও ফুটবল খেলে গেছে। রূপসা ঘাটের কাছে এই জায়গায় বসে বসে হাওয়া খাওয়ার মানুষ সে না। শহর পশ্চিম দিকে আরও কত কত দূর। সেখানে কোর্ট-কাছারি বড়ো বাজার স্টেডিয়াম, ভৈরব নদীর কূল, বড়ো মাঠ, কত কিছু। গায়ে জামা দিয়ে সেই দিকে ঘুরতে যায় নদীর কূলের বাঁধের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে। কাস্টমসঘাট হয়ে চলে যায় বড়ো মাঠ। পাশেই খুলনা স্টেডিয়াম। এই মাঠেও একসময় খেলেছে সে। এখন অকেজো। মাঠের দিকে তাকিয়ে সুকুমারের শ্বাস গভীর থেকে গম্ভীর হয়।

একদিন রেল স্টেশনের কাছে সার্কাসের প্যান্ডেল দেখে সুকুমারের মনে হয়, যদি সার্কাসের দলে কিছুক্ষণের জন্যে ফুটবলের ওই খেলাটা দেখাতে পারত সে। দৌড়তে হবে না। কেউ তার দিকে বলটা ছুঁড়ে দেবে অথবা গড়িয়ে দেবে তার পায়ের দিকে। তারপর সেই বল সে এক পা থেকে অন্য পা, তারপর হাঁটুতে, উরুতে উরুতে ঘাড়ে কি মাথায় নিয়ে খেলা দেখাত। এই একটা খেলাই পারে সে। এইটুকু দেখাত। যদি সুযোগ হয়।

ঘরে ফিরে এই কথা সে ঝিলিককে বলে। ঝিলিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে, নেবে তোমারে?”

কী জানি। ওই এক খেলা দেখানোর জন্যি কেউরে দলে নে?

আর কোথাও খেলা জানো না?” বলেই ঝিলিক হাসে। অদ্ভুত রহস্যপূর্ণ হাসি! সুকুমার তাকিয়ে থাকে। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ এই হাসিটা ঝিলিক তার দিকে চেয়ে হাসে।

আমি তোমার মতো খেলোয়াড় নাকি? ছাপড়ার ভিতরে ঢুকে সুকুমার গামছা খুঁজতে খুঁজতে বলে।

আমি আবার কবে খেলোয়াড় হইলাম, শুনচি তুমি খেলা দেখাও বল দিয়ে।

সুকুমার হাসে। ঝিলিক হাসতে হাসতে ছাপড়ায় ঢুকে একই হাসি মুখে সুকুমারের দিকে তাকায়। সুকুমার বলে, তুমি খেলা দেখাও ভক্তদারে। আমি মানুষেরে দেখাই এক বল দিয়ে তুমি দেখাও দুই বল দিয়ে!

আইজ পিঠে সত্যি সত্যি গরানের চলা ভাঙব, দেওরা!

সুকুমারের পিঠ উদলা। সে স্নান করতে যাবে। নীচু দরজার দিকের আলোতে সে পিঠখানা এগিয়ে দিয়ে বলে, কোন জায়গায় কোন জায়গায় ভাঙবা দেখাও?

ঝিলিক এবার আর পিছনে আসে না। তবে সুকুমারের কাছে আসে। সুকুমার হঠাৎ ঝিলিকের দিকে পিঠ দেয় বলে, দেখাও? আরও বলে, তুমি হইলা দুই বলের খেলোয়াড়, যা বল তোমার!

ঝিলিক আর গরানের চেলা কাঠ পিঠে ভাঙার কথা বলে না। একটু থমকে দাঁড়ায়। অপেক্ষা করে। সুকুমার তা বুঝতে পারে। তারপর ঘুরে ঝিলিককে পিছন থেকে আঁকড়ে ব্লাউজহীন স্তনে হাত দেয়। একসঙ্গে দুটো, দুই হাতে ধরে বলে, এই যে দুই বল, তুমি দুই বলের খেলোয়াড়।

ঝিলিক শুধু একবারই ফিসফিসায়, দরজা খোলা। দরজা খোলা, দেওরা।

সুকুমার আরও অস্ফুট বলে, কেউ আসপে না। এই সময় কেউ আসে না।

ঝিলিক সুকুমারের শরীরে লেপ্টে যায়। অথবা সুকুমার তাকে লেপ্টে ফেলে, এমনকি এই স্মৃতি আরও বহু বহুদিন মনে থাকে ঝিলিকের। অমন নিঃস্ব তাকে কোনওদিনও করেনি ভক্ত।

এর কিছুই এখন সুকুমারের মনে পড়েনি। পড়ার কোনও কারণ নেই। ঝিলিক যে সমস্ত দুর্বিপাক কাটিয়ে এসেছে, তাতে তার কোনওভাবে ও কথা মনে পড়ার কথাও না। তবে, কিছুক্ষণ আগে জরিনা যখন ঝিলিকের ফিরতি লঞ্চটা ফিরে এসেছে কি না, তখন ভিতরে চোরা টান সে টের পেয়েছে। অজ্ঞাত সেই টান। কোনওদিন সেভাবে ভাবেওনি। আজ ভাবল।

জরিনা আজগরের কাছে থেকে ফিরে আবার সুকুমারের কাছে বসে। আবার ওই একই কথা আবার বলে, সব কয়খান লঞ্চ চইলে আসল, খালি মোড়েলগঞ্জের খান এখনও আসল না।

আসপে।

দক্ষিণে কিছু হইচে নিকি? বাতাস আছে আইজকে।

হলি তো এহোন হইচে। সে তো গেল সকালে, সকালে তো আর কিছু হইনি।

সুকুমার ভাই, তোমার যা কতা। তোমার কতা কী? তোমাগো পুরুষ মানুষের আসলে অন্তরে কোনও দরদ নেই। এটা মানুষ কোন পথে ঘাটে কোথায় কোথায় টাক খাতি খাতি আবার তোমারে খুইজে, তোমার ধারে আইচে। নালি যাতে কোতায়, জানো না জাতো কোডায়? ওই মাগি বাড়ি। বিটি মানষির তো শেষমেশ যাওয়ার জায়গা ওই এট্টা

হঠাৎ এসব বলছে কেন জরিনা? সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। এই সময়ে চোখের ভাষা ঠিক ঠাক পড়া যায় তো? সে জরিনাকে বুঝতে পারছে? থাকে ওই আজগর বান্দরঅলার সাথে, সেও দেখো কি বুঝমানের মতন কথা কয়! নাকি ঝিলিক এই এক দেড় দিনে তার জীবনের সব কথা বলে দিয়েছে? কী বলেছে, এই খেলাঅলা দেওরারে তার ভালো লাগে, তাই এসেছে তার কাছে?

কিন্তু জরিনা যাই বলুক, মিথ্যা কিছু বলেনি। মেয়েমানুষের জীবন যেন তাই। অমন একটা ছাপড়ায় রেখে, স-মিলে কাজ করা ভক্তদার সঙ্গে ঝিলিক তো খারাপ ছিল না। কয় বাসায় কাজ করত। একটা ছেলে হল, নাম ভরত। ছেলেটার নাম যে ভরত, তাও আজও মনে আছে জরিনার। কবে কোন একদিন নাকি ঝিলিকের সঙ্গে তার মূলঘর স্টেশনে দেখা হয়েছিল, তারা যাবে যাত্রাপুর লাউফলা রথের মেলায়। সেই সংসার সেই সব কিছু ভক্তদা ওইভাবে ভেঙে দিতে পারল।

সুকুমার ঘটনাটা আগেই জেনেছিল, যতই পথে পথে ঘুরুক, বাড়িঘরের খবর কিছু কিছু তো পায়। এমনিতে মামার গুষ্টির মানুষজন কেমন তা তাদের তিন ভাই আর বোন দুটোর ভালোই জানা ছিল। সুকুমার সবার ছোটো বলে দাদাদের বউদিদের আর দিদিদের কতাবার্তায় কখনও কখনও জানতে পারত। তাই বলে ভক্তদা এই কাজ করবে। হায়রে খুলনা শহর। সুকুমারের মনে হয়, ও জায়গায় না গেলে কোনওভাবেই ওই কাণ্ড ঘটত না। আবার কত মানুষই তো যায়, তারা সবাই অমন কাণ্ড ঘটায় নাকি? সুকুমার ভাবে, জরিনা কি এসব কথা জানে, তাকে বলেছে মেজো বউ?

সুকুমার তখন যশোর, বাড়ির কাছের একজনের কাছে শুনেছিল, তার ছোটদা বলেছে, ভক্তদা এক মহিলাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ। সঙ্গে ছেলেটাকেও নিয়ে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। ঝিলিক তাদের বাড়ি গিয়ে বলে চলে গেছে। সে এখন কোথায় থাকে ওই বাড়ির লোকজন জানে না। তবে সবার ধারণা ঝিলিক বাপ-ভাইর কাছে মোড়েলগঞ্জ চলে গেছে। সুকুমার যদি কোনওভাবে জানতে পারে তাহলে যেন বাড়িতে জানায়।

সত্যি, আজও জানা যায়নি ভক্ত কোথায়? তবে সবার ধারণা সেই মহিলাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। গোপালগঞ্জের একজন বলেছিল, তাদের কিছু আত্মীয়স্বজন আছে ঠাকুরপুকুর, সেখানে। দেখেছে ভক্তকে। যে মহিলাকে নিয়ে গিয়েছিল সে নাকি উড়ে। তাই ভক্ত হয়তো উড়িষ্যাও চলে যেতে পারে। সবই শোনা কথা। সুকুমার এইসব ঘটনার কোনও নিশানা পায়নি। তাছাড়া সে বাড়িঘরে যেতই-বা কত, যদি কোনও খবর আসত তাহলে কিছু হয়তো জানতে পারত।

তারপরে সুকুমারের সঙ্গে এই নিয়ে আর কারও কোনওদিন কথা হয়নি। গুছাইত বাড়ির মেজদা ভক্ত, আর তার বউ ঝিলিকের কথা সে যে ভুলে যাবে তাই স্বাভাবিক। কিন্তু জীবনে একদিন তাদের আশ্রয়ে ছিল, সেখান থেকে এক সার্কাসের দলে। সেই যে খুলনা শহরে রূপসা নদীর কূলের কিছুদিন, সেই সময়ে সেই যে ঝিলিকের সঙ্গে তার দিনমান, ঝিলিকই বলতে গেলে তাকে শিখিয়েছে শরীর কাকে বলে–এসব ঘুরে ফিরে কখনও কখনও মনে পড়ত সুকুমারের। আর ঝিলিকের আন্তরিকতা। মানুষটার মন বড়ো ভালো। সেই যে সুকুমার প্রায় বসে বসে ভাত গিলত, এই নিয়ে কোনওদিন কোনও কথা কয়নি। হয়তো ভক্ত, ভিতরে ভিতরে কিছু বলে থাকতে পারে, ঝিলিক কিছু বলেনি। শুধু খুলনা ছেড়ে ফরিদপুরের দিকে দলের সঙ্গে যাওয়ার আগে ঝিলিককে

একখানা শাড়ি আর ভক্তকে একখানা লুঙ্গি কিনে দিয়েছিল। তারপর আর দেখা নেই।

সেই ঝিলিক পরশু এসে হাজির। কোত্থেকে কীভাবে, কার কাছে শুনে, কত দরজায় ঘুরে কে জানে। যেন সেকথা এইমাত্র আবার জরিনা মনে করিয়ে দিল, দেহ, সেই মানুষ তোমারে খুঁজদি খুঁজদি কোথাদে আইসে হাজির, সুকুমার ভাই!

সুকুমার শুধু  করল। যেন একথা জরিনাকেও জানানো যায়, এহেন তো গেল নিজের বাড়ির দিক, ভাইগো পালি হয়।

পাইয়ে যাবে। সব উপরঅলার ইচ্ছা। তোমারে যহোন পাইচে, সে জায়গায়ও পাইয়ে যাবে মনে কয়।

পালিই তো হবে না জরিনাদি, ভাইরা ঘরে উঠতি দিলি হয়। এট্টা মানুষ বসাইয়ে বসাইয়ে টানা। আর যে মাইয়ে একদিন বাড়িদে বাইরোইয়ে গেইচে।

হয়। তাও খারাপ কও নি।

সুকুমার কেন এই আশঙ্কা করে, সে জানে না। তার মনে হয়েছে তাই বলেছে। কিন্তু এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

একটু দক্ষিণে, প্রায় নাগের বাজারের কাছে নদীতে মোড়েলগঞ্জের লঞ্চখানা দেখা যায়। সুকুমার উলটো মুখো, সে দেখেনি, জরিনা দেখেছে। অন্য লঞ্চগুলোর তুলনায় মোড়েলগঞ্জগামী লঞ্চখানা আয়তনে কিছুটা বড়ো। অথবা, এটাই লঞ্চ, বাকিগুলো ট্রলার। আর ঢাকায় যেখানা যায়, তা প্রায় জাহাজ। জরিনা কিছুটা উচ্ছাসের সঙ্গে বলে, ওই যে দক্ষিণে লঞ্চখান আসতিচে। সুকুমার ভাই একেবারে চিন্তেয় বাঁচে না, লঞ্চখান গেল তো গেল আর ফেরল না, ঠিকঠিক জায়গা মতন গেইচে কি না?

সুকুমার হাসে, কোতায় চিন্তা? দক্ষিণে এট্টা কিছু হলি এতক্ষণ টাউনে খবর হইয়ে যাত। আর মাইজে বউর কিছু হবে না। তার জীবনের উপরদে এত কিছু গেইচে, তাও যখন কিছু হইনি, এইতে আর কী হবে। আমি চিন্তে করিচি, সের বাড়িঘরে উটতি পারিচে কি না। সে সমস্ত ঠিক। আছে কি না–সেইয়ে।

অথচ, তাদের অথবা শুধু সুকুমারের সকল উদ্বেগ কাটিয়ে সেই লঞ্চ থেকেই নামল কি না ঝিলিক!

লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে রাস্তায় উঠেই, একটু দক্ষিণে এগোলে আজগরের ঝুপড়ি। ঝিলিক আর যাবে কোথায়? সে সেখানেই আসবে। সেখানেই জরিনাকে পাওয়া যাবে। জরিনাকে পাওয়া গেলে অবশ্যই আজগরের কাছে খোঁজ মিলবে সুকুমারের।

এখন জরিনার কাছেই বসে আছে সুকুমার। আজগর নেই। জরিনার মুখোনা উদ্বেগ-মাখানো। আর, ঝিলিককে দেখে জরিনা আর সুকুমার দুজনই অবাক।

জরিনা বিস্ময়ে জানতে চায়, এ কেডা?

ঝিলিক বলে, আমি, আর কেডা।

সুকুমার এই প্রায় সন্ধ্যার আধা অন্ধকারে ঝিলিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুই জানতে চায় না। পথক্লান্তি তার চোখজুড়ে। একদিনেই প্রায় বিধ্বস্ত। কোথায় যেন যে মানুষটা গেছে, সেই মানুষটা ফিরে আসেনি। চুল আলুথালু না, খোঁপা বাঁধা, মুখে ঘাম নেই; কিন্তু চোখে রাজ্যের উদ্বেগ। চোখ বসে গেছে যেন একটু, সেখানে দুনিয়াদারির সমস্ত দুঃখ ভর করে আছে! ওদিকে ঝিলিকও জরিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝে, কিছু একটা ঘটে গেছে। নয়তো এই সন্ধ্যায় এভাবে, এখানে। এমন অসহায়ভাবে জরিনাদি বসে আছে কেন?

জরিনা জানতে চাইল, চলে আসলা যে? সে মেলা কথা।

সুকুমার আর কিছু জানতে চাইল না। বুঝল এই মেলা কথার পিছনে কত কথা আছে। বরং, অন্য কথা বলল, সারাদিন পেটে কিছু পড়িছে তোমার?

হয়। গুড়মুড়ি আর গাঙের জল, এইসব তো দক্ষিণ দেশেও পাওয়া যায়!

সুকুমার মরে উদ্বেগে, আর তার ভিতরেও এমন ঠ্যাস মারা কথা। এর দিকে অবাক হয়ে তাকানো ছাড়া আর কী করার আছে? কোনও ভাবনা আছে? হাতে পয়সাপাতি নেই। আসল এই, এখন তো থাকতে হবে আলতাফের হোটেলের দোতলায়। সেখানে কোনার দিকে তক্তাঘেরা রুমে, আর নয় সে চলে যেত দড়াটানা ঘাটের দিকে। অথবা, আলতাফের হোটেলের দোতলায় ঢালাই চাচের উপর শুয়ে শুয়ে গরমের রাত্তির কাবার।

ঝিলিকের যেন সেসব কোনও চিন্তা নেই। তার দিকে সুকুমার তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ঝিলিক জরিনার কাছে জানতে চাইল, আজগর ভাইরে দেকতিচি না। শরীর ভালো হইছে?

নারে। জ্বর আরও বাড়িচে। কতবার জলপট্টি পালটাইয়ে দিচি। ওই মোসলেম কাকা এক ফার্মেসির দে ওষুধ কিনে দিয়ে গেইচে, তাও কুমিনি।

ও ভগবান, এইরাম জ্বর! ডাক্তারের ধারে নেওনি? ডাক্তারের বিষয়টা ঝিলিক সুকুমারের দিকে জানতে চাইল?

হাতে মন্টু থাহা লাগে মন্টু! সুকুমার ডান হাতের আঙুলে টাকা গোনার ভঙ্গি করল, আমাগো কেউর ধারে পয়সা কড়ি নেই। আইজকেও ট্রেন আন্দোলনে কোর্টে মানুষ আইচে, পাবলিক আসিনি—

০৭. দিন চারেক আগের আশঙ্কা

মোসলেম উদ্দিনের দিন চারেক আগের আশঙ্কা আজ সকালে ফলে।

খুব সকালে দক্ষিণ থেকে ধীরে ধীরে বাতাস আসে। তখনও বোঝা যায়নি এই বাতাস মাত্র ঘণ্টা তিনেকের ভিতরে এমন রূপ ধারণ করবে। ধীরে আসা সেই বাতাসে নারকেল গাছের পাতা কাপে। নারকেলই সবচেয়ে উঁচু গাছ। তাছাড়া মেঘনিশ বা শিরীষ গাছের একেবারে উপরের দিকে জোরে হাওয়া লাগছে, যদিও গাছ কতটা কাঁপছে তা এমনিতে ঠিকঠাক বোঝা যায় না, শুধু নারকেল গাছ দেখেই ভালো বোঝা যায়। পাতায় পাতায় দোল, ঝুলে-পড়া পাতার ঘষা লাগে গাছের শরীরে সেই ঘর্ষণে শিরশির শব্দ হয়! বাতাস ধীরে ধীরে বাড়ে, ওই শব্দও বাড়ে। উপরের দিকে পাতা পরস্পরের গায়ে বাড়ি খায়।

সকালে তার মুনিগঞ্জের টিনের চালের বাসায় খুবই পাতলা যেন এক দুই ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ টের পেয়েছে মোসলেম। তখনও ভাবেনি, রোদ একেবারেই উঠবে না। তা রোদ না উঠুক, এই বৃষ্টি যে বাড়বে তার এমন কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু মনে মনে তার সেই আশঙ্কা তবু ছিল। হয়তো হাওয়া বাড়তেও পারে। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ভিতরে বাতাস বাড়ল, যদিও তখন আর বৃষ্টি নেই। মোসলেম উদ্দিন আলেকজানকে বলেছিল, আইজ মনে হয় আর কোনও উপায় নেই। এই জ্যৈষ্ঠের শেষ দিক এইভাবে দাবাড় আসতিচে!

আলেকজান বলেছে, দাবাড় কোতায় দেকতিচো, বৃষ্টি আসপো, বৃষ্টি আসার সময় হইয়ে গেইচে। দাবাড় যা আইল সেয়া বৈশাখ মাসে, এ মাসেও হইছে, কিন্তুক তাকাইয়ে বোঝে না, এই যে আসতিচে এহেবারে বৃষ্টি আইনে ছাড়বে।

মোসলেম জানে না, কী ভেবে কথাটা বলেছিল, কেন বলেছিল। ঝড়-বাদল বৃষ্টি দাবাড়ের হিসেব তার তো ভালোই জানা আছে। তবু তার কেন যেন মনে হয়েছিল, বৃষ্টি হয়তো এখনও আসার সময় হয়নি, আসবে দাবাড়! সে আলেকজানকে বলল, যাই কোর্টের দিকে। আইজকে বেলা বোঝা যাবে না। কিন্তু বেলা হইয়ে যাতিচে।

এই বলে মোসলেম উদ্দিন হাতঘড়ি পরতে পরতে তাতে দম দেয়। ঘড়িটার ডায়াল ছোটো ও পুরনো। ডায়ালের রঙ বেশ কালো হয়ে গেছে। এখনও ভালো সময় দেয়। কীভাবে একদিন তার হাতে এসেছিল এই ঘড়ি, তা এখনও সে মনে করতে পারে। ঘড়িটার দিকে চাইলে কখনও কখনও তার তা মনেও আসে। কিন্তু এখন আকাশের মুখ ভার, মোসলেম সেকথা মনে আসতে আসতে আর মনে এল না। অথবা, হতে পারে সেই কথার খানিকটা তার মনে এসেছিল, পর মুহূর্তেই ঘড়িটা হাতে পরতে পরতে সে সেখান থেকে সরে এল। তার মনে হয়েছিল, আলেকজানকে এখনও একটা কথা বলতে বাকি। সেকথাটা বলবে। তাই ঘরের দরজায় পা দিয়ে মোসলেম জানতে চাইল, পাউডারের মালপত্তর তো আছে? আপাতত আর মনে হয় আনা লাগবে না।

আলেকজান মোসলেম উদ্দিনের হাতে পান দিতে দরজায় দাঁড়িয়েছিল, কিছু বলল না। গাঢ় চোখে দেখল তাকে। দুই দিকে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, লাগবে না। তাছাড়া বহুদিনের অভিজ্ঞতায় আলেকজান জানে, এই আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মানুষের জামা-কাপড় ময়লা হয় বেশি কিন্তু পাউডার চলে কম। মনে হয় এই সময় মোসলেম উদ্দিন তার আসরও তেমনি মিলাতে পারে না। বর্ষাকালে মানুষজনও ফাও কাজে কোর্টের ধারে কাছে তেমন আসে না।

সাধারণত এ সময় মোসলেম উদ্দিনের মুখোনা শুকিয়ে যায়। এখন তা ততটা হল না। তবু কিছুটা শুকনো মুখে সে আলেকজানের দিকে চেয়ে হাসল। একই সঙ্গে বিষয়টা অন্যদিকেও নিয়ে যেতে চাইল, আজগর আছে না? বান্দর খেলা দেখায়, আজগরের ভোমা জ্বর। ছেমড়াডার যে কী হল, মজমা না মিলতি পারলি ওরে এট্টু দেইহে আসপো।

ওর তো শুনি কয়দিন বাদে বাদে শরীর খারাপ হয়।

হয়। কোহানে থাহে, কোহানে খায়, কোথায় ঘুমোয়, কোহানে কী করে, তার কোনও ঠিক আছে। বান্দর নাচাতি নাচাতি নিজেও এট্টা বান্দর হইয়ে গেইচে।

মোসলেম ঘরের সামনে থেকে একটু এগিয়েছে। ফিরে সে আলেকজানকে একথা বলে, তারপর হাঁটতে শুরু করে। ছাতা নিয়ে বেরুতে পারলে হত। বোঁচকটা তার বাম বোগলে। সামনের রাস্তায় রিকশা পেলে হয়। ছাতার কথা ভাবল মোসলেম, কিন্তু জানে না ছাতাটা ব্যবহার উপযোগী আছে কি না। এবার একদিনও মাথায় দেয়নি। তাছাড়া একহাতে লাঠি আর অন্য হাতে ছাতা নিয়ে মোসলেমের হাঁটতে কষ্ট হয়। তাই প্রায়ই সময় তার ছাতার কথা মনে থাকে না।

মোসলেম কোর্ট পর্যন্ত আসতে আসতে বাতাস বাড়ে। মেইন রোড ধরে দক্ষিণে তাকালে রাস্তার দু-পাশে নারকেল ও মেঘনিশ গাছের পাতায় বাতাসের দাপট। একটা রিকশা পেয়ে মোসলেম রিকশাঅলাকে বলে লঞ্চঘাটে আসতে। রিকশা কোর্টের পাশ থেকে আসার সময় সে দেখে, চারপাশ অপেক্ষাকৃত ফাঁকা! বৃষ্টি না-ধরলে ফাঁকাই থাকবে।

লঞ্চঘাটের কাছে নেমে মোসলেম ভাবে, আলতাফকে জিজ্ঞাসা করবে আজগর এখন কোথায় থাকে। কিন্তু আলতাফকে হোটেলের সামনে দেখে না। হয়তো বাজারে গেছে। এসময় কোত্থেকে সুকুমার এসে উদয় হয়। সুকুমার মোসলেমকে দেখেই বুঝেছে, সে আজগরকে দেখতে এসেছে।

একটু এগিয়ে, তারপর নদীর পাড় ধরে আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আসতে কতটুকুই-বা সময়। এর ভিতরে সুকুমারের কাছে মোসলেম জানতে চেয়েছে আজগরের অবস্থা কী? কোনও ওষুধ-পথ্য কি পেটে পড়েছে ছোঁকরার? সুকুমার যদিও সবকিছু জানে না। কাল সারাটা বিকেল ও সন্ধ্যা তার কেটেছে ঝিলিকের চিন্তায়। তবে আজগরকে কোনও ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়নি, তা সে জানে। মনে হয় রাত এক প্রহরের পর সামনের কোনও এক ফার্মেসিঅলার কাছে থেকে কী-একটা বড়ি এনে খাইয়েছিল, তাতে নাকি ভোর রাত্রের দিকে জ্বর খানিকটা ছেড়েছে, কিন্তু হুঁশ সেভাবে আসেনি। জরিনা বলেছে, সারাটা রাত্তির নাকি বিড়বিড় করে কী সমস্ত বলেছে।

সুকুমারের কাছে এসব শুনে আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আসতে আসতে মোসলেমের মেজাজ খিচে যায়। জরিনা ছেমড়ির দেখি কোনও বোধ-ভাষ্য নেই। খালি আছে কথায় যোগ্যতা। এমনিতেই আজগরের শরীরের ওই দশা। মাসের ভিতরে কয়দিনই তো কাশতে কাশতে প্রায় কাৎ হয়ে থাকে। তারপর এই প্রায় দিন তিনেকের জ্বর। আজ বেলা তো এতক্ষণে কম হয়নি, আজগররে নিয়ে তো হাসপাতালের দিকে যেতে পারত। সদর হাসপাতাল না-হয় দূরে, সেই মুনিগঞ্জ, পুরানো হাসপাতালে গেলেও তো সরকারি ডাক্তার দুটো ওষুধ লিখে দিত। মোসলেম সুকুমারেরও মুখের দিকে চায়। সুকুমার তো একটা বুঝমান মানুষ, সে এতক্ষণে তাহলে করেছে কী?

আজগরকে দেখে মোসলেম বোঝে, সুকুমারের মুখে শুনে অবস্থা যা ভেবেছিল, আজগরের অবস্থা তার চেয়ে খারাপ। গায়ে শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। চোখ বসে প্রায় গর্ত হয়ে গেছে। গালের হা-এর পাশে কেমন যেন ফেনার দাগ। এখনি হাসপাতালে অথবা ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। এই দিকে কোনও ডাক্তার বসে না। যারা বসে সবই হোমিওপ্যাথি। এই সকালে এমবিবিএস ডাক্তাররা সবাই হাসপাতালে। একজন আছে রেল রোডে। সেই ডাক্তার এখনও চেম্বারে এসেছে কি না ঠিক নেই। তার চেয়ে পুরানো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ভালো। যদিও মোসলেম ইচ্ছে করেই জানতে চায়নি জরিনা কোনও ডাক্তারের কাছে যায়নি কেন? জরিনার মুখোনা দেখেই বুঝেছে, এদের কাছে পয়সাপাতি কিছু নেই। তবু, নীচু গলায় মোসলেম যখন বলেছে, জরিনা ছেমড়ি, আরও আগে আজগররে হাসপাতালে নেয়া লাগত, তয় আর এইরাম কাহিল হত না। তখন ঝিলিক একবার বলেছে, সেও তাই বলেছিল, কিন্তু জরিনার পাংশুটে মুখোনা দেখে মোসলেম যা বোঝার বুঝে যায়।

মোসলেমের তৎপরতায় সুকুমার একখানা ভ্যান ডেকে আনে। ভ্যানখানা আজগরের ঝুপড়ির সামনে পর্যন্ত আসতে আসতে দক্ষিণ থেকে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার বাতাস আসে। তাতে ভ্যানঅলার ভ্যানখানা আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আনতে কোনও সমস্যা হয় না। শুধু ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মোসলেম দেখে, এমন বাতাসে এই প্রায় দোমড়ানো ভেঙে পড়া ঘরখানার দক্ষিণের বেড়ার দিক থেকে কুলকুলিয়ে বাতাস ঢুকছে, সেই বাতাসে ওই দিকের পাতলা বেড়ার অনেকখানিক ফাঁকা হয়ে গেল।

সুকুমার পাঁজাকোলা করে আজগরকে নিয়ে ভ্যানে তুলল। মোসলেম উঠল ভ্যানের পিছনের দিকে, সুকুমার সামনে বসে আজগরকে শুইয়ে মাথাটা রাখল তার কোলে। মোসলেম বলল, জরি, ঘরদুয়ার এট্টু ঠিকঠাক কর, যা বাতাস আসতিছে! ভ্যান ছাড়তে ছাড়তে মোসলেম আর একবার আজগরের ঘরের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এই আজগর বান্দরঅলার ঘরদুয়ার। এই কইরে আজগর এট্টা জীবন কাটাইয়ে দেল।

জরিনা মোসলেমের কাছে জানতে চেয়েছিল, সে যাবে না? মোসলেম বলেছে, তারা যাবে আর আসবে। কিন্তু সঙ্গে মোসলেম যে তাকে এই ঘরদোর গোছাতে বলেছে, এতে যেন তার আপত্তি। জরিনা কখনও আজগরের ঘরকে নিজের ঘর ভাবেনি। কেন ভাবেনি তার কোনও ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। মোসলেম বলে যাওয়ার পরও তার ইচ্ছে করল না। যদিও ঝিলিক তাকে বলেছে, ও জরিনাদি, চলো, এপাশ ওপাশ এট্টু ঠিক করি। আইজকে বাতাস ঢালবে। পুরোন হাসপাতার যদি ধারে হয়, তালি ডাক্তার দেখাইয়ে আনতি আর কোতোক্ষণ?

জরিনা কোনও কথা বলে না। সকাল থেকেই মন ভালো নেই। আজগরের শরীরে অবস্থা খারাপ এই জন্যে শুধু না, তার হাত একটা পয়সাও নেই। কাল মোসলেম ওষুধ কিনে দিয়ে গেছে। সুকুমার সন্ধ্যার পর রুটি কিনে এনেছে এই দিয়ে চলেছে। সকালবেলা আজগর কিছুই খায়নি, কিন্তু তাদের তিনজনের খাবার এনেছে সুকুমার। তখন দেখেছে ঝিলিক শাড়ির খোট থেকে টাকা দিয়েছে। জরিনা তো জানে, এখানে সবে এসে সুকুমার, তারপর পরশু আজগরের ওপর রাগ করে মজমা মিলায়নি, কাল কোর্টের এলাকায় মানুষজন বলতে গেলে ছিলই না। ইব্রাহিম শেখের মতন মানুষ সেও অল্প সময়ে আসর গুটিয়েছে। ট্রেনের ব্যাপারটা না মিটলে উকিলদের অনেকেই কোর্টে আসবে না। সরকারের সঙ্গে টক্কর!

এসব জরিনার শোনা কথা। তারপর ঝিলিক গেল বাপের বাড়ির দেশে। সেখানে পাঠানোর লঞ্চভাড়া নিশ্চয়ই সুকুমার দিয়েছে। সুকুমারের কাছে আর কিছুই হয়তো নেই। এখন হাসপাতালের ডাক্তার যদি ওষুধ লেখে, জরিনা জানে না, কী হবে!

এদিকে ঝিলিক আজগরের ঝুপড়ির ভিতরে ঢুকে এটা সেটা গোছাতে শুরু করেছে। কিন্তু গোছানোরই-বা এমন কী আছে। ঘর বলতে যা, এই ঘরকে তা বলা যায় না। প্রায় ভেঙেপড়া তক্তপোশ বা খাটও নেই। দক্ষিণের বেড়ার ওই অবস্থা। ঝড়-বাদলে বানর দুটোকেও এর ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়। এখন ওই অবলা প্রাণী দুটো আগাম ঝড় আর বৃষ্টির আশঙ্কায় ঝুপড়ির বেড়ার পাশে গুটিসুটি মেরে আছে। ঝিলিক শুনেছে এইসব বনের প্রাণী আগেই বুঝতে পারে ঝড়-বাদল।

ঝিলিক হঠাৎ দেখে ঝুপড়ির সামনে জরিনা নেই। আজব মানুষ। সুকুমার তাকে বলেছে, চোদ্দ ঘাটে জল খাওয়া পদ। কোথাও দাঁড়ায় নাকি। এখন কী মনে করে আজগরের সাথে আছে তা ভগবান জানে। যদিও ঝিলিকের তা মনে হয়নি। সে বলেছিল, তা না, মানুষটা ভালো আছে। সুকুমারের যা স্বভাব, তাই বলেছিল, মাইজে বউ, আমি কি কইচি খারাপ! কইছি মানুষটার ধরন ওইরাম, ঘরের চালের তলে মাথা দেয়া পদ না।

তখন ঝিলিক তো চাইলে সুকুমারকেও দুই কথা শোনাতে পারত। শুনিয়েছিল। কিন্তু আগায়নি। যখন সুকুমারের ওই কথার উত্তরে বলেছিল, নিজে তো গিরস্ত বাড়ির ছওয়াল, দেলা তুমি কোনওদিন চালের তলে মাথা? এর উত্তরে সুকুমার বলেছিল, আমি বেটা মানুষ। মাথা দেয়ায় কী আর না দেয়ায় কী? এর অবশ্য উত্তর যা হয় তা আর বলেনি ঝিলিক। শুধু বলেছিল, মানুষের ভাইগ্য। বোঝলা, মানুষের ভাইগ্য। ভাইগ্য মানুষরে কোথায় নিয়ে যায়। আইজ আমি এইহেনে

এরপরও ঝিলিকের কথা ছিল। বলেনি কিছুই। বলতে পারত। সুকুমারও এই কথায় কেমন উদাস হয়ে উলটো দিকে তাকিয়ে ছিল। সুকুমারের ওই ভঙ্গিটা বড়ো ভালো লাগে ঝিলিকের উদাসী হয়ে কেমন যেন কোন দিকে তাকিয়ে থাকে। এত দূরে তাকায় মানুষটা, বড়ো গোল চোখ জোড়া তখন একটু যেন কুঁচকে থাকে। তার ভিতরে বহু বহু দূরে কী দেখে। আর আশেপাশে কোথায় আছে, কার কাছে আছে, কী দেখছে–কোনও দিকেই খেয়াল থাকে না তার। সেই রূপসার কুলে এমন একদিন দেখেছিল, পরশু আবার দেখেছে। কিন্তু রূপসার কূলে সুকুমারের চোখে মুখে কোথাও বিষাদ ছিল না, দুঃখ ছিল না, কিন্তু পরশু ঝিলিক দেখেছে সুকুমারের চোখের ভিতরে কোথায় যেন দুঃখ!

যাক, ঝিলিক এখন জরিনার আচরণ বুঝল না। ভাই তুই এই মানুষটার সাথে দিনেমানে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা থাকিস্, খাই ঘুমোস্ একসাথে, আর এই মানুষটার ঘরখান একটু ঝাড়পোচ দিয়ে রাখবি না? যেই সে কথা বলল ঝিলিক, অমনি কোথায় গেল!

ঝুপড়ির ভিতর থেকে কতগুলো কাগজের ঠোঙা, চানাচুরের প্যাকেট কলার পুরনো খোসা এইসমস্ত বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে ঝিলিক বিড়বিড় করে। তারপর মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে, জরিনা দরজার কাছে দাঁড়ানো। হাতে বড়োসড়ো একটা ছালার চট। ঝিলিককে বলে, ওদি, এইখেন ওই দিক দিয়ে দেও। যে বাতাস চালাতিচে। ফুটো বেড়ায় এইখেন থাকলি তবু কিছু বাতাস মানাবে।

পালা কোথায়?

ওই আলতাফের হোটেলের ভিতরদে নিয়ে আইচি। মনে হয় কোনও ব্যাপারি থুইয়ে গেইচে।

এমনি দেল?

হয়, আলতাফ দেবে এমনি? চাইর কথা শুনোল, ফাও কথা কল। চেঁচাইয়ে উঠিচে।

সেইয়ে। এমনি দেয়ার মানুষ আছে?

এই জন্যি কম দিন কথা শোনানো নানে। শুনোক। আমি কইচি, মানুষটার ওই দশা। বাদলের ছিট আসে, যাগো তা থুইয়ে গেইচে, তাগে কইয়ে একখান চোরে নিয়ে গেইচে।

এর কিছুক্ষণের ভিতর সুকুমার আজগরকে নিয়ে ফেরে। এখন আজগরের অবস্থা যেন কিছুটা ভালো। রিকশায় বসে এসেছে। মোসলেম উদ্দিন আসেনি। সুকুমার রিকশা থেকে নেমে আজগরকে ধরে নামায়। ঝিলিক আর জরিনাকে বলে তাকে শুইয়ে দিতে। জ্বর নাকি আজই কমে আসবে। তবে কয়েকদিন গায়ে বেশ ব্যাথা থাকবে। ডাক্তার একটা ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে। কয়েকটা ওষুধও লিখেছে। ওষুধগুলো একটু বাদে নিয়ে আসবে সে।

জরিনা আর ঝিলিক আজগরকে ভিতরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। তবে আজগরকে দেখে বানর দুটো পথের পাশ থেকে দড়ি টানটান করে দরজার কাছে এসেছিল। তাদের মালিকের নিশ্চিত কিছু হয়েছে। চোখ বড়ো করে বানর দুটো আজগর ঝুপড়িতে ঢোকার আগ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্য দেখে সুকুমারের মনে হয়, এই অবুঝ প্রাণীরা জানে না, তাদের মালিক কালকে না-থাকলে, তখন তাদের দেখার কেউ থাকবে না এই ধরাধামে, তখন কোথায় গিয়ে পড়বে কে জানে।

কিন্তু ওষুধ যে নিয়ে আসবে সুকুমার, এই কথা জানিয়ে সে চলে এল, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে জরিনা আর ঝিলিকের শুকনো মুখ, যদিও ওই কথা বলার সময় তার জানা ছিল না, এখনও জানে না ওষুধের টাকা কোথায় পাবে। ওষুধের দাম কত? কত দামের ওষুধ লিখেছে ডাক্তার। লঞ্চঘাটের গলি ধরে মেইন রোডের দিকে আসতে আসতে সুকুমার ভাবে, আলতাফের কাছে টাকা চাবে। আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয়, কাল রাত্রে সে ঝিলিককে নিয়ে দোতলায় শুয়েছিল, সেই পয়সা এখনও দেয়নি, তার ওপর এখন আবার টাকা চাইলে আলতাফ নাও দিতে পারে।

ধীর পায়ে এইসব ভেবে সুকুমার আলতাফের হোটেল পর্যন্ত আসে। তখনই তার মনে হয়, এর আগে একটা ফার্মেসিতে ঢুকে জেনে নিলেই পারে ওষুধগুলোর দাম কত। আজ আর কাল এই দুই দিনের ওষুধ নিলে কেমন দাম পড়বে। সুকুমার তাই করে। রাস্তা উলটো দিকে দি জনতা ফার্মেসিতে ঢুকে জানতে চায় ওষুধের দাম। সুকুমার ভেবে রেখেছিল, আজগরকে দেখে ডাক্তার বুঝেছে গরিব মানুষ, তাই সস্তা ওষুধ লেখার কথা। ডাক্তার লিখেছেও তাই। ফার্মেসির লোকটা আজ আর কালকের ওষুধ নিলে দাম কত লাগবে তা জানায়।

এবার সুকুমার চলে আসে। রাস্তা পার হয়। আলতাফের কাছে টাকা চায়। আলতাফ হোটেল ভাড়ার টাকা নিয়ে কিছুই বলে না। শুধু জানতে চায়, কাল রাতে তাদের কোনও অসুবিধা হয়েছিল কি না। একথা জানতে চাওয়ার অর্থ আজও কি তারা থাকবে। এর অবশ্য কারণ আছে। এই হোটেলের দোতলা প্রায় ফাঁকাই থাকে। এক পাশে খোপের মতো কয়েকটা রুম। সেখানে প্রায়শ কেউ থাকে না। একমাত্র রাতের লঞ্চ ফেল-করা যাত্রীদের কেউ কেউ কখনও রাত কাটায়। তাও তারাই, যাদের প্রকৃত আবাসিক হোটেলে থাকার টাকা নেই। আলতাফ তাদের জানায়, রাতে তার হোটেলে ভাত খাওয়া বাবদ তারা থাকছে। ফলে, দরও তেমন বেশি নেয় না। কেউ কেউ তারপরও দরদাম করে। আলতাফ তখন যাত্রীর মান অনুযায়ী খেকায়। সেখানে সুকুমার খেলাঅলা বউ নিয়ে যদি তার এখানে থাকে তো থাকতে পারে। ঝিলিক যে সুকুমারের বউ এটা অবশ্য আলতাফের নিজের হিসেব। হতে পারে জরিনা তাকে তাই বলেছে। কিন্তু শাঁখা-সিন্দুর হাতে নেই কেন, এই কথা জানতে চায়নি। যদিও জরিনা একদিন কথায় কথায় ঝিলিককে বলেছিল, দেওর হোক আর যাই হোক, শাখা তো হাতে দিতি পারো, তালি মানষি আর কোনও কিছু নিয়ে সন্দেহ করত না।

সন্দেহ করা নিয়ে আলতাফ অবশ্য কিছু বলেনি। সুকুমার আর ঝিলিক যদি তার বাধা কাস্টমার হয় হোক। এমনিতে আলতাফ জরিনার সঙ্গে যত রঙ্গ করে কথা বলুক, ঝিলিক যখন তার কাস্টমার তখন তার সঙ্গে একটু হলেও দূরত্ব সে রক্ষা করে।

এখন সুকুমার আলতাফের কাছে টাকা চাওয়াটা তার জন্যে একটা সুযোগ। সে বরং উলটো ঠেলা দিল, পাঁচ টাকা লাগবে?

সুকুমার বলে, হু–

সুকুমারের জন্যে এটা সংকোচ। আকাশের এই অবস্থা। পুরো কোর্ট চত্বরে মানুষজন কী আসবে তার ভরসা নেই। সেখানে পাতার টিপ। মানুষজন নেই, চত্বরে পাতা, বৃষ্টিতে ভিজে, এর ভিতরে সুকুমার খেলা দেখাতে পারবে না। ফলে, পাঁচ টাকাই তার জন্যে এখন অনেক। এই টাকা কীভাবে শোধ দেবে সে জানে না। আজগর কয়দিনে খাড়া হবে তার ঠিক নেই। একমাত্র ইব্রাহিম শেখ এই চত্বরে পারবে মজমা মিলাতে। দিলদারেরও একটা সুযোগ আজকে বাতের যন্ত্র নিয়ে বসার। বারিক বুড়োর তার বইয়ের দোকান খুলবে কি না কে জানে।

আলতাফ বলে, আরও লাগলি নেও।

হয়, আরও লাগলি নিই। তারপর শোধ দেয়া লাগবে না?

দিয়ানে। একদিন ঠিকঠাক খেলা দেহাতি পারলি তোমার কত আয়। আমাগো মতন নাকি, এই জায়গায় দাঁড়াইয়ে চেঁচাও, আসেন লঞ্চ ছাড়ার দেরি আছে, ভাত খাইয়ে যান, বাইলে-টেংরা, রুই-কাতল, ভেটকি-পাঙ্গাশ, খাশি আর মুরগি। এইয়ে কইয়ে দিন পার করো। কোনওদিন খদ্দের জোটে, কোনওদিন জোটে না।

আলতাফ এক নিশ্বাসে বলে। সুকুমার চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। আলতাফ বলে চলছে তার কথা। এই কয়দিনে তার বোঝা হয়ে গেছে, ভাতের হোটেলের ক্যাশ কাউন্টারে বসতে বসতে লোকটা এক ভাঙা রেকর্ডই বাজায়। মানুষের চোখ মুখের পরিস্থিতি খেয়াল করে না। হয়তো মানুষের পেটের খিদে নিয়ে কারবার। জানে খিদে যদি লাগে মানুষ খেতে বসবেই। আর একবার পাতে ভাত দিয়ে কয়টা খাওয়াতে পারলেই হল, তারপর তুমি যাবা কোথায়, এটা খাও ওটা খাও, সেই সাধাসাধির ধরনও জানা আছে সুকুমারের। শুধু এখানে কেন, এমন ভাতের হোটেলে জীবনে তো কম খায়নি, কত লঞ্চঘাটে কত রেল স্টেশনে ফেরি ঘাটে ফেরির উপরে মাঝি ঘাটে এমনতর ভাতের হোটেল মাপতে মাপতে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।

আলতাফ কী বুঝল কে জানে। গলার স্বরের ধরন হঠাৎ বদলে গেলে তার। নীচু স্বরে সে সুকুমারের কাছে জানতে চাইল, কী ও দা, মন খারাপ? কোনও সমস্যা?

উহুঁ–

তালি কথা কতিচো না যে?

কী কব?

কলাম টাকা আরও লাগলি নাও—

না, টাকা নিলিই হল, সেয়া শোধ দিতি হবে না?

লাগবে কী জানি?

এতক্ষণে এত কথার তোড়ে আলতাফের সুকুমারের হাতে ধরা ছোট্টো কাগজখানায় চোখ পড়েছে। এটা যে প্রেসক্রিপশন তা আলতাফের না-বোঝার কোনও কারণ নেই। আর আজগরকে ভ্যানে নিয়ে যাওয়া আবার হাসপাতাল থেকে রিকশায় করে আনা দুবারই আলতাফ দেখেছে। তাই হয়তো, লাগবে কী জন্যি? বলেই সঙ্গে আরও জানতে চাইল, আচ্ছা, আজগরের কথা কী কল ডাক্তার?

আছে, ভালো হইয়ে যাবে। খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম, লাগাইতে ঠান্ডা, নদীর কূলে রাতে বইসে থাহে, জরিনাও একজন। ডাক্তার কল জ্বর সাইরে যাবে, তয় গায় বল পাবে নানে কয়দিন, এট্টু ভালো মন্দ খাতি হবে।

আর খাইচে। রাত্তির হলি ওই বান্দর নাচানো টাহা নিয়ে যায় কামারপট্টির পিছনে সাইজে মেয়ার দোকানে! কোনওদিন গলা পর্যন্ত টাইনে আসে, কোনওদিন নিয়ে আসে সালসার বোতলে ভইরে।

হয় শুনিচি, জরিনা কইছে।

ও এট্টা আপদ। সাথে জুটিছে ওই জরিনা, করবে না বালডাও। কতদিন কইচি হোটেলে থাল ধুইয়ে দিয়ে যা। তাতে ওনার প্রেস্ট্রিজ যায়। এইরাম নটী মাগি আমি জীবনে দেহিনি

সুকুমারের অবশ্য এ কথায় সায় দেয়া হল না। আবার আলতাফের এমন কথায় উলটো কিছুও বলতে পারছে না। এখনও আলতাফের কাছ থেকে টাকা নেয়নি। এসব কথা বললে কথা আরও বাড়বে। খেলাঅলা সুকুমার, জানে কখন কোন সময়ে স্থির থাকতে হয়। সে বলে, টাকা দেন, দশ টাকাই। আজগর ভাইরে ওষুধ কয়ডা কিনে দিয়ে আসি। তারপর আইসে শোনবানি বাকি কথা।

আলতাফ বলে চলেছে, তারপর আছে বানর দুটো।

তা তো আছে।

আলতাফের কাছে থেকে টাকা নিয়ে আবার জনতা ফার্মেসির দিকে যেতে যেতে সুকুমার ভাবল, আলতাফের সাথে এই কথায় অন্তত একটা কাজ হল, লোকটার সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা হলেও বাড়ল। এখন আর ঝিলিককে সহসা উলটো পালটা কিছু বলতে পারবে না।

সুকুমার ওষুধ নিয়ে আজগরের ঝুপড়ির সামনে আসতে দেখে, ঝিলিক দাঁড়িয়ে। সুকুমারকে দেখেই সে বলল, এতক্ষণে আসলা? গেছেলা কোথায়?

ওষুধ আনতি।

ওষুধ আনতে?

হয়, আজগর ভাইর জন্যি ওষুধ আনতি।

ওষুধ আনলা, তুমি পয়সা পালা কোতায়?

আলতাফের কাছে দে ধার করিচি—

ঝিলিক চোখ বড়ো করে সুকুমারের দিকে তাকিয়ে থাকে। গলা নামায়, তুমি পারোও।

এর মদ্যি পারাপারির কী আছে?

ঝিলিকের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে জরিনা। সেই সোজা ঝুপড়ির ভিতরে আজগরের মাথা দেখা যাচ্ছে। শরীরেরও খানিকটা। ফলে, এখন ঝিলিকের কথার অর্থটা সুকুমার যদি বুঝেও থাকে তার কোনও প্রকাশ তার চোখে নেই। সে জানে, ঝিলিক কী বলেছে। এই আজগরের সঙ্গে সেদিন মজমা মিলনো নিয়ে তার এক চোট হল। তারপর হাতে তার পয়সাপাতি নেই একেবারে। কাল ঝিলিক মোড়েলগঞ্জ থেকে ফিরল। সেখানে কোনও কিছুরই ফয়সালা হয়নি। ঝিলিককে আবারও যেতে হবে।

পিছনে জরিনা দাঁড়িয়ে থাকায় সুকুমার ঝিলিককে চোখ টেপে। ঝিলিকের কথার লজটা জরিনা কিছুটা হলেও তো বুঝেছে। কিন্তু সে সব প্রায় মুহূর্তে ভেঙে দিয়ে সুকুমার জরিনার দিকে এগোল, এই যে জরিনাদি, ওষুধ।

জরিনাও এমন ভঙ্গি করল যেন একথার কিছুই শোনেনি, সুকুমার ভাই, ওষুধ আনিছো। আমি ভাবলাম তোমার ধারে জিগোই ডাক্তার কী কইচে? এর মদ্যি দেখি তুই নেই।

কবে আর কী? জ্বর এমনি বাধিছে। তয় ডাক্তার কইচে শরীরে কিছু নেই। শরীরের দিকে এট্টু খেয়াল দিতি হবে। ভালো মন্দ খাতি কইছে।

কারে কী কও? ওই আজগর দেবে শরীরের দিকে খেয়াল, তালি তো হইল।

তবু। এইয়ে করলি কিন্তু বেশিদিন টেকপে নানে

জানি। ওর আর টেকা না টেকা। জরিনা ঝুপড়ির ভিতরে শুয়ে থাকা আজগরের দিকে তাকাল। সে এখনও বেখোরে ঘুমাচ্ছে। তারপরই কথা অন্যদিকে নিল, ওষুধ আনার টাহা পালা কোতায়?

পাইচি। ওই নিয়ে এহোন ভাবদি হবে না।

কও আমারে।

আলতাফের ধারদে আনিচি।

শুনে জরিনার মুখে কোনও পরিবর্তন যে হবে না, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভিতরে একটা বিষয় খেলে গেল, এবার তাহলে আলতাফ একটা সুযোগ পাবে, এই টাকা নিয়ে জরিনাকে দুই কথা শোনানোর। কিন্তু যতই ভাতের হোটেলের ভাগের মালিক হোক আলতাফ, জরিনা তাকে পছন্দ করে না। ভিতরে কোনও অজ্ঞাত কারণ আছে হয়তো, সে কারণ কোনওভাবেই জরিনা প্রকাশ করবে না, অন্তত সুকুমারের সামনে তো না-ই।

জরিনা জানতে চাইল, কবে শোধ দিতি হবে কিছু কইচে নিকি।

তুমি এত ভাবদিচো কী জন্যি, টাকা তো আনিছি আমি, শোধ দেয়া না দেয়ার মনস্থ আমার। আর ওষুধ আনিচি আইজকে আর কাইলকের, পরশু দিনের ওষুধ কাইল রাত্তিরে কেনবানে।

জরিনা সুকুমারের কাছে উলটো অন্য আর এক আলতাফের পরিচয় দিল, ও যে কীরাম মানুষ তা কয়দিন মিশলি বুঝতি পারবা। দাড়ি মোচ কামানো সুন্দর মানুষ দেখলি হবে কী? গুর মদ্যি টাহা দেখলিও সেইডে তুইলে আনতি পারে।

ঝিলিক পাশ থেকে থেকে বলল, এহোন এইয়ে বাদ দেও। কেননা, একথা এখন ঝিলিকের শুনে কোনও লাভ নেই। রাতে তাদের মাথা গোঁজার আশ্রয় আলতাফ।

হয়। দেলাম বাদ। তোমরা এহোনও ওই আলতাফের ধারে থাহো। দুইজনের এট্টা কিছু না হলি, তার আগে এইসমস্ত কথা কইয়ে কোনও ফ্যাকরা বাদানোর দরকার কী? নদীর কূলের কথা, এট্টু বাদে দেখা গেল আলতাফের কানে চইলে গেল।

সুকুমার বলল, আমি এট্টু বাজারের দিক যাই।

ঝিলিক বলল, কী জন্যি?

এট্টু সাগুদানা কিনে নিয়ে আসি। আজগর উঠলি জরিনাদি খাওয়াইয়ে দেবেনে।

জরিনা বলল, আকাশের যে অবস্থা! দাবাড় কিন্তু চালাল বুইলে।

তার আগে চইলে আসপ।

ঝিলিক জানতে চায়, আইজকে কোর্টের দিকে যাবানা?

আইসে নি। আকাশের গতি ভালো থাকলি যাবানে। আর নয় দুপুরের পরে যাব রেল লাইনের ধারে।

সুকুমার বাজারের দিকে যাওয়ার কথা বলে যায়। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে। হাতে চারটে কলা। ঝিলিক ভেবেছিল, হঠাৎ কলা নিয়ে ফিরল কেন? তার আর জরিনার জন্যে এনেছে নাকি? তারপর মুহূর্তেই মনে হল, এগুলো বানর দুটোর জন্যে। কলাগুলো একটু দাগি আর বেশি পেকে যাওয়া। ঝিলিকের হাতে দিয়েই দ্রুত মেইন রোডের দিকে হাঁটে সুকুমার।

বাজারের কথা বললেই সুকুমার মেইন রোডে বা-দিকে না যেয়ে গেল ডান দিকে। কী মনে করে একটু কোর্ট চত্বরের দিকে যাওয়ার কথা ভাবে। হতে পারে, বানর দুটোর জন্যে কলা কিনতে কিনতে সুকুমারের মনে হয়েছে, এই বানরের খেলা দেখিয়ে পেট চালায় আজগর। আজ জ্বরে বিছানপড়তা, সেও হাতগুটিয়ে বসে আছে, খেলাঅলা সুকুমার কোর্ট চত্বরে খেলা দেখাতে পারছে না, আলতাফের কাছে ধার, মোসলেম তাদের সঙ্গে রিকশা উঠে কোর্টের কাছে এসে নেমেছে, তারপর থেকে টিপটিপ বৃষ্টির কমতি নেই, তবু এর ভিতরে একবার তো কোর্ট চত্বর দেখে আসা যেতে পারে। যদি কোর্ট চত্বরে খেলা দেখানোর উপায় না থাকে, তাহলে সে রেল স্টেশনের দিকে। যাবে। স্টেশন বিল্ডিংয়ের পিছনে কাটা লেকের পাড়ে অনেকখানিক জায়গা কংক্রিটের, বৃষ্টি না থাকলে সেখানে বিকালের দিকে খেলা দেখাতে পারবে সে। লোকজন কী হবে কে জানে। তবে যাই হোক, কুড়ি-পঁচিশ টাকাও যদি জোটে, তাহলেও কিছু তো হল। তাদের রাতের খাওয়া হবে। বেশি হলে আলতাফের ধার শোধ করা যাবে। হোটেল ভাড়া নয় সপ্তাহের শেষে দেবে।

এসব ভেবে, কোর্ট চত্বরে এসে দেখে, কোথায় কী? মোসলেম উদ্দিন নেই। বারিক বুড়ো বটতলায় পলিথিন টাঙিয়েছে, কিন্তু নীচে পলিথিন লেছে বই সাজায়নি। বই পাশে পলিথিনে বাঁধা। সেখানে উপরে বাঁশের স্থায়ী ঢাকনা। তার পাশে দিলদার তার বাত নিরাময় যন্ত্র নিয়ে বসে আছে। বৃষ্টি ঝেপে এলে এক দৌড়ে টাইপিস্টদের শেডে চলে যেতে পারবে।

বারিকের কাছাকাছি যায়নি, তার আগে যে ছোট্ট একটা ঘর, এখানে মহুরিরা হয়তো বসে,সুকুমার জানে না, ওই জায়গায় কান পরিষ্কার করা গোলাপ মিয়া দাঁড়িয়ে। সুকুমার একবার ভাবে গোলাপের কাছে যায়, আবার চারদিকে তাকায়। ঝড়ের আভাস, বৃষ্টি ফাঁকে ফাঁকে হচ্ছে, কিন্তু সেই জন্যে কোর্ট চত্বর এমন ফাঁকা!

বরং, গোলাপ এগিয়ে আসে তার কাছে, কী, ও দাদা, চাইয়ে চাইয়ে দেকতিচে কী?

এমন অবস্থা তো কত হয়। মাঝে মধ্যে কতদিন কত কারণে খেলা দেখানোর সুযোগ থাকে না, কিন্তু তখন তো টাকারও প্রয়োজন থাকে না, কিন্তু যখন হাতে চলার মতো পয়সা দরকার সেই সময়ে এই অবস্থা! এতে সুকুমারের মুখ খানিকটা অসহায়। যদিও রসিক গোলাপ মিয়ার কথার ধরন বদলায় না। কোর্টে মানুষ না আসলে সে কানের ময়লা কি খইল বের করবে এমন মানুষই-বা পাবে কোথায়। শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে ওই কাজের জন্যে মানুষ জোটানেনা কী কষ্টের তার জানা আছে। তাছাড়া, টাউনে মানুষ তারে ততটা পাত্তাই-বা দেয় কই? কেউ হয়তো বলে, কী গোলাপ, তোমারে দিয়ে কান চাওয়ালি কানের কিছু থাকপেনে? গোলাপ হয়তো বলে, দাদা, যে কী কন? এতদিন ধইরে এই কাজ করতিচি, কোনওদিন কোনও কমপিলেন পাইচেন? আসলে এসব গোলাপের সঙ্গে একপ্রকার রসিকতা। ওই যে গোলাপ কমপিলেন কথাটা বলল, ওটা শোনার জন্যে বলা। আবার কেউ হয়তো এরপরে তাকে প্রায় ধূলিসাই করে দেয়। বলে, সেদিন কোর্টে কাজে আমাগো গ্রামদে একজন মানুষ আইল। সে কল, কোর্টের কানের খইল বাইর করা মানুষ নাকি তার কানের পর্দা ছিঁড়ে আইনে দেখাইচে। তুই আইজকাল এইয়ে এইয়ে করতিচিস? গোলাপের বিব্রত হওয়ার দশা। সে তো জানে, শহরের এই মানুষগুলোর সাথে কোনওভাবে পারা যাবে না। কথায় তারা ঠকাবেই। আসলে তার পেটে লাথি মারছে। কিন্তু গোলাপের বলারই-বা কী আছে। এদের কত ক্ষমতা। এসব কথা বলে তার কাজকে উপহাস করে। সে জানে, তারপরও তাদের কেউ কেউ তারে ভালোবাসে। চাইলে দুটো একটা টাকাও দেয় প্রয়োজনে। অথবা বলে, মুখ দেইখে মনে হতিচে আইজকে তোর রোজগারপাতি নেই এহেবারে, তা এট্টা পান খাবি নাই (নাকি)? না চা খাবি?” তখন গোলাপ যদি বলে, চাহা খাতি পারি। তারা যে তার চা-কে চাহা বলা শোনার জন্যে কথাটা বলেছে, তাও সে বুঝতে পারে। সেই গোলাপ সুকুমারকে এই বললে, সুকুমার আর গোলাপ মিয়াকে কতটুকু চেনে? ওদিকে তারা দুজনই এই চত্বরের সওদাগর। যার যার ব্যবসাপাতি নিয়ে এখানে এসেছে। তাদের চোখেমুখের বিহ্বল ভাষা আজকে তো প্রায় একই। তা গোলাপ যা-ই জানতে চাক, এখানে এখন সুকুমার চেয়ে চেয়ে আর দেখবেটা কী? গোলাপ যা দেখে, সুকুমারও তো তাই দেখে। কিন্তু গোলাপের কথাটা দারুণ সুরেলা। শুনে, সুকুমার না হেসে পারল না। এতে যেন উভয়ের ফ্যাকাশে মুখোনা একটুক্ষণের জন্যেও উজ্জ্বল হল। যদিও সুকুমার যেই বলল, ও ভাই, দেকপো আর কী? তুমি যা দেকতিচো, আমিও সেইয়ে দেকতিচি। ধরা খাইয়ে বইসে রইচি।

হয়। দাবাড় চালাল বইলে। তালি আরও ধরা খাওয়া।

দাবাড় তো সকালে একবার চালাইল, সেই জন্যে এহোন একদম মানুষজন থাকপে না?

সুকুমারের কথা শেষ করতে দিল না গোলাপ, উকিলরা মনে হয়, কোর্টেই ওটপে নানে, টেরেন নিয়ে তাগো নামে কেস কাণ্ড হইচে–

সেই জন্যি মানুষজন এহেবারে আসপে না? আমি নয় খেলা দেহাতি পারব না বিষ্টি দাবাড় স্যাক না দিলি, কিন্তু মানুষ আসলি তো তোমার তবু দুই পয়সা হত

গোলাপ শুকনো হাসি হাসল। টাউনো মানুষ দিয়ে আমার কোনও লাভ নেই। কেসের জন্যি যদি গেরাম দিয়ে মানুষ আসে তালি দুই চাইর পয়সা হতি পারে।

আইজকে লঞ্চই আসে না আসে। বলেই সুকুমারের মনে হয়, ঝিলিক কাল চলে এসে ভালোই করেছে, আজ দক্ষিণে না-জানি কী অবস্থা! ওই দিকের নদীতে আজ নিশ্চয়ই তুফান! তারপর সুকুমার গোলাপের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে একবার দক্ষিণের আকাশে তাকায়।

গোলাপ বলে, দেহহা কী? আইজকে কামাই নেই। আসতিচে। তারপর থেমে জানতে চায়, আচ্ছা, ওদা, আজগর ভাই অবস্থা কী? আছে কীরাম?

সহালে পুরনো হাসপাতালে লইয়ে গেইলাম। জ্বর কয়দিন থাকপে। তয় শরীরে নাকি কিছু নেই। এহেবারে কাহিল। ডাক্তার কইচে, ভালোমন্দ খাওয়াতি। এহেন ঘুমোতিচে। কী একটা ইনজেকশন দিচে।

আমাগো আর ভালোমন্দ খাওয়া। কও নেই ডাক্তাররে যে ও বাল বান্দর নাচায়। নিজে খাবে কী আর বান্দর গো খাওয়াবে কী? সাতে আছে এক নটী।

সুকুমারের গোলাপের কথার শেষটুকু ভালো লাগল না। যদিও গোলাপের বলার যা ধরন তাতে সে খেপতেও পারবে না। জরিনাকে নটী বলেছে, কিন্তু এমন হেসে বলেছে যে, তাতে আজগর তার বানর আর জরিনা সব একই। আজগরের আয়ে তাদের অভুক্তই থাকার কথা।

এইয়ে ডাক্তাররে কইয়ে কী হবে?

গোলাপ এ সময় বারিকের বসে থাকা বটগাছের নীচে হাত উঁচু করে সেখানে বসা দিলদারকে দেখায়, ওই দেহে, এক নাটাই সের নাতিপের বাকসো নিয়ে বইসে রইচে। ভাবখানা দেখে যেন আইজকে এই টাউনের সবাইর বাত নামাইয়ে বাড়ি যাবে!

সুকুমার হাসল। দেহিচি। তা আইজকে ওইভাবে বইসে রইচে কী জন্যি, পাবে কেউরে?

কেন বইসে রইচে তা দিলদারই ভালো কতি পারবে। তয় মানষি কয়, ওইসব ওয়ার ভান। আসলে করে সরকারে গোয়েন্দাগিরি।

কী কও?।

কী কও না, সত্যি। ওর চিন্তা কী জমি আছে কিছু। বান্দা লাগায়। হাউসে ওই যন্তর নিয়ে বসে। আর এই কোর্টের সব খবর পুলিশরে পাস করে।

সুকুমার বিস্ময়ে গোলাপের দিকে চেয়ে থাকে। সত্যি মিথ্যা কিছু যাচাই করতে গেল না। দরকার কী। অথবা তার কোনও উপায় আর সুযোগ তার নেই। গোলাপের কথা সে উড়িয়ে দিতে পারে না। আবার এখানে, তাদের ভিতরে বাত নামানো যন্ত্র নিয়ে বসা দিলদার পুলিশের গোয়েন্দা তাই-বা মেনে নেয় কী করে। কিন্তু সুকুমারের জানা আছে, এইসব বিচিত্র খবর হঠাৎ হঠাৎই উড়ে আসে। যেমন এখনই গোলাপ আরও বলল, ও শালার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক। সৌদি চইলে যাবে।

তাই নাকি?

তুমি আবার যাইয়ে জিগাইয়ে না। কবে নানে কিন্তু কিছু। এমন ভাব করবে ওই নাপতালি দিয়ে কোনওমতে দিন চালায়।

সুকুমার চোখ বড়ো করে গোলাপের মুখ দেখে। এই কথা শুনে তার আর কাজ নেই। এখানে। থাকলে গোলাপ আরও বলবে। হয়তো চা খেতে নিয়ে যাবে। যদি চা-খাওয়ার পরে সেটার দাম গোলাপ দেয় তো পানের দাম সুকুমার দিতে হবে। সুকুমারে সেই সঙ্গতি নেই। পকেটে অবশিষ্ট যে পাঁচটি টাকা, তাই দিয়ে আজগরের জন্যে সাবুদানা কিনতে হবে। তারপর তা জলে ফোঁটানোর জন্যে জরিনাকে যেতে হবে হাফেজের বউ লালির কাছে। সেখানেও এই কাজের জন্যে টাকা চাইতে পারে। আবার নাও চাইতে পারে, আজগর তাদের বাধা খদ্দের। তবে যাই হোক, এখন সুকুমারের বাজারের দিকে যাওয়া দরকার। বৃষ্টি পড়ছে না। হয়তো টিপটিপ করে এখনই পড়বে। অথবা ও যে কোনও সময় দাবাড় চালাবে। তার আগে বাজার হয়ে আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত আসতে হবে। তারপর, এখনই ভাবল সে, যদি সম্ভব হয়, সারাটা দুপুর আলতাফের হোটেলের দোতলায় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবে। ঝিলিক ডেকে না উঠালে উঠবে না। খাবেও না কিছু। খাবে যে সে-পয়সা কই?

০৮. আজগরের জন্যে সাগুদানা

বাজার থেকে আজগরের জন্যে সাগুদানা এনে দেবার পরে সারাটা দুপুর সুকুমার ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। ঝিলিক ভেবেছিল বুঝি রঙ্গ করে। এমন কথা সুকুমারের মুখেই মানায়। যে লোক, হঠাৎ যে কোনও জায়গায়, রেল স্টেশন কি পার্কের বেঞ্চিতে কোনও সময়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, তার পক্ষে এমন রঙ্গ করা সত্যি সম্ভব। কিন্তু তাই বলে মোটামুটি আয়োজন করে ঘুম! সেই গেল আলতাফের হোটেলের দিকে তারপর আর দেখা নেই। ঝিলিক ভেবেছিল, একটু ঘুমাবে মানে হয় কোনও লঞ্চের ভিতরে কি পন্টুনের কোনও পাশের বেঞ্চিতে। আকাশে মেঘ আছে। বৃষ্টিও হয়েছে কয়েক পশলা। সকালের পরে আর দাবাড় চালায়নি। ফলে, ঢাকাই লঞ্চের ভিতরে কিংবা অন্য কোনও ছোটো লঞ্চের ভিতরে সুকুমার ঘুমিয়ে নিতে পারে। তাই বলে একেবারে আলতাফের হোটেলের দোতলায় গিয়ে এইরাম ঘুম!

তা সত্যি। আলতাফের হোটেলে এই দুপুরের পর পর্যন্ত সুকুমার ঘুমিয়ে থাকতে পারে, তা ঝিলিক জনমেও ভাবেনি, জরিনারও মনে হয়নি সেকথা। ফলে ওদিকে কেউ আসেনি। আলতাফের হোটেলে সুকুমারকে কেউ খোঁজেনি। ঝিলিক লঞ্চের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে এসেছে সেখানের দু-একজনকে। পন্টুনের চারপাশে দেখেছে। একবার কদম আলিকে জিজ্ঞাসা করেছে। কদম আলি বলেছে, সে গতকালের পর আর সুকুমারকে দেখেনি। যদিও ঝিলিককে বলা তার এই কথাটা মিথ্যা, কারণ কদম আলি সুকুমারকে চেনে না। জরিনাকে বলেছে ঠিক, যে পন্টুনে ওইরম চেহারার কেউকে সে দেখেনি, চেনেও না।

তবে, সুকুমারকে পাওয়া না পাওয়ায় তারা দুজন উতলা হয়নি। সুকুমারকে তাদের প্রয়োজনও পড়েনি। ঝিলিক বসেছিল আজগরের ছাপড়ার সামনে, তখন জরিনা গিয়ে হাফেজের বউয়ের কাছে থেকে সাগু ফুটিয়ে নিয়ে এসেছে। তারপর দুজনে মিলে ধীরে ধীরে খাইয়েছে আজগরকে। তখন আজগর একটুক্ষণের জন্যে আধো জাগরণে। জরিনা বিড়বিড় করে বলছিল, মোসলেম ভাই কী ডাক্তার দেখাইয়ে নিয়ে আসল, আর ডাক্তার এমন এক ইনজেকশন দেল, লোকটা আর ঘুম দিয়ে ওঠে না।

এই প্রায় বিড়বিড়ানি বলার জন্যে বলা হয়তো, জরিনা নিজেও জানে, এই যে মানুষটা ঘুমাল এই ঘুমেই তার কাহিল অবস্থা ছাড়বে। এ জন্যে কয়দিন যাবে না কর্মকার পট্টির পিছনে, সেখানে গিয়ে বোতলভরতি ওই ছাইপাশ গেলে। কোনওদিন ওখানে বসে না, পাইটের বোতল কোমরে গুঁজে নিয়ে আসে, তারপর পন্টুনে হেলান দিয়ে গলায় ঢালে। কোনও কোনওদিন ওইসমস্ত না খেলে তার ঘুম আসে না। সে রাতে ছটফট করে। কোনও রাতে খেয়ে কাঁদে। অস্ফুট সেই কান্নায় আজগর কত কতদিন আগে ফেলে আসা বাড়িঘরের কথা বলে। নাকি বলে বাপ ভাই বোনের কথা। জরিনা শোনার চেষ্টা করেছে, যদিও কোনওদিনও উদ্ধার করতে পারেনি কী বলে। কাকে বলে। কার জন্যে কাঁদে। নাকি একসময় খুলনায় কোর্টের সামনে খেলা দেখাত, সেখানে এই জরিনার মতো কারও সঙ্গে তার পরিচয় ছিল, তার জন্যে এখন নিশি রাইতে আজগরের প্রাণ কান্দে!

জরিনা জানে না। কখনও জানার চেষ্টা করেনি। কোনও দিনও জানতে চায়নি, কেন বলা যাবে, তবে তাকে এই বিষয়ে আজগর কিছু বলেনি। জরিনা তো জানে, আজগর তারে মনে মনে হয়তো মানুষই মনে করে না। যদি মানুষ মনে করে, তাহলে ভাবে বাজারের মাইয়ে মানুষ। আবার এই বাজারের মাইয়ে মানুষটার সাথেই বছর কাটায়। তা কাটাও। কেউ এই নিয়ে কিছু বলতে আসছে না। আশেপাশের মানুষজন কেউই তো তাদের মানুষ বলেই গণ্য করে না, গণ্য করে না বলেই তাদের নিয়ে কোনও কথা নেই। কথা যা কয় ঘাটের কদম আলি। তবু জরিনার মনে হয়, তারা এই লঞ্চঘাটের কাছে আছে দুইজন আর পার্কে আছে বেঙ্গা-বেঙ্গি। এই চারজন মানুষরে নিয়ে বাকি মানুষের কোনও আপত্তি নেই। কোনও চাওয়া চাইয়ি নেই।

সমাজের সে সব হিসেবের বাইরে, জরিনাও এই বানর-নাচানো আজগরকে নিয়ে সংসার গড়ে তুলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আজগরকে বোঝায় কে। শুকনার সময়ে ইচ্ছে হয়, নদীর পাড়ে ওই পাশে একটু বেড়া দিয়ে চারটে ডাল ভাত ফুটানোর। কিন্তু একদিন দুইদিনও কি পেরেছে? চালের নীচে মাথা দেওয়ার স্বভাব নাই ওই আজগরের। মুনিগঞ্জে মেলা থেকে জরিনা কিনেছিল একটা মাটির হাঁড়ি আর একটা কড়াই আর তালগাছের ড্যাগায় বানানো চামচ। সে সব এখন কোথায়? নদীর পানিতে ভেসে ভেসে এতদিনে নিশ্চয়ই দক্ষিণ সমুদ্রে ভেসে গেছে। সেই সংসার পাতা হয়নি জরিনার। লালির কাছে সাগুদানা ফোঁটাতে গিয়ে তার মনে হয়েছে, এইটুকু ফোঁটানোর জন্যে এই নাগের বাজারে হাফেজের দোকান পর্যন্ত আসা লাগে, যদি থাকত তাদের দুটো হাঁড়ি কি একটা কড়াই আর আলগা চুলো তাহলে জরিনা নিজেই রান্না করে আজগরকে খাওয়াতে পারত। তারও তো ইচ্ছে করে। ভাত মাছ তরকারি না-হোক, এই এক বাটি সাগুদানা তো জ্বাল দিতে পারত!

যা হয়নি, হয়নি। হবেও না কোনওদিন। জরিনা আর সে আশাও করে না। মানুষের চোখে রাস্তার মেয়ে মানুষ, তার এত খায়েস কেন সংসার করার। তা বলে মানুষের বাড়িঘর, ঘরদুয়ার সংসার দেখলে জরিনার গা জ্বলে না। বরং চায়, একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আর রান্নার হাঁড়িকুড়ি যেন জোটে এই জীবনে সব মেয়ের কপালে। এই ঝিলিক আর সুকুমারও যেন একদিন থিতু হয়। এইভাবে, ঘরের চালে মাথা না দিয়ে মানুষের জীবন চলে নাকি?

একটু আগেই তো জ্বরের ঘোরে আজগরের মতন মানুষও সে কথা বলল। তখন আজগরের ঠোঁটের কাছে জরিনার ধরা বাটিটা ওই এক মুহূর্তে যেন প্রায় থমকে গিয়েছিল। আজগর বিড়বিড় করার ফাঁকে চোখ খুলে ঝিলিককে দেখে বলে, কী খবর বোইন। আমার এই দশায় তোমাগো যে কষ্ট হতিচে!

ঝিলিক অস্ফুট বলে, হয়, কী যেন কততা করতিচি, কত যেন কষ্ট!

আজগর সাগুর বাটিতে চুমুক দিতে দিতে বলে, ও জরি, ও কয় কী? তারপর ঝিলিককে, কেন আমি যেন বুঝি না?

জরিনা বলে, কতা কইয়ে না, খাও।

আজগর নীচু গলায় বলে, বুইনডারে কী কষ্ট দিতিচি। সেই সহলদে এই হানে—

আজগরের মুখ মুছিয়ে দিয়ে জরিনা বলে, হয়। বইসেই আচে।

আজগর অস্ফুট বলতে বলতে ঘাড় ঘোরায়। তার চোখ বুজে আসছে, সুকুমার কোতায়, তারে দেকলাম না। আইজে বৃষ্টি তো সব মাটি কইরে দেল!

আজগর শুনছে কি শোনেনি, এর ভিতরে জরিনা বলে চলে, তোমার জন্যি এই সাগুদানা কিনে দিয়ে তারপর যে কোহানে গেল।

আজগর ঘুমিয়ে পড়লে তাদের সুকুমারের কথা মনে হয়। তারপর আশেপাশে খোঁজে। কিন্তু একবারও তাদের মনে হয়নি, এমন অবেলায় আলতাফের হোটেলের দোতলায় উঠে লোকটা সটান ঘুমিয়ে থাকতে পারে। তারা বরং ভেবেছে কোর্ট চত্বরে আছে। ঝিলিককে বসিয়ে রেখে, জরিনা কোর্টের দিকে গেছে ডাকবাংলো ঘাট হয়ে। আলতাফের হোটেল তার পথে পড়েনি। কোর্ট চত্বরে গিয়ে জরিনা দেখে এসেছে ফাঁকা। বারিক বুড়ো নেই। বারিক বুড়ো নেই তো কোর্ট চত্বরে কোনও ক্যানভাসারই থাকার কথা নয়। ছিলও না কেউ। শুধু মহুরিদের ঘরের কাছে গলায় চামরার ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল গোলাপ মিয়া। জরিনাকে দেখে হেসেছে। সে জানে আজগরের শরীরের কী অবস্থা। এই হাসিতে কোনও রঙ্গ ছিল না। জরিনা কাছে আসলে হয়তো জানতে চাইত আজগর কেমন আছে। আবার নাও জানতে চাইত পারত, ঘণ্টা দুয়েক আগে সুকুমারের কাছে শুনেছে। জরিনা বাঁ-দিকে একটু এগিয়ে টাইপিস্টদের চত্বরের দিকে যায়। ভিতরের সার সার বেঞ্চি কোনওটাতে সে বসে থাকতে পারে। লোকজন নেই প্রায়। অনেক টাইপিস্টের টাইপ রাইটার কভার দিয়ে ঢাকা দেওয়া। দুই একজন কাজ করছে। তাও নিশ্চয়ই খুব কষ্টে, ভিতরে আলো নেই। বাইরেও আলো কম। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে এই টিন শেডের ভিতরে টাইপের মতন সূক্ষ্ম কাজ করতে টাইপিস্টদের কষ্ট হয়।

এসব হয়তো জরিনা বোঝে না। কিন্তু আজকের বৃষ্টি বাদলে সবই যে খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেছে তা বুঝতে পারছে। আর সুকুমারও যে এইখানে নেই, তাও তার দেখা হয়ে গেছে। এ সময়ে কোত্থেকে এসে হাজির দিলদার। শেডের বাইরে দিলদার এলে জরিনা দেখল তার বাত নিরাময় যন্ত্রটা এক কোনায় রাখা। এখন তা দিলদারের পায়ের কাছে। দিলদার হাসল। জরিনা অবশ্য এই হাসির উত্তর দিল না। তার দিলদারকে সব সময়ে একটু ফটকা মনে হয়। এখনই কোনও ফটকামি শুরু করবে। জরিনা যেন তার কোনও সুযোগ না দেয়ার জন্যে বলল, আইজকে এই বইষ্যাকাদার দিনেও ওই নাপিতের বাকসো লইয়ে আইচো।

জরিনা এভাবে কথা বলে, তা জানা আছে দিলদারের। কিন্তু আজগর অসুস্থ, আর আবহাওয়ার এই দশা, তার ভিতরে হঠাৎ এভাবে তার প্রতি চড়াও হল কেন, দিলদার যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আত্মরক্ষার ভিতর দিয়ে আক্রমণের জন্যে মিয়ানা গলায় বলে, তোমার এই একথা। এইডে দেকলিই নাপিতের বাকশো। কত মানষির কাজ হয়। বুড়ো তো হওনেই হলি বোঝদা, বাত কারে কয়।

হয়। ওইয়ে দিয়ে বাত সারাতি যাবেনে মানুষ। মানষির আর খাইয়ে কাজ নেই।

কেন, দেহো না, মানুষ আসে তো। ধরে আর আমি কত মানষির বাত ছাড়াইয়ে ভালো কইরে দেলাম।

হইচে। জানি জানি। কার কার বালে আসে তোমার ধারে বাত ছাড়াতি, সেয়া আমার জানা আছে।

ফাও কতা কইয়ে না। বাদুক বোঝবা!

হয় হইছে।

জরিনার ধান্দাটা কী? দিলদারের সঙ্গে এখন কথা জমিয়ে, তারপর তাকে নিয়ে কোনও চায়ের দোকানে যাবে? আজগর তাকে পেশানে পেশানে একবারে এক শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু সে যে সুকুমারকে খুঁজতে এসেছে, সে কথা কি ভুলে গেছে। নাকি সুকুমারকে খুঁজতে আসার উছিলায় এমন একটা দিনে কোর্ট চত্বরটা কেমন তাই দেখে গেল। আবার এই মুহূর্তে দিলদারকে পেয়ে একটু যদিও রঙ্গ করে এক কাপ চা আর এক খিলি পান মুখে দেয়া যায়, তাই-বা মন্দ কী?

হয় হইচে না। ঘুমোও তো ওই আজগরের সাতে, ঠিকমতো ডলা দেনা, ঠিকমতো ডলা দিতি পারলি তোমারে বাত বাদাইয়ে দিতি সময় লাগদ না!

জরিনা ফিক করে হাসল। চাইল একবার দিলদারের চোখে। অন্য সময়েও দিলদার এমন সব কথা বলে। কিন্তু এখন দিলদারের কথায় জরিনার এই হাসিতে অনুমোদন ঠিক নয়, কিন্তু আবার একপ্রকার অনুমোদনও। আবার তাও হয়তো না, দিলদারের কথা বলার ভঙ্গিটা এই মুহূর্তে ভালো লেগেছে তার। কিন্তু মুখে তার কপট রাগত একটা ভঙ্গি এখন ঠিকই থাকে, হইচে। ঘুরোয় ঝাঁকাও ওই কাটাবাড়ার এক কল, সেইয়ের জোরে আমার বাত বাধাতি চাতিচো। তোমার ওই যন্তর দেখলিই বোঝা যায় তোমার মুরোদ কীরাম!”

আমার মুরোদ আবার দেখলা কবে?

দেখিনি, চেহারা দেকলিই বোঝা যায় কার কী মুরোদ।

চেহারা দেকলি! আর ফাও কতা কইয়ে না। মুরোদ দেকতি চালি কইয়েনে, দেহাইয়ে দেবানে।

জরিনা আবারও চাইল দিলদারের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল। ওদিকে দিলদার তার কথা বলে চলছে, তারপর দেইয়েহানে আমার এই যন্তরের ধারে আইসে বাত কোমান লাগে নাকি?”

জরিনা হাসে। সে বুঝেছে দিলদারের কথায় সে আটকে যাচ্ছে। এসব ক্যানভাসারের সঙ্গে কথায় পারা যায় না। এরা প্রত্যেকটাই কথায় এক একটা ঝুনো তাল। এমনভাবে পাকাবে যে সে কথা দিয়ে কোনও ভাবে বের হওয়া যাবে না। এই পর্যন্ত ভাবতেই জরিনার মনে হল, সুকুমারকে খুঁজতে এসে সে দিলদারের সঙ্গে এভাবে আলাপে জড়িয়ে পড়ছে? ওদিকে ঝিলিক বুঝি এখনও একা একা বসে আছে ঝুপড়ির সামনে। বেলা পশ্চিমে হেলে গেছে কখন। সূর্যের মুখ আজকে দেখা যাচ্ছে না বলে বোঝা যাচ্ছে না বেলা কত হয়েছে। খিদেও হয়তো এখনও সেভাবে লাগেনি, কিন্তু পেট সময়মতো যা জানান দেয়ার তা জানাবে।

হইচে, তোমার আর কতা দিয়ে ভিজোনোর দরকার নেই। এই মেঘলা দিনে এমনিই ভিজে রইচি, মানষি বাচতিচে না নিজের জ্বালায়, এর মদ্যি উনি খালি কতা দিয়ে ভিজোইয়ে যাতিচে।

তা চলো গলা ভিজোইয়ে দি। নদী ভরা পানি, সেইয়ে দিয়ে ভিজোবা না চা দিয়ে ভিজোবা?

নদীর পানি দিয়ে ভিজোলি আর তোমার ধারে জিগোতি যাব নানে। যাইয়ে নদীতেই নাইমে যাবানে–

তা চলো চা দিয়ে ভিজোইয়ে আনি।

এবারও জরিনার আলতাফের দোকানের পথে নদীর পাড়ে আসা হল না। দিলদার টাইপিস্টদের শেডের একজনের জিম্মায় তার বাত নিবারণের যন্ত্রটা রেখে জরিনাকে নিয়ে চলল ডাকবাংলোর কাছে, বার কাউন্সিলের সামনে। সেখানে অবশ্য কিছুটা ভিড় আছে। উকিল মোক্তার মহুরিরা সেখানে থাকবে, তাই স্বাভাবিক। এত পথটুকু যেতে যেতে জরিনার মনে হল, অনেকক্ষণ হয়েছে। সুকুমারকে খুঁজতে এসেছে সে, চা খেয়েই তাকে চলে যেতে হবে।

আলমের দোকানের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দিলদার আর জরিনা চা খায়। এক ফাঁকে জরিনা দিলদারকে জিজ্ঞাসা করে, আইজ এমন দিন লোক নেই, জন নেই, আইজকে কেন আইছো?

দিলদার জানায় এমনি। রোজই আসে। আইজকেও আসল। বিকেলে নদীর ওপর দিয়ে এক বেয়াই আসপে, তার সাথে এট্টা কাজ আছে। সন্ধ্যা বাদে বাড়ির দিক যাবে।

জরিনার মনে হয়, মানুষ যে এই লোকরে গোয়েন্দা কয়, এ শালা আসলেই মনে হয় গোয়েন্দা। কাজ নেই কাম নেই তবু আসপে। মনে হয়, কোর্টের এলাকার সব খবরাখবর পুলিশরে দে। নিশ্চিত পুলিশের লোক। আবার ভাবে, হোক, তাদের কারও সাথে আইজ পর্যন্ত কোনও উলটো পালটা ব্যবহার করেনি। যা এট্ট রঙ্গ-রসিকতা করে। আর পকেটে পয়সা আছে।

কী ভেবে জরিনা জানতে চায়, সন্ধ্যারও পর?

হয়। এই জায়গায় থাকপো। সন্ধ্যার পর আসো না এদিক।

যাব কোয়ানে, এই এলাকায়ই তো থাহি। আর যাব কোয়ানে? এরপরই সে বলে, পান। খাওয়াবা না?” তারপর দ্রুত রাস্তার উলটো পাশের পানের দোকান থেকে এক খিলি পান নিয়ে দিলদারকে বলে, দাম দিয়ে দিও, গেলাম। কাজ আছে।

জরিনা দ্রুত হেঁটে ছাপড়ার সামনে এসে দেখে, ঝিলিক নেই। হয়তো এতক্ষণ ধরে জরিনার অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে কোথাও চলে গেছে। সেই সকালের পর তার পেটে কিছু পড়েনি, সুকুমার এসে একবার খোঁজ নেয়নি, কতক্ষণ একজন জ্বরের মানুষের মাথার কাছে হাত পা-গুঁজে বসে থাকতে পারে। বৃষ্টির আর বাদলের জন্যে নদীতে জোয়ার ভাটা প্রায় নেই। নদীর বুকে অথই জল। অন্য দিন হলে একবার ভাটা হয়ে আবার জোয়ারে নদী ভরে যেত। জরিনা গেছিল তাওবা কম সময়। এতক্ষণ এখানে না-থাকলে ঝিলিককে সে দোষ দেয় কী করে?

কিন্তু ঝিলিকও তো গিয়েছিল সুকুমারকে খুঁজতে। জরিনা এখান থেকে যাওয়ার পর যখন আর আসে না, তখন ঝিলিকের কেন যেন মনে হয়, কোথায় গেল লোকটা? একবার বলেছিল, যদি কোর্টের সামনের অবস্থা এমন হয়, তাহলে হয় রেল স্টেশনে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে। তা যদি যায়, তাহলে তো তার মাল-সামান নেবে আলতাফের হোটেল থেকে। এইসব ভেবে ঝিলিক আলতাফের হোটেলেই যায়। আলতাফের আজ মন খারাপ। নদীতে লঞ্চ চলাচল কম। মোংলা পোর্টে নাকি সিগন্যাল দিয়েছে। তাই দক্ষিণ আর পুব থেকে শহরে লঞ্চ ভিড়েছে কম। কোর্টেও তো লোকজন তেমন নেই। লোক না থাকলে তার হোটেলে ভাত খেতে আসবে কে? শহরের মানুষ তো আলতাফের হোটেলে খেতে আসে না। ঝিলিক আলতাফের কাছে জানতে চেয়েছে, সুকুমারকে দেখেছে কি না? আলতাফ দেখেনি। আলতাফের অবশ্য এই কথা বলায় কোনও ভুল নেই। সুকুমার যখন এখন থেকে গিয়ে, পাশের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেছিল, তখন আলতাফ দোকানের সামনে ছিল না। পিছনের রান্না ঘরের বাবুর্চিকে বলতে গিয়েছিল ভাত যেন কম চড়ায়। তরকারিও একটু কম কাটুক। মাছ-মাংস তো রান্না হলে জ্বাল দিয়ে রাখা যাবে। তারপর যা থাকবে তা মেশানো যাবে আগের দিনের ঝোলে। এ তো সব সময়ই করে। প্রতিদিনই রাতে কিছু তরকারি বাঁচে, তা আগের দিনেরটার সঙ্গে মিশায়। আর ভাজা মাছ হলে আবার ভেজে রাখে। তারপর নতুন আর পুরনো ভাজা মাছ এক করে। কয়জন খদ্দের তা বুঝতে পারে? খাওয়ানোর কত পদের কায়দা আছে। একবার ধরে বেঁধে আঁট করে বসাতে পারলে হল। তারপর এটা খান এই দাম। ঠিক আছে কম নেওয়া যাবে। ওটা খান, এই দাম, কম নেওয়া যাবে। একসঙ্গে দুইখানা খান, আরও কম। একটা বেলে আর একটা টেংরা খান। টেংরাটা ফ্রি। আসলে টেংরাটা দিন দুইয়েক আগের। কড়কড়ে ভাজা। বোঝার কোনও উপায় নেই, দুই দিনে কতবার এই টেংরা তেলের চুবনি খেয়েছে। আজকের বেলে মাছের সঙ্গে গছিয়ে দিতে পারলে হল। দেড় গুণ দাম তো পাওয়া গেল।

সামনে একটু উঁচু টেবিল মতন জায়গায় সাজানো ভাজা মাছের সামনে দাঁড়িয়ে আলতাফ ঝিলিককে জানিয়েছে, সে সুকুমারকে দেখেনি। ওদিকে ভাজা মাছের ঘ্রাণ। সঙ্গে ঘন মশলা মাছ মিলে যে এক অদ্ভুদ বাহারি স্বাদ তৈরি হয়, ঝিলিক তা ভেবে নিতে পারল। কতদিন এই সব মাছ দিয়ে যেন ভরপেট ভাত খায় না। যদিও নাগের বাজারের মাঝি ঘাটায় মতির হোটেলে সে আর সুকুমার ছোটো গুলশা টেংরা দিয়ে ভাত খেয়েছে গত পরশু। কিন্তু এইরকম বড়ো বড়ো সাইজের বেলে মাছ। এগুলো বেলে না তুলার দান্ডি! আলতাফ কালকে বলছিল, চুডা বাইলা। ঝিলিক ভালো করে তাকায়, না এগুলো বেলে। তাদের দিকে এক সময় তুলার দান্ডি কেউ খেত না।

ঝিলিক একটু সরে আসে। আলতাফ হয়তো বুঝে ফেলবে জরিনার পেটের ভিতরে এই মাছ মোচড় দিয়ে চলেছে। তখন আলতাফ কী ভেবে বলে, দেহো উপরে যাইয়ে, থাকতিও পারে। আমি মাঝে মদ্যি পিছনে যাই। এদিক ওদিক চা পান বিড়ি খাতি যাই, তহোন আইসে উপরে যাইয়ে ঘুমোইয়ে রইচে নিকি তোমার লোক, জানে কেডা?

ঝিলিক চকিত চোখে আলতাফের দিকে তাকায়। কোনও বদ মতলবে এই দুপুরে তাকে উপরে যেতে বলল না তো? পুরুষ মানুষ বিশ্বাস করা যায় না। তাছাড়া, তাকে জরিনা এই লঞ্চঘাটের এক একজন সম্পর্কে যা বলার বলেছে। আলতাফের চোখ কেমন চলে, তা বলতে বলতে জরিনা ঝিলিকের গায়ে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়েছিল। সেই আলতাফ এখন সুকুমার উপরে আছে কি না তা না-জানার ভান করে, তা উপরে যেতে বলছে। যদিও কথাটা একেবারে নীচু গলায় আর সঙ্গে তার–জানাকে মিশিয়ে দিয়েই বলেছে, মনে হল ঝিলিকের। সে হোটেলের বড়ো দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। এক থাক সিঁড়ি। তার নীচে জল জমেছে। ঝিলিকে পায়ের নীচে জল। রাবারের স্যান্ডেলটা ভিজে চুপচুপে। সামনে একখানা মোটা ছালার চট লেছে দেয়া। সেখানে উঠে দাঁড়িয়ে আবার জানতে চাইবে, না এখনই একটু এগিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তাই ভাবল।

না, থাকলি আপনি জানতেন! ঝিলিক তার সন্দেহ প্রকাশ করে।

আলতাফ বিষয়টা বুঝতে পারল। কিন্তু আলতাফের হিসেব তো ভিন্ন, একটু ইয়ার্কি ফাজলামি যাই করুক, গ্রাহক খরিদ্দারের সঙ্গে কোনও প্রকার নগুছগু সে যেমন নিজে করে না, তার কোনও কর্মচারী কি আশেপাশের কোনও দোকানদার এই কাজ করুক তা সে চায় না। সে বলল, কেন, অসুবিধা কী? যাইয়ে দেইখে আসো। আমি জানি না, দেহিনি।

তালি থাহে কী কইরে। এহোন তয় যাই, পরে নয় জরিনাদিরে নিয়ে আসপানে।

কেন, রাইতে উপরে থাকতি পারো আর এহেন উপরে যাইয়ে দেইহে আসতি ভয়! পিছনে। শিউলির মা আছে। দরকার হলি তারে লইয়ে যাইয়ে দেইহে আসে।

কেন যেন ঝিলিকের সন্দেহ কাটল একথায়। অথবা সে যেন না বুঝে সন্দেহ করেছে আলতাফকে। শুনেই ঝিলিক হাসল। অর্থ এই, না সে একাই যেতে পারব, অথবা, আসলে সে ভেবেছিল জরিনাকে নিয়ে আসাই তার জন্যে ভালো। ঝিলিক বলে, না, ভাবিলাম, সেই মানুষটা যদি ঘুমোইয়ে থাকে, তালি জরিনাদিরে নিয়েই আসা ভালো। না-পালি আপনার এই জায়গাদে দুইজনে চাইরডে ভালোমন্দো খাইয়ে খাতি পারতাম।

তা লইয়ে আসো, খাইয়ে যাও। আইজে আমার এমনিতেই বাণিজ্য খারাপ। দেহো না, মানুষজন নেই। তবু তোমরা খাইয়ে গেলা। বেচলাম কয়ডা ভাত।

হয়। এইয়ে আমরা খাতি পারি নিকি। এসব খাওয়ার যে দাম!

আসো, কোমাইয়ে রাখপানে। আইজকে এহেবারে বিক্রি বাট্টা নেই।

দেহি। তার আগে দেইহে আমি সেই মানুষটা আছে নিকি। বাপুরে বাপুরে, যদি ঘুমোইয়ে থাহে, তবু এইরাম ঘুমোতি পারে মানুষ?

আইজে ঘুমোনোর দিন।

হয়, যেন লাট সাহেব। ঘুমোইয়ে থাকলি পেটের ভাত জোটাবে কেডা?

বলতে বলতে ঝিলিক ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোয়। আলতাফের চোখে চোখ রাখে। বুঝতে চায়, আলতাফ যে তাকে আর জরিনাকে খেতে বলল, আসলেই বলল তো। যদিও এখন তার সুকুমাররে পাওয়া দরকার। এখানে খাওয়ার ব্যাপারে জরিনা বা সুকুমারের সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছুই করা যাবে না।

দোতলায় উঠে দেখে, পুরোটাই ফাঁকা। সামনের ছোটো কাঠের বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা দেওয়া। আর ওইপাশে যে খুপরি ঘরগুলো, প্রতিটারই দরজা খোলা। কোনার দিকেরটায়, প্যান্ট পরা অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে সুকুমার। খাটের পাশে তার খেলা দেখানোর মালামাল রাখা। একটা বাক্সর মুখ ভোলা। বুকের ওপর এক পেটি তাস ছড়ানো। ঝিলিক এমন আধো অন্ধকারে ঘুমন্ত সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ঘুমন্ত সুকুমারের মুখোনা দেখতে বড়ো ভালো লাগছে। কী সরল মুখোনা মানুষটার। যেন এই জগতের কোনও কিছুর উপর তার কোনও রাগ নেই। বিরক্ত নেই। মুখোনায় আছে শুধু ক্লান্তি। একেবারে হাভাতে ঘরের ছেলে না, বাপ ভাইয়ের উপরে কোন রাগে পথে পথে এই জীবনটা কাটিয়ে দিল। তারপর, ঝিলিক নিজের কথাও ভাবে, সে এসে জুটেছে লোকটার জীবনে। তারপর, তারপর তারা জানে না, একদিন কোথায় ভেসে যাবে।

ঝিলিকের কখনও কখনও মনে হয়, এখন, এই মুহূর্তে সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে তার আরও বেশি মনে হল, সুকুমারকে আবারও বলবে তারে বিয়ে করতে। আবার ভাবে, সে জানে না, আবার বিয়ে করা যায় কি না? যদিও একদিন এমন কথা সুকুমারের কাছে তুলতেই সে বলেছিল, শাখা খুলতি কইচে কেডা? ভক্তদা মরিচে নাকি? তাও তো সত্যি কথা, শাখা জোড়া না খুললেই হত। সুকুমার তাই বলেছিল, শাঁখা যদি নাই খোলতা তালি দরকার হলি মানুষজনরে কতি পারতাম আমার বউ। আর ওয়া হাতে থাকলি এমনিতে কেউ জিগোনিও আসত না।

আহা, কী সোজা পরামর্শ! শাখা একজন মানুষ খোলে কেন? যা করিচে তোমার ভক্তদা, সেয়া কোনও মানুষ করে? একেবারে না-মানুষের জাত। ওই গুষ্টির রক্ত খারাপ! এরপর বিড়বিড় করে সুকুমারের মামাতো দাদা ভক্তর আর খানিক মুণ্ডুপাত করে। তবে, সে জন্যে ঝিলিকের কষ্ট না, কষ্ট তার ছেলে ভরতের জন্যে। এখন পথে ঘাটে যে কোনও জায়গায় ওই বয়সের কোনও ছেলে দেখলে ঝিলিক অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। তখন ঝিলিকের অজান্তে কখন যে চোখ ভিজে যায়। ঝিলিকের তখন একবারও ভক্তর কথা মনে পড়ে না। ছেলেটার মুখ চোখে ভাসে শুধু। সে তারপর সেই ভেজা চোখে অন্যত্র তাকায়। অন্যদিকে মনোযোগ দিয়ে নিজেকে স্মৃতি থেকে সরিয়ে নেয়।

এখন ঘুমন্ত সুকুমারের দিকে এই আধো অন্ধকারে চেয়ে থাকতে থাকতে অজান্তে ঝিলিকের চোখ ভিজে গেল। কিন্তু এখন তার চোখে তেমন আলো নেই, অন্ধকারই, আলো যেন অস্কুট, ওপাশে একটি জানলা মতন থেকে সুকুমারের মুখে খানিকটা আলোর আভাস, সেই মুখোনার দিকে তাকিয়ে অজ্ঞাতে ঝিলিকের চোখ জ্বলে ভরে উঠছে। কিন্তু ঝিলিক জানে না, কেন এমন হচ্ছে। কেন হঠাৎ ভরেছে তার চোখ জলে। আজকের ভেজা আকাশের মতন তার চোখের দশা! ভেজা চোখের অস্তিত্ব বুঝতে একটুক্ষণ সময় লাগল তার। তারপর আঁচল টেনে চোখ মুছে এবারও অজ্ঞাতে সে ফিসফিসায়, এই যে, এই যে, সুকুমার বাবু, আমার সাধের দেওরা, ওঠেন।

একথায় সুকুমারের কোনও প্রকার নড়চড় নেই। সে হয়তো শোনেনি, মুখোনা দেখে এমনিতে মনে হয়, গভীর ঘুমে অচেতন। আসলেই তাই। কিন্তু ঝিলিকের তো জানা আছে, সুকুমারের ঘুম কত পাতলা। এক ডাকেই সাড়া নেয়। পথেঘাটে থাকা মানুষ, ঘুম গাঢ় হবার জো আছে। কিন্তু এখন এভাবে ডাকার পরও উঠছে না কেন? নেশাটেশা করে ঘুমায়নি তো। কিন্তু ওসব অভ্যাস কখনও সুকুমারের দেখেনি। বিড়ি-সিগারেট খায়, তাও খুব পাতলা পাতলা। নাকি আজকের এই বৃষ্টি বাদলায় শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে লোকটা।

ঝিলিক আবার ডাকে, ও সু, সুকুমার?

সুকুমার চোখ খুলল না, কিন্তু আড়মোড়া ভাঙল। একটু নড়েচড়ে উলটো ফিরে শুল। বুকের ওপরে আলগোছে রাখা তাসগুলো গড়িয়ে পড়ল দুদিকে। কিছু নীচে, কিছু খাটের ওপর। আর বুকের ওপরে রাখা হাতখানা গড়িয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাতখানা মুখের কাছে এনে সে মুখ ডলল। ঝিলিকের মনে হয়, এখনই জাগবে। সে সুকুমারের কাছে যায়। ঝুঁকে মুখের কাছে হাত নিয়ে সুকুমারের মুখে হাত বুঝিয়ে ডাকে, ওঠো আমার সাধের দেওরা–

সুকুমার চোখ খোলে। সত্যি রাস্তাঘাটে ঘুমানো মানুষ, চোখ খোলামাত্রই যেন জাগরণে। আর, সেই জাগরণে ঝিলিককে কিছু বুঝতে না-দিরে সুকুমার তাকে টেনে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে। ঠোঁটে ঠোঁটে খুঁজতে চায়। কিন্তু ঝিলিক দাঁড়িয়ে থাকায়, তারপক্ষে ঘাড় তোলা যেন সহজ। সে বলে, এই দিনে দুপুরে! এই সময়! এই জায়গায়? তোমার আর আক্কেল হল না।

কেন আগে যেন দিনে দুপুরে কোনও দিন কিছু করিনি। মনে আছে, আমারে রূপসার পড়ে দিনের বেলা ভজাইলে?

কেডা ভজাইল তোমারে? আমি? আমার আর খাইয়ে কাজ নেই।

তালি কি আমি ভজাইলাম?

হইচে। এহোনও কতা কইয়ে না। ওঠো। খিদেয় জীবন যায়। কয়ডা সাগুদানা আইনে দিয়ে এইরাম কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোইয়ে রইছো?

তা কী করব। কোর্টের সামনে গেইলাম, মানুষজন নেই, সুকুমার উঠতে উঠতে বলে, তালি ঘুমাইয়ে থাকপো না তো করব কী?

সেই জন্যি এই বেলা পর্যন্ত!

আজগর ভাইর কী অবস্থা?

ঘুমোচ্ছে। আমরা দুইটে মানুষ কী খাইচি না খাইচি, কোথায় গেইচি না গেইচি, তোমারে জরিনাদিও খুঁজদি গেইচে। পারোও। মানুষের নাওয়া খাওয়া লাগে না!

হইচে। উঠতিচি। তোমার গলা কোমল না মাইজে বউ।

কথাটা খুবই কোমল গলায় বলল সুকুমার। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওই কথা বলেই সে ঝিলিককে জড়িয়ে ধরে, গালে আলত চুমু দেয়। ঝিলিক তাতে অবাক হল না তেমন, এমন কাজ সুযোগ পেলে সুকুমার করে। কিন্তু এখন কেন? সে বলে, হইচে, চলো।

তুমি যাও। আমি আসতিচি। সে পেচ্ছাপ করে আসবে সেই ইঙ্গিত করল।

নীচে নেমে ঝিলিক হোটেলের দরজার দিকে যায়, সুকুমার পিছনে। আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত যেতে হল না ঝিলিককে। তার আগেই নদীর কূলে জরিনার সঙ্গে দেখা। জরিনা ঝিলিককে দেখেই জানতে চায়, পাইচো তোমার নাগররে? আমি এই সারা বাড়ি খুঁইজে আসলাম, সে চান্দু কোনও জায়গায় নেই।

পাইচি। ওই আলতাফ মিয়ার হোটেলের দোতলায় প্যান্ট পইরে সে ঘুমোইয়ে রইচে। এদিক তুমিও তো গেইচো কোম সমায় না, বাপুরে বাপুরে তোমরা সব পারোও এক-একজন। আমি এই জ্বরের মানুষটার মাথার ধারে বইসে রইচি তো রইচি। কেউ যদি আসে।

জরিনার মনে হল, গেরস্ত ঘরের বউ ঝিলিক। তারমতো এমন এখানে ওখানে বেরিয়ে বেড়ানো পদের না। তাছাড়া, এখনও এই যেখানে রাত সেখানে কাত শিখতে পারেনি। থাকুক সুকুমারের সাথে কিছুদিন, সব এক সময় শিখে যাবে। তবু সে যেন ঝিলিককে বুঝ দিতে বলল, হয় এট্টু দেরি হইয়ে গেইচে আমার আসতি। কিছু মনে কইরে না। তা সে বাবু যে আসতিচে না?

আসপেনে। এই আইসে গেল।

সুকুমার এলে তারা কোথায় যাবে তাই নিয়ে আলোচনা করে। ঝিলিক জানায়, একটু আগে আলতাফ তাদের খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। একথা শুনে সুকুমার একটু বিস্ময়ে চোখ বড়ো করে ঝিলিকের দিকে তাকায়। ওদিকে জরিনা বলে, মাগনা খাওয়াবে? টাহা নেবে না? ঝিলিক এর উত্তরে বলে, দেবেহানে মাগনা।

জরিনা বলে, ওই শগুন খাওয়াবেনে মাগনা?

এসব কথায় কোনও সমাধান হয় না। যদি বৃষ্টি এখন নেই। চাইলে তারা হেঁটে নাগের বাজারে হাফেজের হোটেলে যেতে পারে। তবে, ঝিলিকের মনে হয়, এত খিদেয় এতটা পথ যাওয়া যাবে লাগবে না। তাছাড়া, আলতাফ তো বলেছে, দাম কম নেবে। সে কথা তাদের বলে সে। ঝিলিকের এ কথায় সুকুমার এট্টু অবাক হয়। কয়দিন আগেও যে ঝিলিক হিন্দু হোটেল ছাড়া খেতে চাইত না, সে এখন যাবে আলতাফের হোটেলে!

তারা আলতাফের হোটেলে খেতে যায়। খেতে খেতে জরিনা বলে, সুকুমার ভাই, এইভাবে সারা দিন পেরায় ঘুমাইয়া কাটাইলা?

এর উত্তরে অবশ্য সুকুমার বলেছে, এই বাদলায় কার কী করার আছে? এর ভিতরে সুকুমার জানতে চেয়েছে আজগর অবস্থা এখন কেমন। একটু আগে আজগরকে দেখে সুকুমারের মনে। হয়েছে, এই দুইদিনে লোকটা শুকিয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। কয়দিনে সেরে উঠবে পারবে একমাত্র ভগবান জানে। এইভাবে হাফেজের আর আলতাফের হোটেলে বাকি খাওয়া!

কিন্তু জরিনা কেন কথাটা বলেছে, তা সুকুমার কিছুটা হলেও বুঝতে পারলেও কারই-বা কী করার আছে। তবু এ ফাঁকে সুকুমার ভেবেছে, যদি আকাশ এমনই ধরা থাকে, তাহলে বল আর তাস নিয়ে চলে যাবে রেল স্টেশনে। ওখানে হয়তো খেলা দেখাতে পারবে। যদি পারে তাহলে, আলতাফের ধারের কিছুটা হলেও শোধ হবে। কিন্তু এই ভাবনার কিছুই সে ঝিলিককে বলল না, জরিনার কথারও কোনও উত্তর দিল না। বরং, ঝিলিকের কাছে জানতে চাইল, ঝিলিক আবার মোড়েলগঞ্জ যাবে কি না?

এ সবই এখন, আজকের এই দিনে কিছুটা হলেও অপ্রয়োজনীয় কথা। কারণ, আবহাওয়ার ভাবগতিক ভালো না হলে কোনওতায় কিছু আসবে যাবে না। আবার, যদি আজগরের শরীর ভালো না-হয়, তাহলে জরিনাকেও তাদের টেনে যেতে হবে।

খাওয়া প্রায় শেষ হতে সুকুমার জানতে চায়, আচ্ছা, বান্দর দুটোরে কিচু খাতি দেয়া হইছে?

জরিনা জানাল, সে সেই কলা কিনে দেয়ার পরে একবার বিস্কুট খাইয়েছে। আর লালির কাছ থেকে এসেছিল দুইখানা বাসি রুটি। সেইসব খেয়ে ছাউনির তলে এখনও ঝিমাচ্ছে। ওই দুটোও অবাক আজ অনেকদিন বাদে তাদের কেন কোর্ট চত্বরে নেওয়া হল না, আর ওই ট্রেজারির পাশে কুল গাছটার নীচে কেন আজ তাদের বেঁধে রাখা হল না।

এরপর বিকেলের অনেকখানিক কেটে গেলে, জরিনা আর ঝিলিক বসে থাকে আজগরের মাথার কাছে। এর আগে, আলতাফের হোটেল থেকে ফুটিয়ে আনা সাগুদানা আর ভাতের মাড় খাওয়ায় আজগরকে। আজগর আবার ঘুমিয়ে যায়। তারা দুজন নিজেদের সুখ-দুখের কথা কয়। তারপর কী মনে করে চলে যায় লঞ্চের ঘাটের পন্টুনে। কদম আলি নেই। কিন্তু একটু আগেই জরিনা তাকে দেখেছিল নদীর কূলে কিছু শ্যাওড়া গাছ আর কলা গাছের নীচে কেঁচো খুঁজতে। মানুষটা গেল কোথায়। এখন তার বড়শিতে মাছ ধরার সময়। জরিনা জানে, কদম আলির বড়শি কোথায় থাকে। বড়শি খুঁজতে গিয়ে তারপাশে একটা আঁচায় কেঁচেও পেল। তারপর জরিনা আর ঝিলিক পন্টুনে বসে মাছ ধরতে শুরু করে।

এ সময়ে আলতাফের হোটেলের উপরে উঠে সুকুমার আর একটু গড়াগড়ি দেয়। পেটের ভাত একটু তলানিতে গেলেই সে চলে যাবে রেল স্টেশন। ফুটবলের খেলা যদি নাও দেখানো যায়, চাউনির নীচে তাসের খেলা দেখাতে পারবে। আর লেকের পাড়ের কংক্রিটের চত্বরে খেলা দেখানোর সুযোগ হলে, বলটা পায়ে নিয়ে কয়েকটা কায়দা দেখাবে! তার আগে দিয়াশলাইটা পকেট থেকে বের করে কাঠি জ্বালিয়ে জিহ্বায় লাগিয়ে বারবার জ্বালিয়ে দেখানো। হাতের তালুতে রাখা ওই দিয়াশলাই বাক্স মুহূর্তে নিয়ে যাবে হাতের উলটো পিঠে। এইসব করে যদি মানুষ জমে তাহলে ফুটবলের খেলা দেখাতে পারবে। তখন পাবলিক পকেটের পয়সা নিশ্চিত ছুড়বে। আর যদি বৃষ্টির জন্যে তা না-পারে, তাহলে ভাগ্য খারাপ।

কদম আলিকে ডিসি অফিস থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাই সে পন্টুনে নেই। লঞ্চের একজনের কাছে থেকে জরিনা এ সংবাদ জানতে পেরে অতি উৎসাহের সঙ্গে মাছ ধরে। জরিনার চেয়ে দ্রুত মাছ তুলতে পারে ঝিলিক। যদিও আজ নদীতে অথই পানি। এত ভরা থাকলে মাছরা সাধারণত কম ধরা পড়ে। এখন পানি কিছু নামছে, হয়তো আরও খানিকক্ষণ বাদে মাছ ধরা পড়তে পারে। তবে, এসবই তাদের শুধু সময় কাটানো। মাছ যাই পাক, সবই তো নেবে ওই কদম আলি।

মেঘ থাকায় আজ বিকেল দ্রুত মরে আসে। জরিনা ওপারে চরগার দিকে তাকিয়ে দেখেছে। একটু আগেও যতটা আলো ছিল এখন তা নেই। অন্ধকার ঝুপ করেই নামবে। সে হঠাৎ ঝিলিককে বলে, তুই বাও বড়শি, আমি এট্টু বান্দর আলারে দেইহে আসি।

ঝিলিক জানতে চায়, যার বড়শি, সে যদি কিছু কয়?”

কবে কী? সে আইসে এইডে বাবে। জরিনা হাতের বড়শি গুটিয়ে রাখতে রাখতে বলে, মাছ কয়ডা ঠিকমতো পালি ওই কদম আলি কেউরে কিছু কয় না।

তাড়াতাড়ি আইসো। আচ্ছা, এই বড়শি কার, ওই ঘাটে যে থাহে সেই?”

হয়। সেই। মুহের এই জায়গায় কয়গাছ দাড়ি–সেই বেটা এই জায়গায় থাহে।

আচ্ছা।

জরিনা পন্টুন ছেড়ে যেতে যেতে বলে, আমি দেহি মোসলেম ভাইরে পাই নিকি। পালি কবানে এট্টু সাগুদানা আর মুড়ি কিনে দিয়ে যাতি–

তালি তুমি আর তাড়াতাড়ি আইচো।

আসপানে। অন্ধকার হলি তুমি নয়, বান্দরআলার ঘরের সামনে যাইয়ে বইসো।

অন্ধকার হতি যেন বাকি আছে। লঞ্চের মদ্যি বাতি জ্বালাইয়ে দিচে।

বাইরে এহোন আলো আচে।

পন্টুন থেকে উঠে জরিনা নদীর কূলে আসে। সোজা রাস্তায় মুখ দিয়ে দাঁড়ায়। এখন নদীর কূল ধরে বাঁয়ে গেলে আজগরের ঝুপড়ি ডানে গেলে ডাক বাংলো ঘাট। এখন সে সামনে রাস্তা ধরে মেইন রোডে যাবে না। যাবে ডাক বাংলো ঘাটের দিকে। সেখান থেকে ডাক বাংলো ঘাট হয়ে আলমের চায়ের দোকান। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। যদি মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় তো ভালো। তাকে আজগরের কথা বলবে। তাদের হাতে টাকা পয়সা নেই, তা জানাবে। সুকুমার আলতাফের কাছ থেকে ধার করেছে। আলতাফের হোটেলে দুপুরের পরে তারা বাকিতে খেয়েছে। এইসব। এক কাপ চাও খাবে, যদি মোসলেম উদ্দিন খাওয়ায়।

কিন্তু জরিনা আলমের চায়ের দোকানে মোসলেম উদ্দিনকে পায় না। পাওয়ার কথাও নয়। এসময় মোসলেম উদ্দিনের কোনওভাবেই এখানে থাকার কথা নয়। আজ কোর্ট বসেনি বলতে গেলে। যদি কোর্টের কাজ হয়েও থাকে, তখন মানুষ প্রায় ছিলই না। ফলে মোসলেম উদ্দিনের কোর্ট চত্বরে থাকার কোনও কারণ ছিল না। তারপর আর ওই মানুষ এখানে থাকে। আজগরকে হাসপাতাল থেকে এখানে পাঠিয়ে তারপর কিছুক্ষণ এখানে থেকে কখন চলে গেছে মুনিগঞ্জে।

তবু আলমের দোকানে দাঁড়িয়ে জরিনা চা খায়। জরিনা জানে এখন পয়সা না-দিলে আলম কিছু বলবে না। লিখে রাখবে দোকানের দেয়ালের তক্তার এক কোনায়। অথবা, মনে রাখবে। পরে এলে দাম চাবে। আলম মানুষটা ভালো আছে। শুধু গলার স্বরে কোনও রস নেই।

চা খাওয়ার সময় জরিনা ডানে বামে তাকায়। যদি পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু এখন উকিল বারের সামনে তার পরিচিত কারও থাকার কথা নয়। তবু, কখনও তো ভাগ্যে মেলে। অথবা, দুপুরের পর দিলদার বলেছিল, এসময় থাকতে পারে। যদি দিলদার থাকত। জরিনা মনে মনে দিলদারকে খুঁজছিল। দুপুরের পর পর তার মনে হয়েছিল, দিলদারের সঙ্গে তার দেখা হবে।

তবে, দিলদার এই এলাকায় থাকতে পারে, একথা বললেও এখন আলমের দোকানের সামনে এসে এভাবে উদয় হবে, একথা কিন্তু তার ভাবনার বাইরেই ছিল। জরিনা চায়ের গ্লাস নামিয়ে বলে, ও আল্লা, এ আমি কারে দেকতিচি। তুমি কোহানদে?

কেন, সেই সময় কলাম না, এই জায়গায় থাকার কতা তো কইলাম, সন্ধ্যা পর্যন্ত আইজকে থাকপো। ওপারদে একজন আসপে, তার সাথে কাজ সাইরে তারপর যাব।

আইচে তোমার সে ওপারের লোক?

হয়। এই গেল।

ও। চা খাইছো?

খাইচি সেই লোকের সাতে দুইবার। এহোন আর খাব না।

তালি রাস্তার ওপার চলো। পান খাওয়াও আমারে। আর এই চায়ের দামড়া দাও

হয়। খাইয়ে কাজ নেই আমার। ওনার চায়ের দাও। ওপার যাইয়ে পান খাওয়াও। কত তা করো।

দেও। দেহো না, এহোন তোমারে দেইহে চেইনি, কইনি তোমার ওই নাপিতের বাকসোডা কই?

সেয়া কলি আরও দেতাম না।

একথা বলার আগে দিলদার তো জরিনার চোখ দেখেছে। সেখানে বলার ধরনে ইয়ার্কি যেমন আছে, আছে একপ্রকার অনুমোদন, যেন এই মুহূর্তে এসব কথা বলার জন্যেই সে দিলদারকে খুঁজছিল, যেন দিলদার চাইলে তাকে আরও দুটো কথা শোনাতে পারে। রাস্তার ওপার পানের দোকানের সামনে যেতে যেতে সে, দিলদারের কথার উত্তর দিতে বাম হাতখানা দিয়ে দিলদারকে ছুঁতে চায়, হইছে, আমার পানের দাম না দিয়ে তুমি যাতা কোন দুয়ারে?

দিলদার চকিতে তাকাল। হঠাৎ জরিনার গলায় এত রঙ্গ। সে বলে, সেই তো কতা, কোন দুয়োরে যাই, তুমি কি আমার যন্তর ধরা বাতের রুগি?

এবার তাকায় জরিনা। হয়তো দিলদার কথায় এসেছে, সে বুঝতে পারল। উকিল বারের সামনে আর কোর্ট বিল্ডিংয়ের পিছনে ফাঁকা ছোটো এক চিলতে মাঠ হয়ে পথ চলে গেছে সোজা ক্লাব আর পার্কের দিকে, সেখানে ঢুকে পড়ে। জরিনা তখন পানটা মুখে দিয়েছে, হয় খাইয়ে কাজ নেই? ওই যন্তর ধরতি যাবানে?

কেন, কইলে না, অন্য যন্তর ধইরে তুমি ভালো ঝাঁকাতি পারো?

হুঁ। পারি তো।

যদিও এখন পরস্পরের দিকে তাকালেও চোখ দেখা যাচ্ছে না। এ জায়গা আধো অন্ধকার। আজ অন্ধকার খুব মিশমিশে। মেঘলা দিন বলেই অন্ধকারটা গাঢ়ও। একটু পরে যখন পুরোপুরি রাত আসবে, তখন তা আরও গাঢ় হবে। পথে লোকজন সকাল থেকেই কম, এখন আরও কম, তাতে বরং রাত্রির গভীরতা এখনই পথে। মনে হচ্ছে রাত্রির এক প্রহর পার হয়ে গেছে।

জরিনা পার্কের দিকে হাঁটে। সঙ্গে হাঁটে দিলদার। দিলদার কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে, আবার বুঝতে পারছে না, জরিনা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবু, সেদিকে যেতে যেতে জরিনা বলে, চলো পার্কের দিক। দেইহে আসি বেঙ্গা-বেঙ্গি কী করে?

এহেন পার্কে?

চলো বাতাস খাই। পুকুর পাড়ে যে বাতাস।

আইজ যে বাতাস চালাল, তাও বাতাস খাইয়ে হই নেই?

গেলি চলো–

এই যেন দিলদার বুঝতে পারল, জরিনা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এখন এই সন্ধ্যার পর পর পার্কে কী? পার্কের সামনে এসে, দিলদার স্বাধীনতা উদ্যান সাইনবোর্ডখানা পড়ে। তারপর মাঝখানের গেট দিয়ে ঢোকে। জরিনা আগেই ঢুকেছে। বামে রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিং ফেলে একটু সামনে, যুবকেন্দ্রের কোনায় বেঙ্গি তার আলগা চুলায় রান্না চড়ায় প্রতিদিন। এখনও আয়োজন শেষ করেনি। হয়তো বৃষ্টি আসতে পারে এই ভয়ে দেরি করছে। বৃষ্টি যদি আসেই, তাহলে কোনও উঁচু বেঞ্চির নীচে রান্না চড়াবে অথবা রেড ক্রিসেন্টের বারান্দার এই কোনায়। যুবকেন্দ্রে আলো নেই। তার মানে, এখনও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। ভিতরে মোমের আলো।

এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জরিনা কিছুক্ষণ সময় লাগে। সে বুঝে গেছে, কারেন্ট নেই, তাই যুবকেন্দ্রে প্রায় কেউ নেই। পুকুরের ঘাটে বেজি আছে, বাতি ধরাবে একটা বেঞ্চির নীচে। জরিনা বেঙ্গি কী করছে দেখতে যায়। বেঙ্গি চোখ তুলে জরিনার অবয়ব দেখে। একটু পিছনে দিলদার। জরিনা ও দিলদারকে দেখে বেঙ্গি কাজে মন দেয়। যে জানে এখন তাকে কী করতে হবে। জরিনা দিলদারকে গায়ে টোকা দেয়। তারপর রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিংয়ের দিকে হাঁটে। দিলদার হাঁটে জরিনার পিছনে। বেঙ্গি হাতের কাজ রেখে গেটের দিকে যায়।

রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিংয়ের পিছনের কোনায়, সিঁড়ির কাছে পৌঁছে জরিনা উলটো ফিরে দিলদারকে বলে, দেহি তোমার যন্তরটা কীরাম? আমার বাত নামে কি না?

দিলদার যেন এজন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিল।

দেহো- বলে সে জরিনাকে কাছে টানে।

জরিনা বলে, কত দেবা?

কত দিতি হবে?

কও কত দেবা?

তুমি কও—

কুড়ি টাহা। কত লোন দোকানে হোটেলে।

না। দশ– ততক্ষণে দিলদার বসে পড়েছে রেডক্রিসেন্টের সিঁড়িতে। পাহারাদার বেঙ্গি গেট থেকে মাঠের মাঝখানে এসে, অন্ধকারে দুটো শরীর মিশে থাকা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারছে না।

০৯. আকাশের ঘুমোট ভাব

আকাশের ঘুমোট ভাব কাটল আরও দুদিন পরে, আজগরও সেদিন কোর্ট চত্বরে আসতে পারে।

কিন্তু আজগর তার ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া-তুড়া ডাকা বানর দুটো নিয়ে কোর্ট চত্বরে আসলেই-বা কী, সেখানে মানুষজন থাকতে হবে তো। এই দিন তিনেকে, ঝড়-বাদল পরশু দিনের ব্যাপার, তারপর গতকাল গেছে, আর আজ, এই মোটমাট তিন দিনে এই এলাকার যেন অনেকখানিক বদলে গেছে। এখানকার চারপাশের আবহাওয়া এখন অনেকটাই গুমোট। কখন কী হয় তার ঠিক নেই। সর্বত্রই এক চাপা ভাব।

গতকাল আজগরকে দেখতে গিয়েছিল মোসলেম উদ্দিন। আজগর তখন উঠে বসতে পারে। চোখ দুটো কোঠরে ঢুকে গেছে। মুখোনা চিমসে। তাতে পান-তামাকের গুনে পোকায় খাওয়া দাঁতগুলো একেবারেই কেলিয়ে পড়ে। ভাঙাচোরা চেহারার আজগরকে মোসলেম উদ্দিন কেন, কোর্ট চত্বরে মানুষজন আগেও দেখেছে, কিন্তু দেখতে এতটা কাহিল আজগরকে যেন কেউ দেখেনি। এ কী চেহারা হয়েছে আজগরের। মাত্র দুটো দিনের ভিতরে মানুষটা এইরকম কাহিল হয়ে গেল। মোসলেম উদ্দিন চেয়ে চেয়ে আজগরকে দেখে। গলায় জোর আছে ঠিকই, ঠিকমতো দাঁড়াতে পারবে তো ছেলেটা। এরপর খেলা দেখাতে পারবে তো। বান্দর দুটোকে নাচানোর সময়ে গায়ে বল থাকতে হয়, সেই বল আবার ফিরে পাবে?

এই পর্যন্ত ভাবলেও, মোসলেম উদ্দিন এও জানা আছে, এই মুহূর্তে কোর্ট চত্বরের যে অবস্থা তাতে কয়দিনে যে এখানে আবার লোকজন ঠিকঠাক মতো হবে, তাই-বা কে জানে। ততদিনে আজগর নিশ্চয়ই আরও সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই কয়দিন তাহলে খাবে কী? অসুখ হয়ে কত জায়গায় ধার কর্য করেছে তার ইয়ত্তা নেই। যদি সুকুমার যদি খেলা দেখাতে পারত তাহলে হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারত। যদিও গতকাল বিকালে মোসলেম রেল স্টেশনে সুকুমারকে দেখেছে। মোসলেমও গিয়েছিল কাপড় কাঁচার পাউডার নিয়ে। কিন্তু সেখানেও জনমানুষ কিছুটা হলে কমে গেছে। বাসের মালিকরা নাকি লোক লাগিয়েছে, যেন মানুষ বাসেই ওঠে। মাত্র এক ঘণ্টায় সবাইকে নিয়ে যাবে খুলনায়। অর্থাৎ, নদীর এপারের রূপসায়। তারপর তারা যাবে খুলনায়। সেখানে এই ট্রেনে, গরুরগাড়ি মার্কা ট্রেনে দুই ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টায় খুলনায় যাওয়ার কোনও অর্থ আছে? মানুষও যুক্তি বোঝে। তারা বাস মালিকদের কথা শোনে। সদ্য বানানো তেলতেলে সিএণ্ডবি রাস্তা, এই রাস্তায় বাসে ওঠো আর একটানে চলে যাও খুলনা। চোখ খুলতে না খুলতেই রূপসা ঘাট। ফলে, বাস মালিকরা যদি ট্রেনঅলাদের সঙ্গে দেন দরবার করে, ভিতরে ভিতরে ঘুষ দিয়ে ট্রেনটা তুলে দিতে পারে, তাহলে ট্রেন স্টেশনে খেলা দেখানোর যে সুযোগ তাও আর কয়দিন বাদে থাকবে না।

কিন্তু এখন বিষয়টা তো একেবারে অন্য। মোসলেম যা ভাবছিল, যদি কোর্ট চত্বরের অবস্থা এই হয়, তাহলে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আজগরেরই-বা কী হবে। মোসলেম যখন আজগরের ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন সেখানে জরিনা নেই। ঝিলিকও ছিল না। সুকুমারকে একবার দেখছিল, তার কাছে জানতে চেয়েছিল, চা খাবে কি না, তারপর কোন দিকে যে গেল! সুকুমার বড়ো অদ্ভুত ছেলে। মোসলেম আজগরের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে এসব ভাবল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ মন সবই তখন পড়েছিল কোর্ট চত্বরে। আজগর বুঝল, মোসলেম উদ্দিন এখানে থেকেও এখানে নেই। এই বয়সেও লোকটা কাজের। এই বয়সেও লোকটা চলাচলতি সব ভালোই পারে, এখনও দেখো জামা কাপড় কী সুন্দর! এখানের উকিল মোক্তার পেশকার হাকিম ম্যাজিস্ট্রেটরাও এই মোসলেমের মতন ধবধবে জামা কাপড় পরে না। যদিও মোসলেম উদ্দিন তাদেরই মতন একজন ক্যানভাসার। আর সে সারডা জীবন বান্দর নাচাইয়ে এই জীবনে একদিনই এট্টু পরিষ্কার কাপড় পরে সে কোর্টের সামনে যেতে পারে নাই।

আজগর মোসলেমের দিকে চোখের পাতা নাচিয়ে বলল, দেহো কী? এইভাবে চাইয়ে চাইয়ে?

দেখপো আর কী? দেখি তোরে আজগর। তোর চেহারা হইচে কী, কোনও দিন আয়নায় দেহিচিস?

তুমি আছো তোমার ভাবে। বেচে কাপড় কাঁচার পাউডার, মানুষের জামা কাপড় পরিষ্কার করাও, আর আমার মতন বান্দর নাচানো আজগররেও তুমি সুন্দর দেকতি চাও!

সেয়া কইনিইরে ছেমড়া, সেয়া কইনিই, কইচি তুই তোর চেহারাডা বানাইচিস্ কী?

চেহারা তো আগেও এইয়ে ছেল, এহোনও তাই আছে। এয়ার আর ভালোমন্দ কী?

ওরে সেয়া কইনি। শরীলডার অবস্থা করিচিত্স কী? এহেবারে ভাইঙ্গে গেইচে তোর শরীর। তাকানো যায় না।

তাহানো না গেলি তাইয়ো না। তোমারে তাহাইয়ে দেকতি কইছি?

ফাও কতা কইস নে। ফাও কতা কওয়া স্বভাব তোর গেল না।

শোনো, আমরা চেহারা দেখপো কোয়ানদে, আয়না নেই। গোসল করার সময় যে দিন নদীর পানি ভালো পরিষ্কার থাহে, সেদিন নদীর পানিতে চেহারা দেইহে লই।

আবার ফাও কতা কইস?

আজগর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল! চোখ ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খুঁজল সুকুমারকে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ মোসলেম উদ্দিন শোনেনি। কিন্তু কাউকে খোঁজার জন্যে যে চোখ ঘোরাচ্ছে সেটা মোসলেম উদ্দিন বুঝতে পারল। আজগর দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে, যেন নিজের অবস্থাকে মানিয়ে নিতে। অথবা, একখানা আয়নাও না-থাকা নিয়ে নিজের দারিদ্র্যকে বুঝে নিতে, অথবা, এমনিতেই আজগরের অজানিতে বেরিয়ে এসেছে ওই দীর্ঘশ্বাস। এখন সুকুমার এখানে থাকলে ভালো হত। যদি পারত মোসলেম ভাইকে একটু চা খাওয়াত, তার জন্যেও আনত একটু। ওই টিনের মগটাতে আনলেও হত। আজগরের জন্যে ওই টিনের মগে চা-ই সই। সুকুমার তার জন্যে যথেষ্ট করেছে। কদিন আগে তার সঙ্গে যে কথা কাটাকাটি হয়েছে তা মনে রাখেনি। এক জায়গা কাজ করলে অমন মন কষাকষি হয়, আবার তা মিটেও যায়। আজগর যখন এসব ভাবছিল, তখন মোসলেম উদ্দিন বলে, তোর নয় আয়না না আছে; সেই জন্যি জরিনারও আয়না নেই? ও মাইয়েডা নাইয়ে ধুইয়ে চোখে মুখে রংটং মাহে কী দিয়ে?

সের মনে হয় আছে একখান।

তালি সেইহানে নিজের চেহারা একবার দেকলি পারিস?

হইচে। বান্দর নাচানো আজগর তার আবার চেহারা।

এসময় নদীর কূল বেয়ে হাওয়া আসে। বৃষ্টি-বাদল কেটে যাওয়ার পরে এই বাতাস অনেক ঠান্ডা ও শীতল। প্রাণ জুড়ানো। যদিও দুপুরের আগ পর্যন্ত হাওয়া তেমন ছিল না। বিকেল থেকে এই কুলকুলানো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দুপুরে পেট ভরে খাওয়ার পরে এই হাওয়া গায়ে লাগলে সত্যি শরীর জুড়োয়। সুকুমারের সঙ্গে জরিনা আর ঝিলিক আলতাফের হোটেলে খেতে গেছিল, আর তার জন্যে এনেছিল থালাভরতি ভাত, ভেটকি মাছের ঝোল, একটা ছোটো ভেটকির মাথা, ডাল আর পুইশাকের তরকারি। বেশ কয়েকদিন বাদে আজগর আজ পেট ভরে খেয়েছে। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে আজগরের মনে হয়েছিল, সে যেন মায়ের হাতের ভেটকি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাইছে। চোখ ভেজার কথা না আজগরের। অত দয়ামায়া কোনও কালেই ছিল না তার। আজও নেই। তবু মনে পড়ায় পরানের একেবারে গভীর তলানিতে কোথায় যে হাহাকার করে উঠেছিল। কিন্তু এরপর আরও ওকথা মনে করে ভাতের থালায় হাত নামিয়ে রাখতে চায়নি সে। শুধু জরিনার কাছে জানতে চেয়েছিল, এ জরি, এই মাছের ঝোল রান্না করিচে কেডা?”

জরিনা বলেছে, শিউলির মা মনে কয়।

আজগর বলেছিল, আমি ভাবলাম, আলতাফের বউ রান্দিচে নিকি।

তোমার দেহি কোনও হিসেব হল না?

কেন হইচে কী?

খাইয়ে কাজ নেই আলতাফের বউ রানতি যাবে নে! তার এহোন কত পদের ফেনসিয়ান। ছওয়াল-মাইয়ে ইস্কুলে পড়ায়, আর এহোন সে ভাতের হোটেলের রান্ধা রাইন্ধে জীবন শেষ করবে!

ও কথার ওখানেই শেষ। তবে, মাছ-ঝোল-ভাত-তরকারি সবমিলে গড়ানো দুপুরে আজগর খেয়েছিল পেট পুরে। তারপর এখন নদী বেয়ে উঠে আসছে এই কুলকুলে হাওয়া। ঝুপড়ির একপাশে হেলান দিয়ে আজগর বসে আছে। তার গায়ে এই হাওয়ার কতটুকু লাগছে, তাতে অন্য সময় হলে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে যেত। এখন গেল না। এই কয়দিন যে রাম ঘুম ঘুমিয়েছে সে এখন রাত ছাড়া কোনওভাবেই তার চোখে ঘুম আসবে না।

এ সময়, সুকুমার একটা এলুমনিয়ামের মগে চা নিয়ে আসে। হাতে তিনটে ছোটো চা খাওয়ার গেলাস। মোসলেম উদ্দিন একটু অবাক। তাহলে সে আসার একটু পরে ভালো মন্দ কোনও কথা না-বলে সুকুমার যে চলে গেল, এই চা আবার জন্যে।

মোসলেম বলল, চা কোন জায়গা দিয়ে আনলা?

আলম ভাইর ওই জায়গা দে–

তুমি আলমের দোকানও দেহি চেনো।

জরিনাদি চেনোইয়ে দেছে।

মগের চা কাপে ঢালে। কাপ মানে ছোটো সাইজের গেলাস। এগুলোতেই এসব চায়ের দোকানে চা খাওয়া হয়। সুকুমার যখন ঢাকার ওদিকে গেছে, সেখানে দেখেছে, চায়ের দোকানে চা দেয় কাপে, কোনও জায়গায় দেয় গেলাসের গায়ে একটা আংটা লাগানো। আর এদিকে চায়ের দোকানে চা মানেই এইরকম ছোটো ছোটো গেলাসে চা।

চা খেতে খেতে মোসলেম উদ্দিন কথা শেষ করে উঠবে ভাবে। এসেছিল আজগরকে দেখতে। দেখা শেষ। এখন যাবে। আরও ভেবেছিল, জরিনাকে একটু গালমন্দ করবে। কোনওদিকে খেয়াল নেই। এই ঝুপড়ি ঘরটাও তো একটু গুছিয়ে রাখা যায়। তা করবে না। সারাটা দিন গায়ে বাতাস লাগিয়ে ড্যাং-ড্যাং করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবে। খাবে এই আজগরের, থাকবে এই আজগরের সাথে, তারপরও যদি কোনও কিছুর একটু খেয়াল রাখত ওই মেয়ে। মেয়েটার কোনও বোধ হইল না আজও। হবেও না কোনও কালে। সে তুলনায় ঝিলিককে অনেক লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে মনে হয় মোসলেমের। আসলে, এটা গাল দিতে গিয়েও ভিতরে ভিতরে নিজের সামলাল মোসলেম।

মোসলেম উঠবে, আজগর বুঝতে পারে। তা বুঝেছে সুকুমারও। সুকুমার মোসলেমকে নিয়ে সামনের মেইন রোড পর্যন্ত যাবে। যদি মোসলেম নদীর পাড় বেয়ে বাজারের দিকে যায়, তাহলে সেদিকেও যেতে পারে সুকুমার। ঝিলিক বলেছে, বাজারের দিকে গেরে সাগুদানা ও কলা আনতে, আর সুই-সুতো। সুকুমার জানতে চেয়েছিল, কলা কেন? ঝিলিকের সে কি হাসি। কলা কেন? আরে বাজারের করার আড়তের পাশে প্রচুর পচা কলা থাকে, দাম কম, এ কথা যে কতবার বলেছে সুকুমারকে। কতবার আর। সুকুমার কি বান্দরের ওস্তাদ নাকি। তবে ব্যাপার হল, এই বিষয়টা মনে থাকে না জরিনার। ওই অবলা বনের প্রাণী দুটো, কোর্টের সামনে যায় না, আজগরের ওই অবস্থা, তা বলে জরিনা তাদের খাওয়ার দিকে খেয়াল দেবে না।

কিন্তু মোসলেম উঠতে না উঠতেই বলল, কাইল যদি শরীর জুতের ঠেকিস, তাইলে যাইস একবার কোর্টের দিক।

আচ্ছা, যাবানে। কিন্তু যাইয়ে করব কী? উকিল সাবরা সব কোর্ট বাতিল করিচে।

হয়।

এরপর আজগর মোসলেমের কাছে কোর্টের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চায়। মোসলেম বলে। ট্রেন নিয়ে সমস্যা এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। হক উকিল আর মোজাম্মেল উকিলরে তো ছাড়িনি, কাইলকে নাকি আবার সবুর উকিলের উপরও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। তবে তার চেয়েও গুরুতর বিষয় যেটা, বারের সামনে চা খেতে খেতে, ঘুরতে ঘুরতে মোসলেম শুনেছে তাই জানায়। সে বিষয়টা হল, উকিলদের ভিতরে আবার দুই ভাগ, যাগো যাগো ভাই ব্রাদারগো বাসের বিজনেস আছে তারা ট্রেন তুলে দেয়ার পক্ষে। আর যাগো নেই, তারা বিপক্ষে। তয়, হক সাব, মোজাম্মেল সাব আর সবুর সাব প্রত্যেকেই কিন্তু উকিল হিসেবে ভালো, তাগো ওইসমস্ত দেখার কোনও সুযোগ নেই। তাদের কথা হচ্ছে, এতকাল ধরে এই এলাকায় যে ট্রেন চলেছে, সেই ট্রেন কোনও ভাবে তুলে নেয়া যাবে না।

এরপর মোসলেম জানায় এই ঘটনায় ছাত্রদের কী প্রতিক্রিয়া। পিসি কলেজের ছাত্ররা ঠিক করেছিল, ট্রেনের টিটিদের সাথে একদিন টিকিটের পয়সা কালেকশন করবে, তা করেছে। করে দেখিয়েছে, সরকার যে বলে ট্রেনে লস হয়, লস্ কোথায় হয়। তাতে নাকি একদিনের তিন ট্রিপে এত টাকা উঠেছে যে, সারা সপ্তাহে এই লাইনের ট্রেনে এত পয়সা ওঠে না।

এসব জানিয়ে মোসলেম আজগরকে বলে, বোঝ অবস্থা। টিটি সরকারি, ট্রেন উঠাতে চায় সরকার, আবার সরকারেরই বড় গলা। চোরের মায়ের গলা তো বড়ো হবেই।

আজগর তো আজগর, সে এত সমস্ত বোঝে না। তার বোধেও কুলায় না এই হিসেব। জানে, কোর্টের কাছে একদিন তোক না আসলে তার পেটে ভাত নেই। যদি কখনও কোর্টের সামনে খেলা দেখানোর পর গায়ে সয় তো সে যায় রেল স্টেশন। তারপর কোনওদিন দুপুরে কোর্ট বন্ধ থাকলে সে পাড়ায় পাড়ায় বান্দর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তার আগে অবশ্য তার জানতে হয়, সেদিন ইস্কুল ছুটি কি না। তবে তা বুঝতে তার এমন কিছু বেগ পেতে হয়নি কোনও দিন। এই কোর্ট চত্বরের দক্ষিণ দিকে ও বাজারের আশেপাশের বাড়ি থেকে কত ছেলেমেয়ে স্কুলের জামা পরে ইস্কুলের দিকে। যায়। তাই দেখে সে বুঝে নিতে পারে, আজ স্কুল খোলা না বন্ধ।

মোসলেম উদ্দিন এরপর আরও যা জানায় তার কিছু কিছু এই শহরে নতুন হলেও সুকুমার ভালোই বুঝতে পারে। আজগরও বোঝে, কিন্তু সেভাবে মিলাতে পারে না। মোসলেম উদ্দিন জানায়, এই টেরেন তোলা নিয়ে অন্য রাজনীতিও আছে। সেই রাজনীতি আওয়ামী লীগ বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টির। জাতীয় পার্টির সরকার যদি এখন ট্রেনটা এখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে তাদের জিত। ওদিকে আওয়ামী লীগ বিএনপি যদি ট্রেনটা না রাখতে পারে তাহলে তাদের হার। হক সাব বিএনপির নেতা, মোজাম্মেল উকিল আওয়ামী লীগের নেতা, আর সবুর সাব কমিউনিস্ট। জাতীয় পার্টি মনে করে এদের ঠাসা দিতে পারলে শহরের রাজনীতিতে তারা একটু বেশি সুবিধা করতে পাবে।

এই যে বিষয়গুলো আজগরের সামনে বলে গেল মোসলেম, সে এর ভিতরে নিজের হিসেবে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। সে ভাবে, এ সব বোঝাবুঝি দিয়ে তার কাজটা কী?

সুকুমার এক ফাঁকে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা, এইরাম কোর্ট বন্ধ কয়দিন থাকপে?

মোসলেম বলল, আরে কোর্ট কি বন্ধ থাকপে? কোর্টের ভিতরের কাজ চলতি ঠিকই। তলে তলে একটা দফারফা কোনও না কোনওভাবে হবে। সরকারের সাথে সমঝোতা হবে। আর নয় সরকারই বসপেনে আপোষে।

কিন্তু টেরেন তো তুইলগা নিয়ে যাবে! জানতে চাইল আজগর।

না, অত সোজা মনে হয় হবে নানে। পারবে নানে। আবার কওয়াও যায় না। এরশাদ তো এক আজব জিনিস। তার কোনও কিছু ঠিক আছে? কোনও কিছুতে কিছু যায় আসে। আইজ এটা

তো কাইল ওটা।

আজগর বলল, ছলপলরা স্লোগান দিয়ে যায় না, এরশাদ লেখে কবিতা, পিছে আছে ববিতা।

সুকুমার এই স্লোগান শোনেনি। হাসল গলা উঁচু করে। তারপর জানতে চাইল, ববিতা আবার এরশাদের দলে যোগ দিচে নাকি?

না দিলি কয়?

গতকাল এই পর্যন্ত আলাপ হয়েছিল, এমন এক পরিস্থিতির জানা শোনা ছিল আজগরের কাছে। আজ বানর দুটো নিয়ে সে এসে কোর্ট চত্বরে। সুকুমার এসেছে তার আগে। বারিক বুড়োর বইয়ের দোকানের অশত্থ গাছটার নীচে সুকুমার মালপত্তর রেখেছে। ইব্রাহিম শেখ আসেনি। আসবে হয়তো। অথবা, ওই দড়াটানা ঘাটের দিক থেকে খবর পেয়েছে আজও কোর্ট চত্বরের অবস্থা ভালো না। কিন্তু দিলদার এসেছে। আজগর জানে দিলদার আসবে। এমন দিন দিলদারের মতন। পাবলিকের না-আসার কোনও কারণ নেই। তাদের তো অনুমান, তলে তলে গোয়েন্দাগিরি তার কাজ!

বানর দুটো ট্রেজারির পাশে কুল গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে, ফাঁকা চত্বরে দাঁড়িয়ে আজগর একবার চারদিকে নিরিখ করে। এই নাকি কোর্ট চত্বর! লোকজন আছে, আছে ঠিকই, তারা সব এখানকারই। উকিল পেশকার মোক্তার মহুরিরাও আছে। কিন্তু তারা আজগরের বান্দর খেলা দেখবে কেন? যাকে বলে পাবলিক, তা প্রায় নেই। ছাত্রদের একটা ছোটোখাটো জমায়েত উলটো পাশের ডিসির অফিসের সামনে হয়েছে, তারপর তারা চলে গেছে। মুখে মুখে শোনা গেছে, একটু বাদে কলেজের সকল ছাত্র আসবে স্কুল থেকেও বাকি ছাত্রদের নিয়ে, ছাত্রদের দাবি একটাই, এই ট্রেন কোনওভাবে তোলা যাবে না।

বারিকের দোকানের কাছে যখন তারা দাঁড়িয়ে, মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে এসে আজগর আর সুকুমারের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ওদিক নদীর ওপারের মফিজ শেখ এই টেরেন উঠোইয়ে দেয়া নিয়ে গান বান্ধিছে–

এই সংবাদ অবশ্য আজগরের কাছে নতুন কিছু নয়। শহরে নতুন কিছু ঘটলেই মুনিগঞ্জের খেয়ার ওপারের কেশবপুর গ্রামের মফিজুদ্দিন শেখ তা নিয়ে গান বান্ধে। এমনকি দেশে নতুন ঘটনা ঘটলেও। আজগরের আর কতটুকু জানা শোনা এইসমস্ত। এ বিষয় ভালো জানে মোসলেম উদ্দিন আর বারিক বুড়ো।

মোসলেমের মুখে একথা শোনার পরে বারিক বুড়ো তার তন্দ্রা তার প্রতি মুহূর্তের তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ দুটো আলত খুলে মোসলেমের দিকে তাকায়। মোসলেম হাতের লাঠিখানা একপাশে রেখে সুকুমারের বাক্স-পেঁটলার উপর বসে। বারিকের সঙ্গে তার চোখ চোখি হয়। তাদের প্রায় সমবয়েসি এই মফিজ শেখ, লতায় পাতায় জড়িয়ে মোসলেমের জ্ঞাতি ভাই। একেবারে বেবোধ এক মানুষ। হাট-বাজার-গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়। এ নিয়ে তার একপ্রকার অহংকারও আছে। সে অহংকার মফিজ করতেও পারে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে দেশের হাটে মাঠে ঘাটে সবখানে গলায় গান অথবা ছড়া কবিতা নিয়ে না ঘুরেছে। তার বই শহরের প্রেসের মালিকেরা অল্প পয়সায় ছাপিয়ে দিয়েছে। সেই পাতলা চটি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়ত মফিজ। লঞ্চে, ট্রেনে, বাস স্ট্যান্ডে, মাঝি ঘাটে বেচত। পড়ে শোনাত। মানুষকে বলত, সে পল্লিকবি।

মফিজের কবিতা লেখা, আর তা ছাপিয়ে বিক্রি করা নিয়ে মোসলেম আর বারিকের আলাপ শুরু হলে আরও জানা যায়, মফিজ শেখ সাহেবের ছয় দফা নিয়েও কবিতা লিখেছিল। তাই শুনেছিল তখন সবাই। এই কোর্ট চত্বরে কত মানুষ যে গোল হয়ে মফিজের কবিতা শুনত। শেখ সাহেব সে সময় ইলেকশনের জন্যে আসলে, সেই পাকিস্তান আমলে মফিজ ছয় দফার উপর কবিতা শুনিয়ে পাঁচশ টাকা পেয়েছিল। সেকথা দেশ স্বাধীনের পর নিজের পাউডারে টাকার ময়লা পরিষ্কার করতে করতে মোসলেমও কতজনকে বলেছে। বারিক এই গাছের নীচে কত কত দিন কত বার বেচেছে মফিজ শেখের বই।

সুকুমার চেনে না মফিজ শেখকে, আজগর চেনে। কিন্তু মোসলেম আর বারিকের ঝুলিতে থাকা এই ইতিহাস তাদের জানা থাকার কথা নয়। তবে, কিছুদিন আগে এরশাদকে নিয়ে কবিতা লিখলে মোসলেম যে মফিজকে গালমন্দ করেছিল, সেকথা আজগরের মনে আছে। আজগর এখন তা আর তুলল না। জ্ঞাতি ভাইকে নিয়ে এখন মোসলেম উদ্দিন বেশ আমোদে আছে। থাকুক, যখন ওপাশের বারের সামনে দেখে এসেছে, নিশ্চয়ই এখনই চলে আসবে।

তাই ঘটে। হাতে ছাপানো পাতলা এক দলা কাগজ। চাইলে লিফলেটের মতন হাতে হাতে বিতরণ করা যায়। কিন্তু তা করলে মফিজ শেখের পেটে ভাত উঠবে না। এগুলোর কিছু দিয়ে যাবে বারিকের এখানে, বারিক বেচবে। কিছু থাকবে মফিজ শেখের হাতে, ছাত্রদের দেবে। ছাত্রদের মাঝে বিক্রি করবে। তার কবিতার কদর যদি কিছু বোঝে এই ছাত্ররাই বুঝবে। বারিককে দিয়ে, তারপর গুনে নিতে বলে মফিজ শেখ প্রায় এক নিশ্বাসে বলে যায়, কাইলকে যাব কলেজে। কলেজের ছাত্ররা যা কেনবে, তাতে ছাপার খরচ উঠে যাবে।

তবে মফিজ শেখ সঙ্গে একথা জানাতে ভোলে না, এইসব ছাপার খরচ কোন উকিল, কোন ডাক্তার সাব, অর্থাৎ কোন কোন নেতা তাকে দেয়ার কথা বলেছে। যদিও বারিক বুড়ো আর মোসলেমের কাছে সেকথার তেমন গুরুত্ব নেই। কারণ, এমন কথা আগেও অনেক সময় অনেকে মফিজকে দিয়েছে, পরে তাদের কাউকে আর খুঁজে পায়নি। তখন ধরনা দেবে এই বারিকেরই কাজে। কয়ডা বিক্রি হইছে, দেবে নাকি সে বাবদ কিছু পয়সা।

মফিজ এক তোড়া কাগজ বারিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, গুইনে দেহে, এই জায়গায় শ খানেক আছে। আরও লাগলি আইনে দেবানে।

বারিক বলল, এতেই হবে নে। আর লাগবে না। আজকাল মানুষ বই পড়ে না?”

মফিজ শেখ উলটো ঠেলা দেয়, রাইহে দে, এবারের কবিতা ভালো হইছে। জীবনে তো এরাম বই কম লিহিনি। তা প্রায় ষাইট সত্তরখান তো হবে।

মফিজের উঁচু গলার এসব কথা, ঘটনার উত্তেজনা–সব মিলে অশত্থ গাছতলায় খানিকটা জমায়েত। এর ভিতরে যদি এখন মফিজ শেখকে এভাবে থামিয়ে দেয় বারিক তা সে শুনবে কেন? সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে তারপর বারিককে বলে, পইড়ে দেখ হইচে কীরাম এবার।

এরপর বারিককে আর পড়ার সময় না দিয়ে নিজেই মাত্র একবার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর বলে যেতে থাকে :

শোনেন শোনেন শোনেন, শোনেন দিয়া মন,
ও বাগেরহাটবাসী, আর থাকপে না টেরেন।।

আশেপাশে মানুষের আগ্রহ খেয়াল করে। মফিজ শেখ আরও জানায় :

এইবার বুঝি ছুঁইটে গেল রেললাইন–
নিয়ে গেল আমাগোর মেলা দিনের পেরেম ॥

তারপর তার রচিত এই চারটি পদের সঙ্গে জুড়ে দেয় অনেক অনেক দিন ধরে এই অঞ্চলে ট্রেন নিয়ে প্রচলিত আরও দুটো লাইন :

রেলের গাড়ি কলে চলে রূপসা হইতে বাগেরহাট।
গড়গড়াইয়া চলে গাড়ি লাট সাহেবের ছাতির বাট ॥

এ লাইন দুটোও হয়তো কোনও লোককবিরই রচনা। সেকথা জানে না মফিজ শেখ। জানে না। এখানকার কেউ। তারা একদা এই ট্রেন নিয়ে এমন লোকগান শুনে এসেছে। আজ সেই ট্রেন এখান থেকে উঠে যাচ্ছে, তা নিয়ে মফিজ শেখও এই লাইনগুলো সবাইকে শোনাচ্ছে। হয়তো একদিন এই ট্রেন উঠে যাবে, ছাত্রদের জনতার এলাকাবাসীর কোনও প্রতিরোধ কাজে আসবে না, অথবা এ নিয়ে প্রতিরোধে সামিল হওয়ার থাকবে না কেউ, তখন এমন পল্লিকবি মফিজ শেখের এই পঙক্তিগুলোও প্রয়োজনীয় মনে হবে। যেমন, এই ট্রেনের সারাটা কাল ধরে গড়গড়িয়েই চলেছে ব্রিটিশ লাট সাহেবের ছাতির বাটেরই মতন। এর বেশি কোনও গতি তার কোনওকালে আসেনি। আজও আসেনি, পাকিস্তান গেছে, বাংলাদেশেও গেছে দেড় যুগ। লাটের ছাতি নেই, তাই গড়গড়িয়ে চলে সে এক গরুর গাড়িরই মতন। তাকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে কতজনের কত পদের আয়োজন, তা মফিজ শেখ তার গান দিয়ে এখন কী করে আটকাবে।

যদিও ছাত্ররা অত শত জানে না। তারা জানে, কলেজে আসতে তাদের প্রয়োজন এই ট্রেন। তাই তারা আন্দোলনে শামিল। নেতাদেরও কেউ কেউ, কারণ এই সরকারবিরোধী তারা, সরকারের সিদ্ধান্তও ঠিক নয়। কিন্তু তারা অনেকে এও জানে, তাদেরই আত্মীয়স্বজন অনেকেরই বাসের ব্যবসার উন্নতি হবে। বাস মালিক সমিতি তাদের দূরের কেউ নয়।

প্রচলিত লাইন দুটো শোনাতে না শোনাতেই, ছাত্রদের একটা বড়ো মিছিল ডিসির অফিসের দিকে আসে। মিছিলটি খুব জঙ্গি, এই অর্থে ছাত্ররা প্রায় দৌড়ে এসেছে যেন। ডিসি সাহেবকে এখনই তাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। স্লোগানে জানাচ্ছে তারা, যদি আটক নেতাদের কিছু হয়, প্রতিটি ঘরে আগুন জ্বলবে। তারা জেলের তালা ভেঙে হক, মোজাম্মেল আর সবুরকে বের করে আনবে। আর এরপর একজন বক্তা জানাচ্ছে, যদি এই রেল তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে শেষ ট্রেন যাওয়ার আগে তারা রেল পাটির ওপর শুয়ে আত্মাহুতি দেবে। তার ভিতর দিয়ে এরশাদ শাহির পতন হবে। সঙ্গে সঙ্গে রেলের স্লোগানের সঙ্গে ছাত্রদের একাংশ এও জানায়, এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি!

অশত্থ গাছতলা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে উলটো তাকালে ডিসির অফিস। মফিজ শেখ হাতের লিফলেট মতন কবিতাগুলো নিয়ে সেদিকে ছোটে। বাকিরাও ওদিকে তাকিয়ে। সেখানে প্রচুর পুলিশ। ছাত্ররা উত্তেজিত। যদিও সবারই জানা আছে, অন্তত বোঝেও, ছাত্ররা এখানে কিছু করবে না। যদি তেমন কিছু করে তো রেল স্টেশনে। এখানে নয়।

ছাত্ররা কিছুই করে না, তাও-বা কী করে হয়। ডিসি অফিসের সামনে থেকে উঁচু গলার শব্দ আসে। কথা কাটাকাটি ভেসে আসে। মোসলেম কিংবা বারিক ডিসিকে চেনে, আজগরও এক আধদিন তাকে দেখেছে। তারা জানে, এই লোক তার সুন্দর কথা দিয়ে ছাত্রদের বোঝাতে পারবে।

ছাত্রদের ওই জমায়েত থেকে দিলদার এখানে এসে জানায়, ছাত্রদের দাবি শুধু ট্রেন নিয়েই না, তারা জানতে চায় উকিলদের ছাড়বে কবে। এই দাবি তো তাদেরও। এই উকিলরা নেতা মানুষ। উকিলদেরও নেতা, তাদের ছাড়লে কোর্টও সচল হবে। কোর্টের সবচেয়ে বয়েসি উকিল নারায়ণ বাবু নাকি হুমকি দিয়েছেন, যদি তাদের না-ছাড়া হয়, তাহলে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোর্টে কোনও কাজ হবে না।

মোসলেম উদ্দিন এই শোনে আর সরু চোখে দিলদারের দিকে তাকায়। দিলদার জানে, এটা মোসলেম উদ্দিনের স্বভাব। এই লোক কোনও দিন যেন দিলদারকে দেখতে পারে না। সব সময়ই দিলদারের কথায় তার সন্দেহ। কিন্তু এতই যদি সন্দেহ, তাহলে গিয়ে দেখে আসলে পারে ওই জায়গায় ছাত্রনেতারা ডিসিকে এইসব কথা বলছে কি না?

এ সময় জরিনা আসে। মুখোনা বিষণ্ণ। আসতে আসতে, এখানে দিলদার দাঁড়িয়ে আছে দেখেও তার মুখের বিষণ্ণ ভাব কোনওক্রমেই কাটে না। কাটার কোনও কারণ নেই। দিলদার আছে থাকুক। যদিও দিলদার জরিনার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। জরিনা তার উত্তর দেয়নি। আর এমনভাবে তাকিয়ে মুচকি হাসা তো সব সময়ই তাদের ভিতরে বিনিময় হয়, এ নিয়ে আজগর-বা আর কারও বাড়তি খেয়াল দেয়ারও কোনও প্রয়োজন নেই।

জরিনা সুকুমারকে খোঁজে। আজগরের কাছে সুকুমার কোথায় জানতে চায়। চারপাশের পরিস্থিতি অনুযায়ী আজগর নীচু গলায় জানায়, এইমাত্র সুকুমার এখানেই ছিল, আছে আশেপাশে। মনে হয় পান-বিড়ি খেতে গেছে।

জরিনা চারদিকে তাকায়। পান-বিড়ি খেতে গেলে, ডিসি অফিস কিংবা চত্বরের ওপাশে কোর্টের দিক থেকে সুকুমারের আসার কথা নয়। আসবে পিছনের মেইন রোডের দিক থেকে অথবা একটু ডান দিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের ফাঁক গলে। জরিনা সেদিকে উল্কণ্ঠিত চোখে তাকায়। সে তাকানোয় আজগর উঠে জরিনার কাছে আসে, কী হইচে? তোরে এইরাম দেখাতিচে কী জন্যি!

জরিনা একটু যেন হতবিহ্বল। সে আজগরকেও বলতে চায় না কিছু, এমন তার চোখ। বলে, সুকুমার ভাই গেল কোতায়? তারে লাগবে

কেন, হইচে কী, আমারে ক–

ঝিলিক মনে হয় চইলে গেল। চইলে গেইচে হাহাকার করে ওঠে জরিনার গলা। ঝিলিক চলে গেছে কথাটা সে কষ্টে একাকার মুখে বলল সে। জানাল, ঝিলিককে আটকাতে পারেনি। কিন্তু এখন আজগরের কাছে কোথায়, কখনও, কেন এমন কোনও প্রশ্নও শুনতে চায় না।

আজগরের চোখমুখও ভ্যাবাচেকা দশা, কোথায় গেল? কোন দিক?”

সেয়া তুমি জাইনে করবা কী?

কেন?”

এই শরীরে তুমি এহেন কোথায় খুঁজদি যাবা? মাঝিঘাটা, বাসস্ট্যান্ড না রেল স্টেশনে? কোনদিক গেইচে, কোথায় যাবে আমারে কিছু কইয়ে যাইনি। আলতাফের হোটেলের সামনে দেহি নিজের একটা মোলা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়াইয়ে রইচে। আমি সামনে আসতিই কল-

জরিনা থামে। মেইন রোডের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, সদ্য অসুখ থেকে ওঠা আজগরকে এ সব বলা অর্থহীন। এই শরীরে যদি মানুষটা এখন ঝিলিককে খুঁজতে রওনা দেয়। জরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে টাইপিস্টদের ছাউনির দিকে তাকায়। ওখানেই সুকুমার আছে, কিন্তু জরিনার চোখে পড়ল না। কারণ, এসময়ে ডিসি অফিসের সামনে থেকে ছাত্রদের সমবেত স্লোগান আসছে। নিশ্চয়ই তাদের কোনও দাবি মেনে নিয়েছে। অথবা, জানা গেছে কাউকে আজই ছেড়ে দেয়া হবে। জরিনা এসব বোঝে না। তার জানার কথা না। কোর্ট এখন স্থবির, এই অবস্থায় দিন চলতে পারে না, এমন হলে তাকে দিলদার কেন, অন্য মানুষ খুঁজতে হবে। অথবা সন্ধ্যার অন্ধকার পড়লে ঘুরঘুর করতে হবে ট্রাফিক ব্যারাকের সামনে। যদি তাকে কোনও পুলিশ ওই শুকলাল সংগীতের পিছনে নিয়ে যায়। আর নয়, সারাটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দিতে হবে বেঙ্গির সঙ্গে, যদি বেঙ্গি তার জন্যে পার্কে অথবা অফিসার্স ক্লাবের পিছনে কোনও খদ্দের নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এসব চায় না জরিনা। আজগর কাবু-কেতরা, আজগরের আয় রোজগার নেই, তবু সে আজগরের সঙ্গেই তো থাকে। আজগরই তার সব। সেই আজগরের চোখ এড়িয়ে এভাবে দুটো ভাতের জন্যে এইসব! নিরুপায় জরিনার ভিতরে হাহাকার করে ওঠে, সত্যি তার ভালো লাগে না।

আজগর উদ্বেগজড়ানো চোখে বলে, কী কইল?

কল, জরিনাদি তোমার ভাইরে কইয়ো আমি চইলে গেলাম।

কোতায় গেল?

সেয়া তো জানি না। আলতাফের হোটেলের কোনায় ওই পানের দোকানের সামনে দাঁড়ানো ছেলে একখানা রিকশা, আমি কিছু জিগানোর আগে রিকশায় যাইয়ে লাফ দিয়ে ওটল!

আজগর জরিনার মুখে তাকায়, গেল কোন দিক?

কী কইরে কব? কলাম না, সোজা মাঝিঘাট গেল না, না ডাইনে ঘুইরে রেল লাইনের দিক না সেইহেন দে বাস স্ট্যান্ডে আমি আর রিকশাখানা ঠাওড় করতি পারিনি।

আজগর পারে তো এখনই রওনা দেয়। জরিনা বলে, তুমি আবার যাইয়ে না। এই শরীর লইয়ে রোদ্দুরে ঘুরলি আর থাকপা নানে। এহেবারে কেতরাইয়ে যাবানে।

তবু যেন আজগর রওনা দেয়। ওই জায়গায় থেকে ট্রেজারির পাশে তার বানর দুটোর দিকে দেখে। সে দুটো ছায়াতেই আছে। দড়ি একটু লম্বা করে দেয়ার পাশের আতা গাছটার তলায় ঝিমুচ্ছে। এই কোর্ট-কাছারি, এই স্থবিরতা, তাদেরকে কলা দেওয়া ঝিলিক–কোথায় কি ওলোট পালট হল, অবলা প্রাণীর সে খোঁজ জানার কথা নয়। তার চেয়ে, বেশ কদিন পরে এই পরিচিত চত্বরে আসতে পেরে দিব্যি আছে। এখন আতা গাছটার নীচে ছায়াও বেশ। সেখানে তারা বুড়া বুড়িও নয়, জোয়ান নয়, শ্বশুরবাড়ি কি রান্নাঘরে কোথাও কারও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। একদল মানুষের সামনে কোনও ছদ্ম ভালোবাসাও তাদের প্রদর্শন করতে হচ্ছে না। বরং, এখনকার এই তন্দ্রা অনেক নিরাপদ!

এখন ঝিলিককে খুঁজতে গেলে আজগর যে কেতরে-কাহিল হবে, তা সে নিজেও জানে। জরিনা বললেও সে যেতে পারত না। এই কোর্ট চত্বর পর্যন্ত আসতেই তার হাঁটুগুলো অসহযোগিতা করছে। দাঁড়াতে ভালো লাগে না। তবু এসেছে। যদি মানুষজন আসত, তাহলে খেলা দেখিয়ে দুটো পয়সা পেত। আলতাফের কাছে বাকি, হাফেজের রুটির দোকানে বাকি, হাফেজের বউ লালি পয়সা না পেলে দিন দুই বাদে কথা শুনাইতে ছাড়বে না।

এখন না-গেলও আজগর কিন্তু জরিনার কাছে এটা তো জানতে চাইতে পারে, গেল কেন ঝিলিক?

জরিনা বলল, ওরে সেয়া তো আমারে কইয়ে যায়নি।

কানদিচে নাকি?

চোখ এট্টু ভেজা।

মোড়েলগঞ্জ না কোন জায়গায় গেইল কয়দিন আগে, সেইহেনে গেল নাকি?

তোমার যা কতা, লি ওইভাবে কইয়ে যায় যে, তোমার ভাইরে কইয়ো, আমি চইলে গেলাম।

হয়।

তোমার বোধ হল না কোনও কালে। বাল তোমার সাতে থাকপে কোন বিটি। বাল বোঝে কিছু? আমি বুইলে থাইহে গেলাম।

থাকতি কয় কার বালে? থাহিস না। চইলে যা, যেহানে মনে চায় চোদাইয়ে আয়—

ফাও কতা কইয়ে না দিন। তোমার চেটের ফাও কতা শুনতি শুনতি জীবনডা গেল।

সত্যি, এই মুহূর্তে এসব ফাও কথা। একথা তর্ক বা ঝগড়া করেও বলা না। পরস্পরের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা। এর মানে আজগরের শরীর খানিকটা ভালো, গলায় অন্তত প্রকৃত আজগরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। দিন দুয়েকের ভিতরে লোকটা আরও চাঙা হবে নিশ্চিত।

আজগর জরিনার কাছে নিজেদের কথায় ফিরে আসে, দুইজনের এই কয়দিনে ঝগড়া করতি দেহিচিস?”

না। সেয়া করার মানুষ তারা না। সামনে তো করবে না। আলতাফের হোটেলে রাত্তিরে ঘুমোনোর সময় করিচে নিকি?

আলতাফের কিছু জিগোইচিস?

কী জিগোব?

এই যে?

এইয়ে মানুষের ঢোল দিয়ে জিগোন যায়? তুমি যে কী? তাছাড়া ওরা সম্পর্কে কী তা তুমি আর আমি ছাড়া অন্য মানুষ জানে নাকি?”

না, তা জানে না।

তালি?

আজগরের কাছে সত্যি এর কোনও জবাব নেই।

এই সময়ে টাইপিস্টদের ছাউনির বাইরে সুকুমারকে দেখতে পেল জরিনা। উঁচু গলায় ডাকল, ও সুকুমার ভাই?

সুকুমারের হাতে মফিজ শেখের ট্রেন নিয়ে লেখা পদ্যখানাসহ আরও-একটা কাগজ। এটা ট্রেন তুলে নেওয়া নিয়ে ছাত্ররা বিলি করেছে। তার একখানা সুকুমারের হাতে। একমনে পড়ছিল। জরিনার ডাক প্রথম বারে শুনল না। তারপর শুনে তাকাতেই দেখে, তার দিকে উৎকণ্ঠিত মুখে তাকিয়ে আছে আজগর আর জরিনা।

সুকুমার তাদের দিকে এগিয়ে আসতে, মাঝখানের রাস্তাটা প্রায় দৌড়ি পার হয়ে জরিনা বলে, ঝিলিক বুন্ডি কোথায় জানি চইলে গেইচে, ও সুকুমার ভাই!

সুকুমার কিছুটা বিস্মিত কিছুটা জেনে জানত এমনভাবে বলল, চইলে গেইচে? কহোন?

কেন তুমি জানতা?

না, জানতাম না।

তালি, কলা যে কহোন?”

কাইল কতিল, লালির ওইহানদে আসার সময়, একজনরে পাইচে, যে ওর স্বামী মানে আমার সেই দাদারে চেনে। জানে ওর ছওয়ালডা কোতায় আছে। ওর এহোন ছওয়ালডারে দেকতি মন চায়।

চায় তো ভালো কতা। সব মায়েরই চায়। তার এহেন কোতায় গেলি ছওয়ালরে পাবে, তারা তো থাহে ইন্ডিয়ায়। সে কি এই জায়গায়?

সেয়া তারে বুঝেইয়ে কয় কেডা? উপরদে দেখিচেন ঠান্ডা, আসলে ভিতরে ভিতরে মাইজে বউ ভীষণ ঘাউরো। কেউর কথা শোনে না। পরশু দিনদে মনে হইচে চইলে যাবে, আইজই হাঁটল।

তা তো বোঝালাম, তা যাবে কোয়ানে?

এহোন নাকি যাবে ফুলতলা। যার সাতে কথা হইচে সে ফুলতলায় থাহে, সেই জায়গার ঠিকানা দিয়ে গেইচে।

তারপর?

তারপর আর কী, সেই ফুলতলার বিটি সাতক্ষীরার ওই জায়গা দে ওপার নিয়ে যাবে। সেই জায়গা বশিরহাট না কী কয় কোন জায়গা নাকি ধারে—

সুকুমারের এ সব কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিল না। গেছে গেছে। যেমন হঠাৎ এসেছিল সেভাবেই চলে গেছে। আবার কোনওদিন দেখা হবে তারই-বা নিশ্চয়তা কী? একবার একবার এই কথা ভেবে সুকুমার উদাস হতে পারে। এখন অবশ্য তার কিছু ঘটবে। এই চত্বরে আজও তার আসর বসানোর সুযোগ নেই। আলতাফের কাছে ঋণ। এর ভিতরে ছিল ওই কথা কওয়ার মতন। একটা মানুষ, সেও চলে গেল। কেন গেল, সেকথা তো সে চাইলে সব জরিনাকে বলতেও পারবে না।

তবু জরিনা যেন সেই কথাই জানতে চাইল, তোমাগো মদ্যি বাদাবাদি হইচে নিকি?

দেখো জরিনা প্রায় আসল প্রসঙ্গে চলে আসছে। সেদিকে যাবে না সুকুমার। এখন একবার ডিসি সাবের অফিসের সামনে যেতে পারলে হত। ছাত্রদের ভিড় পাতল হয়ে গেছে। নেতাদের নিয়ে মিটিং হচ্ছে। পরে কী সিদ্ধান্ত হয়, জানা যাবে।

সুকুমার বলল, না, কোনও বাদাবাদি হইনি—

তালি যাও এহোনই ফিরোইয়ে নিয়ে আসো। যাওয়ার সময় দেখলাম, চোখ দুটো ভরা পানি নিয়ে গেল।

কী যে কও, এহোন গেলি আর পাবানে?”

অন্তত জানো যহোন খুলনো যাবে, তালি টেরেনের ওই জায়গায় যাইয়ে দেহহা, পাইয়ে যাবানে মনে কয়–

কী যে কও না? কহোন গেইচে। এহোন আবার পাওয়া যাবে নিকি?

তবু যাও।

জরিনার পিড়াপিড়িতে সুকুমার রেল স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। যাবে হেঁটেই। তাতে ততক্ষণে ট্রেন হয়তো চলে যাবে। তার ঝিলিককে ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে না। তবু সুকুমার জানে না কেন যাচ্ছে।

যে কথা হয়েছিল তার সঙ্গে ঝিলিকের তা অতি তুচ্ছ। এমন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে ঝিলিকের চলে যাওয়া পর্যন্ত গড়ানোর কথা না। কিন্তু ঝিলিকই সেখানে নিয়েছে। কথার মাত্রা এত দূরে ছাড়িয়ে গেছে যে সুকুমার বলতে বাধ্য হয়েছে, তোমার যা ইচ্ছে করো।

লালির-হাফেজের রুটির দোকানে ব্ল্যাকে শাড়ি-বেচা যে মহিলার সঙ্গে ঝিলিকের দেখা হয়েছিল, তার কোনও কিছুই পছন্দ হয়নি সুকুমারের। ঝিলিকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। ঝিলিক রুটির দোকানের বাইরে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তার দেবর। তারপর এই পথটুকু আসতে আসতে ঝিলিক জানায়, ভরত কোথায় আছে ওই মহিলা জানে।

তুই জানো, ওই বিটি ফুলতলার কোতায় থাকে?

হয়, খুলনায় ওর বোনের বাসায় আসত।

আচ্ছা, তালি তুমি যে যাবা, ভক্তদা তোমারে নেবে। সে তো অন্য মানুষ নিয়া থাহে।

যাইয়া তো দেহি–

সে সময় এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সুকুমার। কথা মুলতবি রেখেছিল, পরে বলবে। রাতে আলতাফের হোটেলে শুয়ে সুকুমারের গলার স্বর নামিয়ে, এমনকি আলত করে ঝিলিকের মুখমণ্ডল ছুঁয়ে বলে, মাইঝে বউ, তুমি যাইয়ে না। আমি একলা মানুষ, এ জায়গায় ও জায়গায় ঘুরি–তুমি সাতে থাকলি তবু একজন মানুষ থাকল, ফিরি আইসে চাইরডে কতা কওয়ারও একজন মানুষ হয়।

সবই বুঝি, কিন্তু আমারও তো ছওয়ালডারে দেকতি ইচ্ছে করে।

আমরা নয় ফাঁকে একবার যাবানে—

হয়, আর গেইচি—

থাইয়ে যাও।

সুকুমারের এই আকুতির উত্তরে ঝিলিক হঠাৎ না– বলে একেবারে যেন খেঁকিয়ে উঠল, যাই, চইলে যাব। তোমার ধারে থাকলি মানষি কবে আমি তোমার বান্দা মাগি!

কী ফাও কথা কও! মুখটুকু ঠিক আছে? অন্য পাশে মানুষজনও থাকতি পারে।

ফাও কত না, কও দেহি, আমি তোমার বান্দা মাগি ছাড়া আর কী।

বাদ দেও।

কাজ নেই, কাম নেই। উনি সারাদিন খেলা দেখাইয়ে ফিরে আসপে, আমি পা ফাঁক কইরে ওনার জন্যি শুইয়ে থাহি!

সুকুমার শোয়া থেকে উঠে বসে। মেজো বউর মাথা পাগল হয়ে গেল নাকি। নাকি ছেলের শোকে মাথা খারাপ। এসব কী বলে। ফাঁকা জায়গায় পরে রাস্তার দিকে এই দোতলায় যে বাড়তি জায়গা সেখানে এসে দাঁড়ায়। একবার ভাবে নীচে নেমে যাবে। কিন্তু এখন এই রাতে নীচে মেসিয়াররা শুয়ে আছে। সামনের দরজা বন্ধ। সুকুমার খুপড়ির সামনে এসে ঝিলিককে বলে, তোমার যে জায়গায় মন চায়, চলে যাও। আমি তোমারে আটকাব না।

আচ্ছা, ভালো হইছে।

আর এই জায়গাদে আমিও চইলে যাব, ফিরি আসলিও পাবা না।

কোথায় যাবা?”

তা জানি না।

এসব কথা একটু আগে জরিনাকে বলল না সুকুমার। তবে তার হেঁটে রেল স্টেশন আসতে আসতে ট্রেন ছেড়ে গেছে। তাহলে ছাত্ররা আর ট্রেন আটকাবে না, আজকের মতো চলেছে। ঝিলিক এতক্ষণে নিশ্চয়ই কলেজ স্টেশন পর্যন্ত চলে গেছে। আরও দূরেও যেতে পারে।

সুকুমার রেল স্টেশন থেকে নদীর কূলে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে ফিরে আসেবে আজগরের ঝুপড়ির সামনে। ততক্ষণে নিশ্চয় অন্ধকার হয়ে যাবে। এখন তার কিছু ভালো লাগছে না। এই পথটুকু হেঁটে আসতে আসতে সুকুমার সিদ্ধান্ত নিল, সেও চলে যাবে!

১০. চারদিকে ঝকঝকে রোদ

পরের দিন সকাল থেকেই চারদিকে ঝকঝকে রোদ। আবহাওয়ার যেমন, কোর্ট চত্বরেরও থমথমে ভাবও কেটে গেছে। বারিক বুড়ো তার বইপত্তর সাজিয়ে নিয়ে বসেছে। আজ সবার আগে চত্বরে মজমা মিলাবে মোসলেম উদ্দিন। এই কদিনে প্রকৃতিতে যেমন ময়লা আবর্জনা, মানুষের জামা কাপড়েও তাই। ফলে, তার পক্ষে এই নিয়ে একটা সহজ ভাষণ দিয়ে কাপড় কাঁচার পাউডার বিক্রির এখন মোক্ষম সময়। তাই তো হওয়া উচিত। তাছাড়া, আজগরের শরীর সবে সেরেছে, সে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। তার নাস্তা খেয়ে আসতে আসতে একটু সময় লাগে। ইব্রাহিম শেখ কাল আসেনি, আজ আসলেও আসবে একটু দেরি করে। তাহলে সুকুমার আসরে নামবে মোসলেম উদ্দিনের পর পর। তাই সই। এই হিসেব।

এদিকে অন্যান্য যে সব খবরে চত্বর চনমনে, তা যেমন সবাই জানে, জানে বারিক আর মোসলেম উদ্দিনও। টাইপিস্টদের চত্বরেও তা নিয়ে আলাপ। এমনকি দিলদারও খবরাখবর এনেছে কিছু। তাতে সবার উৎকণ্ঠিত ভাব কিছুটা কম। আজ সকালেই আটক নেতাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হক আর মোজাম্মেল উকিল আজ কোর্টে না আসলেও তাদের সহকর্মীরা তাদের পক্ষে কোর্টে উঠবে। এদিকে ছাত্ররা আজ আর মিছিল বের করেনি এখনও, যতদূর জানা গেছে তারা তা করেবে না। নয়টা নাগাদ কলেজ স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। স্টেশন মাস্টার তাদের জানিয়েছে, এখন থেকে মেইল ট্রেনও কলেজ স্টেশনে দাঁড়াবে। ছাত্রদের দাবি বলে কথা।

কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে, তাতে সবাই আনন্দিত, আপাতত ট্রেন তুলে নেওয়া হবে না।

এ নিয়েও আলমের চায়ের দোকান, বারের সামনের পানের দোকান, সবখানেই আলাদা আলাদা হিসেব। যে যাই বলুক ট্রেন আর কোনওদিনও আগের মতন চলবে না। এখন কোনওদিন ষাটগম্বুজ স্টেশনে এসে ট্রেন পড়ে যাবে। কোনওদিন সকালের ট্রেন সময়মতো অফিসে ধরার জন্যে রূপসা স্টেশনে গিয়ে পৌঁছবে না। কোনওদিন লাইনচ্যুত হয়ে সারাদিনের ট্রেন বসে থাকবে। এরপর একসময়, আবার বাস মালিকদের চাপে সত্যি সত্যি ট্রেন তুলে নেওয়া হবে।

যদিও এই সবই ভবিষ্যতের কথা। এখন সে হিসেব মিলিয়ে কোনও লাভ নেই। এখনকার হিসেব এখনকার মতো। এখন যে ট্রেন ছেড়েছে, তাতে তাদের মতো ক্যানভাসারদের পেটের ভাত থাকল। কোর্ট কাঁচারি আপাতত আর বন্ধ হবে না। বারিক প্রতিদিন সকালে এসে বসতে পারবে। পাউডার বিক্রি করে, বাজার সদাই শেষ করে আগামী দিনের জন্যে পাউডার বানানোর জিনিসপত্তর কিনতে পারবে মোসলেম উদ্দিন। আলেকজানের কয়দিন কোনও কাজ ছিল না। মোসলেমের পাউডার বেচার কোনও সুযোগ নেই তো আলেকজানের হাতে কাজ থাকে কী করে।

তাহলে, এই কদিন বাদে, এখন মোসলেম উদ্দিন আবার প্রস্তুত। একটু বাদে নামবে সে। এর আগে চা খেয়ে এসেছে। মুখে দিয়েছে পান। একটা বিড়ি ধরানোর কথা ভেবেছিল, ধরায়নি। বিড়ির অত নেশা নেই মোসলেমের। কথা বলতে বলতে শ্বাস ঘন হয়ে এলে কখনও সখনও একটা দুটো টান দেয়। তা শুধু অনেকদিনের অভ্যাসের একটা দুটো টান কখনও কখনও চাঙা করে মোসলেম উদ্দিনকে।

ঘাড়ের বোচকা বাম হাতে নামিয়ে, ডান হাতে আকারে খুবই ছোটো ডুগডুগিটা বাজাতে বাজাতে মোসলেম লাঠিখানায় ভর দিয়ে চত্বরে দাঁড়াল। ফকফকে সাদা লুঙ্গি সাদা পাঞ্জাবি শার্ট আর যত্ন করে কাটা ও আচড়ানো দাড়িতে আজ মোসলেমকে লাগছে বেশ। সুকুমার সে কথা বারিক বুড়োকে বলল। বারিক জানাল, শুধু পা-খানা যা খোঁড়া, ল্যাংচে হাঁটে, তাছাড়া আরও বছর দশেক। আগে এই মোসলেমের দেখতে যা লাগত! সে সময়ে তারা দেখেছে। জামা কাপড়ে ওর চেয়ে ফিটফাট কোনও কোনও লোক আছে নাকি এই এলাকায়!

মোসলেমের জমায়েতে লোক হয়েছে। এই কয়দিন এমন মজমা মেলেনি, আজ এমনিতেই পাবলিকের আগ্রহ যেন একটু বেশি। তাছাড়া, গত কদিনের আবহাওয়া আর শহরের সমস্ত পরিস্থিতি নিয়ে একটা ছোটোখাটো ভাষণও সে দিল। সঙ্গে মফিজ শেখের কবিতার দুটো পঙক্তি। অবাক হল মোসলেম, তাদের নদীর ওপারের কেশবপুর ইস্কুলের সেই মাস্টার মশাইরা আজ তারে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন। জীবনে বেশির ভাগ দিন সে কবিতা মুখস্থ করা নিয়ে মার খেত, আর আজ এমনিতে তার জ্ঞাতি ভাই মফিজ শেখের লেখা একটা কবিতার দুটো লাইন সে গড়গড় করে বলে দিতে পারল। আসলে এ সবই পেটের ব্যাপার। মানুষ আটকানোর জন্যে মাথাও কত সহজে কাজ করে। একেবারে সরাসরি প্রয়োজনীয় কাজ।

এই সময়ে বানর দুটো নিয়ে চত্বরের দিকে আসে আজগর। মোসলেম উদ্দিন তখন মজমায় একটা পুরনো ন্যাকড়া আর একটা পাঁচ টাকা কাদায় চটকে চলেছে। নীচে ইট দিয়ে কাৎ করে রাখছে গামলাটা! সেখানে কিছু পানি দিয়ে পাউডার ছেড়ে দিয়েছে। পানির ঘটিটা একটু আগে বারিক মোসলেম উদ্দিনের কাছে রেখে এসেছে। আজগরের মোসলেম কাজের দিকে খেয়াল দেয়ার দরকার নেই। মজমায় মোসলেম যেখানে বসেছে, ও জায়গায় একটু ফাঁক। বাকি অংশে মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো। আজগরের মুখে হাসি। সুকুমার আর বারিকের দিকে সেই হাসিমুখে তাকাল সে। তার মানে আজ মানুষজন ভালোই।

বারিককে বলে, ও কা, দেইচো, তোমার দোস্ত মজমা মিলাইচে কী ফাইন!

তুইও মিলে, তোরে মানা করতিচে কেডা?

মেলাবানে। আইজকে বান্দর দুইটে কথা শুনলি হয়।

তোর বান্দরে যদি তোর কতা না শোনে, তালি শোনবে কার কতা?”

বোজলা কাকা, এই চ্যাটের আজগরের কতা এই দুনিয়ায় কেউ শোনে না। না শোনে বান্দর দুইটে, না শোনে জরি–

জরিনাদি আবার কী করল? সুকুমার জানতে চায়।

এই যে জরিনার পার্টির লোক একজন পাওয়া গেইচে। এদেশে পার্টি আর একটা বাড়ল!

কেন হইচে কী পার্টি কোতায়?

এই যে হাসিনার পার্টির লোক আমলিগ, খালেদার পার্টির লোক বিএমপি আর জরিনার পার্টির লোক সুকুমার! হা হা হা। উঁচু গলায় হেসে সুকুমারের উদ্দেশে আজগর আরও যোগ করল, চোদ্দনা, সংসার তো করলি না বিটি মানুষ নিয়ে, ও বালের বুজবি কী?

সময় নেই অসময় নেই এমন খাপছাড়া কথা বলার স্বভাব আজগরের। সবই রঙ্গ করে বলা। কিন্তু একথায় হঠাৎ মন খারাপ হল সুকুমারের। ঝিলিকের কথা মনে পড়ল। সংসার তারা করেনি ঠিকই, কিন্তু ঝিলিককে পেয়ে সংসারের কথা মাথায় এসেছিল সুকুমারের। মনে হয়েছিল, যদি থাকে তো ঝিলিক থাক তার সঙ্গে, কোনওদিন যদি একঘরের নীচে একখানে, একখানা চালে মাথা গুঁজে জীবন কাটিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু কোথায় কী? কোত্থেকে উড়ে এসেছিল, হঠাৎ আবার চলেও গেল। আসলে ঝিলিকের জীবনটা বরবাদ করে দিয়ে গেছে তার মামাতো ভাই। সুকুমার বিড়বিড় করে, ভক্তদা আসলে কোনও মানুষ না। একেবারে অমানুষের বাসা। কিন্তু সেই ভক্তদার কাছেই যাবার জন্যে একপায়ে খাড়া হইচে ঝিলিক!

আজগর এরপরই বারিকের সঙ্গে রঙ্গ তামাশা করতে শুরু করে। তার মানে এই কয়দিন একটানা শুয়ে থেকে, একটু নিয়ম মেনে আর কামার পট্টির পিছনের জল গলায় না ঢালায় আজগর বেশ সেরে উঠেছে। ভাবখানা চনমনে। আসলে পকেটে টান। অসুখ-বিসুখ। এইসব মিলে ও জায়গায় যাবার সুযোগ ঘটেনি। আর নয়, ওখানে না-যাওয়ার পাবলিক না আজগর। যেতই যে কোনওভাবে ওখানে।

বারিকের সঙ্গে ওই রঙ্গের ফাঁকে যখন সুকুমারের ওভাবে ঝিলিকের কথা মনে পড়েছে, যেন সেই ভাবনায় তার আর ছেদ না পড়ে, তাই সে রাস্তার পাশের কোনার পান-সিগারেটের দোকানের দিকে যায়। আর ভাবে, আচ্ছা গেল তো মেজো বউ! হ্যাঁ, ঝিলিককে এখনও সে মেজ বউয়ের ছাড়া ভাবতে পারে না। আসলে ঝিলিকও কি তাকে দেবরের বাইরে আর কিছু ভেবেছে? তাদের এক সঙ্গে থাকা নিয়ে ঝিলিকের ভিতরে কোনও দোটানা সে দেখেনি। কিন্তু তারপরও সে চলে গেল।

এখন সুকুমারের দোটানা। একটু পরে সে নামবে। মোসলেম উদ্দিনের প্রায় শেষ, তার আগে এখন এইভাবে ঝিলিকের কথা মনে আসছে কেন? মনে করছে শুধু সে, যে গেছে, সে তো তাকে মনে করছে না। কিন্তু এই যে গেল, জীবনে গেছে কোনওদিন ফুলতলা। খুলনা তারপর দৌলতপুর তারপর ফুলতলা। যদি সেখানে ওই মহিলারে না-পায়। যদি সেখানে ঝিলিকের কোনও অনিষ্ট হয়। কোন বুঝে যে গেল। চারপাশে কত কিছু শোনে। সুকুমার একলাই শোনে নাকি, এমন কথা সবাই শোনে জানে। তার উপর আবার ব্ল্যাকে শাড়ি বিক্রি করা মহিলা। আইজ বাগেরহাট কাল খুলনা পরশু যশোর, তারপরদিন সাতক্ষীরা তা বাদে মাগুরা ঝিনেদা। কোথায় যে যায় আর কোথায় যে যায় না, তার ঠিক আছে। কোথায় কোথায় ঠেলা খায়, কে জানে। কোথায় কী করে কে জানে। সেই চক্করের হাতে পড়ল মেজো বউ!

সুকুমার এক খেলা দেখানো মানুষ, সাতঘাট চরে বেড়ানো মানুষ, কিন্তু তার ভিতরে এক অদ্ভুত সারল্য আছে। সে তুলনায় জীবনভর এই জায়গায় কাটানো আজগর অনেক বেশি সেয়ানা। আর ইব্রাহিম শেখ তো তাকে বেচতে পারে। তা পারবেই, ইব্রাহিমের মতন কথায় ওস্তাদ লোক সে দেখেছে কয়জন। ইব্রাহিমের এখানে ওখানে যেতে হয়, তার ওই ওস্তাদি থাকা স্বাভাবিক, সালসা বেচতে হলে, ওইটুকু ওস্তাদি লাগেই। তবে এর বাইরে, সুকুমার যতটুকু ঘাগু হতে পারত তা নয়। হওয়া সম্ভবও নয় তার পক্ষে, ফুটবল খেলত, সেখান থেকে এই খেলা দেখানোয় এসেছে। অতশত মানুষ চেনা তার হয়নি। ফলে, ভিতরে ভিতরে ঝিলিককে নিয়ে তার আতঙ্ক কাটে না। কিন্তু একটু বাদে, এইমাত্র হাতে নেয়া ছোট্ট ডুগডুগিটা বাজিয়ে আসরে নামবে সে, তার কি এখন ঝিলিককে নিয়ে এভাবে চিন্তিত হওয়া চলে।

তবু, এখন একটু আনমনা, উদাসী সুকুমারের সাথ ছাড়ছে না ঝিলিক। কোথায় গেল। ফুলতলায় ওইসমস্ত মানুষজনের চেনে কিছু। কোনওদিন গেছে ও জায়গায়? জীবনে কোনওদিন সুখ পাইল না, এখন যদি আবার একটা কিছু হয়ে যায়? দেখা গেলে যশোর নিয়ে খারাপ পাড়ায় বেচে দিল। এখনও তো গায়ে কিছু মাংস আছে ঝিলিকের। খারাপ পাড়ায় একবার ঢোকলে আর কোনওদিন ওই জায়গা দিয়ে বের হতে পারবে না। তাহলে এই জীবন গেছে মেজো বউর! এই জীবনে কোনওদিন তাহলে ভরতরে আর দেখা হইচে! তার ভরত থাকপে কোথায় আর সে থাকপে কোথায়।

পানের দোকান পর্যন্ত যেতে যেতে সুকুমার এই সমস্ত ভাবে। একবার ভাবে আজই, পারলে এখনওই চলে যায় ফুলতার দিকে। কিন্তু, ফুলতালার কোথায় গিয়ে খোঁজবে? শুধু ওই মহিলার সঙ্গে ঝিলিকের কথায় কথায় জেনেছিল, ফুলতলা বাজারে দোকান আছে ওই মহিলার ভাইর। স্বামী ওই জায়গায় কোন একটা আড়তে কাজ করে। অথচ নাম জানে না, কিছু জানে না, এইভাবে ফুলতলায় সে কারে খুঁজে বের করবে? এ নিয়ে সুকুমারের দোটানা। সে জানে না কী করবে। নাম ধাম ঠিকুজি কুলজি কিছুই না জানা মানুষকে কীভাবে পাওয়া যাবে। আর ওই মহিলাকে না পেলে কোথায় ঝিলিক!

একটা সিগারেট ধরিয়ে বারিকের গাছতলার দিকে আসে সুকুমার। চত্বরের দিকে তাকায়। মোসলেম উদ্দিনের আসর প্রায় শেষের দিকে। গাছতলায় আজগরের পাশে জরিনা এসেছে। তার পাশে গোলাপ মিয়া। গলায় ঝোলানো কান পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতি। কয়েকদিন বাদে গোলাপ মিয়ার সঙ্গে দেখা হল। সে এখন তক্কে তক্কে আছে মোসলেমের আসরটা ভাঙলে কোনও কান পরিষ্কারের কোনও খদ্দের পায় কি না। গোলাপ মিয়ার গায়ের জামাটা খুব ময়লা। সুকুমারের একবার বলতে মন চাইল, মোসলেম কাকার কাছ থেকে এক প্যাকেট পাউটার নিয়ে সে জামাটা ধুইলে পারে। নদীর জল এখন কী পরিষ্কার। যদিও এই জলে বেশ লবণ, কাপড় কাচলেও যেন খুব ভালো পরিষ্কার হয় না। মোসলেম উদ্দিন তার ক্যানভাসের জন্যে আনে সাপ্লাই কলের জল, চাপ কলের জল কখনও আনে না। তাতে নাকি ময়লা ছাড়ালেও একটা লালচে ভাব থেকে যায়। বলে, ওই পানিতে আয়রন! তা আয়রণ হোক আর নদীর পানিতে লোনাই হোক, গোলাপ মিয়া তো জামাডা এট্টু কাচলি পারে। এইরম জামা কাপড় নিয়ে মানুষের ধারে কান খোঁচানের জন্যি গোলাপের এট্টু লাজও করে না?

এখন সুকুমারের মাথা থেকে ঝিলিক খানিকক্ষণের জন্যে উধাও, সেখানে গোলাপ মিয়া। সিগারেট ধোঁয়া উড়িয়ে মোসলেম উদ্দিনের আর কতক্ষণ লাগবে তা দেখতে দেখতে যখন সে বারিকসহ সবার বেশ কাছাকাছি, তখন আজগরের পাশে হাঁটুমুড়ে বসা জরিনা বলে, ওই দেখি সুকুমার ভাইডি!

আজগরের জন্যে এটা কোনও সংবাদই নয়, সুকুমার এতক্ষণ এখানেই ছিল। সে জরিনাকে জানায়, তা কী হইচে। ওতো এইহেনেই ছেল!

আমি ভাবলাম, গলা নামায় জরিনা। এমনভাবে বলে যেন শুধু আজগরই শোনে, চইলে গেইচে নিকি?

যাবে কোয়ানে? মোসলেম কাকা উঠলিই ও নামবে।

সেইয়ে? আইজকে তুমি নামবা না?

যাবানে একবার। যাই, মোসলেম কার শেষ। বান্দর দুইটের ধারদে এট্টু ঘুইরে আসি।

আজগর উঠে খাড়াখাড়ি মাঠ পাড়ি দিয়ে ট্রেজারির দিকে যায়। সুকুমার এগোয় সদ্য ভঙ্গুর জমাতের দিকে। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ছোট্টো ডুগডুগিটা বাজায়। গোলাপ মিয়াকে বলে গিয়েছিল, সে মজমা মিলানোর পর পরই যেন তার বাক্স-বোচকা ওখানে রেখে আসে।

মোসলেমের আসর ভাঙতে না ভাঙতেই সুকুমার সেখানে আসায় আসরটা তেমন ভাঙল না। এতে বারিকে মুখে হাসি। তাদের দিকে আগুয়ান মোসলেমকে বলল, আইজ মনে হয়, পাবলিক থাকপে।

সুকুমারের খেল দেকতি তো থাকপেই।

হ্যাঁ, সুকুমার পকেট থেকে একটা ডিমবল অর্থাৎ টেবিল টেনিস খেলার বল বের করেছে। দুই আঙুলের মাঝখানে ওই একটা বলকে রেখে তা এমনভাবে সবার সামনে ঘুরাল যেন চারটা বল। তারপর আরও দুটো বল পকেটে থেকে বের করে। তা গিলে ফেলল, মুখ হা করল, মুখে নেই সে বল, তারপর আবার প্রত্যেকটি এক এক করে হাতে নিয়ে এল। এবার এই চারটি বল আঙুলগুলোর ফাঁকে রেখে ঘুরাতে ঘুরাতে ক্রমে একটি বলে রূপান্তরিত করল।

আসরের সমবেত জনতার হাতে তালি। আজ সত্যি সুকুমার জমিয়ে তুলছে। এতক্ষণে গোলাপ মিয়া সুকুমারের পাশে তার মালপত্র রেখে এসেছে। আর সেগুলো খুলতে খুলতে, ভিতর থেকে কোনও কিছু হাতড়ে বের করার আগে, একবারে ইব্রাহিম শেখের ভঙ্গিতে সমবেত জনতার উদ্দেশে সে বলে যেত নাগল, এই কয়দিনের অস্থিরতা, প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার পরে আপনাদের সামনে। এসেছি। আজ আপনারাও এসেছেন আমার সামনে। এই কোর্ট চত্বরে। একটি শতবর্ষী বৃক্ষের নীচে আমাদের আজকের প্রদর্শনী। আপনারা না থাকলে আমাদের পেটে ভাত আসে না। আবার আমরা–এলে এইটুকু আনন্দ বিনোদনও থাকে না। মামলা মোকদ্দমা কাজিয়া বিবাদ ফ্যাসাদ নিয়ে এইযোনে এসে এইটুকু আনন্দ নিয়েই ফিরে যাওয়া।

সুকুমার দম নেয়। বোচকা থেকে বের করে তিনটে টেনিস বল। কিন্তু তার মনে হচ্ছে আগের কথার আরও খানিকটা বলা দরকার। মানুষ আঠার মতন তার মজমায় লেগে আছে। জমায়েত ছোট হয়ে কাছে আসছে। তার খেলা দেখানোর জন্যে বৃত্ত একটু বড় হলেই ভালো। তাতে এরপর যখন ফুটবল পায়ে দিয়ে করসত দেখাবে সে, তখন তাতে সুবিধা হবে।

সুকুমার বলে চলে, এইখানে আনন্দ নিয়ে, চক্ষু দুটো ভরে এই খেলা দেখে, আমাকে দুটো পয়সা দিয়ে বাড়িঘরে ফিরে মা ভাই বোন বউ ছেলে মেয়েকে বলতে পারবেন, আজ খেলা দেখেছি। একটু আগে কিনলেন কাপড় কাঁচার পাউডার তাতে জামা কাপড় সাদা হবে আর খেলা দেখলে মন সাদা হবে। আনন্দ হবে। কী হবে না? জোরে বলেন?”

মোসলেম উদ্দিন বানর নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা আজগরকে বলে, এই ছেমড়াও দেখি কতা জানে। শিহিছে কোহানদে? দেকতি মনে কয় নরম।

শিহিছে ইব্রাহিমের কতা শুইনে।

সুকুমার টেনিস বলগুলো একহাতে ধরে। একটা বাঁ হাতে নেয়। আবার বাম হাত ডান হাত করে। তারপর ডান হাতেরটা একটু উপরে ছুঁড়ে দিতে দিতে সমবেত জনতার একদিকে যায়। তাতে বৃত্ত বড় হয় ফিরে এসে গাছতলার দিকে দাঁড়িয়ে টেনিস বলটা একটু বেশি ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বাম হাত থেকে আর একটা নিয়ে একই সময়ে উপরে দেয়। উপরেরটা হাতে আসতে আসতে আবার ছেড়ে পরেরটা তখন হাতে আসে। এরপর বাঁ হাতের বাকিটা। তিনটে বল এভাবে তার হাতে একই সঙ্গে উপরে নীচে হতে থাকে। জনতা তালি দেয়।

হাতের এমন আর একটা খেলাও দেখায়। ছোটো মুগুর সাইজের তিনটে কাঠির। তারপর পকেট থেকে একটা রাবারের বল বের করে সেটা তালুতে রেখে আবার উধাও করে দেয়। তালুতে আছে, তালুতে নেই। এমনকি একটা দিশলাইয়ের বাকসো এমনভাবে ঘোরায় হাতে। এই তালুতে আছে সেটা, পর মুহূর্তে নেই। আবার জনতার তালি।

এবার বোচকা থেকে ফুটবল বের করে সুকুমার। বের করার আগেই একপ্রস্ত করতালি। বোঝা গেল, সুকুমারের এই খেলায় জনতার উৎসাহের শেষ নেই। তারা টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখে। ম্যারাদোনার পায়ের জাদুর কথা তাদের জানা আছে। স্টেডিয়ামে খেলা হলে এদের অনেকেই দেখতে যায়, টিকেট কাটতে না-পারলে পাশের গাছে উঠে দেখে। এখন তাদের সামনে বাইশ জনের খেলা না-হোক, একজন ফুটবল নিয়ে পায়ের জাদু দেখাবে।

সুকুমার বলটা হাতে নিয়েই বোঝে পাম্প একটু কম। এ কয়দিন খেলা না দেখানোয় বলটা একদিনও বের করে দেখা হয়নি। দেখা দরকার ছিল। যা হোক, এখন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে লাথি দিতে হবে। সুকুমার মাথায় বলটা রাখে। সেখানে কয়েকবার উঠিয়ে নামিয়ে তারপর ঘাড়ের কাছে আনে। ঘাড় থেকে নিজের শরীর দ্রুত এক পাশে সরিয়ে আনে ডান পায়ে। ডান পায়ে থেকে বাম পায়ে। হাঁটুতে, হাঁটু দিয়ে খোঁচা দিয়ে আবার পায়ে। সেখান থেকে উরুতে। দুই উরুতে বার কয়েক নাচিয়ে আবার ঘাড়ে, ঘাড় থেকে সোজা ডান পায়ে। সেখান থেকে মাথায়।

জনতার তালি থামে না। সুকুমার বলটা মাথা থেকে দুই হাতে জড়িয়ে চুমু খায়। জনতার করতালি। টাকা পয়সা পড়ে কিছু। কেউ কেউ এসে সুকুমারের হাতে দেয়। সুকুমার বৃত্তাকারে যারা দাঁড়ানো তাদের কাছে যায়। তারা তার হাতে দেয়।

এই ব্যাপারটা একটু অকস্মাই ঘটে। এরপর অন্য আর কোনও খেলা সে দেখাবে কি না, মজমার জনতা তার জন্যে আর অপেক্ষাই করেনি। তারা ধরে নিয়েছে, এটাই সুকুমারের দেখানো শেষ খেলা। তাই যেন তাকে খেলা দেখানোর বকশিস হিসেবে এই আয়োজন।

সুকুমারও বলে, যাবেন না আপনারা। এরপর ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া তুড়া নিয়ে আসতেছে একজন। দেখবেন বান্দরের খেইল।

এতে কাজ হল। আবার হল না। যারা বানর খেলা দেখবে তারা থাকল, যারা আজগরের বানর নাচানো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত তারা চলে গেল।

সুকুমার ফিরল বারিকের গাছতলায়। তখনও সেখানে মোসলেম উদ্দিন আছে। আছে গোলাপ মিয়া আর জরিনাও। আজগর ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে বানর দুটো নিয়ে এগিয়ে গেছে। যদিও এখন ফির সুকুমারের আসরের তুলনায় পাতলা।

সুকুমার কাছে আসতেই মোসলেম উদ্দিন বলেন, দেহালি আইজ, জন্মের ফাইন।

জরিনাও তাই বলে। কিন্তু মোসলেম সঙ্গে আরও বলে, তা এত কথা তুই শিকলি কোয়ানদে? খেলা যেরাম দেহাইচিস। কথাও কইচিস সেইরাম। বলে, মোসলেম বারিকেরও অনুমোদন চায়। তারা একটু আগে এই কথা আলোচনা করছিল। বারিক তার প্রায় মুদে থাকা চোখজোড়া খুলে অনুমোদন দিল ঠোঁটে লাগানো হাসিতে।

গোপালা মিয়া বলল, চা খাওয়াও। কামাইচো তো মন্দ না?

জরিনা বলে, যাবেনে, আগে বান্দর নাচানোর মজমাডা এট্টু শেষ হোক। বলে মোসলেম উদ্দিনের দিকে তাকাল। এখন মোসলেম যা বলবে তাই হবে।

সে সুকুমারের দিকে একটা আচা দিয়ে ঢাকা দেয়া ঘটিটা এগিয়ে দিয়ে বলে, নে, পানি খা। পানি খা। গলাটলা এহেবারে শুকোইয়ে গেইচে তোর। কতা কতিচিস যেন হাঁসের ছাও।

তা সত্যি, কদিন বাদে এতটা উঁচু গলায় কথা বলে সুকুমারের গলা থেকে আর স্বর বেরুচ্ছে না। এমনকি রোদের এই তীব্র তাপে এখন চোখেও আর দেকছে না কিছুই। একটু চা খেতে পারলে হত। কিন্তু আজগরের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

একটু পরেই আজগর আসে। আজগরের আসর তেমন জমেনি। আসলে আজগর এখনও শরীরের তা যেমন পায়নি, একইসঙ্গে তার বানর দুটোই যে এই কদিনের জড়তায় খানিকটা জড়। আজগর আজ মর্দাটাকে মজমার মাঝখানেই দুটো পিটান লাগিয়েছে। তাতে অবশ্য কিছুটা কাজ হয়েছিল, কিন্তু আজগর নিজেই তেমন জুত পাচ্ছিল না।

ফিরে এসে আজগর বলে, আইজ সেরাম মজমা হল না।

মোসলেম উদ্দিন বলে, বাদ দে, আইজ যা পাইচিস্ এই কত। এদিকের অবস্থা এই। তারপর নিজে উঠিল জ্বরদে। শরীর জুতের না থাকলি কোনও কিছুই জমে না বাবাজি। এট্টু শরীরের দিকে খেয়াল দে এহোন, আর ওই কামারপট্টির পিছনে যাইস নে। গেলিও এট্টু কমাইয়ে যা।

জরিনা বলে, এই বিলে না কইয়ে, হাতের ওই লাঠিখান দিয়ে কলি পারেন?

সুকুমার বলে, বাদ দেন, চলেন চা খাই।

চা খাওয়ার জন্যে তারা আলমের চায়ের দোকানের দিকে যায়। দিলদার তাদের সঙ্গে রওনা দিয়েও গেল না। মোসলেম উদ্দিন তার কাছে জানতে চাইল, এ নাটাই, তুই যাবি না?”

দিলদার কিছু বলল না। আজগর তাকে বানর দুটো দেখিয়ে বলল, ও দুটোকে দেখতে। তখন অবশ্য দিলদার বলে, বারিক দুদু দেকপেনে।

আলমের দোকানে আজ বেশ ভিড়। স্বাভাবিক এই ভিড়। গত কদিন কোনও ভিড় ছিল না, যা ছিল তা অস্বাভাবিক। এর ভিতরে এখন চায়ের অর্ডার দিয়ে কখন সে চা পাওয়া যাবে কে জানে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। মোসলেমের পেটে খিদে। সেই সকালে বেরিয়েছে। আজ আর বাজারে যাবে না। পাউডার বানানোর মতো জিনিসপত্তর আলেকজানের কাছে এখনও মজুদ আছে। সে বলে, নদীর পাড়ে চল, দেহি ছাত্তারের দোকানের চা পাই নিকি?

ডাকবাংলোর সামনে দিয়ে ছাত্তারের দোকানে গিয়ে তারা চা খায়। সুকুমার দুটো দাগঅলা কলা ছিঁড়ে জরিনার হাতে দেয়। তার আগে ছাত্তারকে জানায়, এই কলার দাম অর্ধেক। সুকুমার বানরের জন্যে কলা কিনছে দেখে আজগর বলে, আইজকে কামাই মনে কয় খারাপ হইনি, না?

মোসলেম উদ্দিন বলে, যে খেলা দেখাইচে! তুই পারবি ভাইডি। লাইগে থাহিস। তোর পেটে ভাত হবে।

সেয়া হত, জরিনা বলে, কিন্তুক কতদিন লাইসে থাহে, সেইয়ে দেহার।

কেন?”

ঝিলিক বুন্ডি কইচে, ওর কোনওতায় বেশিদিন লাইগে থাহে না।

কইচে তোমারে? সুকুমার বলে।

কইচে না। বেড়া মানুষ সব একপদ। জানা আছে আমাগে।

আজগর চার গোলাস মুখের কাছে নিয়ে সুকুমারকে দেখে। এইমাত্র ঝিলিকের কথা বলায় সে একটু আনমনা হল। কী হত, যদি এখন জরিনা এই কথা না বলত।

হইচে, তোরা ক তোগো ফাও কতা, আমি গেলাম। মোসলেম উদ্দিন পকেটে হাত দেয়। পকেটে হাত দেয়ার আগেও তার ফিনফিনে জামার পকেটে দশ টাকা খানা উঁকি দিতে দেখা গেছে। অবশ্য সুকুমার তাকে মানা করে। কিন্তু মোসলেম শোনে না। ছাত্তারকে চায়ের দাম আর আজগরের বানরের জন্যে দুটো দাগঅলা কলার দাম দেয়। তারপর তার লাঠিখানা হাতে নিয়ে লেংচে লেংচে চলে।

হাঁটায় একটা ছন্দ আছে মোসলেম উদ্দিনের। এই ছন্দটা না-থাকলে হয়তো খোঁড়া মানুষটা এভাবে হাঁটতে পারত না। সুকুমার দেখে। সারাটা জীবন এই করে কাটিয়ে দিল। কারও প্রতি অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই এমন একটা মানুষ। একথা বলে এই চত্বরের সবাই। আর বেশভূষা কী অসাধারণ। কোনওভাবেই মনে হবে না, এই লোকটা জামা কাপড় ধোয়ার পাউডার বিক্রির ক্যানভাস করে!

দুপুরের দিকেও নদীর পাড়ে এই রকম হাওয়া আসে, যেন কোনও দিনও একথা জানা ছিল না সুকুমারের! এই দুপুরের রোদের ভিতরে এমন হাওয়ায় মন উদাস হয়। এত গরম, তার ভিতরে এ হাওয়ায় মুহূর্তখানেকের স্বস্তি! এই যে এল, এরপর আবার হয়তো অনেকক্ষণ আসবে না। না আসুক, এইটুকু সময়ে তাকে যেভাবে এই জায়গা থেকে উড়িয়ে ফুলতলায় নিয়ে গেল, তা কি জানে?

আজগর বলে, কী হল?

জরিনা হাসে, বোজো না, কারে মনে পড়িচে।

সুকুমার জানতে চায়, উত্তরে এই নদী গেইচে কোন কোন দিক- হাত বাম দিয়ে উত্তর দিকে দেখায়।

আজগর বলে, আমি বিষ্টুপুরের পর আর যাই নিই উত্তরে। তয় নদী গেইচে খুলনা। এডা তো ভৈরব, আমরা কই দড়াটানা। যাইয়ে খুলনায় রূপসার সাথে মিলিছে। তার আরও উত্তরে দৌলতপুর ফুলতলা নওয়াপাড়া যশোর- আজগর তার কথা বলে যেতে থাকে। খেয়াল নেই, সুকুমার একসময় খুলনাতেই ছিল।

কেন, এই নদী বাইয়ে কোনও দিকে যাবা নিকি? জরিনা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সুকুমারকে বলে।

সুকুমার একবার জরিনাকে দেখে তারপর নদী দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তাতে তার হয়তো রূপান্তর হয়। সেখান থেকে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে বলে, চলো, খাইয়ে নিই। দুপুর হইচে কহোন। সেইয়ের পর শরীরে জুত পালি রেলস্টেশনে যাইয়ে আর একবার খেলা দেহাবানে সন্ধ্যার আগে।

আজগর উৎসাহ দেয়, এডা কাজের কতা কইচিস, সেইয়ে কর।

তুমি যাবা নাকি?

নারে, আমার শরীরের সে গতি নেই।

জরিনা হাসে, উনি এহোন ওনার খোপে জরিনার কোলে মাতা দিয়ে শুইয়ে থাকপে। আর কবে উনি নবাব সিরাজ আমি আলেয়া। চেটের নবাব আমার। শালার ফাও চাইল গেল না কোনও কালে?

আজগর মুখ ছোটায়, ওরে সাউয়ো আমার, তুই কোন বাল ছিঁড়ে আটি বান্দিস?

দেহিচ্ছো সুকুমার ভাই, এরে এট্টু রসের কথা কলিও কীভাবে মুখ খারাপ করে।

বাদ দেও। চলো, আলতাফের হোটেলে যাই। আচ্ছা, আমার মালপত্তর রইচে বারিক খুড়োর ওই জায়গায়–

পাঁচটা পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই। বারিক আছে। তার আগে গেলি আলতাফের ওই জায়গায় খবর পাঠাবে নে।

একটু আগে জরিনা যা বলেছে, তাই ঘটল। খাওয়ার পরে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে নিজের ঝুপড়ির পর্যন্ত এসে সেই কাজই করল আজগর। বাইরের দিকে বসা জরিনা, তার কোলে মাথা দিয়ে সে তন্দ্রা গেল। বিড়িটা শেষ হওয়ার আগেই চোখ জুড়িয়ে গেছে। মাথার কাছে দাঁড়ানো সুকুমারের বিড়ি তখনও শেষ হয়নি। জরিনা বলল, ঘুমোইয়ে গেলি বান্দর দুইটে নিয়ে আসপো।

আমি তালি কোর্টের দিকে যাই।

এক সাথে যাবানে। এহোন যাও আলতাফের উপরে যাইয়ে এট্টু চোখ বোজো।

দিনে চোখে ঘুম আসে না আমার। যাইয়ে বারিক খুড়োর ওই জায়গায় এট্টু বইসে থাইহে তারপর যাব রেল স্টেশন। ততক্ষণে বেলা পইড়ে আসপেনে।

জরিনা হাতের ইশারায় সুকুমারকে তার কাছে বসতে বলে। গলা নামায়। একটু ফিসফিসিয়ে সরে বলে, তোমাগো মদ্যি হইচে কী?

কী হবে?

ঝিলিক বুন্ডি চইলে গেল?

ছওয়ালরে দেকিত ইচ্ছে করে।

তুমি এট্টা বাদাইয়ে দিলি পারতা?

আমার নেই চাউল-চুলো। আর মামাতো ভাইর থুইয়ে যাওয়া বউ–

হইচে। মাইয়ে মানুষ যার সাতে থাহে তার। ওই মুনিগঞ্জ কালীবাড়ি যাইয়ে কপালে এট্টু সিন্দুর ছোঁয়াইয়ে লইয়ে আসলি হত, বাল কও নিকি?

জরিনাদি, হয় না ওভাবে।

হওয়ানোর ইচ্ছে থাকলি হয়।

তা হয়। কিন্তু আমাগো সে সুযোগ হয়নি।

হবে নে। যাও, মানুষটারে ফিরোইয়ে নিয়ে আসো।

সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে জরিনা কথাটা বলল, সে কথায় দাবিও আছে। সুকুমার তখন পন্টুনের দিকে তাকানো। নদীর জল নেমে যাচ্ছে। বড়ো স্থির এই জল। আজকে যে গরম, এখন একবার ডুব দিয়ে এসে সে জরিনাকে স্থির মাথায় বলতে পারত, কী করবে। কিন্তু তা যাবে না।

জরিনা আবার জানতে চায়, কী যাবা? কী মায়া ওই মুখোনে। তোমার উপর কত দরদ।

জানি।

কও দেহি, আর কিছু ঘটিচে নিকি তোমাগো ভিতরে?

না, ঘটিনি।

ওই যে মোড়েলগঞ্জ গেল?

সে তো বাড়িঘরের খোঁজ নিতি। যে জন্যি গেইল, তাতে আমার সাতে কী?

চলো। কোর্টের দিক যাই। ঘুমোইয়ে গেইচে।

কোর্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জরিনা জানতে চায়, আলতাফের ধারদেনা শোধ করিচো?”

হু।

ওই লোকের জন্যি তোমার কতডি টাকা বাইরোইয়ে গেল। ঋণ যে কবে সে শোধ করব?

ফাও কতা কইয়ে না, কাইলকে যদি আমার হয়? ওই রম অকম্মা হইয়ে থাহি?

কোর্ট চত্বর প্রায় ফাঁকা। বারিক তার বইপত্তর একটু আগেই গোছাতে শুরু করেছে। উলটো দিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের বারান্দার সিঁড়িতে বসে ঝিমোচ্ছে গোলাপ মিয়া। দাঁত তোলার সলেমান খাঁ নেই তার বাক্সর সামনে। শুধু টাইপিস্টদের বড়ো ঘরটার সামনে বসে আছে দিলদার। জরিনার দিকে চেয়ে হেসেছে। জরিনা দেখেনি। সুকুমার এমনি হাত নাড়ল। তারপর বারিককে বলল, কী খুড়ো, আইজকে আগে আগে?

আরে বাপু, যে গরম পড়িছে, মানুষ থাহে?

তোমার এই গাছতলায় কী ঠান্ডা, ওই জায়গায় এট্টু শুইয়ে নিলি পারো?

গাছতলায় ঘুম আসে না আমার।

সুকুমার তার মালপত্তর নিয়ে মেইন রোডের দিকে আসে। একটা রিকশার জন্যে অপেক্ষা করে। জরিনার কেন যেন মনে হয়, সুকুমার ঝিলিককে খুঁজতে যাবে। আবার সুকুমারেরও কেন যেন মনে হয়, জরিনা এখনও তাই চায়। সেই জন্যে তাকে বিদায় দিতে দাঁড়িয়ে আছে।

রিকসায় উঠে সুকুমার বলে, সন্ধ্যার বাদে লাস্ট ট্রেন ছাইড়ে গেলিই চইলে আসতিচি।

আচ্ছা। কিন্তু ভাইবে দেহো, তারে ফিরোইয়ে আনবা নিকি?

সুকুমার একটু উদাস। যেন কথা অন্য দিকে নিতে পারলে ভালো। সে ঝিলিকের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে, কলা দুইটে আনলা না যে?

ভুইলে গেইচি। বান্দরঅলার মাথার ধারে রইচে। এহোন ওই দুইটের ওইহেনদে নিয়ে আইসে তারপর দেবানে।

সুকুমার রিকশাঅলার পিঠে আলত খোঁচা দেয়। তখনও জরিনা সুকুমারের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওই কথা আবারও বলে, ভাইবে দেইহো

পিছন ফেরে সুকুমার, আচ্ছা।

জরিনা কোর্ট চত্বরে ঢুকছে। দিলদার বারিকের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে। আর কিছু দেখা গেল না। রিকশা কাজী নজরুল ইসলাম রোড হয়ে রেল রোডে পড়বে একটু পর।

রেল স্টেশনের চত্বরে, লেকের পাড় ঘেঁষে সুকুমারের খেলা দেখানো শেষ হওয়ার পর দিনের আলো আর প্রায় নেই। মালপত্তর গুছিয়ে সে লেকের পাড়ে বসে থাকে। তারপর এক কাপ চা খেয়েছে। পাশের ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। ট্রেনটা তখন ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে বার দুই হুইসেল দিয়েছে। সুকুমার জানে ট্রেন ছাড়তে আরও কিছুক্ষণ বাকি আছে। লেকের পাড়ে হাঁটুমুড়ে বসে সে ভাবে, লঞ্চঘাটে যাবে নাকি আজগর আর জরিনার কাছে, নাকি উঠে বসবে ট্রেনে। মেজো বউ ফুলতায় যেখানে গেছে, গেছে তো ঠিকঠাক? এখন গেলে সে আজ রাতে ফুলতলা পৌঁছতে পারবে? না পারুক, কাল সকালে যাবে ফুলতলা। আবার পরক্ষণেই ভাবে, না যাবে না। এখন রেল রোডের মুখে গিয়ে একটা রিকশায় উঠে চলে যাবে লঞ্চঘাটে। আজগর নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠেছে।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুকুমার। মালপত্তর হাতে নেয়। সোজা স্টেশন বিল্ডিংয়ের ভিতর দিয়ে দাঁড়ার প্লাটফর্মে। আবার ভাবে, উঠবে ট্রেনে? এই ট্রেন রূপসা পৌঁছতে পৌঁছতে নটা সাড়ে নটা, ওপার গিয়ে কাল খুব ভোরে ট্রেনে অথবা বাসে যাবে ফুলতলা। ততক্ষণে মেজো বউ ওখানে থাকবে তো। তারপর ফুলতায় কাকে কোথায় কী খুঁজতে হবে তা ভাবে। তবু ট্রেনে উঠবে কি না, সেই দোটানা কাটে না তার!

ইঞ্জিনে আবারও বার দুই হুইসেল দিতেই সুকুমার আলগোছে ট্রেনে ওঠে। যেন যাবে বলেই এসেছিল, এখন কোনও দোটানার আভাস নেই। ট্রেনের ভিতরে খুব অন্ধকার। কামরা ওই কোনায় একটা লাইট জ্বলছে। তাও যেন টেমি!

সিটে বসার পর পরও সুকুমারের দোটানা কাটে না। নামবে নাকি? আবার ভাবে। একটু আগে সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যাবেই, সেটা আবার কেটে গেছে। তার মনে হয়, নেমে যায়।

ট্রেন ছাড়ে। সুকুমার বসে থাকে। কামরায় আলো জ্বলেছে আরও দুই-একটা। প্রায় ফাঁকা কামরা।

লঞ্চঘাট থেকে শোনা যায় ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার হুইসেল। জরিনা আজগরকে বলে, সুকুমার ভাই মনে হয় চইলে গেল এই ট্রেনে।

আজগর বলে, না, আসপেনে।

জরিনা বলে, আসলি এতক্ষণ আসত। যাক, যাইয়ে যেন ঝিলিকের পায়!

এ সময় নদীর কূলজুড়ে বেশ বাতাস। আজগরের চুলে বিলি কাটতে কাটতে জরিনা বলে, মানষির মনে কত দুখ, সে যার দুখখো সেই বোঝে।

আজগর এই আধো অন্ধকারে জরিনার মুখ দেখে। একথা আগে কখনও বলেনি জরিনা!…

২০১৫-১৬

 

Exit mobile version