হইচে। আর ভণিতা করিস না।
যা কলেন? ওই দাঁত নেই, বান্দর নাচানো, খাতি পায় না মানুষটা সামলাবে আমারে। এক দুই দিন সাতে ঘুরলি অমনি সামলানো হইয়ে গেল। ওয়ার ধারে যাওয়া যায় গোন্দে? শেষ কথাটা জরিনা একটু গলা নামিয়ে বলল। সঙ্গে নিজের মতো করে আরও যোগ করে, ও লোক নায় ধোয়? বান্দরগুলোর সাতে থাকতি থাকতি নিজেও হইয়ে গেইচে বান্দরচোদা পদ।
তোর মুহে কিছু আটকায় না, না? চল যাই—
ও খোদা, পান খাবেন না? চা খাইয়ে পান না খালি হয়?
আমি দুপুরে খাইয়ে তারপর পান খাই, এহোন খাব না। তুই খালি নে, আমি পয়সা দিতিচি
জরিনা চায়ের দোকানের পাশে পানের দোকানে পান আনতে যায়। মোসলেম ভাবে, সত্যি মেয়ের ঠোঁট দুটো পানে সব সময় লাল। পানই তো চাবায় সারাদিন। মনে হয়, পান খাওয়ার জন্যে চা খায়, ভাত খায়। হয়তো পান খাওয়ার জন্যে যার-তার সঙ্গে কোথায় কোথায় চলে যায়।
জরিনা এলে মোসলেম একটু আগে হাঁটে। একটা হোটেলের টিনের বেড়ায় জরিনা হাতের চুন। মোছে। পানের পিক ফেলে। তারপর মোসলেম প্রায় কাছে এসে আবার কোর্ট চত্বরে ঢুকে পড়ে। চত্বর আগের তুলনায় একটু যেন ফাঁকা। আদালত ভবনে মানুষের তেমন ভিড় নেই। হঠাৎ মানুষজন গেল কোথায়?
মোসলেম ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাঁ-দিকে যায়। সেদিকে টাইপিস্টদের বড়ো ঘরখানা। এ সময় মোসলেম খেয়াল করে জরিনা যেন তার পাশ থেকে সরে গেছে। সে দাঁড়ায়। পিছনে তাকায়। দেখে জরিনা কী করে। না জরিনা আসছে। পাশের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে কী যেন দেখছিল। তারপর মোসলেমের কাছে এসে বলে, মনে হয় ঝিলিক আইচে। ওই হোটেলে বইসে খায়।
মোসলেম জানতে চাইল, ঝিলিক কেডা?
পরে কবানে–
জরিনা এইটুকু বলতে পেরেছে অথবা পুরোপুরি বলে শেষও করতে পারেনি, এ সময়ে মোসলেম খেয়াল করে, টাইপিস্টদের ঘরের সামনে ছোটোখাটো জটলা। ভিড় তেমন না, কিন্তু উঁচু গলায় ঝগড়া হচ্ছে। কোর্ট চত্বরে ভিড় কম, তার মানে এই নয় মানুষের কোলাহল থেমে গেছে। ডানে তাকালে আজকের অসহনীয় গরমের কারণে চত্বর ফাঁকা ঠিকই, কিন্তু বুড়ো বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে লোক আছে। তার পাশে একটা ছোটো বাক্সমতন নিয়ে ডেমা না শ্রীফলতলার সেই ছোঁকড়া বসছে। আজকালকার ছোঁকড়ারা পারেও। কোথায় না কোথায় দিয়ে বানানো এক যন্ত্র এনে বসে বলে, এতে বাত নিরাময় হয়। নাম যে কী এই ছোঁকড়ার? মনে পড়েছে, দিলদার। নামের বাহার। পাশে ইব্রাহিমের মজমা এখনও চলছে।
যা হোক, ভিড় কমে গেলেও কোলাহল একটু কম, কিন্তু দুইজন মানুষ টাইপিস্টদের বড়ো একচালার সামনে বেশ চেঁচিয়ে কথা বলছে, তা বোঝা যায়। জরিনা তার পাশ থেকে আগেই এগিয়ে গেছে। মোসলেম দেখে, সুকুমার আর আজগরের প্রায় হাতাহাতি হওয়ার দশা। হয়তো জরিনা একটু আগে দেখতে পেয়েছে। তাই মোসলেমের পাশ থেকে আগেই গেছে। মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে যথাসাধ্য দ্রুত এগোয়। শোনে :
সুকুমার ॥ হইচে হইচে, তুই আর কথা কইস নে, শালার মোড়েলগইঞ্জে পদ।
আজগর ॥ মোড়েলগঞ্জ তোরে করচে কী? চোদ্দচে না পোন্দাইচে?
সুকুমার ॥ ফাও কতা কইস নে–
আজগর ॥ ফাও কতা কই কইলাম, কতায় কতায় খালি মোড়েলগঞ্জে মানুষ বুইলগা আমারে খোডা দাও। আমার বাড়ি মোড়েলগঞ্জ না রায়েন্দা সেয়া দিয়া তোর দরকার কী?
সুকুমার ॥ দরকার আছে। তোরা হলি ডাকাইত, খাতি ডাকাতি কইরে, এহোন এইহেনে আইসে বান্দর চড়াইয়ে খাতিচিস–
আজগর ॥ তাতে হইচে কী? বান্দর চড়াইয়া খাই আর যাই করি–ডাহাতি করচি নাকি?
সুকুমার ॥ ডাকাতিই। বালের ডাকাইতে পদ, এহোন এইহেনে আইসে জুটিচে!
মোসলেম চারদিকে তাকায়। পরিচিত কাউকে খোঁজে। তাদের এই ঝগড়ার কারণ বুঝতে চেষ্টা করে। বেশির ভাগ দিন তো সুকুমার আর আজগরের দোস্তিই দেখে। আজ সকালেও তাই দেখেছে। মোসলেম যখন একবার এদিকে এসেছিল, তখন দেখেছে, তারা দুজন লঞ্চঘাটের দিক থেকে আসছে। জরিনা সঙ্গে ছিল না। আজগরের বাঁদর দুটো তখন ট্রেজারির পাশে কুল গাছতলায়। সুকুমারের খেলা দেখানোর জিনিসপত্র এপাশের মেহগনি গাছটার নীচে। এখনও সেখানেই আছে। মোসলেম প্রায় তার কাছেই দাঁড়ানো। তারপর লঞ্চঘাটের দিক থেকে এসে তারা মোসলেমেকে বলেছে, কী আপনি এই জায়গায়, এহোন যাননি? নাকি আইজ সারা কোর্ট চত্বরের মানুষজনের জামা-কাপুড় সব পরিষ্কার। কোথায় নেই কোনও মলিনতা। সব শুভ্র সমুজ্জ্বল।
কথাগুলো বলেছিল সুকুমার। ছেলেটা কথা জানে। চটপটেও। প্যান্ট পরে। কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে কে জানে? মোসলেম তা জানতে চেয়েছে, তুই মনেও মেট্রিক-ট্রেট্রিক পড়িচিস? হাই স্কুলে গেইলি নাকি?
সুকুমার বলেছে, ধইরে নেন, মেট্রিক ফেল।
ধইরে নেন না। ক দেহি—
আজগর বলেছে, ও মোসলেম কা, ওর কথায় কান দিয়েন না। ও বাড়া এক সেয়ান পাগল।
সেয়ান পাগল? এ আজগর ওর মদ্যি তুই পাগলামির কী দেকলি? ছেমড়াডা কী সুন্দর কইরে কতা কয়?
তাই নাকি? আজগর বলে, ও সুন্দর কইরগা কতা কয়? ওর মুখ শোনচেন আপনে? শোনলে আর ওই কতা কইতেন না।
এই যে এট্টু আগে কী সুন্দর করে আমার ধারে জিগল?
তখন সুকুমার একবার আজগরের শরীরে খোঁচা দিয়েছে, ফাও কতা কইয়ে না। মুরব্বি গুরুজন মান্য কইরও!
ওই দেখিছেন- আজগর বলেছে, আসলে কতা জানে, আপনার সামনে ভক্ত কতা কয়।