কোথায়? লঞ্চঘাটের দিক?
হয়। কেন যাবি না?
না, আমি ভাবলাম আপনি আবার ওই বারের সামনে আলম ভাইর দোকানে যান নাই (নাকি? ওই জায়গায় তো সব সাউয়োর ভদ্দরলোকরা চা খায়, ওহানে আমি যাই না। আপনি আবার ওই আলমের দোকান ছাড়া চা খান না!”
তোরে কল কেডা? তোর জন্মের আগের তে এই লঞ্চঘাটে চা খাই। আলমের দোকানডা হল বছরখানেক।
না, আমি আপনারে লঞ্চঘাটের দিক সেরম আসতি দেহি না তো—
তুই এইহেনে আসলি সেদিন, তার দেকপি কোয়ানদে?
জরিনা মোসলেমের সঙ্গে হাঁটে। মেইন রোড ধরে দক্ষিণে একটু এগোলেই বামে লঞ্চঘাটের গলি। দু-পাশে ভাতের হোটেল। সেখান থেকে লঞ্চের যাত্রীদের অনবরত ডাকার কোনও বিরাম নেই। এখন মোড়েলগঞ্জ, হেড়মা, কচুয়া এসব জায়গার লঞ্চ ছাড়ার সময়। এক-আধ ঘণ্টার ভিতরে ছাড়বে। এই লঞ্চঘাটে লঞ্চ আসার ও ছাড়ার সঙ্গে কোর্টের সময়ের সম্পর্ক আছে। প্রতিদিন সকালে এমন সময়ে বিভিন্ন নদী তীরবর্তী অঞ্চল থেকে এমন লঞ্চগুলো এসে ভেড়ে যাতে যাত্রীরা কোর্ট কাছারিতে তাদের কাজ সারতে পারে। আবার একে একে ছেড়েও যায় এমন সময়, যখন ওই সব জায়গার মানুষের সেদিনের মতন কোর্টের কাজ শেষ হয়ে গেছে। তখনও যারা যেতে পারে না অথবা যাদের কোর্টের কাজ শেষ হয় না, তারা অনেকেই লঞ্চঘাটের এসব হোটেলে থাকে। এগুলো বেশির ভাগ ছাঁচলাছা হোটেল। দোতলায় শোয়ার ব্যবস্থা। বালিশ-চাদর কোনও রকমের। গরমের দিনে হয়তো একটা বালিশই দেয়। আব্রু বলতে নেই। নীচতলায় খাবার জায়গা, বেঞ্চি লাছা, তারপর পিছনের দিকে ফাঁকা জায়গায় কোনও রকমে একটু টিন দিয়ে ঘেরা পায়খানার জায়গা। গোসলাদি করার জন্যে সামনে নদী।
লঞ্চঘাট রেখে মেইন রোড ধরে নাগের বাজারের দিকে একটু এগোলেই রাহাতের মোড়ে পাশাপাশি তিনটি হোটেল। এই তুলনায় ভালো। রাহাত হোটেল, রহমত হোটেল আর হোটেল বিলাশ। সেই হোটেলগুলোয় একটু অবস্থাপন্ন মানুষজন রাতে থাকে। আরও এগোল মাঝিঘাটের কাছাকাছি আছে হিন্দু হোটেল। সেখানেও ওই চাঁচ লেছে থাকার ব্যবস্থা। যারা শুধু খেতে সেখানে যায়, তারা খেয়ে এসে এই রাহাত, রহমত কি বিলাশ হোটেলে থাকে।
লঞ্চঘাটের দিকে যেতে যেতে মোসলেমকে এক হোটেলের সামনে বসা ম্যানেজার ডাকল, ও মোসলেম ভাই, আইজকে কোর্টে কত লোক–বাণিজ্য খারাপ হইনি–আসেন, ভেটকির মাথা দিয়ে খাইয়ে যান!
মোসলেমকে চেনে সবাই। তাই স্বাভাবিক। একটা পা লুলো মোসলেমকে না চিনে উপায় আছে। এমনকি তার সঙ্গে যে জরিনা, তাকেও চেনে অনেকে। তা মোসলেম তাকে যতই বলুক সে এখানে সেদিন এসেছে, আজগরের সঙ্গে তাকে তো এই লঞ্চঘাটে দেখে সবাই। কেউ কেউ আজগর থাকলে জরিনার সঙ্গে এক আধবার রংঢং-ও করেছে। মোসলেম একবার ভাবে, এই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে লঞ্চঘাটের দিকে না আসাই ছিল ভালো। কোনওদিন তাকে এইসব হোটেল থেকে কেউ ডাকেনি অথবা ডাকার সাহস পায়নি, আজ মনে হয় জরিনার কারণেই তাকে ডাকছে।
মোসলেম হাসে! জরিনা মোসলেমের গা ঘেঁষে এসে বলে, ফটকা এক-একটা মাইয়ে মানুষ দেকলি এহেবারে!
মোসলেম পাশ ফিরে জরিনার মুখ দেখে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে। বুঝে ফেলছে এখন সে তার সঙ্গে আছে তাই তাকে ডাকছে। মোসলেম বলল, হয়। এমনি আমারে ডাহে না কোনওদিন, আইজকে তোরে সাতে দেইহে তারপর ডাকল।
সেইয়ে? তালি দেতাম কয়ডা কতা শুনেইয়ে–
বাদ দে। তোর যা চোপা–এই বয়সে এইরাম চোপা বানালি কী কইরে?
তাই নাই (নাকি)? ও কা, মনে হয় বাড়ির দে বাইরোনের সমায় শাড়ির আঁচলে আমার এই চোপাডারে বাইন্দে নিয়ে আইচি!
মোসলেম পাশ ফিরে আবার জরিনাকে দেখে। সামনে লঞ্চঘাট। সেদিকে যাওয়ার আগে পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাবে। সব কটা চায়ের দোকানের সামনে উপরে পলিথিন অথবা দোকানের ঝাঁপ উঁচু করে দেয়া। এমন রোদ, ওই ঝাপের নীচে দাঁড়াতে পারলে হয়। মোসলেম জরিনাকে দেখতে দেখতে ভাবে। অবাক করা মেয়ে। সে কোর্টের সামনে ক্যানভাস কইরে জীবন পার করল, কত পদের মেয়েমানুষ দেখল এই জায়গায়, কিন্তু এমন সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা মেয়ে কম দেখেছে। চোপা নাকি শাড়ির আঁচলের সাথে বাড়ি দিয়ে বাইরোনোর সময় বাইন্দে নিয়ে আইচে, নাকি এই চোপার জন্যেই বাড়ি টিকতে পারেনি।
চায়ের ছোট্ট গেলাস হাতে নিয়ে, চুমুক দিয়ে মোসলেম জরিনার দিকে চোখ বড়ো করে তাকায়। তার ছোটোছেলের চেয়ে বয়সে খুব বড়ো হবে না। চোখ দেখলে বোঝা যায় বুদ্ধি আছে। জীবনের কোন ফেরে পড়ে যে আজ এইখানে এসে জুটেছে, কে জানে।
মোসলেম বলল, তা কী কতিলি চোপা নিয়ে, বাড়িরদে ওই চোপা তোর শাড়ি আঁচলে বাইন্দে নিয়ে আইচিস! কতা জানিস ছেমড়ি, ভালোই কতা জানিস।
জানতি হয় কাকা, জানতি হয়। ভাবেন আপনেরা কোর্টের সামনে মানুষের পকেটদে ফাটকি দিয়ে টাহা নেন, আপনারই কতা জানেন, এই জীবন চালাতি হলি কিছু কতা তো জানতি হয়।
হয়। হইচে আর বুড়ো কতা কইসে না।
জরিনা শব্দ করে হাসে, এইডেরে বুড়ো কতা কলেন?
হয়, নালি কী? কদেহি আজগর তোরে সামলায় কী কইরে?
সঙ্গে সঙ্গে জরিনার চোখের তারায় ঝিলিক খেলে। পাপড়িগুলো কাঁপল। একই সঙ্গে সে মোসলেমের আশেপাশের মানুষজনেরও চোখ নিরিখ করল। কেউ মোসলেমের একথা শুনেছে নাকি! তারপর বলল, কেডা যে কারে সামলায়? তারে আমি সামলাতি যাব কোন দুখ্যে? আমার খাইয়ে কাজ নেই?