যেমন, সুকুমার এ সবের প্রায় কিছুই জানে না। আবার, আজগর কি ইব্রাহিম শেখের তুলনায় একটু বেশিই জানে। আবার জরিনা কি ঝিলিক এসবের কিছুই জানে না, জানে অন্যকে অবলম্বন করে জীবনকে ধারণ করার কৌশল। আর, বারিক কি মোসলেম তাদের তুলনায় অনেক নির্বিরোধ মানুষ, বয়েসে বড়ো। এই চত্বরে পাকিস্তান জামানার শুরুর দিকে কি তার আগের ইংরাজ জামানার শেষের দিকের কায়দা-কৌশল তাদের কিছুটা হলেও জানা আছে। তারা সেকথা বলে। কিন্তু সেইসমস্ত কথায় তাদের প্রাত্যহিক দিনযাপনের কৌশলে কোনও বদল হয় না, বদল যদি কিছু হয় তা রাজনৈতিক কারণে। অন্য কোনও কারণে তেমন নয়। দেশের শাসক বদলায়, কোর্ট চত্বরের আচার আচরণ তো তেমন বদলে না। কিন্তু কোর্ট ভেঙে উপজেলায় চলে যায়, তাদের আয় রোজগার কমে। আবার, এত দিন মুন্সেফ আদালতে যা লোক সমাগম হত, জজ কোর্ট হওয়ায় তা বেড়েছে। লোক সমাগম বাড়লে আদালতে ক্যানভাসার বাড়ে। তাতে আয় রোজগার বাড়ে ঠিকই, পাশাপাশি জায়গা নিয়ে কিছু কামড়াকামড়িও সৃষ্টি হয়। কেননা, মানুষ তো সীমিত। এমনিতেই এই জেলার লোকজন বলে, মাত্রর তিন উপজেলার জেলা এটা, যদিও কাগজে কলমে উপজেলা নয়টা। কারণ, পুব-দক্ষিণের মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলার মানুষ সব কাজে যায় পিরোজপুরে। পশ্চিমের মোংলা-রামপাল-ফকিরহাটের মানুষ যায় খুলনায় আর উত্তরের মোল্লাহাটের লোকজন যায় গোপালগঞ্জ, এমনকি কেউ কেউ একথাও বলে, গোপালগঞ্জে চিতলমারির মানুষও যায়। তাহলে জেলা সদরে আসে শুধু কচুয়া উপজেলার মানুষ। একমাত্র কোর্টে-কাছারিতেই আসে সব উপজেলার মানুষ। যদি কোর্টে তাদের কোনও কাজ না-থাকত, সদরের জল কোনওদিন কোনও কারণে তাদের পেটে পড়ত কি না সন্দেহ?
ফলে, কোর্ট চত্বরই যা গোটা জেলার প্রতিনিধিত্ব করে। সে জায়গাকে কেন্দ্র করে এই ক্যানভাসারদের জীবনযাপন, বেঁচে থাকা, তাদের ভিতরে ভিতরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বাইরে থেকে ভোলা চোখে কোনওভাবে বোঝা না গেলেও, ভিতরে বিষয়টি আছে। থাকবে। তাই স্বাভাবিক।
এই যেমন, কিছুক্ষণ আগে আজগরের সঙ্গে সুকুমারের এক পশলা বসচা হয়ে গেল। এমন তো কতই হয়, কিন্তু এবারের ঘটনাটা হয়তো স্থায়ী হবে। আপাতভাবে বিষয়টা চত্বরে ক্যানভাসের জায়গা নিয়ে হলেও ভিতরে অন্য কোনও কারণ আছে কি না, তা বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। যদিও আছে। ইব্রাহিম শেখ তাই বলে। সে মোসলেম আর বারিককে জানিয়েছে ভিতরে কারণ ওই জরিনা। মোসলেমের অবশ্য এমন মনে হয়নি যে, জরিনার জন্যে সুকুমারের সঙ্গে আজগরের কিছু হতে পারে। ইব্রাহিম জানিয়েছে, পিছনের ঘটনা আরও বেশ কয়দিন আগের। সেটা মোসলেমের বিস্তারিত জানলে চলে, না জানলেও চলে। কিন্তু ঘটনাটা সে যখন ইব্রাহিমের কাছে শুনেছে, তাকে পুরো ঘটনা বিস্তারিত জানবে, তাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন ইব্রাহিম হোক আর মোসলেমই হোক, তারা তো ঘটনার মাঝখান থেকে দেখছিল।
আজকের মতো ক্যানভাস শেষ করে মোসলেম উদ্দিন গিয়ে টাইপিস্টের ঘরের সামনে বসেছে। এখন সে একটুক্ষণ জিরোবে। একটার পর একটা বিড়ি খাবে। মন চাইলে এক কাপ চা খেতে লঞ্চঘাটের দিকে যেতে পারে। এই সময়, মোসলেম একটা বিড়ি ধরিয়ে দেখে, তার জায়গায় মজমা মিলিয়েছে আজগর। আজগর কী-কী করে তা তার জানা আছে। বৃত্তটা বড়ো করে দিতে একটা বানরের গলার দড়ি একটু ঢিলে দিয়ে এক পাক ঘুরিয়ে আনবে। ওটা মর্দা বানর। মাদি বানরটা তখন তার কোলের কাছে।
এ সময় বারিকের দোকানের কাছে দাঁড়িয়েছিল সুকুমার। তার সামনের ফাঁকা জায়গায় ইব্রাহিম শেখ। ইব্রাহিম এখনও আসর জমিয়ে পারেনি। সবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এইটুকু দেখে মোসলেম নিজের পোটলাটা টাইপিস্টদের ঘরের কাছে রেখে, চা খেতে লঞ্চঘাটের দিকে যায়। মোসলেম রওনা দেয়ার পরপরই তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আসে জরিনা। মোসলেম জরিনাকে দেখে একটু অবাক। জানতে চাইল, তুই ছিল কোতায়?
জরিনা বলল, নদীর কূলে গেইলাম, হাওয়া খাতি। আইজকে যে গরম পড়িছে, তাতে মাইনষির জিন্ধে বাইড়োইয়ে যাবে। দুপুরের মদ্যি কোর্ট ফাঁকা।
হয়। তুই কলিই হল, দুই দিন আগেও পড়িল, সেদিন ফাঁকা হইল? গরম পড়িলই কোর্ট ফাঁকা হইয়ে যাবে নানে, আইজকে বিশেষ কোনও কেসের তারিখ, দেহিসনি সহলদে কী ভিড়!
জরিনা একটু অবাক, বড়ো কেসের তারিখ থাকলি সেদিন ভিড় বাড়ে?
তুই দেখি কিছু জানিস না, ভিড় বাড়ে না তয়?”
আপনি এইহেনে কতদিন ধইরে?
তা প্রায় প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর। তারও আগে আসতাম, তখনও ক্যানভাসার হইনি
মোসলেম একথা বলে একটু সরু চোখে জরিনার দিকে তাকায়। মেয়েটা এত নাদান ভাব করে কী জন্যে? মনে হয় তো যেন বেবোধ পাবলিক! ভাজা মাছ উলটোইয়ে খাতি জানে না। কিন্তু আজগরের সাথে ফেউর মতন জুইড়ে আছে।
জরিনা জানতে চাইল, ও কা, আপনি যাতিচেন কোহানে?
মোসলেম একবার ভাবে বলে কোথায় যায়, আবার ভাবে, বলবে না। মেয়েটা তাকে জ্বালিয়ে মারছে। আধ ঘণ্টা পোনে এক ঘণ্টা ক্যানভাস করার পর একটু নিজের মতন থাকবে, সেই উপায় নেই। ফেউর মতন এই জরিনা তার পিছনে লেগেছে। এই ছেমড়ি পারেও। আজগরের জীবনটা প্রায় ঝুরঝুরা বানাইয়ে ফেলিচে। কিন্তু যাই হোক, হঠাৎ জরিনার মুখোনার দিকে তাকিয়ে মোসলেমের মনে হয়, মেয়েটার মুখোনায় বড়ো মায়া। চেয়ে পড়লে চোখে ভাসে, যেন তার সেই বড়ো বোনের আদল। তবে বোনটা জরিনার মতন এত কালো ছিল না। মোসলেম এই ফাঁকে বিড়িতে বার দুয়েক টান দিয়েছে। ধোঁয়া ছাড়ল আকাশে। দুপুরের রোদে প্রায় হাওয়াহীন রাস্তায় সে ধোয়া একটু উপরে উঠে খানিকক্ষণ দলা পাকিয়ে থাকে। তারপর হাতের লাঠিখানায় আবার ভর দিয়ে একবারই জরিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, যাই চা খাতি, যাবি?