জরিনা হাতের ইশারায় সুকুমারকে তার কাছে বসতে বলে। গলা নামায়। একটু ফিসফিসিয়ে সরে বলে, তোমাগো মদ্যি হইচে কী?
কী হবে?
ঝিলিক বুন্ডি চইলে গেল?
ছওয়ালরে দেকিত ইচ্ছে করে।
তুমি এট্টা বাদাইয়ে দিলি পারতা?
আমার নেই চাউল-চুলো। আর মামাতো ভাইর থুইয়ে যাওয়া বউ–
হইচে। মাইয়ে মানুষ যার সাতে থাহে তার। ওই মুনিগঞ্জ কালীবাড়ি যাইয়ে কপালে এট্টু সিন্দুর ছোঁয়াইয়ে লইয়ে আসলি হত, বাল কও নিকি?
জরিনাদি, হয় না ওভাবে।
হওয়ানোর ইচ্ছে থাকলি হয়।
তা হয়। কিন্তু আমাগো সে সুযোগ হয়নি।
হবে নে। যাও, মানুষটারে ফিরোইয়ে নিয়ে আসো।
সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে জরিনা কথাটা বলল, সে কথায় দাবিও আছে। সুকুমার তখন পন্টুনের দিকে তাকানো। নদীর জল নেমে যাচ্ছে। বড়ো স্থির এই জল। আজকে যে গরম, এখন একবার ডুব দিয়ে এসে সে জরিনাকে স্থির মাথায় বলতে পারত, কী করবে। কিন্তু তা যাবে না।
জরিনা আবার জানতে চায়, কী যাবা? কী মায়া ওই মুখোনে। তোমার উপর কত দরদ।
জানি।
কও দেহি, আর কিছু ঘটিচে নিকি তোমাগো ভিতরে?
না, ঘটিনি।
ওই যে মোড়েলগঞ্জ গেল?
সে তো বাড়িঘরের খোঁজ নিতি। যে জন্যি গেইল, তাতে আমার সাতে কী?
চলো। কোর্টের দিক যাই। ঘুমোইয়ে গেইচে।
কোর্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জরিনা জানতে চায়, আলতাফের ধারদেনা শোধ করিচো?”
হু।
ওই লোকের জন্যি তোমার কতডি টাকা বাইরোইয়ে গেল। ঋণ যে কবে সে শোধ করব?
ফাও কতা কইয়ে না, কাইলকে যদি আমার হয়? ওই রম অকম্মা হইয়ে থাহি?
কোর্ট চত্বর প্রায় ফাঁকা। বারিক তার বইপত্তর একটু আগেই গোছাতে শুরু করেছে। উলটো দিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের বারান্দার সিঁড়িতে বসে ঝিমোচ্ছে গোলাপ মিয়া। দাঁত তোলার সলেমান খাঁ নেই তার বাক্সর সামনে। শুধু টাইপিস্টদের বড়ো ঘরটার সামনে বসে আছে দিলদার। জরিনার দিকে চেয়ে হেসেছে। জরিনা দেখেনি। সুকুমার এমনি হাত নাড়ল। তারপর বারিককে বলল, কী খুড়ো, আইজকে আগে আগে?
আরে বাপু, যে গরম পড়িছে, মানুষ থাহে?
তোমার এই গাছতলায় কী ঠান্ডা, ওই জায়গায় এট্টু শুইয়ে নিলি পারো?
গাছতলায় ঘুম আসে না আমার।
সুকুমার তার মালপত্তর নিয়ে মেইন রোডের দিকে আসে। একটা রিকশার জন্যে অপেক্ষা করে। জরিনার কেন যেন মনে হয়, সুকুমার ঝিলিককে খুঁজতে যাবে। আবার সুকুমারেরও কেন যেন মনে হয়, জরিনা এখনও তাই চায়। সেই জন্যে তাকে বিদায় দিতে দাঁড়িয়ে আছে।
রিকসায় উঠে সুকুমার বলে, সন্ধ্যার বাদে লাস্ট ট্রেন ছাইড়ে গেলিই চইলে আসতিচি।
আচ্ছা। কিন্তু ভাইবে দেহো, তারে ফিরোইয়ে আনবা নিকি?
সুকুমার একটু উদাস। যেন কথা অন্য দিকে নিতে পারলে ভালো। সে ঝিলিকের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে, কলা দুইটে আনলা না যে?
ভুইলে গেইচি। বান্দরঅলার মাথার ধারে রইচে। এহোন ওই দুইটের ওইহেনদে নিয়ে আইসে তারপর দেবানে।
সুকুমার রিকশাঅলার পিঠে আলত খোঁচা দেয়। তখনও জরিনা সুকুমারের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওই কথা আবারও বলে, ভাইবে দেইহো
পিছন ফেরে সুকুমার, আচ্ছা।
জরিনা কোর্ট চত্বরে ঢুকছে। দিলদার বারিকের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে। আর কিছু দেখা গেল না। রিকশা কাজী নজরুল ইসলাম রোড হয়ে রেল রোডে পড়বে একটু পর।
…
রেল স্টেশনের চত্বরে, লেকের পাড় ঘেঁষে সুকুমারের খেলা দেখানো শেষ হওয়ার পর দিনের আলো আর প্রায় নেই। মালপত্তর গুছিয়ে সে লেকের পাড়ে বসে থাকে। তারপর এক কাপ চা খেয়েছে। পাশের ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে। ট্রেনটা তখন ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে বার দুই হুইসেল দিয়েছে। সুকুমার জানে ট্রেন ছাড়তে আরও কিছুক্ষণ বাকি আছে। লেকের পাড়ে হাঁটুমুড়ে বসে সে ভাবে, লঞ্চঘাটে যাবে নাকি আজগর আর জরিনার কাছে, নাকি উঠে বসবে ট্রেনে। মেজো বউ ফুলতায় যেখানে গেছে, গেছে তো ঠিকঠাক? এখন গেলে সে আজ রাতে ফুলতলা পৌঁছতে পারবে? না পারুক, কাল সকালে যাবে ফুলতলা। আবার পরক্ষণেই ভাবে, না যাবে না। এখন রেল রোডের মুখে গিয়ে একটা রিকশায় উঠে চলে যাবে লঞ্চঘাটে। আজগর নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠেছে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুকুমার। মালপত্তর হাতে নেয়। সোজা স্টেশন বিল্ডিংয়ের ভিতর দিয়ে দাঁড়ার প্লাটফর্মে। আবার ভাবে, উঠবে ট্রেনে? এই ট্রেন রূপসা পৌঁছতে পৌঁছতে নটা সাড়ে নটা, ওপার গিয়ে কাল খুব ভোরে ট্রেনে অথবা বাসে যাবে ফুলতলা। ততক্ষণে মেজো বউ ওখানে থাকবে তো। তারপর ফুলতায় কাকে কোথায় কী খুঁজতে হবে তা ভাবে। তবু ট্রেনে উঠবে কি না, সেই দোটানা কাটে না তার!
ইঞ্জিনে আবারও বার দুই হুইসেল দিতেই সুকুমার আলগোছে ট্রেনে ওঠে। যেন যাবে বলেই এসেছিল, এখন কোনও দোটানার আভাস নেই। ট্রেনের ভিতরে খুব অন্ধকার। কামরা ওই কোনায় একটা লাইট জ্বলছে। তাও যেন টেমি!
সিটে বসার পর পরও সুকুমারের দোটানা কাটে না। নামবে নাকি? আবার ভাবে। একটু আগে সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যাবেই, সেটা আবার কেটে গেছে। তার মনে হয়, নেমে যায়।
ট্রেন ছাড়ে। সুকুমার বসে থাকে। কামরায় আলো জ্বলেছে আরও দুই-একটা। প্রায় ফাঁকা কামরা।
লঞ্চঘাট থেকে শোনা যায় ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার হুইসেল। জরিনা আজগরকে বলে, সুকুমার ভাই মনে হয় চইলে গেল এই ট্রেনে।