জরিনা বলে, এই বিলে না কইয়ে, হাতের ওই লাঠিখান দিয়ে কলি পারেন?
সুকুমার বলে, বাদ দেন, চলেন চা খাই।
চা খাওয়ার জন্যে তারা আলমের চায়ের দোকানের দিকে যায়। দিলদার তাদের সঙ্গে রওনা দিয়েও গেল না। মোসলেম উদ্দিন তার কাছে জানতে চাইল, এ নাটাই, তুই যাবি না?”
দিলদার কিছু বলল না। আজগর তাকে বানর দুটো দেখিয়ে বলল, ও দুটোকে দেখতে। তখন অবশ্য দিলদার বলে, বারিক দুদু দেকপেনে।
আলমের দোকানে আজ বেশ ভিড়। স্বাভাবিক এই ভিড়। গত কদিন কোনও ভিড় ছিল না, যা ছিল তা অস্বাভাবিক। এর ভিতরে এখন চায়ের অর্ডার দিয়ে কখন সে চা পাওয়া যাবে কে জানে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। মোসলেমের পেটে খিদে। সেই সকালে বেরিয়েছে। আজ আর বাজারে যাবে না। পাউডার বানানোর মতো জিনিসপত্তর আলেকজানের কাছে এখনও মজুদ আছে। সে বলে, নদীর পাড়ে চল, দেহি ছাত্তারের দোকানের চা পাই নিকি?
ডাকবাংলোর সামনে দিয়ে ছাত্তারের দোকানে গিয়ে তারা চা খায়। সুকুমার দুটো দাগঅলা কলা ছিঁড়ে জরিনার হাতে দেয়। তার আগে ছাত্তারকে জানায়, এই কলার দাম অর্ধেক। সুকুমার বানরের জন্যে কলা কিনছে দেখে আজগর বলে, আইজকে কামাই মনে কয় খারাপ হইনি, না?
মোসলেম উদ্দিন বলে, যে খেলা দেখাইচে! তুই পারবি ভাইডি। লাইগে থাহিস। তোর পেটে ভাত হবে।
সেয়া হত, জরিনা বলে, কিন্তুক কতদিন লাইসে থাহে, সেইয়ে দেহার।
কেন?”
ঝিলিক বুন্ডি কইচে, ওর কোনওতায় বেশিদিন লাইগে থাহে না।
কইচে তোমারে? সুকুমার বলে।
কইচে না। বেড়া মানুষ সব একপদ। জানা আছে আমাগে।
আজগর চার গোলাস মুখের কাছে নিয়ে সুকুমারকে দেখে। এইমাত্র ঝিলিকের কথা বলায় সে একটু আনমনা হল। কী হত, যদি এখন জরিনা এই কথা না বলত।
হইচে, তোরা ক তোগো ফাও কতা, আমি গেলাম। মোসলেম উদ্দিন পকেটে হাত দেয়। পকেটে হাত দেয়ার আগেও তার ফিনফিনে জামার পকেটে দশ টাকা খানা উঁকি দিতে দেখা গেছে। অবশ্য সুকুমার তাকে মানা করে। কিন্তু মোসলেম শোনে না। ছাত্তারকে চায়ের দাম আর আজগরের বানরের জন্যে দুটো দাগঅলা কলার দাম দেয়। তারপর তার লাঠিখানা হাতে নিয়ে লেংচে লেংচে চলে।
হাঁটায় একটা ছন্দ আছে মোসলেম উদ্দিনের। এই ছন্দটা না-থাকলে হয়তো খোঁড়া মানুষটা এভাবে হাঁটতে পারত না। সুকুমার দেখে। সারাটা জীবন এই করে কাটিয়ে দিল। কারও প্রতি অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই এমন একটা মানুষ। একথা বলে এই চত্বরের সবাই। আর বেশভূষা কী অসাধারণ। কোনওভাবেই মনে হবে না, এই লোকটা জামা কাপড় ধোয়ার পাউডার বিক্রির ক্যানভাস করে!
দুপুরের দিকেও নদীর পাড়ে এই রকম হাওয়া আসে, যেন কোনও দিনও একথা জানা ছিল না সুকুমারের! এই দুপুরের রোদের ভিতরে এমন হাওয়ায় মন উদাস হয়। এত গরম, তার ভিতরে এ হাওয়ায় মুহূর্তখানেকের স্বস্তি! এই যে এল, এরপর আবার হয়তো অনেকক্ষণ আসবে না। না আসুক, এইটুকু সময়ে তাকে যেভাবে এই জায়গা থেকে উড়িয়ে ফুলতলায় নিয়ে গেল, তা কি জানে?
আজগর বলে, কী হল?
জরিনা হাসে, বোজো না, কারে মনে পড়িচে।
সুকুমার জানতে চায়, উত্তরে এই নদী গেইচে কোন কোন দিক- হাত বাম দিয়ে উত্তর দিকে দেখায়।
আজগর বলে, আমি বিষ্টুপুরের পর আর যাই নিই উত্তরে। তয় নদী গেইচে খুলনা। এডা তো ভৈরব, আমরা কই দড়াটানা। যাইয়ে খুলনায় রূপসার সাথে মিলিছে। তার আরও উত্তরে দৌলতপুর ফুলতলা নওয়াপাড়া যশোর- আজগর তার কথা বলে যেতে থাকে। খেয়াল নেই, সুকুমার একসময় খুলনাতেই ছিল।
কেন, এই নদী বাইয়ে কোনও দিকে যাবা নিকি? জরিনা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সুকুমারকে বলে।
সুকুমার একবার জরিনাকে দেখে তারপর নদী দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তাতে তার হয়তো রূপান্তর হয়। সেখান থেকে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে বলে, চলো, খাইয়ে নিই। দুপুর হইচে কহোন। সেইয়ের পর শরীরে জুত পালি রেলস্টেশনে যাইয়ে আর একবার খেলা দেহাবানে সন্ধ্যার আগে।
আজগর উৎসাহ দেয়, এডা কাজের কতা কইচিস, সেইয়ে কর।
তুমি যাবা নাকি?
নারে, আমার শরীরের সে গতি নেই।
জরিনা হাসে, উনি এহোন ওনার খোপে জরিনার কোলে মাতা দিয়ে শুইয়ে থাকপে। আর কবে উনি নবাব সিরাজ আমি আলেয়া। চেটের নবাব আমার। শালার ফাও চাইল গেল না কোনও কালে?
আজগর মুখ ছোটায়, ওরে সাউয়ো আমার, তুই কোন বাল ছিঁড়ে আটি বান্দিস?
দেহিচ্ছো সুকুমার ভাই, এরে এট্টু রসের কথা কলিও কীভাবে মুখ খারাপ করে।
বাদ দেও। চলো, আলতাফের হোটেলে যাই। আচ্ছা, আমার মালপত্তর রইচে বারিক খুড়োর ওই জায়গায়–
পাঁচটা পর্যন্ত কোনও সমস্যা নেই। বারিক আছে। তার আগে গেলি আলতাফের ওই জায়গায় খবর পাঠাবে নে।
একটু আগে জরিনা যা বলেছে, তাই ঘটল। খাওয়ার পরে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে নিজের ঝুপড়ির পর্যন্ত এসে সেই কাজই করল আজগর। বাইরের দিকে বসা জরিনা, তার কোলে মাথা দিয়ে সে তন্দ্রা গেল। বিড়িটা শেষ হওয়ার আগেই চোখ জুড়িয়ে গেছে। মাথার কাছে দাঁড়ানো সুকুমারের বিড়ি তখনও শেষ হয়নি। জরিনা বলল, ঘুমোইয়ে গেলি বান্দর দুইটে নিয়ে আসপো।
আমি তালি কোর্টের দিকে যাই।
এক সাথে যাবানে। এহোন যাও আলতাফের উপরে যাইয়ে এট্টু চোখ বোজো।
দিনে চোখে ঘুম আসে না আমার। যাইয়ে বারিক খুড়োর ওই জায়গায় এট্টু বইসে থাইহে তারপর যাব রেল স্টেশন। ততক্ষণে বেলা পইড়ে আসপেনে।