সুকুমার বলে চলে, এইখানে আনন্দ নিয়ে, চক্ষু দুটো ভরে এই খেলা দেখে, আমাকে দুটো পয়সা দিয়ে বাড়িঘরে ফিরে মা ভাই বোন বউ ছেলে মেয়েকে বলতে পারবেন, আজ খেলা দেখেছি। একটু আগে কিনলেন কাপড় কাঁচার পাউডার তাতে জামা কাপড় সাদা হবে আর খেলা দেখলে মন সাদা হবে। আনন্দ হবে। কী হবে না? জোরে বলেন?”
মোসলেম উদ্দিন বানর নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা আজগরকে বলে, এই ছেমড়াও দেখি কতা জানে। শিহিছে কোহানদে? দেকতি মনে কয় নরম।
শিহিছে ইব্রাহিমের কতা শুইনে।
সুকুমার টেনিস বলগুলো একহাতে ধরে। একটা বাঁ হাতে নেয়। আবার বাম হাত ডান হাত করে। তারপর ডান হাতেরটা একটু উপরে ছুঁড়ে দিতে দিতে সমবেত জনতার একদিকে যায়। তাতে বৃত্ত বড় হয় ফিরে এসে গাছতলার দিকে দাঁড়িয়ে টেনিস বলটা একটু বেশি ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বাম হাত থেকে আর একটা নিয়ে একই সময়ে উপরে দেয়। উপরেরটা হাতে আসতে আসতে আবার ছেড়ে পরেরটা তখন হাতে আসে। এরপর বাঁ হাতের বাকিটা। তিনটে বল এভাবে তার হাতে একই সঙ্গে উপরে নীচে হতে থাকে। জনতা তালি দেয়।
হাতের এমন আর একটা খেলাও দেখায়। ছোটো মুগুর সাইজের তিনটে কাঠির। তারপর পকেট থেকে একটা রাবারের বল বের করে সেটা তালুতে রেখে আবার উধাও করে দেয়। তালুতে আছে, তালুতে নেই। এমনকি একটা দিশলাইয়ের বাকসো এমনভাবে ঘোরায় হাতে। এই তালুতে আছে সেটা, পর মুহূর্তে নেই। আবার জনতার তালি।
এবার বোচকা থেকে ফুটবল বের করে সুকুমার। বের করার আগেই একপ্রস্ত করতালি। বোঝা গেল, সুকুমারের এই খেলায় জনতার উৎসাহের শেষ নেই। তারা টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখে। ম্যারাদোনার পায়ের জাদুর কথা তাদের জানা আছে। স্টেডিয়ামে খেলা হলে এদের অনেকেই দেখতে যায়, টিকেট কাটতে না-পারলে পাশের গাছে উঠে দেখে। এখন তাদের সামনে বাইশ জনের খেলা না-হোক, একজন ফুটবল নিয়ে পায়ের জাদু দেখাবে।
সুকুমার বলটা হাতে নিয়েই বোঝে পাম্প একটু কম। এ কয়দিন খেলা না দেখানোয় বলটা একদিনও বের করে দেখা হয়নি। দেখা দরকার ছিল। যা হোক, এখন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে লাথি দিতে হবে। সুকুমার মাথায় বলটা রাখে। সেখানে কয়েকবার উঠিয়ে নামিয়ে তারপর ঘাড়ের কাছে আনে। ঘাড় থেকে নিজের শরীর দ্রুত এক পাশে সরিয়ে আনে ডান পায়ে। ডান পায়ে থেকে বাম পায়ে। হাঁটুতে, হাঁটু দিয়ে খোঁচা দিয়ে আবার পায়ে। সেখান থেকে উরুতে। দুই উরুতে বার কয়েক নাচিয়ে আবার ঘাড়ে, ঘাড় থেকে সোজা ডান পায়ে। সেখান থেকে মাথায়।
জনতার তালি থামে না। সুকুমার বলটা মাথা থেকে দুই হাতে জড়িয়ে চুমু খায়। জনতার করতালি। টাকা পয়সা পড়ে কিছু। কেউ কেউ এসে সুকুমারের হাতে দেয়। সুকুমার বৃত্তাকারে যারা দাঁড়ানো তাদের কাছে যায়। তারা তার হাতে দেয়।
এই ব্যাপারটা একটু অকস্মাই ঘটে। এরপর অন্য আর কোনও খেলা সে দেখাবে কি না, মজমার জনতা তার জন্যে আর অপেক্ষাই করেনি। তারা ধরে নিয়েছে, এটাই সুকুমারের দেখানো শেষ খেলা। তাই যেন তাকে খেলা দেখানোর বকশিস হিসেবে এই আয়োজন।
সুকুমারও বলে, যাবেন না আপনারা। এরপর ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া তুড়া নিয়ে আসতেছে একজন। দেখবেন বান্দরের খেইল।
এতে কাজ হল। আবার হল না। যারা বানর খেলা দেখবে তারা থাকল, যারা আজগরের বানর নাচানো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত তারা চলে গেল।
সুকুমার ফিরল বারিকের গাছতলায়। তখনও সেখানে মোসলেম উদ্দিন আছে। আছে গোলাপ মিয়া আর জরিনাও। আজগর ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে বানর দুটো নিয়ে এগিয়ে গেছে। যদিও এখন ফির সুকুমারের আসরের তুলনায় পাতলা।
সুকুমার কাছে আসতেই মোসলেম উদ্দিন বলেন, দেহালি আইজ, জন্মের ফাইন।
জরিনাও তাই বলে। কিন্তু মোসলেম সঙ্গে আরও বলে, তা এত কথা তুই শিকলি কোয়ানদে? খেলা যেরাম দেহাইচিস। কথাও কইচিস সেইরাম। বলে, মোসলেম বারিকেরও অনুমোদন চায়। তারা একটু আগে এই কথা আলোচনা করছিল। বারিক তার প্রায় মুদে থাকা চোখজোড়া খুলে অনুমোদন দিল ঠোঁটে লাগানো হাসিতে।
গোপালা মিয়া বলল, চা খাওয়াও। কামাইচো তো মন্দ না?
জরিনা বলে, যাবেনে, আগে বান্দর নাচানোর মজমাডা এট্টু শেষ হোক। বলে মোসলেম উদ্দিনের দিকে তাকাল। এখন মোসলেম যা বলবে তাই হবে।
সে সুকুমারের দিকে একটা আচা দিয়ে ঢাকা দেয়া ঘটিটা এগিয়ে দিয়ে বলে, নে, পানি খা। পানি খা। গলাটলা এহেবারে শুকোইয়ে গেইচে তোর। কতা কতিচিস যেন হাঁসের ছাও।
তা সত্যি, কদিন বাদে এতটা উঁচু গলায় কথা বলে সুকুমারের গলা থেকে আর স্বর বেরুচ্ছে না। এমনকি রোদের এই তীব্র তাপে এখন চোখেও আর দেকছে না কিছুই। একটু চা খেতে পারলে হত। কিন্তু আজগরের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
একটু পরেই আজগর আসে। আজগরের আসর তেমন জমেনি। আসলে আজগর এখনও শরীরের তা যেমন পায়নি, একইসঙ্গে তার বানর দুটোই যে এই কদিনের জড়তায় খানিকটা জড়। আজগর আজ মর্দাটাকে মজমার মাঝখানেই দুটো পিটান লাগিয়েছে। তাতে অবশ্য কিছুটা কাজ হয়েছিল, কিন্তু আজগর নিজেই তেমন জুত পাচ্ছিল না।
ফিরে এসে আজগর বলে, আইজ সেরাম মজমা হল না।
মোসলেম উদ্দিন বলে, বাদ দে, আইজ যা পাইচিস্ এই কত। এদিকের অবস্থা এই। তারপর নিজে উঠিল জ্বরদে। শরীর জুতের না থাকলি কোনও কিছুই জমে না বাবাজি। এট্টু শরীরের দিকে খেয়াল দে এহোন, আর ওই কামারপট্টির পিছনে যাইস নে। গেলিও এট্টু কমাইয়ে যা।