তবু, এখন একটু আনমনা, উদাসী সুকুমারের সাথ ছাড়ছে না ঝিলিক। কোথায় গেল। ফুলতলায় ওইসমস্ত মানুষজনের চেনে কিছু। কোনওদিন গেছে ও জায়গায়? জীবনে কোনওদিন সুখ পাইল না, এখন যদি আবার একটা কিছু হয়ে যায়? দেখা গেলে যশোর নিয়ে খারাপ পাড়ায় বেচে দিল। এখনও তো গায়ে কিছু মাংস আছে ঝিলিকের। খারাপ পাড়ায় একবার ঢোকলে আর কোনওদিন ওই জায়গা দিয়ে বের হতে পারবে না। তাহলে এই জীবন গেছে মেজো বউর! এই জীবনে কোনওদিন তাহলে ভরতরে আর দেখা হইচে! তার ভরত থাকপে কোথায় আর সে থাকপে কোথায়।
পানের দোকান পর্যন্ত যেতে যেতে সুকুমার এই সমস্ত ভাবে। একবার ভাবে আজই, পারলে এখনওই চলে যায় ফুলতার দিকে। কিন্তু, ফুলতালার কোথায় গিয়ে খোঁজবে? শুধু ওই মহিলার সঙ্গে ঝিলিকের কথায় কথায় জেনেছিল, ফুলতলা বাজারে দোকান আছে ওই মহিলার ভাইর। স্বামী ওই জায়গায় কোন একটা আড়তে কাজ করে। অথচ নাম জানে না, কিছু জানে না, এইভাবে ফুলতলায় সে কারে খুঁজে বের করবে? এ নিয়ে সুকুমারের দোটানা। সে জানে না কী করবে। নাম ধাম ঠিকুজি কুলজি কিছুই না জানা মানুষকে কীভাবে পাওয়া যাবে। আর ওই মহিলাকে না পেলে কোথায় ঝিলিক!
একটা সিগারেট ধরিয়ে বারিকের গাছতলার দিকে আসে সুকুমার। চত্বরের দিকে তাকায়। মোসলেম উদ্দিনের আসর প্রায় শেষের দিকে। গাছতলায় আজগরের পাশে জরিনা এসেছে। তার পাশে গোলাপ মিয়া। গলায় ঝোলানো কান পরিষ্কার করার যন্ত্রপাতি। কয়েকদিন বাদে গোলাপ মিয়ার সঙ্গে দেখা হল। সে এখন তক্কে তক্কে আছে মোসলেমের আসরটা ভাঙলে কোনও কান পরিষ্কারের কোনও খদ্দের পায় কি না। গোলাপ মিয়ার গায়ের জামাটা খুব ময়লা। সুকুমারের একবার বলতে মন চাইল, মোসলেম কাকার কাছ থেকে এক প্যাকেট পাউটার নিয়ে সে জামাটা ধুইলে পারে। নদীর জল এখন কী পরিষ্কার। যদিও এই জলে বেশ লবণ, কাপড় কাচলেও যেন খুব ভালো পরিষ্কার হয় না। মোসলেম উদ্দিন তার ক্যানভাসের জন্যে আনে সাপ্লাই কলের জল, চাপ কলের জল কখনও আনে না। তাতে নাকি ময়লা ছাড়ালেও একটা লালচে ভাব থেকে যায়। বলে, ওই পানিতে আয়রন! তা আয়রণ হোক আর নদীর পানিতে লোনাই হোক, গোলাপ মিয়া তো জামাডা এট্টু কাচলি পারে। এইরম জামা কাপড় নিয়ে মানুষের ধারে কান খোঁচানের জন্যি গোলাপের এট্টু লাজও করে না?
এখন সুকুমারের মাথা থেকে ঝিলিক খানিকক্ষণের জন্যে উধাও, সেখানে গোলাপ মিয়া। সিগারেট ধোঁয়া উড়িয়ে মোসলেম উদ্দিনের আর কতক্ষণ লাগবে তা দেখতে দেখতে যখন সে বারিকসহ সবার বেশ কাছাকাছি, তখন আজগরের পাশে হাঁটুমুড়ে বসা জরিনা বলে, ওই দেখি সুকুমার ভাইডি!
আজগরের জন্যে এটা কোনও সংবাদই নয়, সুকুমার এতক্ষণ এখানেই ছিল। সে জরিনাকে জানায়, তা কী হইচে। ওতো এইহেনেই ছেল!
আমি ভাবলাম, গলা নামায় জরিনা। এমনভাবে বলে যেন শুধু আজগরই শোনে, চইলে গেইচে নিকি?
যাবে কোয়ানে? মোসলেম কাকা উঠলিই ও নামবে।
সেইয়ে? আইজকে তুমি নামবা না?
যাবানে একবার। যাই, মোসলেম কার শেষ। বান্দর দুইটের ধারদে এট্টু ঘুইরে আসি।
আজগর উঠে খাড়াখাড়ি মাঠ পাড়ি দিয়ে ট্রেজারির দিকে যায়। সুকুমার এগোয় সদ্য ভঙ্গুর জমাতের দিকে। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ছোট্টো ডুগডুগিটা বাজায়। গোলাপ মিয়াকে বলে গিয়েছিল, সে মজমা মিলানোর পর পরই যেন তার বাক্স-বোচকা ওখানে রেখে আসে।
মোসলেমের আসর ভাঙতে না ভাঙতেই সুকুমার সেখানে আসায় আসরটা তেমন ভাঙল না। এতে বারিকে মুখে হাসি। তাদের দিকে আগুয়ান মোসলেমকে বলল, আইজ মনে হয়, পাবলিক থাকপে।
সুকুমারের খেল দেকতি তো থাকপেই।
হ্যাঁ, সুকুমার পকেট থেকে একটা ডিমবল অর্থাৎ টেবিল টেনিস খেলার বল বের করেছে। দুই আঙুলের মাঝখানে ওই একটা বলকে রেখে তা এমনভাবে সবার সামনে ঘুরাল যেন চারটা বল। তারপর আরও দুটো বল পকেটে থেকে বের করে। তা গিলে ফেলল, মুখ হা করল, মুখে নেই সে বল, তারপর আবার প্রত্যেকটি এক এক করে হাতে নিয়ে এল। এবার এই চারটি বল আঙুলগুলোর ফাঁকে রেখে ঘুরাতে ঘুরাতে ক্রমে একটি বলে রূপান্তরিত করল।
আসরের সমবেত জনতার হাতে তালি। আজ সত্যি সুকুমার জমিয়ে তুলছে। এতক্ষণে গোলাপ মিয়া সুকুমারের পাশে তার মালপত্র রেখে এসেছে। আর সেগুলো খুলতে খুলতে, ভিতর থেকে কোনও কিছু হাতড়ে বের করার আগে, একবারে ইব্রাহিম শেখের ভঙ্গিতে সমবেত জনতার উদ্দেশে সে বলে যেত নাগল, এই কয়দিনের অস্থিরতা, প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার পরে আপনাদের সামনে। এসেছি। আজ আপনারাও এসেছেন আমার সামনে। এই কোর্ট চত্বরে। একটি শতবর্ষী বৃক্ষের নীচে আমাদের আজকের প্রদর্শনী। আপনারা না থাকলে আমাদের পেটে ভাত আসে না। আবার আমরা–এলে এইটুকু আনন্দ বিনোদনও থাকে না। মামলা মোকদ্দমা কাজিয়া বিবাদ ফ্যাসাদ নিয়ে এইযোনে এসে এইটুকু আনন্দ নিয়েই ফিরে যাওয়া।
সুকুমার দম নেয়। বোচকা থেকে বের করে তিনটে টেনিস বল। কিন্তু তার মনে হচ্ছে আগের কথার আরও খানিকটা বলা দরকার। মানুষ আঠার মতন তার মজমায় লেগে আছে। জমায়েত ছোট হয়ে কাছে আসছে। তার খেলা দেখানোর জন্যে বৃত্ত একটু বড় হলেই ভালো। তাতে এরপর যখন ফুটবল পায়ে দিয়ে করসত দেখাবে সে, তখন তাতে সুবিধা হবে।