মোসলেমের জমায়েতে লোক হয়েছে। এই কয়দিন এমন মজমা মেলেনি, আজ এমনিতেই পাবলিকের আগ্রহ যেন একটু বেশি। তাছাড়া, গত কদিনের আবহাওয়া আর শহরের সমস্ত পরিস্থিতি নিয়ে একটা ছোটোখাটো ভাষণও সে দিল। সঙ্গে মফিজ শেখের কবিতার দুটো পঙক্তি। অবাক হল মোসলেম, তাদের নদীর ওপারের কেশবপুর ইস্কুলের সেই মাস্টার মশাইরা আজ তারে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন। জীবনে বেশির ভাগ দিন সে কবিতা মুখস্থ করা নিয়ে মার খেত, আর আজ এমনিতে তার জ্ঞাতি ভাই মফিজ শেখের লেখা একটা কবিতার দুটো লাইন সে গড়গড় করে বলে দিতে পারল। আসলে এ সবই পেটের ব্যাপার। মানুষ আটকানোর জন্যে মাথাও কত সহজে কাজ করে। একেবারে সরাসরি প্রয়োজনীয় কাজ।
এই সময়ে বানর দুটো নিয়ে চত্বরের দিকে আসে আজগর। মোসলেম উদ্দিন তখন মজমায় একটা পুরনো ন্যাকড়া আর একটা পাঁচ টাকা কাদায় চটকে চলেছে। নীচে ইট দিয়ে কাৎ করে রাখছে গামলাটা! সেখানে কিছু পানি দিয়ে পাউডার ছেড়ে দিয়েছে। পানির ঘটিটা একটু আগে বারিক মোসলেম উদ্দিনের কাছে রেখে এসেছে। আজগরের মোসলেম কাজের দিকে খেয়াল দেয়ার দরকার নেই। মজমায় মোসলেম যেখানে বসেছে, ও জায়গায় একটু ফাঁক। বাকি অংশে মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো। আজগরের মুখে হাসি। সুকুমার আর বারিকের দিকে সেই হাসিমুখে তাকাল সে। তার মানে আজ মানুষজন ভালোই।
বারিককে বলে, ও কা, দেইচো, তোমার দোস্ত মজমা মিলাইচে কী ফাইন!
তুইও মিলে, তোরে মানা করতিচে কেডা?
মেলাবানে। আইজকে বান্দর দুইটে কথা শুনলি হয়।
তোর বান্দরে যদি তোর কতা না শোনে, তালি শোনবে কার কতা?”
বোজলা কাকা, এই চ্যাটের আজগরের কতা এই দুনিয়ায় কেউ শোনে না। না শোনে বান্দর দুইটে, না শোনে জরি–
জরিনাদি আবার কী করল? সুকুমার জানতে চায়।
এই যে জরিনার পার্টির লোক একজন পাওয়া গেইচে। এদেশে পার্টি আর একটা বাড়ল!
কেন হইচে কী পার্টি কোতায়?
এই যে হাসিনার পার্টির লোক আমলিগ, খালেদার পার্টির লোক বিএমপি আর জরিনার পার্টির লোক সুকুমার! হা হা হা। উঁচু গলায় হেসে সুকুমারের উদ্দেশে আজগর আরও যোগ করল, চোদ্দনা, সংসার তো করলি না বিটি মানুষ নিয়ে, ও বালের বুজবি কী?
সময় নেই অসময় নেই এমন খাপছাড়া কথা বলার স্বভাব আজগরের। সবই রঙ্গ করে বলা। কিন্তু একথায় হঠাৎ মন খারাপ হল সুকুমারের। ঝিলিকের কথা মনে পড়ল। সংসার তারা করেনি ঠিকই, কিন্তু ঝিলিককে পেয়ে সংসারের কথা মাথায় এসেছিল সুকুমারের। মনে হয়েছিল, যদি থাকে তো ঝিলিক থাক তার সঙ্গে, কোনওদিন যদি একঘরের নীচে একখানে, একখানা চালে মাথা গুঁজে জীবন কাটিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু কোথায় কী? কোত্থেকে উড়ে এসেছিল, হঠাৎ আবার চলেও গেল। আসলে ঝিলিকের জীবনটা বরবাদ করে দিয়ে গেছে তার মামাতো ভাই। সুকুমার বিড়বিড় করে, ভক্তদা আসলে কোনও মানুষ না। একেবারে অমানুষের বাসা। কিন্তু সেই ভক্তদার কাছেই যাবার জন্যে একপায়ে খাড়া হইচে ঝিলিক!
আজগর এরপরই বারিকের সঙ্গে রঙ্গ তামাশা করতে শুরু করে। তার মানে এই কয়দিন একটানা শুয়ে থেকে, একটু নিয়ম মেনে আর কামার পট্টির পিছনের জল গলায় না ঢালায় আজগর বেশ সেরে উঠেছে। ভাবখানা চনমনে। আসলে পকেটে টান। অসুখ-বিসুখ। এইসব মিলে ও জায়গায় যাবার সুযোগ ঘটেনি। আর নয়, ওখানে না-যাওয়ার পাবলিক না আজগর। যেতই যে কোনওভাবে ওখানে।
বারিকের সঙ্গে ওই রঙ্গের ফাঁকে যখন সুকুমারের ওভাবে ঝিলিকের কথা মনে পড়েছে, যেন সেই ভাবনায় তার আর ছেদ না পড়ে, তাই সে রাস্তার পাশের কোনার পান-সিগারেটের দোকানের দিকে যায়। আর ভাবে, আচ্ছা গেল তো মেজো বউ! হ্যাঁ, ঝিলিককে এখনও সে মেজ বউয়ের ছাড়া ভাবতে পারে না। আসলে ঝিলিকও কি তাকে দেবরের বাইরে আর কিছু ভেবেছে? তাদের এক সঙ্গে থাকা নিয়ে ঝিলিকের ভিতরে কোনও দোটানা সে দেখেনি। কিন্তু তারপরও সে চলে গেল।
এখন সুকুমারের দোটানা। একটু পরে সে নামবে। মোসলেম উদ্দিনের প্রায় শেষ, তার আগে এখন এইভাবে ঝিলিকের কথা মনে আসছে কেন? মনে করছে শুধু সে, যে গেছে, সে তো তাকে মনে করছে না। কিন্তু এই যে গেল, জীবনে গেছে কোনওদিন ফুলতলা। খুলনা তারপর দৌলতপুর তারপর ফুলতলা। যদি সেখানে ওই মহিলারে না-পায়। যদি সেখানে ঝিলিকের কোনও অনিষ্ট হয়। কোন বুঝে যে গেল। চারপাশে কত কিছু শোনে। সুকুমার একলাই শোনে নাকি, এমন কথা সবাই শোনে জানে। তার উপর আবার ব্ল্যাকে শাড়ি বিক্রি করা মহিলা। আইজ বাগেরহাট কাল খুলনা পরশু যশোর, তারপরদিন সাতক্ষীরা তা বাদে মাগুরা ঝিনেদা। কোথায় যে যায় আর কোথায় যে যায় না, তার ঠিক আছে। কোথায় কোথায় ঠেলা খায়, কে জানে। কোথায় কী করে কে জানে। সেই চক্করের হাতে পড়ল মেজো বউ!
সুকুমার এক খেলা দেখানো মানুষ, সাতঘাট চরে বেড়ানো মানুষ, কিন্তু তার ভিতরে এক অদ্ভুত সারল্য আছে। সে তুলনায় জীবনভর এই জায়গায় কাটানো আজগর অনেক বেশি সেয়ানা। আর ইব্রাহিম শেখ তো তাকে বেচতে পারে। তা পারবেই, ইব্রাহিমের মতন কথায় ওস্তাদ লোক সে দেখেছে কয়জন। ইব্রাহিমের এখানে ওখানে যেতে হয়, তার ওই ওস্তাদি থাকা স্বাভাবিক, সালসা বেচতে হলে, ওইটুকু ওস্তাদি লাগেই। তবে এর বাইরে, সুকুমার যতটুকু ঘাগু হতে পারত তা নয়। হওয়া সম্ভবও নয় তার পক্ষে, ফুটবল খেলত, সেখান থেকে এই খেলা দেখানোয় এসেছে। অতশত মানুষ চেনা তার হয়নি। ফলে, ভিতরে ভিতরে ঝিলিককে নিয়ে তার আতঙ্ক কাটে না। কিন্তু একটু বাদে, এইমাত্র হাতে নেয়া ছোট্ট ডুগডুগিটা বাজিয়ে আসরে নামবে সে, তার কি এখন ঝিলিককে নিয়ে এভাবে চিন্তিত হওয়া চলে।