সবই বুঝি, কিন্তু আমারও তো ছওয়ালডারে দেকতি ইচ্ছে করে।
আমরা নয় ফাঁকে একবার যাবানে—
হয়, আর গেইচি—
থাইয়ে যাও।
সুকুমারের এই আকুতির উত্তরে ঝিলিক হঠাৎ না– বলে একেবারে যেন খেঁকিয়ে উঠল, যাই, চইলে যাব। তোমার ধারে থাকলি মানষি কবে আমি তোমার বান্দা মাগি!
কী ফাও কথা কও! মুখটুকু ঠিক আছে? অন্য পাশে মানুষজনও থাকতি পারে।
ফাও কত না, কও দেহি, আমি তোমার বান্দা মাগি ছাড়া আর কী।
বাদ দেও।
কাজ নেই, কাম নেই। উনি সারাদিন খেলা দেখাইয়ে ফিরে আসপে, আমি পা ফাঁক কইরে ওনার জন্যি শুইয়ে থাহি!
সুকুমার শোয়া থেকে উঠে বসে। মেজো বউর মাথা পাগল হয়ে গেল নাকি। নাকি ছেলের শোকে মাথা খারাপ। এসব কী বলে। ফাঁকা জায়গায় পরে রাস্তার দিকে এই দোতলায় যে বাড়তি জায়গা সেখানে এসে দাঁড়ায়। একবার ভাবে নীচে নেমে যাবে। কিন্তু এখন এই রাতে নীচে মেসিয়াররা শুয়ে আছে। সামনের দরজা বন্ধ। সুকুমার খুপড়ির সামনে এসে ঝিলিককে বলে, তোমার যে জায়গায় মন চায়, চলে যাও। আমি তোমারে আটকাব না।
আচ্ছা, ভালো হইছে।
আর এই জায়গাদে আমিও চইলে যাব, ফিরি আসলিও পাবা না।
কোথায় যাবা?”
তা জানি না।
এসব কথা একটু আগে জরিনাকে বলল না সুকুমার। তবে তার হেঁটে রেল স্টেশন আসতে আসতে ট্রেন ছেড়ে গেছে। তাহলে ছাত্ররা আর ট্রেন আটকাবে না, আজকের মতো চলেছে। ঝিলিক এতক্ষণে নিশ্চয়ই কলেজ স্টেশন পর্যন্ত চলে গেছে। আরও দূরেও যেতে পারে।
সুকুমার রেল স্টেশন থেকে নদীর কূলে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে ফিরে আসেবে আজগরের ঝুপড়ির সামনে। ততক্ষণে নিশ্চয় অন্ধকার হয়ে যাবে। এখন তার কিছু ভালো লাগছে না। এই পথটুকু হেঁটে আসতে আসতে সুকুমার সিদ্ধান্ত নিল, সেও চলে যাবে!
১০. চারদিকে ঝকঝকে রোদ
পরের দিন সকাল থেকেই চারদিকে ঝকঝকে রোদ। আবহাওয়ার যেমন, কোর্ট চত্বরেরও থমথমে ভাবও কেটে গেছে। বারিক বুড়ো তার বইপত্তর সাজিয়ে নিয়ে বসেছে। আজ সবার আগে চত্বরে মজমা মিলাবে মোসলেম উদ্দিন। এই কদিনে প্রকৃতিতে যেমন ময়লা আবর্জনা, মানুষের জামা কাপড়েও তাই। ফলে, তার পক্ষে এই নিয়ে একটা সহজ ভাষণ দিয়ে কাপড় কাঁচার পাউডার বিক্রির এখন মোক্ষম সময়। তাই তো হওয়া উচিত। তাছাড়া, আজগরের শরীর সবে সেরেছে, সে বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। তার নাস্তা খেয়ে আসতে আসতে একটু সময় লাগে। ইব্রাহিম শেখ কাল আসেনি, আজ আসলেও আসবে একটু দেরি করে। তাহলে সুকুমার আসরে নামবে মোসলেম উদ্দিনের পর পর। তাই সই। এই হিসেব।
এদিকে অন্যান্য যে সব খবরে চত্বর চনমনে, তা যেমন সবাই জানে, জানে বারিক আর মোসলেম উদ্দিনও। টাইপিস্টদের চত্বরেও তা নিয়ে আলাপ। এমনকি দিলদারও খবরাখবর এনেছে কিছু। তাতে সবার উৎকণ্ঠিত ভাব কিছুটা কম। আজ সকালেই আটক নেতাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হক আর মোজাম্মেল উকিল আজ কোর্টে না আসলেও তাদের সহকর্মীরা তাদের পক্ষে কোর্টে উঠবে। এদিকে ছাত্ররা আজ আর মিছিল বের করেনি এখনও, যতদূর জানা গেছে তারা তা করেবে না। নয়টা নাগাদ কলেজ স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। স্টেশন মাস্টার তাদের জানিয়েছে, এখন থেকে মেইল ট্রেনও কলেজ স্টেশনে দাঁড়াবে। ছাত্রদের দাবি বলে কথা।
কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে, তাতে সবাই আনন্দিত, আপাতত ট্রেন তুলে নেওয়া হবে না।
এ নিয়েও আলমের চায়ের দোকান, বারের সামনের পানের দোকান, সবখানেই আলাদা আলাদা হিসেব। যে যাই বলুক ট্রেন আর কোনওদিনও আগের মতন চলবে না। এখন কোনওদিন ষাটগম্বুজ স্টেশনে এসে ট্রেন পড়ে যাবে। কোনওদিন সকালের ট্রেন সময়মতো অফিসে ধরার জন্যে রূপসা স্টেশনে গিয়ে পৌঁছবে না। কোনওদিন লাইনচ্যুত হয়ে সারাদিনের ট্রেন বসে থাকবে। এরপর একসময়, আবার বাস মালিকদের চাপে সত্যি সত্যি ট্রেন তুলে নেওয়া হবে।
যদিও এই সবই ভবিষ্যতের কথা। এখন সে হিসেব মিলিয়ে কোনও লাভ নেই। এখনকার হিসেব এখনকার মতো। এখন যে ট্রেন ছেড়েছে, তাতে তাদের মতো ক্যানভাসারদের পেটের ভাত থাকল। কোর্ট কাঁচারি আপাতত আর বন্ধ হবে না। বারিক প্রতিদিন সকালে এসে বসতে পারবে। পাউডার বিক্রি করে, বাজার সদাই শেষ করে আগামী দিনের জন্যে পাউডার বানানোর জিনিসপত্তর কিনতে পারবে মোসলেম উদ্দিন। আলেকজানের কয়দিন কোনও কাজ ছিল না। মোসলেমের পাউডার বেচার কোনও সুযোগ নেই তো আলেকজানের হাতে কাজ থাকে কী করে।
তাহলে, এই কদিন বাদে, এখন মোসলেম উদ্দিন আবার প্রস্তুত। একটু বাদে নামবে সে। এর আগে চা খেয়ে এসেছে। মুখে দিয়েছে পান। একটা বিড়ি ধরানোর কথা ভেবেছিল, ধরায়নি। বিড়ির অত নেশা নেই মোসলেমের। কথা বলতে বলতে শ্বাস ঘন হয়ে এলে কখনও সখনও একটা দুটো টান দেয়। তা শুধু অনেকদিনের অভ্যাসের একটা দুটো টান কখনও কখনও চাঙা করে মোসলেম উদ্দিনকে।
ঘাড়ের বোচকা বাম হাতে নামিয়ে, ডান হাতে আকারে খুবই ছোটো ডুগডুগিটা বাজাতে বাজাতে মোসলেম লাঠিখানায় ভর দিয়ে চত্বরে দাঁড়াল। ফকফকে সাদা লুঙ্গি সাদা পাঞ্জাবি শার্ট আর যত্ন করে কাটা ও আচড়ানো দাড়িতে আজ মোসলেমকে লাগছে বেশ। সুকুমার সে কথা বারিক বুড়োকে বলল। বারিক জানাল, শুধু পা-খানা যা খোঁড়া, ল্যাংচে হাঁটে, তাছাড়া আরও বছর দশেক। আগে এই মোসলেমের দেখতে যা লাগত! সে সময়ে তারা দেখেছে। জামা কাপড়ে ওর চেয়ে ফিটফাট কোনও কোনও লোক আছে নাকি এই এলাকায়!