ফাও কতা কইয়ে না দিন। তোমার চেটের ফাও কতা শুনতি শুনতি জীবনডা গেল।
সত্যি, এই মুহূর্তে এসব ফাও কথা। একথা তর্ক বা ঝগড়া করেও বলা না। পরস্পরের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা। এর মানে আজগরের শরীর খানিকটা ভালো, গলায় অন্তত প্রকৃত আজগরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। দিন দুয়েকের ভিতরে লোকটা আরও চাঙা হবে নিশ্চিত।
আজগর জরিনার কাছে নিজেদের কথায় ফিরে আসে, দুইজনের এই কয়দিনে ঝগড়া করতি দেহিচিস?”
না। সেয়া করার মানুষ তারা না। সামনে তো করবে না। আলতাফের হোটেলে রাত্তিরে ঘুমোনোর সময় করিচে নিকি?
আলতাফের কিছু জিগোইচিস?
কী জিগোব?
এই যে?
এইয়ে মানুষের ঢোল দিয়ে জিগোন যায়? তুমি যে কী? তাছাড়া ওরা সম্পর্কে কী তা তুমি আর আমি ছাড়া অন্য মানুষ জানে নাকি?”
না, তা জানে না।
তালি?
আজগরের কাছে সত্যি এর কোনও জবাব নেই।
এই সময়ে টাইপিস্টদের ছাউনির বাইরে সুকুমারকে দেখতে পেল জরিনা। উঁচু গলায় ডাকল, ও সুকুমার ভাই?
সুকুমারের হাতে মফিজ শেখের ট্রেন নিয়ে লেখা পদ্যখানাসহ আরও-একটা কাগজ। এটা ট্রেন তুলে নেওয়া নিয়ে ছাত্ররা বিলি করেছে। তার একখানা সুকুমারের হাতে। একমনে পড়ছিল। জরিনার ডাক প্রথম বারে শুনল না। তারপর শুনে তাকাতেই দেখে, তার দিকে উৎকণ্ঠিত মুখে তাকিয়ে আছে আজগর আর জরিনা।
সুকুমার তাদের দিকে এগিয়ে আসতে, মাঝখানের রাস্তাটা প্রায় দৌড়ি পার হয়ে জরিনা বলে, ঝিলিক বুন্ডি কোথায় জানি চইলে গেইচে, ও সুকুমার ভাই!
সুকুমার কিছুটা বিস্মিত কিছুটা জেনে জানত এমনভাবে বলল, চইলে গেইচে? কহোন?
কেন তুমি জানতা?
না, জানতাম না।
তালি, কলা যে কহোন?”
কাইল কতিল, লালির ওইহানদে আসার সময়, একজনরে পাইচে, যে ওর স্বামী মানে আমার সেই দাদারে চেনে। জানে ওর ছওয়ালডা কোতায় আছে। ওর এহোন ছওয়ালডারে দেকতি মন চায়।
চায় তো ভালো কতা। সব মায়েরই চায়। তার এহেন কোতায় গেলি ছওয়ালরে পাবে, তারা তো থাহে ইন্ডিয়ায়। সে কি এই জায়গায়?
সেয়া তারে বুঝেইয়ে কয় কেডা? উপরদে দেখিচেন ঠান্ডা, আসলে ভিতরে ভিতরে মাইজে বউ ভীষণ ঘাউরো। কেউর কথা শোনে না। পরশু দিনদে মনে হইচে চইলে যাবে, আইজই হাঁটল।
তা তো বোঝালাম, তা যাবে কোয়ানে?
এহোন নাকি যাবে ফুলতলা। যার সাতে কথা হইচে সে ফুলতলায় থাহে, সেই জায়গার ঠিকানা দিয়ে গেইচে।
তারপর?
তারপর আর কী, সেই ফুলতলার বিটি সাতক্ষীরার ওই জায়গা দে ওপার নিয়ে যাবে। সেই জায়গা বশিরহাট না কী কয় কোন জায়গা নাকি ধারে—
সুকুমারের এ সব কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিল না। গেছে গেছে। যেমন হঠাৎ এসেছিল সেভাবেই চলে গেছে। আবার কোনওদিন দেখা হবে তারই-বা নিশ্চয়তা কী? একবার একবার এই কথা ভেবে সুকুমার উদাস হতে পারে। এখন অবশ্য তার কিছু ঘটবে। এই চত্বরে আজও তার আসর বসানোর সুযোগ নেই। আলতাফের কাছে ঋণ। এর ভিতরে ছিল ওই কথা কওয়ার মতন। একটা মানুষ, সেও চলে গেল। কেন গেল, সেকথা তো সে চাইলে সব জরিনাকে বলতেও পারবে না।
তবু জরিনা যেন সেই কথাই জানতে চাইল, তোমাগো মদ্যি বাদাবাদি হইচে নিকি?
দেখো জরিনা প্রায় আসল প্রসঙ্গে চলে আসছে। সেদিকে যাবে না সুকুমার। এখন একবার ডিসি সাবের অফিসের সামনে যেতে পারলে হত। ছাত্রদের ভিড় পাতল হয়ে গেছে। নেতাদের নিয়ে মিটিং হচ্ছে। পরে কী সিদ্ধান্ত হয়, জানা যাবে।
সুকুমার বলল, না, কোনও বাদাবাদি হইনি—
তালি যাও এহোনই ফিরোইয়ে নিয়ে আসো। যাওয়ার সময় দেখলাম, চোখ দুটো ভরা পানি নিয়ে গেল।
কী যে কও, এহোন গেলি আর পাবানে?”
অন্তত জানো যহোন খুলনো যাবে, তালি টেরেনের ওই জায়গায় যাইয়ে দেহহা, পাইয়ে যাবানে মনে কয়–
কী যে কও না? কহোন গেইচে। এহোন আবার পাওয়া যাবে নিকি?
তবু যাও।
জরিনার পিড়াপিড়িতে সুকুমার রেল স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। যাবে হেঁটেই। তাতে ততক্ষণে ট্রেন হয়তো চলে যাবে। তার ঝিলিককে ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে না। তবু সুকুমার জানে না কেন যাচ্ছে।
যে কথা হয়েছিল তার সঙ্গে ঝিলিকের তা অতি তুচ্ছ। এমন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে ঝিলিকের চলে যাওয়া পর্যন্ত গড়ানোর কথা না। কিন্তু ঝিলিকই সেখানে নিয়েছে। কথার মাত্রা এত দূরে ছাড়িয়ে গেছে যে সুকুমার বলতে বাধ্য হয়েছে, তোমার যা ইচ্ছে করো।
লালির-হাফেজের রুটির দোকানে ব্ল্যাকে শাড়ি-বেচা যে মহিলার সঙ্গে ঝিলিকের দেখা হয়েছিল, তার কোনও কিছুই পছন্দ হয়নি সুকুমারের। ঝিলিকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। ঝিলিক রুটির দোকানের বাইরে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তার দেবর। তারপর এই পথটুকু আসতে আসতে ঝিলিক জানায়, ভরত কোথায় আছে ওই মহিলা জানে।
তুই জানো, ওই বিটি ফুলতলার কোতায় থাকে?
হয়, খুলনায় ওর বোনের বাসায় আসত।
আচ্ছা, তালি তুমি যে যাবা, ভক্তদা তোমারে নেবে। সে তো অন্য মানুষ নিয়া থাহে।
যাইয়া তো দেহি–
সে সময় এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সুকুমার। কথা মুলতবি রেখেছিল, পরে বলবে। রাতে আলতাফের হোটেলে শুয়ে সুকুমারের গলার স্বর নামিয়ে, এমনকি আলত করে ঝিলিকের মুখমণ্ডল ছুঁয়ে বলে, মাইঝে বউ, তুমি যাইয়ে না। আমি একলা মানুষ, এ জায়গায় ও জায়গায় ঘুরি–তুমি সাতে থাকলি তবু একজন মানুষ থাকল, ফিরি আইসে চাইরডে কতা কওয়ারও একজন মানুষ হয়।