জরিনা সুকুমারকে খোঁজে। আজগরের কাছে সুকুমার কোথায় জানতে চায়। চারপাশের পরিস্থিতি অনুযায়ী আজগর নীচু গলায় জানায়, এইমাত্র সুকুমার এখানেই ছিল, আছে আশেপাশে। মনে হয় পান-বিড়ি খেতে গেছে।
জরিনা চারদিকে তাকায়। পান-বিড়ি খেতে গেলে, ডিসি অফিস কিংবা চত্বরের ওপাশে কোর্টের দিক থেকে সুকুমারের আসার কথা নয়। আসবে পিছনের মেইন রোডের দিক থেকে অথবা একটু ডান দিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের ফাঁক গলে। জরিনা সেদিকে উল্কণ্ঠিত চোখে তাকায়। সে তাকানোয় আজগর উঠে জরিনার কাছে আসে, কী হইচে? তোরে এইরাম দেখাতিচে কী জন্যি!
জরিনা একটু যেন হতবিহ্বল। সে আজগরকেও বলতে চায় না কিছু, এমন তার চোখ। বলে, সুকুমার ভাই গেল কোতায়? তারে লাগবে
কেন, হইচে কী, আমারে ক–
ঝিলিক মনে হয় চইলে গেল। চইলে গেইচে হাহাকার করে ওঠে জরিনার গলা। ঝিলিক চলে গেছে কথাটা সে কষ্টে একাকার মুখে বলল সে। জানাল, ঝিলিককে আটকাতে পারেনি। কিন্তু এখন আজগরের কাছে কোথায়, কখনও, কেন এমন কোনও প্রশ্নও শুনতে চায় না।
আজগরের চোখমুখও ভ্যাবাচেকা দশা, কোথায় গেল? কোন দিক?”
সেয়া তুমি জাইনে করবা কী?
কেন?”
এই শরীরে তুমি এহেন কোথায় খুঁজদি যাবা? মাঝিঘাটা, বাসস্ট্যান্ড না রেল স্টেশনে? কোনদিক গেইচে, কোথায় যাবে আমারে কিছু কইয়ে যাইনি। আলতাফের হোটেলের সামনে দেহি নিজের একটা মোলা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়াইয়ে রইচে। আমি সামনে আসতিই কল-
জরিনা থামে। মেইন রোডের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, সদ্য অসুখ থেকে ওঠা আজগরকে এ সব বলা অর্থহীন। এই শরীরে যদি মানুষটা এখন ঝিলিককে খুঁজতে রওনা দেয়। জরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে টাইপিস্টদের ছাউনির দিকে তাকায়। ওখানেই সুকুমার আছে, কিন্তু জরিনার চোখে পড়ল না। কারণ, এসময়ে ডিসি অফিসের সামনে থেকে ছাত্রদের সমবেত স্লোগান আসছে। নিশ্চয়ই তাদের কোনও দাবি মেনে নিয়েছে। অথবা, জানা গেছে কাউকে আজই ছেড়ে দেয়া হবে। জরিনা এসব বোঝে না। তার জানার কথা না। কোর্ট এখন স্থবির, এই অবস্থায় দিন চলতে পারে না, এমন হলে তাকে দিলদার কেন, অন্য মানুষ খুঁজতে হবে। অথবা সন্ধ্যার অন্ধকার পড়লে ঘুরঘুর করতে হবে ট্রাফিক ব্যারাকের সামনে। যদি তাকে কোনও পুলিশ ওই শুকলাল সংগীতের পিছনে নিয়ে যায়। আর নয়, সারাটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দিতে হবে বেঙ্গির সঙ্গে, যদি বেঙ্গি তার জন্যে পার্কে অথবা অফিসার্স ক্লাবের পিছনে কোনও খদ্দের নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এসব চায় না জরিনা। আজগর কাবু-কেতরা, আজগরের আয় রোজগার নেই, তবু সে আজগরের সঙ্গেই তো থাকে। আজগরই তার সব। সেই আজগরের চোখ এড়িয়ে এভাবে দুটো ভাতের জন্যে এইসব! নিরুপায় জরিনার ভিতরে হাহাকার করে ওঠে, সত্যি তার ভালো লাগে না।
আজগর উদ্বেগজড়ানো চোখে বলে, কী কইল?
কল, জরিনাদি তোমার ভাইরে কইয়ো আমি চইলে গেলাম।
কোতায় গেল?
সেয়া তো জানি না। আলতাফের হোটেলের কোনায় ওই পানের দোকানের সামনে দাঁড়ানো ছেলে একখানা রিকশা, আমি কিছু জিগানোর আগে রিকশায় যাইয়ে লাফ দিয়ে ওটল!
আজগর জরিনার মুখে তাকায়, গেল কোন দিক?
কী কইরে কব? কলাম না, সোজা মাঝিঘাট গেল না, না ডাইনে ঘুইরে রেল লাইনের দিক না সেইহেন দে বাস স্ট্যান্ডে আমি আর রিকশাখানা ঠাওড় করতি পারিনি।
আজগর পারে তো এখনই রওনা দেয়। জরিনা বলে, তুমি আবার যাইয়ে না। এই শরীর লইয়ে রোদ্দুরে ঘুরলি আর থাকপা নানে। এহেবারে কেতরাইয়ে যাবানে।
তবু যেন আজগর রওনা দেয়। ওই জায়গায় থেকে ট্রেজারির পাশে তার বানর দুটোর দিকে দেখে। সে দুটো ছায়াতেই আছে। দড়ি একটু লম্বা করে দেয়ার পাশের আতা গাছটার তলায় ঝিমুচ্ছে। এই কোর্ট-কাছারি, এই স্থবিরতা, তাদেরকে কলা দেওয়া ঝিলিক–কোথায় কি ওলোট পালট হল, অবলা প্রাণীর সে খোঁজ জানার কথা নয়। তার চেয়ে, বেশ কদিন পরে এই পরিচিত চত্বরে আসতে পেরে দিব্যি আছে। এখন আতা গাছটার নীচে ছায়াও বেশ। সেখানে তারা বুড়া বুড়িও নয়, জোয়ান নয়, শ্বশুরবাড়ি কি রান্নাঘরে কোথাও কারও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। একদল মানুষের সামনে কোনও ছদ্ম ভালোবাসাও তাদের প্রদর্শন করতে হচ্ছে না। বরং, এখনকার এই তন্দ্রা অনেক নিরাপদ!
এখন ঝিলিককে খুঁজতে গেলে আজগর যে কেতরে-কাহিল হবে, তা সে নিজেও জানে। জরিনা বললেও সে যেতে পারত না। এই কোর্ট চত্বর পর্যন্ত আসতেই তার হাঁটুগুলো অসহযোগিতা করছে। দাঁড়াতে ভালো লাগে না। তবু এসেছে। যদি মানুষজন আসত, তাহলে খেলা দেখিয়ে দুটো পয়সা পেত। আলতাফের কাছে বাকি, হাফেজের রুটির দোকানে বাকি, হাফেজের বউ লালি পয়সা না পেলে দিন দুই বাদে কথা শুনাইতে ছাড়বে না।
এখন না-গেলও আজগর কিন্তু জরিনার কাছে এটা তো জানতে চাইতে পারে, গেল কেন ঝিলিক?
জরিনা বলল, ওরে সেয়া তো আমারে কইয়ে যায়নি।
কানদিচে নাকি?
চোখ এট্টু ভেজা।
মোড়েলগঞ্জ না কোন জায়গায় গেইল কয়দিন আগে, সেইহেনে গেল নাকি?
তোমার যা কতা, লি ওইভাবে কইয়ে যায় যে, তোমার ভাইরে কইয়ো, আমি চইলে গেলাম।
হয়।
তোমার বোধ হল না কোনও কালে। বাল তোমার সাতে থাকপে কোন বিটি। বাল বোঝে কিছু? আমি বুইলে থাইহে গেলাম।
থাকতি কয় কার বালে? থাহিস না। চইলে যা, যেহানে মনে চায় চোদাইয়ে আয়—