মফিজ এক তোড়া কাগজ বারিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, গুইনে দেহে, এই জায়গায় শ খানেক আছে। আরও লাগলি আইনে দেবানে।
বারিক বলল, এতেই হবে নে। আর লাগবে না। আজকাল মানুষ বই পড়ে না?”
মফিজ শেখ উলটো ঠেলা দেয়, রাইহে দে, এবারের কবিতা ভালো হইছে। জীবনে তো এরাম বই কম লিহিনি। তা প্রায় ষাইট সত্তরখান তো হবে।
মফিজের উঁচু গলার এসব কথা, ঘটনার উত্তেজনা–সব মিলে অশত্থ গাছতলায় খানিকটা জমায়েত। এর ভিতরে যদি এখন মফিজ শেখকে এভাবে থামিয়ে দেয় বারিক তা সে শুনবে কেন? সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে তারপর বারিককে বলে, পইড়ে দেখ হইচে কীরাম এবার।
এরপর বারিককে আর পড়ার সময় না দিয়ে নিজেই মাত্র একবার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর বলে যেতে থাকে :
শোনেন শোনেন শোনেন, শোনেন দিয়া মন,
ও বাগেরহাটবাসী, আর থাকপে না টেরেন।।
আশেপাশে মানুষের আগ্রহ খেয়াল করে। মফিজ শেখ আরও জানায় :
এইবার বুঝি ছুঁইটে গেল রেললাইন–
নিয়ে গেল আমাগোর মেলা দিনের পেরেম ॥
তারপর তার রচিত এই চারটি পদের সঙ্গে জুড়ে দেয় অনেক অনেক দিন ধরে এই অঞ্চলে ট্রেন নিয়ে প্রচলিত আরও দুটো লাইন :
রেলের গাড়ি কলে চলে রূপসা হইতে বাগেরহাট।
গড়গড়াইয়া চলে গাড়ি লাট সাহেবের ছাতির বাট ॥
এ লাইন দুটোও হয়তো কোনও লোককবিরই রচনা। সেকথা জানে না মফিজ শেখ। জানে না। এখানকার কেউ। তারা একদা এই ট্রেন নিয়ে এমন লোকগান শুনে এসেছে। আজ সেই ট্রেন এখান থেকে উঠে যাচ্ছে, তা নিয়ে মফিজ শেখও এই লাইনগুলো সবাইকে শোনাচ্ছে। হয়তো একদিন এই ট্রেন উঠে যাবে, ছাত্রদের জনতার এলাকাবাসীর কোনও প্রতিরোধ কাজে আসবে না, অথবা এ নিয়ে প্রতিরোধে সামিল হওয়ার থাকবে না কেউ, তখন এমন পল্লিকবি মফিজ শেখের এই পঙক্তিগুলোও প্রয়োজনীয় মনে হবে। যেমন, এই ট্রেনের সারাটা কাল ধরে গড়গড়িয়েই চলেছে ব্রিটিশ লাট সাহেবের ছাতির বাটেরই মতন। এর বেশি কোনও গতি তার কোনওকালে আসেনি। আজও আসেনি, পাকিস্তান গেছে, বাংলাদেশেও গেছে দেড় যুগ। লাটের ছাতি নেই, তাই গড়গড়িয়ে চলে সে এক গরুর গাড়িরই মতন। তাকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে কতজনের কত পদের আয়োজন, তা মফিজ শেখ তার গান দিয়ে এখন কী করে আটকাবে।
যদিও ছাত্ররা অত শত জানে না। তারা জানে, কলেজে আসতে তাদের প্রয়োজন এই ট্রেন। তাই তারা আন্দোলনে শামিল। নেতাদেরও কেউ কেউ, কারণ এই সরকারবিরোধী তারা, সরকারের সিদ্ধান্তও ঠিক নয়। কিন্তু তারা অনেকে এও জানে, তাদেরই আত্মীয়স্বজন অনেকেরই বাসের ব্যবসার উন্নতি হবে। বাস মালিক সমিতি তাদের দূরের কেউ নয়।
প্রচলিত লাইন দুটো শোনাতে না শোনাতেই, ছাত্রদের একটা বড়ো মিছিল ডিসির অফিসের দিকে আসে। মিছিলটি খুব জঙ্গি, এই অর্থে ছাত্ররা প্রায় দৌড়ে এসেছে যেন। ডিসি সাহেবকে এখনই তাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। স্লোগানে জানাচ্ছে তারা, যদি আটক নেতাদের কিছু হয়, প্রতিটি ঘরে আগুন জ্বলবে। তারা জেলের তালা ভেঙে হক, মোজাম্মেল আর সবুরকে বের করে আনবে। আর এরপর একজন বক্তা জানাচ্ছে, যদি এই রেল তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে শেষ ট্রেন যাওয়ার আগে তারা রেল পাটির ওপর শুয়ে আত্মাহুতি দেবে। তার ভিতর দিয়ে এরশাদ শাহির পতন হবে। সঙ্গে সঙ্গে রেলের স্লোগানের সঙ্গে ছাত্রদের একাংশ এও জানায়, এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি!
অশত্থ গাছতলা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে উলটো তাকালে ডিসির অফিস। মফিজ শেখ হাতের লিফলেট মতন কবিতাগুলো নিয়ে সেদিকে ছোটে। বাকিরাও ওদিকে তাকিয়ে। সেখানে প্রচুর পুলিশ। ছাত্ররা উত্তেজিত। যদিও সবারই জানা আছে, অন্তত বোঝেও, ছাত্ররা এখানে কিছু করবে না। যদি তেমন কিছু করে তো রেল স্টেশনে। এখানে নয়।
ছাত্ররা কিছুই করে না, তাও-বা কী করে হয়। ডিসি অফিসের সামনে থেকে উঁচু গলার শব্দ আসে। কথা কাটাকাটি ভেসে আসে। মোসলেম কিংবা বারিক ডিসিকে চেনে, আজগরও এক আধদিন তাকে দেখেছে। তারা জানে, এই লোক তার সুন্দর কথা দিয়ে ছাত্রদের বোঝাতে পারবে।
ছাত্রদের ওই জমায়েত থেকে দিলদার এখানে এসে জানায়, ছাত্রদের দাবি শুধু ট্রেন নিয়েই না, তারা জানতে চায় উকিলদের ছাড়বে কবে। এই দাবি তো তাদেরও। এই উকিলরা নেতা মানুষ। উকিলদেরও নেতা, তাদের ছাড়লে কোর্টও সচল হবে। কোর্টের সবচেয়ে বয়েসি উকিল নারায়ণ বাবু নাকি হুমকি দিয়েছেন, যদি তাদের না-ছাড়া হয়, তাহলে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোর্টে কোনও কাজ হবে না।
মোসলেম উদ্দিন এই শোনে আর সরু চোখে দিলদারের দিকে তাকায়। দিলদার জানে, এটা মোসলেম উদ্দিনের স্বভাব। এই লোক কোনও দিন যেন দিলদারকে দেখতে পারে না। সব সময়ই দিলদারের কথায় তার সন্দেহ। কিন্তু এতই যদি সন্দেহ, তাহলে গিয়ে দেখে আসলে পারে ওই জায়গায় ছাত্রনেতারা ডিসিকে এইসব কথা বলছে কি না?
এ সময় জরিনা আসে। মুখোনা বিষণ্ণ। আসতে আসতে, এখানে দিলদার দাঁড়িয়ে আছে দেখেও তার মুখের বিষণ্ণ ভাব কোনওক্রমেই কাটে না। কাটার কোনও কারণ নেই। দিলদার আছে থাকুক। যদিও দিলদার জরিনার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। জরিনা তার উত্তর দেয়নি। আর এমনভাবে তাকিয়ে মুচকি হাসা তো সব সময়ই তাদের ভিতরে বিনিময় হয়, এ নিয়ে আজগর-বা আর কারও বাড়তি খেয়াল দেয়ারও কোনও প্রয়োজন নেই।