সুকুমার এক ফাঁকে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা, এইরাম কোর্ট বন্ধ কয়দিন থাকপে?
মোসলেম বলল, আরে কোর্ট কি বন্ধ থাকপে? কোর্টের ভিতরের কাজ চলতি ঠিকই। তলে তলে একটা দফারফা কোনও না কোনওভাবে হবে। সরকারের সাথে সমঝোতা হবে। আর নয় সরকারই বসপেনে আপোষে।
কিন্তু টেরেন তো তুইলগা নিয়ে যাবে! জানতে চাইল আজগর।
না, অত সোজা মনে হয় হবে নানে। পারবে নানে। আবার কওয়াও যায় না। এরশাদ তো এক আজব জিনিস। তার কোনও কিছু ঠিক আছে? কোনও কিছুতে কিছু যায় আসে। আইজ এটা
তো কাইল ওটা।
আজগর বলল, ছলপলরা স্লোগান দিয়ে যায় না, এরশাদ লেখে কবিতা, পিছে আছে ববিতা।
সুকুমার এই স্লোগান শোনেনি। হাসল গলা উঁচু করে। তারপর জানতে চাইল, ববিতা আবার এরশাদের দলে যোগ দিচে নাকি?
না দিলি কয়?
গতকাল এই পর্যন্ত আলাপ হয়েছিল, এমন এক পরিস্থিতির জানা শোনা ছিল আজগরের কাছে। আজ বানর দুটো নিয়ে সে এসে কোর্ট চত্বরে। সুকুমার এসেছে তার আগে। বারিক বুড়োর বইয়ের দোকানের অশত্থ গাছটার নীচে সুকুমার মালপত্তর রেখেছে। ইব্রাহিম শেখ আসেনি। আসবে হয়তো। অথবা, ওই দড়াটানা ঘাটের দিক থেকে খবর পেয়েছে আজও কোর্ট চত্বরের অবস্থা ভালো না। কিন্তু দিলদার এসেছে। আজগর জানে দিলদার আসবে। এমন দিন দিলদারের মতন। পাবলিকের না-আসার কোনও কারণ নেই। তাদের তো অনুমান, তলে তলে গোয়েন্দাগিরি তার কাজ!
বানর দুটো ট্রেজারির পাশে কুল গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে, ফাঁকা চত্বরে দাঁড়িয়ে আজগর একবার চারদিকে নিরিখ করে। এই নাকি কোর্ট চত্বর! লোকজন আছে, আছে ঠিকই, তারা সব এখানকারই। উকিল পেশকার মোক্তার মহুরিরাও আছে। কিন্তু তারা আজগরের বান্দর খেলা দেখবে কেন? যাকে বলে পাবলিক, তা প্রায় নেই। ছাত্রদের একটা ছোটোখাটো জমায়েত উলটো পাশের ডিসির অফিসের সামনে হয়েছে, তারপর তারা চলে গেছে। মুখে মুখে শোনা গেছে, একটু বাদে কলেজের সকল ছাত্র আসবে স্কুল থেকেও বাকি ছাত্রদের নিয়ে, ছাত্রদের দাবি একটাই, এই ট্রেন কোনওভাবে তোলা যাবে না।
বারিকের দোকানের কাছে যখন তারা দাঁড়িয়ে, মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে এসে আজগর আর সুকুমারের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ওদিক নদীর ওপারের মফিজ শেখ এই টেরেন উঠোইয়ে দেয়া নিয়ে গান বান্ধিছে–
এই সংবাদ অবশ্য আজগরের কাছে নতুন কিছু নয়। শহরে নতুন কিছু ঘটলেই মুনিগঞ্জের খেয়ার ওপারের কেশবপুর গ্রামের মফিজুদ্দিন শেখ তা নিয়ে গান বান্ধে। এমনকি দেশে নতুন ঘটনা ঘটলেও। আজগরের আর কতটুকু জানা শোনা এইসমস্ত। এ বিষয় ভালো জানে মোসলেম উদ্দিন আর বারিক বুড়ো।
মোসলেমের মুখে একথা শোনার পরে বারিক বুড়ো তার তন্দ্রা তার প্রতি মুহূর্তের তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ দুটো আলত খুলে মোসলেমের দিকে তাকায়। মোসলেম হাতের লাঠিখানা একপাশে রেখে সুকুমারের বাক্স-পেঁটলার উপর বসে। বারিকের সঙ্গে তার চোখ চোখি হয়। তাদের প্রায় সমবয়েসি এই মফিজ শেখ, লতায় পাতায় জড়িয়ে মোসলেমের জ্ঞাতি ভাই। একেবারে বেবোধ এক মানুষ। হাট-বাজার-গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়। এ নিয়ে তার একপ্রকার অহংকারও আছে। সে অহংকার মফিজ করতেও পারে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে দেশের হাটে মাঠে ঘাটে সবখানে গলায় গান অথবা ছড়া কবিতা নিয়ে না ঘুরেছে। তার বই শহরের প্রেসের মালিকেরা অল্প পয়সায় ছাপিয়ে দিয়েছে। সেই পাতলা চটি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়ত মফিজ। লঞ্চে, ট্রেনে, বাস স্ট্যান্ডে, মাঝি ঘাটে বেচত। পড়ে শোনাত। মানুষকে বলত, সে পল্লিকবি।
মফিজের কবিতা লেখা, আর তা ছাপিয়ে বিক্রি করা নিয়ে মোসলেম আর বারিকের আলাপ শুরু হলে আরও জানা যায়, মফিজ শেখ সাহেবের ছয় দফা নিয়েও কবিতা লিখেছিল। তাই শুনেছিল তখন সবাই। এই কোর্ট চত্বরে কত মানুষ যে গোল হয়ে মফিজের কবিতা শুনত। শেখ সাহেব সে সময় ইলেকশনের জন্যে আসলে, সেই পাকিস্তান আমলে মফিজ ছয় দফার উপর কবিতা শুনিয়ে পাঁচশ টাকা পেয়েছিল। সেকথা দেশ স্বাধীনের পর নিজের পাউডারে টাকার ময়লা পরিষ্কার করতে করতে মোসলেমও কতজনকে বলেছে। বারিক এই গাছের নীচে কত কত দিন কত বার বেচেছে মফিজ শেখের বই।
সুকুমার চেনে না মফিজ শেখকে, আজগর চেনে। কিন্তু মোসলেম আর বারিকের ঝুলিতে থাকা এই ইতিহাস তাদের জানা থাকার কথা নয়। তবে, কিছুদিন আগে এরশাদকে নিয়ে কবিতা লিখলে মোসলেম যে মফিজকে গালমন্দ করেছিল, সেকথা আজগরের মনে আছে। আজগর এখন তা আর তুলল না। জ্ঞাতি ভাইকে নিয়ে এখন মোসলেম উদ্দিন বেশ আমোদে আছে। থাকুক, যখন ওপাশের বারের সামনে দেখে এসেছে, নিশ্চয়ই এখনই চলে আসবে।
তাই ঘটে। হাতে ছাপানো পাতলা এক দলা কাগজ। চাইলে লিফলেটের মতন হাতে হাতে বিতরণ করা যায়। কিন্তু তা করলে মফিজ শেখের পেটে ভাত উঠবে না। এগুলোর কিছু দিয়ে যাবে বারিকের এখানে, বারিক বেচবে। কিছু থাকবে মফিজ শেখের হাতে, ছাত্রদের দেবে। ছাত্রদের মাঝে বিক্রি করবে। তার কবিতার কদর যদি কিছু বোঝে এই ছাত্ররাই বুঝবে। বারিককে দিয়ে, তারপর গুনে নিতে বলে মফিজ শেখ প্রায় এক নিশ্বাসে বলে যায়, কাইলকে যাব কলেজে। কলেজের ছাত্ররা যা কেনবে, তাতে ছাপার খরচ উঠে যাবে।
তবে মফিজ শেখ সঙ্গে একথা জানাতে ভোলে না, এইসব ছাপার খরচ কোন উকিল, কোন ডাক্তার সাব, অর্থাৎ কোন কোন নেতা তাকে দেয়ার কথা বলেছে। যদিও বারিক বুড়ো আর মোসলেমের কাছে সেকথার তেমন গুরুত্ব নেই। কারণ, এমন কথা আগেও অনেক সময় অনেকে মফিজকে দিয়েছে, পরে তাদের কাউকে আর খুঁজে পায়নি। তখন ধরনা দেবে এই বারিকেরই কাজে। কয়ডা বিক্রি হইছে, দেবে নাকি সে বাবদ কিছু পয়সা।