মোসলেম বলল, চা কোন জায়গা দিয়ে আনলা?
আলম ভাইর ওই জায়গা দে–
তুমি আলমের দোকানও দেহি চেনো।
জরিনাদি চেনোইয়ে দেছে।
মগের চা কাপে ঢালে। কাপ মানে ছোটো সাইজের গেলাস। এগুলোতেই এসব চায়ের দোকানে চা খাওয়া হয়। সুকুমার যখন ঢাকার ওদিকে গেছে, সেখানে দেখেছে, চায়ের দোকানে চা দেয় কাপে, কোনও জায়গায় দেয় গেলাসের গায়ে একটা আংটা লাগানো। আর এদিকে চায়ের দোকানে চা মানেই এইরকম ছোটো ছোটো গেলাসে চা।
চা খেতে খেতে মোসলেম উদ্দিন কথা শেষ করে উঠবে ভাবে। এসেছিল আজগরকে দেখতে। দেখা শেষ। এখন যাবে। আরও ভেবেছিল, জরিনাকে একটু গালমন্দ করবে। কোনওদিকে খেয়াল নেই। এই ঝুপড়ি ঘরটাও তো একটু গুছিয়ে রাখা যায়। তা করবে না। সারাটা দিন গায়ে বাতাস লাগিয়ে ড্যাং-ড্যাং করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবে। খাবে এই আজগরের, থাকবে এই আজগরের সাথে, তারপরও যদি কোনও কিছুর একটু খেয়াল রাখত ওই মেয়ে। মেয়েটার কোনও বোধ হইল না আজও। হবেও না কোনও কালে। সে তুলনায় ঝিলিককে অনেক লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে মনে হয় মোসলেমের। আসলে, এটা গাল দিতে গিয়েও ভিতরে ভিতরে নিজের সামলাল মোসলেম।
মোসলেম উঠবে, আজগর বুঝতে পারে। তা বুঝেছে সুকুমারও। সুকুমার মোসলেমকে নিয়ে সামনের মেইন রোড পর্যন্ত যাবে। যদি মোসলেম নদীর পাড় বেয়ে বাজারের দিকে যায়, তাহলে সেদিকেও যেতে পারে সুকুমার। ঝিলিক বলেছে, বাজারের দিকে গেরে সাগুদানা ও কলা আনতে, আর সুই-সুতো। সুকুমার জানতে চেয়েছিল, কলা কেন? ঝিলিকের সে কি হাসি। কলা কেন? আরে বাজারের করার আড়তের পাশে প্রচুর পচা কলা থাকে, দাম কম, এ কথা যে কতবার বলেছে সুকুমারকে। কতবার আর। সুকুমার কি বান্দরের ওস্তাদ নাকি। তবে ব্যাপার হল, এই বিষয়টা মনে থাকে না জরিনার। ওই অবলা বনের প্রাণী দুটো, কোর্টের সামনে যায় না, আজগরের ওই অবস্থা, তা বলে জরিনা তাদের খাওয়ার দিকে খেয়াল দেবে না।
কিন্তু মোসলেম উঠতে না উঠতেই বলল, কাইল যদি শরীর জুতের ঠেকিস, তাইলে যাইস একবার কোর্টের দিক।
আচ্ছা, যাবানে। কিন্তু যাইয়ে করব কী? উকিল সাবরা সব কোর্ট বাতিল করিচে।
হয়।
এরপর আজগর মোসলেমের কাছে কোর্টের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চায়। মোসলেম বলে। ট্রেন নিয়ে সমস্যা এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। হক উকিল আর মোজাম্মেল উকিলরে তো ছাড়িনি, কাইলকে নাকি আবার সবুর উকিলের উপরও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। তবে তার চেয়েও গুরুতর বিষয় যেটা, বারের সামনে চা খেতে খেতে, ঘুরতে ঘুরতে মোসলেম শুনেছে তাই জানায়। সে বিষয়টা হল, উকিলদের ভিতরে আবার দুই ভাগ, যাগো যাগো ভাই ব্রাদারগো বাসের বিজনেস আছে তারা ট্রেন তুলে দেয়ার পক্ষে। আর যাগো নেই, তারা বিপক্ষে। তয়, হক সাব, মোজাম্মেল সাব আর সবুর সাব প্রত্যেকেই কিন্তু উকিল হিসেবে ভালো, তাগো ওইসমস্ত দেখার কোনও সুযোগ নেই। তাদের কথা হচ্ছে, এতকাল ধরে এই এলাকায় যে ট্রেন চলেছে, সেই ট্রেন কোনও ভাবে তুলে নেয়া যাবে না।
এরপর মোসলেম জানায় এই ঘটনায় ছাত্রদের কী প্রতিক্রিয়া। পিসি কলেজের ছাত্ররা ঠিক করেছিল, ট্রেনের টিটিদের সাথে একদিন টিকিটের পয়সা কালেকশন করবে, তা করেছে। করে দেখিয়েছে, সরকার যে বলে ট্রেনে লস হয়, লস্ কোথায় হয়। তাতে নাকি একদিনের তিন ট্রিপে এত টাকা উঠেছে যে, সারা সপ্তাহে এই লাইনের ট্রেনে এত পয়সা ওঠে না।
এসব জানিয়ে মোসলেম আজগরকে বলে, বোঝ অবস্থা। টিটি সরকারি, ট্রেন উঠাতে চায় সরকার, আবার সরকারেরই বড় গলা। চোরের মায়ের গলা তো বড়ো হবেই।
আজগর তো আজগর, সে এত সমস্ত বোঝে না। তার বোধেও কুলায় না এই হিসেব। জানে, কোর্টের কাছে একদিন তোক না আসলে তার পেটে ভাত নেই। যদি কখনও কোর্টের সামনে খেলা দেখানোর পর গায়ে সয় তো সে যায় রেল স্টেশন। তারপর কোনওদিন দুপুরে কোর্ট বন্ধ থাকলে সে পাড়ায় পাড়ায় বান্দর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তার আগে অবশ্য তার জানতে হয়, সেদিন ইস্কুল ছুটি কি না। তবে তা বুঝতে তার এমন কিছু বেগ পেতে হয়নি কোনও দিন। এই কোর্ট চত্বরের দক্ষিণ দিকে ও বাজারের আশেপাশের বাড়ি থেকে কত ছেলেমেয়ে স্কুলের জামা পরে ইস্কুলের দিকে। যায়। তাই দেখে সে বুঝে নিতে পারে, আজ স্কুল খোলা না বন্ধ।
মোসলেম উদ্দিন এরপর আরও যা জানায় তার কিছু কিছু এই শহরে নতুন হলেও সুকুমার ভালোই বুঝতে পারে। আজগরও বোঝে, কিন্তু সেভাবে মিলাতে পারে না। মোসলেম উদ্দিন জানায়, এই টেরেন তোলা নিয়ে অন্য রাজনীতিও আছে। সেই রাজনীতি আওয়ামী লীগ বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টির। জাতীয় পার্টির সরকার যদি এখন ট্রেনটা এখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে তাদের জিত। ওদিকে আওয়ামী লীগ বিএনপি যদি ট্রেনটা না রাখতে পারে তাহলে তাদের হার। হক সাব বিএনপির নেতা, মোজাম্মেল উকিল আওয়ামী লীগের নেতা, আর সবুর সাব কমিউনিস্ট। জাতীয় পার্টি মনে করে এদের ঠাসা দিতে পারলে শহরের রাজনীতিতে তারা একটু বেশি সুবিধা করতে পাবে।
এই যে বিষয়গুলো আজগরের সামনে বলে গেল মোসলেম, সে এর ভিতরে নিজের হিসেবে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। সে ভাবে, এ সব বোঝাবুঝি দিয়ে তার কাজটা কী?