কিন্তু এখন বিষয়টা তো একেবারে অন্য। মোসলেম যা ভাবছিল, যদি কোর্ট চত্বরের অবস্থা এই হয়, তাহলে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আজগরেরই-বা কী হবে। মোসলেম যখন আজগরের ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তখন সেখানে জরিনা নেই। ঝিলিকও ছিল না। সুকুমারকে একবার দেখছিল, তার কাছে জানতে চেয়েছিল, চা খাবে কি না, তারপর কোন দিকে যে গেল! সুকুমার বড়ো অদ্ভুত ছেলে। মোসলেম আজগরের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে এসব ভাবল ঠিকই, কিন্তু তার চোখ মন সবই তখন পড়েছিল কোর্ট চত্বরে। আজগর বুঝল, মোসলেম উদ্দিন এখানে থেকেও এখানে নেই। এই বয়সেও লোকটা কাজের। এই বয়সেও লোকটা চলাচলতি সব ভালোই পারে, এখনও দেখো জামা কাপড় কী সুন্দর! এখানের উকিল মোক্তার পেশকার হাকিম ম্যাজিস্ট্রেটরাও এই মোসলেমের মতন ধবধবে জামা কাপড় পরে না। যদিও মোসলেম উদ্দিন তাদেরই মতন একজন ক্যানভাসার। আর সে সারডা জীবন বান্দর নাচাইয়ে এই জীবনে একদিনই এট্টু পরিষ্কার কাপড় পরে সে কোর্টের সামনে যেতে পারে নাই।
আজগর মোসলেমের দিকে চোখের পাতা নাচিয়ে বলল, দেহো কী? এইভাবে চাইয়ে চাইয়ে?
দেখপো আর কী? দেখি তোরে আজগর। তোর চেহারা হইচে কী, কোনও দিন আয়নায় দেহিচিস?
তুমি আছো তোমার ভাবে। বেচে কাপড় কাঁচার পাউডার, মানুষের জামা কাপড় পরিষ্কার করাও, আর আমার মতন বান্দর নাচানো আজগররেও তুমি সুন্দর দেকতি চাও!
সেয়া কইনিইরে ছেমড়া, সেয়া কইনিই, কইচি তুই তোর চেহারাডা বানাইচিস্ কী?
চেহারা তো আগেও এইয়ে ছেল, এহোনও তাই আছে। এয়ার আর ভালোমন্দ কী?
ওরে সেয়া কইনি। শরীলডার অবস্থা করিচিত্স কী? এহেবারে ভাইঙ্গে গেইচে তোর শরীর। তাকানো যায় না।
তাহানো না গেলি তাইয়ো না। তোমারে তাহাইয়ে দেকতি কইছি?
ফাও কতা কইস নে। ফাও কতা কওয়া স্বভাব তোর গেল না।
শোনো, আমরা চেহারা দেখপো কোয়ানদে, আয়না নেই। গোসল করার সময় যে দিন নদীর পানি ভালো পরিষ্কার থাহে, সেদিন নদীর পানিতে চেহারা দেইহে লই।
আবার ফাও কতা কইস?
আজগর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল! চোখ ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খুঁজল সুকুমারকে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ মোসলেম উদ্দিন শোনেনি। কিন্তু কাউকে খোঁজার জন্যে যে চোখ ঘোরাচ্ছে সেটা মোসলেম উদ্দিন বুঝতে পারল। আজগর দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে, যেন নিজের অবস্থাকে মানিয়ে নিতে। অথবা, একখানা আয়নাও না-থাকা নিয়ে নিজের দারিদ্র্যকে বুঝে নিতে, অথবা, এমনিতেই আজগরের অজানিতে বেরিয়ে এসেছে ওই দীর্ঘশ্বাস। এখন সুকুমার এখানে থাকলে ভালো হত। যদি পারত মোসলেম ভাইকে একটু চা খাওয়াত, তার জন্যেও আনত একটু। ওই টিনের মগটাতে আনলেও হত। আজগরের জন্যে ওই টিনের মগে চা-ই সই। সুকুমার তার জন্যে যথেষ্ট করেছে। কদিন আগে তার সঙ্গে যে কথা কাটাকাটি হয়েছে তা মনে রাখেনি। এক জায়গা কাজ করলে অমন মন কষাকষি হয়, আবার তা মিটেও যায়। আজগর যখন এসব ভাবছিল, তখন মোসলেম উদ্দিন বলে, তোর নয় আয়না না আছে; সেই জন্যি জরিনারও আয়না নেই? ও মাইয়েডা নাইয়ে ধুইয়ে চোখে মুখে রংটং মাহে কী দিয়ে?
সের মনে হয় আছে একখান।
তালি সেইহানে নিজের চেহারা একবার দেকলি পারিস?
হইচে। বান্দর নাচানো আজগর তার আবার চেহারা।
এসময় নদীর কূল বেয়ে হাওয়া আসে। বৃষ্টি-বাদল কেটে যাওয়ার পরে এই বাতাস অনেক ঠান্ডা ও শীতল। প্রাণ জুড়ানো। যদিও দুপুরের আগ পর্যন্ত হাওয়া তেমন ছিল না। বিকেল থেকে এই কুলকুলানো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দুপুরে পেট ভরে খাওয়ার পরে এই হাওয়া গায়ে লাগলে সত্যি শরীর জুড়োয়। সুকুমারের সঙ্গে জরিনা আর ঝিলিক আলতাফের হোটেলে খেতে গেছিল, আর তার জন্যে এনেছিল থালাভরতি ভাত, ভেটকি মাছের ঝোল, একটা ছোটো ভেটকির মাথা, ডাল আর পুইশাকের তরকারি। বেশ কয়েকদিন বাদে আজগর আজ পেট ভরে খেয়েছে। মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে আজগরের মনে হয়েছিল, সে যেন মায়ের হাতের ভেটকি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাইছে। চোখ ভেজার কথা না আজগরের। অত দয়ামায়া কোনও কালেই ছিল না তার। আজও নেই। তবু মনে পড়ায় পরানের একেবারে গভীর তলানিতে কোথায় যে হাহাকার করে উঠেছিল। কিন্তু এরপর আরও ওকথা মনে করে ভাতের থালায় হাত নামিয়ে রাখতে চায়নি সে। শুধু জরিনার কাছে জানতে চেয়েছিল, এ জরি, এই মাছের ঝোল রান্না করিচে কেডা?”
জরিনা বলেছে, শিউলির মা মনে কয়।
আজগর বলেছিল, আমি ভাবলাম, আলতাফের বউ রান্দিচে নিকি।
তোমার দেহি কোনও হিসেব হল না?
কেন হইচে কী?
খাইয়ে কাজ নেই আলতাফের বউ রানতি যাবে নে! তার এহোন কত পদের ফেনসিয়ান। ছওয়াল-মাইয়ে ইস্কুলে পড়ায়, আর এহোন সে ভাতের হোটেলের রান্ধা রাইন্ধে জীবন শেষ করবে!
ও কথার ওখানেই শেষ। তবে, মাছ-ঝোল-ভাত-তরকারি সবমিলে গড়ানো দুপুরে আজগর খেয়েছিল পেট পুরে। তারপর এখন নদী বেয়ে উঠে আসছে এই কুলকুলে হাওয়া। ঝুপড়ির একপাশে হেলান দিয়ে আজগর বসে আছে। তার গায়ে এই হাওয়ার কতটুকু লাগছে, তাতে অন্য সময় হলে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে যেত। এখন গেল না। এই কয়দিন যে রাম ঘুম ঘুমিয়েছে সে এখন রাত ছাড়া কোনওভাবেই তার চোখে ঘুম আসবে না।
এ সময়, সুকুমার একটা এলুমনিয়ামের মগে চা নিয়ে আসে। হাতে তিনটে ছোটো চা খাওয়ার গেলাস। মোসলেম উদ্দিন একটু অবাক। তাহলে সে আসার একটু পরে ভালো মন্দ কোনও কথা না-বলে সুকুমার যে চলে গেল, এই চা আবার জন্যে।