দিলদার চকিতে তাকাল। হঠাৎ জরিনার গলায় এত রঙ্গ। সে বলে, সেই তো কতা, কোন দুয়োরে যাই, তুমি কি আমার যন্তর ধরা বাতের রুগি?
এবার তাকায় জরিনা। হয়তো দিলদার কথায় এসেছে, সে বুঝতে পারল। উকিল বারের সামনে আর কোর্ট বিল্ডিংয়ের পিছনে ফাঁকা ছোটো এক চিলতে মাঠ হয়ে পথ চলে গেছে সোজা ক্লাব আর পার্কের দিকে, সেখানে ঢুকে পড়ে। জরিনা তখন পানটা মুখে দিয়েছে, হয় খাইয়ে কাজ নেই? ওই যন্তর ধরতি যাবানে?
কেন, কইলে না, অন্য যন্তর ধইরে তুমি ভালো ঝাঁকাতি পারো?
হুঁ। পারি তো।
যদিও এখন পরস্পরের দিকে তাকালেও চোখ দেখা যাচ্ছে না। এ জায়গা আধো অন্ধকার। আজ অন্ধকার খুব মিশমিশে। মেঘলা দিন বলেই অন্ধকারটা গাঢ়ও। একটু পরে যখন পুরোপুরি রাত আসবে, তখন তা আরও গাঢ় হবে। পথে লোকজন সকাল থেকেই কম, এখন আরও কম, তাতে বরং রাত্রির গভীরতা এখনই পথে। মনে হচ্ছে রাত্রির এক প্রহর পার হয়ে গেছে।
জরিনা পার্কের দিকে হাঁটে। সঙ্গে হাঁটে দিলদার। দিলদার কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে, আবার বুঝতে পারছে না, জরিনা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবু, সেদিকে যেতে যেতে জরিনা বলে, চলো পার্কের দিক। দেইহে আসি বেঙ্গা-বেঙ্গি কী করে?
এহেন পার্কে?
চলো বাতাস খাই। পুকুর পাড়ে যে বাতাস।
আইজ যে বাতাস চালাল, তাও বাতাস খাইয়ে হই নেই?
গেলি চলো–
এই যেন দিলদার বুঝতে পারল, জরিনা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এখন এই সন্ধ্যার পর পর পার্কে কী? পার্কের সামনে এসে, দিলদার স্বাধীনতা উদ্যান সাইনবোর্ডখানা পড়ে। তারপর মাঝখানের গেট দিয়ে ঢোকে। জরিনা আগেই ঢুকেছে। বামে রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিং ফেলে একটু সামনে, যুবকেন্দ্রের কোনায় বেঙ্গি তার আলগা চুলায় রান্না চড়ায় প্রতিদিন। এখনও আয়োজন শেষ করেনি। হয়তো বৃষ্টি আসতে পারে এই ভয়ে দেরি করছে। বৃষ্টি যদি আসেই, তাহলে কোনও উঁচু বেঞ্চির নীচে রান্না চড়াবে অথবা রেড ক্রিসেন্টের বারান্দার এই কোনায়। যুবকেন্দ্রে আলো নেই। তার মানে, এখনও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। ভিতরে মোমের আলো।
এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জরিনা কিছুক্ষণ সময় লাগে। সে বুঝে গেছে, কারেন্ট নেই, তাই যুবকেন্দ্রে প্রায় কেউ নেই। পুকুরের ঘাটে বেজি আছে, বাতি ধরাবে একটা বেঞ্চির নীচে। জরিনা বেঙ্গি কী করছে দেখতে যায়। বেঙ্গি চোখ তুলে জরিনার অবয়ব দেখে। একটু পিছনে দিলদার। জরিনা ও দিলদারকে দেখে বেঙ্গি কাজে মন দেয়। যে জানে এখন তাকে কী করতে হবে। জরিনা দিলদারকে গায়ে টোকা দেয়। তারপর রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিংয়ের দিকে হাঁটে। দিলদার হাঁটে জরিনার পিছনে। বেঙ্গি হাতের কাজ রেখে গেটের দিকে যায়।
রেডক্রিসেন্ট বিল্ডিংয়ের পিছনের কোনায়, সিঁড়ির কাছে পৌঁছে জরিনা উলটো ফিরে দিলদারকে বলে, দেহি তোমার যন্তরটা কীরাম? আমার বাত নামে কি না?
দিলদার যেন এজন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিল।
দেহো- বলে সে জরিনাকে কাছে টানে।
জরিনা বলে, কত দেবা?
কত দিতি হবে?
কও কত দেবা?
তুমি কও—
কুড়ি টাহা। কত লোন দোকানে হোটেলে।
না। দশ– ততক্ষণে দিলদার বসে পড়েছে রেডক্রিসেন্টের সিঁড়িতে। পাহারাদার বেঙ্গি গেট থেকে মাঠের মাঝখানে এসে, অন্ধকারে দুটো শরীর মিশে থাকা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারছে না।
০৯. আকাশের ঘুমোট ভাব
আকাশের ঘুমোট ভাব কাটল আরও দুদিন পরে, আজগরও সেদিন কোর্ট চত্বরে আসতে পারে।
কিন্তু আজগর তার ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া-তুড়া ডাকা বানর দুটো নিয়ে কোর্ট চত্বরে আসলেই-বা কী, সেখানে মানুষজন থাকতে হবে তো। এই দিন তিনেকে, ঝড়-বাদল পরশু দিনের ব্যাপার, তারপর গতকাল গেছে, আর আজ, এই মোটমাট তিন দিনে এই এলাকার যেন অনেকখানিক বদলে গেছে। এখানকার চারপাশের আবহাওয়া এখন অনেকটাই গুমোট। কখন কী হয় তার ঠিক নেই। সর্বত্রই এক চাপা ভাব।
গতকাল আজগরকে দেখতে গিয়েছিল মোসলেম উদ্দিন। আজগর তখন উঠে বসতে পারে। চোখ দুটো কোঠরে ঢুকে গেছে। মুখোনা চিমসে। তাতে পান-তামাকের গুনে পোকায় খাওয়া দাঁতগুলো একেবারেই কেলিয়ে পড়ে। ভাঙাচোরা চেহারার আজগরকে মোসলেম উদ্দিন কেন, কোর্ট চত্বরে মানুষজন আগেও দেখেছে, কিন্তু দেখতে এতটা কাহিল আজগরকে যেন কেউ দেখেনি। এ কী চেহারা হয়েছে আজগরের। মাত্র দুটো দিনের ভিতরে মানুষটা এইরকম কাহিল হয়ে গেল। মোসলেম উদ্দিন চেয়ে চেয়ে আজগরকে দেখে। গলায় জোর আছে ঠিকই, ঠিকমতো দাঁড়াতে পারবে তো ছেলেটা। এরপর খেলা দেখাতে পারবে তো। বান্দর দুটোকে নাচানোর সময়ে গায়ে বল থাকতে হয়, সেই বল আবার ফিরে পাবে?
এই পর্যন্ত ভাবলেও, মোসলেম উদ্দিন এও জানা আছে, এই মুহূর্তে কোর্ট চত্বরের যে অবস্থা তাতে কয়দিনে যে এখানে আবার লোকজন ঠিকঠাক মতো হবে, তাই-বা কে জানে। ততদিনে আজগর নিশ্চয়ই আরও সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই কয়দিন তাহলে খাবে কী? অসুখ হয়ে কত জায়গায় ধার কর্য করেছে তার ইয়ত্তা নেই। যদি সুকুমার যদি খেলা দেখাতে পারত তাহলে হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারত। যদিও গতকাল বিকালে মোসলেম রেল স্টেশনে সুকুমারকে দেখেছে। মোসলেমও গিয়েছিল কাপড় কাঁচার পাউডার নিয়ে। কিন্তু সেখানেও জনমানুষ কিছুটা হলে কমে গেছে। বাসের মালিকরা নাকি লোক লাগিয়েছে, যেন মানুষ বাসেই ওঠে। মাত্র এক ঘণ্টায় সবাইকে নিয়ে যাবে খুলনায়। অর্থাৎ, নদীর এপারের রূপসায়। তারপর তারা যাবে খুলনায়। সেখানে এই ট্রেনে, গরুরগাড়ি মার্কা ট্রেনে দুই ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টায় খুলনায় যাওয়ার কোনও অর্থ আছে? মানুষও যুক্তি বোঝে। তারা বাস মালিকদের কথা শোনে। সদ্য বানানো তেলতেলে সিএণ্ডবি রাস্তা, এই রাস্তায় বাসে ওঠো আর একটানে চলে যাও খুলনা। চোখ খুলতে না খুলতেই রূপসা ঘাট। ফলে, বাস মালিকরা যদি ট্রেনঅলাদের সঙ্গে দেন দরবার করে, ভিতরে ভিতরে ঘুষ দিয়ে ট্রেনটা তুলে দিতে পারে, তাহলে ট্রেন স্টেশনে খেলা দেখানোর যে সুযোগ তাও আর কয়দিন বাদে থাকবে না।