এ সময়ে আলতাফের হোটেলের উপরে উঠে সুকুমার আর একটু গড়াগড়ি দেয়। পেটের ভাত একটু তলানিতে গেলেই সে চলে যাবে রেল স্টেশন। ফুটবলের খেলা যদি নাও দেখানো যায়, চাউনির নীচে তাসের খেলা দেখাতে পারবে। আর লেকের পাড়ের কংক্রিটের চত্বরে খেলা দেখানোর সুযোগ হলে, বলটা পায়ে নিয়ে কয়েকটা কায়দা দেখাবে! তার আগে দিয়াশলাইটা পকেট থেকে বের করে কাঠি জ্বালিয়ে জিহ্বায় লাগিয়ে বারবার জ্বালিয়ে দেখানো। হাতের তালুতে রাখা ওই দিয়াশলাই বাক্স মুহূর্তে নিয়ে যাবে হাতের উলটো পিঠে। এইসব করে যদি মানুষ জমে তাহলে ফুটবলের খেলা দেখাতে পারবে। তখন পাবলিক পকেটের পয়সা নিশ্চিত ছুড়বে। আর যদি বৃষ্টির জন্যে তা না-পারে, তাহলে ভাগ্য খারাপ।
কদম আলিকে ডিসি অফিস থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাই সে পন্টুনে নেই। লঞ্চের একজনের কাছে থেকে জরিনা এ সংবাদ জানতে পেরে অতি উৎসাহের সঙ্গে মাছ ধরে। জরিনার চেয়ে দ্রুত মাছ তুলতে পারে ঝিলিক। যদিও আজ নদীতে অথই পানি। এত ভরা থাকলে মাছরা সাধারণত কম ধরা পড়ে। এখন পানি কিছু নামছে, হয়তো আরও খানিকক্ষণ বাদে মাছ ধরা পড়তে পারে। তবে, এসবই তাদের শুধু সময় কাটানো। মাছ যাই পাক, সবই তো নেবে ওই কদম আলি।
মেঘ থাকায় আজ বিকেল দ্রুত মরে আসে। জরিনা ওপারে চরগার দিকে তাকিয়ে দেখেছে। একটু আগেও যতটা আলো ছিল এখন তা নেই। অন্ধকার ঝুপ করেই নামবে। সে হঠাৎ ঝিলিককে বলে, তুই বাও বড়শি, আমি এট্টু বান্দর আলারে দেইহে আসি।
ঝিলিক জানতে চায়, যার বড়শি, সে যদি কিছু কয়?”
কবে কী? সে আইসে এইডে বাবে। জরিনা হাতের বড়শি গুটিয়ে রাখতে রাখতে বলে, মাছ কয়ডা ঠিকমতো পালি ওই কদম আলি কেউরে কিছু কয় না।
তাড়াতাড়ি আইসো। আচ্ছা, এই বড়শি কার, ওই ঘাটে যে থাহে সেই?”
হয়। সেই। মুহের এই জায়গায় কয়গাছ দাড়ি–সেই বেটা এই জায়গায় থাহে।
আচ্ছা।
জরিনা পন্টুন ছেড়ে যেতে যেতে বলে, আমি দেহি মোসলেম ভাইরে পাই নিকি। পালি কবানে এট্টু সাগুদানা আর মুড়ি কিনে দিয়ে যাতি–
তালি তুমি আর তাড়াতাড়ি আইচো।
আসপানে। অন্ধকার হলি তুমি নয়, বান্দরআলার ঘরের সামনে যাইয়ে বইসো।
অন্ধকার হতি যেন বাকি আছে। লঞ্চের মদ্যি বাতি জ্বালাইয়ে দিচে।
বাইরে এহোন আলো আচে।
পন্টুন থেকে উঠে জরিনা নদীর কূলে আসে। সোজা রাস্তায় মুখ দিয়ে দাঁড়ায়। এখন নদীর কূল ধরে বাঁয়ে গেলে আজগরের ঝুপড়ি ডানে গেলে ডাক বাংলো ঘাট। এখন সে সামনে রাস্তা ধরে মেইন রোডে যাবে না। যাবে ডাক বাংলো ঘাটের দিকে। সেখান থেকে ডাক বাংলো ঘাট হয়ে আলমের চায়ের দোকান। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। যদি মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় তো ভালো। তাকে আজগরের কথা বলবে। তাদের হাতে টাকা পয়সা নেই, তা জানাবে। সুকুমার আলতাফের কাছ থেকে ধার করেছে। আলতাফের হোটেলে দুপুরের পরে তারা বাকিতে খেয়েছে। এইসব। এক কাপ চাও খাবে, যদি মোসলেম উদ্দিন খাওয়ায়।
কিন্তু জরিনা আলমের চায়ের দোকানে মোসলেম উদ্দিনকে পায় না। পাওয়ার কথাও নয়। এসময় মোসলেম উদ্দিনের কোনওভাবেই এখানে থাকার কথা নয়। আজ কোর্ট বসেনি বলতে গেলে। যদি কোর্টের কাজ হয়েও থাকে, তখন মানুষ প্রায় ছিলই না। ফলে মোসলেম উদ্দিনের কোর্ট চত্বরে থাকার কোনও কারণ ছিল না। তারপর আর ওই মানুষ এখানে থাকে। আজগরকে হাসপাতাল থেকে এখানে পাঠিয়ে তারপর কিছুক্ষণ এখানে থেকে কখন চলে গেছে মুনিগঞ্জে।
তবু আলমের দোকানে দাঁড়িয়ে জরিনা চা খায়। জরিনা জানে এখন পয়সা না-দিলে আলম কিছু বলবে না। লিখে রাখবে দোকানের দেয়ালের তক্তার এক কোনায়। অথবা, মনে রাখবে। পরে এলে দাম চাবে। আলম মানুষটা ভালো আছে। শুধু গলার স্বরে কোনও রস নেই।
চা খাওয়ার সময় জরিনা ডানে বামে তাকায়। যদি পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু এখন উকিল বারের সামনে তার পরিচিত কারও থাকার কথা নয়। তবু, কখনও তো ভাগ্যে মেলে। অথবা, দুপুরের পর দিলদার বলেছিল, এসময় থাকতে পারে। যদি দিলদার থাকত। জরিনা মনে মনে দিলদারকে খুঁজছিল। দুপুরের পর পর তার মনে হয়েছিল, দিলদারের সঙ্গে তার দেখা হবে।
তবে, দিলদার এই এলাকায় থাকতে পারে, একথা বললেও এখন আলমের দোকানের সামনে এসে এভাবে উদয় হবে, একথা কিন্তু তার ভাবনার বাইরেই ছিল। জরিনা চায়ের গ্লাস নামিয়ে বলে, ও আল্লা, এ আমি কারে দেকতিচি। তুমি কোহানদে?
কেন, সেই সময় কলাম না, এই জায়গায় থাকার কতা তো কইলাম, সন্ধ্যা পর্যন্ত আইজকে থাকপো। ওপারদে একজন আসপে, তার সাথে কাজ সাইরে তারপর যাব।
আইচে তোমার সে ওপারের লোক?
হয়। এই গেল।
ও। চা খাইছো?
খাইচি সেই লোকের সাতে দুইবার। এহোন আর খাব না।
তালি রাস্তার ওপার চলো। পান খাওয়াও আমারে। আর এই চায়ের দামড়া দাও
হয়। খাইয়ে কাজ নেই আমার। ওনার চায়ের দাও। ওপার যাইয়ে পান খাওয়াও। কত তা করো।
দেও। দেহো না, এহোন তোমারে দেইহে চেইনি, কইনি তোমার ওই নাপিতের বাকসোডা কই?
সেয়া কলি আরও দেতাম না।
একথা বলার আগে দিলদার তো জরিনার চোখ দেখেছে। সেখানে বলার ধরনে ইয়ার্কি যেমন আছে, আছে একপ্রকার অনুমোদন, যেন এই মুহূর্তে এসব কথা বলার জন্যেই সে দিলদারকে খুঁজছিল, যেন দিলদার চাইলে তাকে আরও দুটো কথা শোনাতে পারে। রাস্তার ওপার পানের দোকানের সামনে যেতে যেতে সে, দিলদারের কথার উত্তর দিতে বাম হাতখানা দিয়ে দিলদারকে ছুঁতে চায়, হইছে, আমার পানের দাম না দিয়ে তুমি যাতা কোন দুয়ারে?