মেহগনি গাছের নীচে পেটলার পাশে বসে মোসলেম উদ্দিন আবার চারদিকে তাকাল। বারিকের বই লাছা শেষ। এবার বারিক চুপচাপ মেঘনিশ গাছটায় হেলান দিয়ে বসে থাকবে। মোসলেম একটু সামনে এগিয়ে বোচকটা রাখল। দিন কয়েক আগে একটা অল্প বয়েসি ছেলে এসেছিল। মাথাভরতি চুল। দাড়ি গোঁফ তেমন গজায়নি, গজাবে গজাবে। দারুণ সুন্দর গান গায়। লালন ফকিরের গান অথবা ভাওয়াইয়া কি ভাটিয়ালি। সুকুমারের সঙ্গে ট্রেনে চেপে এসেছে। সারা গায়ে মশার কামড়ের দাগ। কিন্তু সুকুমার তার খেলা দেখানোর আগে তাকে পাশের ওই বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে মেঘনিশ গাছের তলায় গান গাইতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আহা, কী গায় সে ছেলে! মোসলেম তখন বারিকের দোকানের পাশে দাঁড়ানো। মুখে মাথায় কড়া রোদ। তাতে কী? ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ধরতেই ভিড়। তারপর গাইল একখানা সিনেমার গান, ‘তুমি কি দেখেছো কভু, জীবনের পরাজয়’। একেবারে যেন আবদুল জব্বার। ছেলেটির নাম মনে করার চেষ্টা করে মোসলেম, কোনওভাবেই মনে পড়ে না। মাত্র তো ওই কয়দিনের দেখা, তাও হয়ে গেল বছর কয়েক, সেবার এরশাদ এসেছিল মহকুমা থেকে জেলা করতে। তখন এটা ছিল এসডিও অফিস। মোসলেম বছরের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। সে হিসেব মেলেও, কিন্তু ছেলেটির নাম কোনওভাবেই তার মনে আসে না। তাহলে অমন গান গাওয়া, কয়েক দিনের জন্যে দেখা সেই ছেলেটির নাম সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে বসে আছে। আজকাল এমন হয়, নিশ্চয়ই বয়স হচ্ছে।
মোসলেম ভাবে, এখন রোদ চড়ার আগে সেই ছেলেটিকে যদি একটু সামনে এগিয়ে, গাছের এই ছায়া আর রোদ্দুর মেলানো চত্বরে একখানা গান গাইতে দাঁড় করিয়ে দেয়া যেত, তাহলে তাকে আর কষ্ট করে মজমা মেলাতে হত না। রোদ তাপ আলো ছায়া গাছের পাতায় রোদের ঝিলিক, সকল কিছুর ভিতরে মোসলেম এখন কল্পনায় সেই ছেলেটিকে চত্বরে গান গাইতে দেখে। অথবা, সেই কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ক্যানভাসের প্রস্তুতি নেয়। যেন, ছেলেটি ওই সুর ধরছে, এই যে গাইছে : এ মালিকে জাহান, আমি বড়ো অসহায়, আজ দু-ফোঁটা পানি তরে বুক ফেটে যায়। কোন ছবির গান? মোসলেমের মনে নেই। ফকির মজনু শাহ? হতে পারে। তবে মনে আছে লাইট হল সিনেমায় সে আর আলেকজান ইভিনিং শোতে ছবিটা দেখেছিল। আজ আর সেকথা মনে করতে ইচ্ছে করছে না। ওই ছেলেটার মুখ মনে পড়ছে না। আজগর অথবা বারিক নিশ্চয়ই নামটা মনে করতে পারবে। কোনও কিছু স্মরণ না-এলে সে এই বয়সেও একবার একবার মাথা চুলকায়। তা করল, তারপর হাত বোলাল মুখের সঙ্গে মিশিয়ে ছাঁটা দাড়িতে।
এরপর কয়েক কদম সামনে এগিয়ে মোসলেম পোটলাটা রাখল। মনে মনে বহুদিন আগে এখানে এক ক্যানভাসারের বলা সেই কথা কটা আওড়াল, কিন্তু শব্দ করে বলল না। সে আওড়া, আজ এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এইখানে এই প্রান্তরে শুভ্রতার খোঁজে আপনাদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি। এটুকুই বলেই সেই লোক এরপর প্রায় বরিশালের উচ্চারণে কথা বলতে শুরু করত। দাঁতের মাজন বিক্রেতা ছিল লোকটা। মোসলেম আজও জানে না, কেন শুরুতে সে অমন করে কথা বলত। মোসলেম জানত, লোকটার বাড়ি মোড়েলগঞ্জ; ওখানকার লোকজন প্রায় বরিশালের ধরনে। কথা বলে। যাই বলুক, লোকটির শুরুতে বলা ওই বইয়ের ভাষায় কথাগুলো তার ভালো লেগেছিল। তাই আজও মনে আছে। নিজেও পরে এক-আধবার চেষ্টা করেছে ওভাবে শুরুতে বলতে, কিন্তু পারেনি। তাছাড়া পরে ভেবেছে, ওভাবে কথা বলে তার লাভ কী? কিন্তু লাভ হোক কি লোকসান, যাই ঘটুক, ওই কথাগুলো এখনও কখনও কখনও আসর শুরু করার আগে তার মনে পড়ে। এইমাত্র আর একবার মনে পড়ল। সেই লোকটার নামও সে ভুলে গেছে, নিশ্চয়ই বারিকের মনে আছে, ওর সঙ্গে বেশ খাতির ছিল। বারিকের কাছ থেকে বই নিত। পড়া হয়ে গেলে একদিন দুইদিন বাদে ফেরত দিয়ে দিত। বারিক বসেছে বই বেচার জন্যে, কিন্তু ওই লোকটিকে একখানা দুইখানা বই পড়তে দিতে বারিকের কখনও আপত্তি ছিল না।
পোটলাটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে কি মানুষ জমে? তখন কিছুক্ষণ বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয় একলা কোন প্রান্তরে মানুষজনের অপেক্ষায় বসে আছে। অথচ দেখো চারধারে এত মানুষ। ওই যে বয়েসি উকিলরা যাচ্ছে। মোসলেম তাদের কারও কারও নামও জানে। এমনকি শহরে কার কোথায় বাড়িঘর তাও জানা আছে তার। তাদের পিছন পিছন মহুরিরা। ওইদিকে কোর্টের লোকজনও আছে। জজ সাহেবের জন্যে অপেক্ষা। আজ কোন কোন কেসের তারিখ সেই অনুযায়ী মানুষজন এসেছে। জজ সাহেব খাস কামরায় নাকি এজলাসে, তাও এখান থেকে বোঝা যায়। আর সে এই একটা পোটলা নিয়ে এখন প্রায় একাকী বসে আছে। বারিক একইভাবে চোখ বন্ধ করে বসে। বারিকের দোকানের সামনে কেউ নেই। অথচ চত্বরে কত মানুষ, একজন মানুষ কি বারিকের সামনে। থাকতে পারত না। মোসলেমের মনে হয়, একবার ডাকবে নাকি আজগরকে। বান্দর নাচানোর ডুগডুগিটা বাজিয়ে মুখে যে ‘আউ-আউ-আউ’ করে, তাতে নিশ্চয়ই বেশ বড়োসড়ো একটা জমায়েত হয়ে যেত। কিন্তু আজগরকে কোথায় পায়। ট্রেজারির কাঁটাতার ঘেরা দেয়া সীমানার বাইরে কুলগাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ আগে বানর দুটো বেঁধে রেখে কোথায় সে যেন গেছে। যাবে আর কই? নিশ্চয়ই ওই দিকের টাইপিস্টের ঘরের পাশে খাড়া সবেদা গাছটার নীচে জরিনার সাথে বসে আছে। না না, তাও-বা কী করে হয়, এখন কোর্টের এই ভরার সময়, টাইপিস্টদের ঘরের দিকে লোকজন আসে যায়, এখন ওই গাছের নীচে জরিনার সঙ্গে রঙ্গ করার সুযোগ পাবে? মোসলেম সেদিকে দেখতে মাথা ঘোরায়। না, বারিক বইয়ের দোকানের উপরে ছাউনি দিয়েছে, ফলে ওই দিকে নজর এখান থেকে আটকে যাচ্ছে।