প্রায় সেই ভঙ্গিতে, এখন আর লুলো ভিখিরি নয়, কিন্তু যেন মঞ্চে উঠছে এমন ভঙ্গিতে মোসলেম উদ্দিন কোর্ট চত্বরের দক্ষিণে, কোর্ট বিল্ডিং আর ডিসি অফিসের মাঝখান দিয়ে যাওয়া রাস্তায় পাশের মেহগনি গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। একটু হাঁফ ছাড়ে। চারদিকে দেখে। যা রোদ চেতেছে! যদিও চত্বরে পুবের বড় মেগনিশ গাছটার ছায়া। পাশের আকৃতিতে কিছুটা ছোটো মেগনিশ গাছের নীচে বই সাজিয়ে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বারিক বুড়ো। বুড়ো কেন? মোসলেম সত্যি জানে না। বারিকের বয়েস তার চেয়ে কত আর বেশি হবে, কিন্তু ওই আজগর কি সুকুমার সবাই তাকে পিছনে বারিক বুড়ো বলেই ডাকে। সামনে বলে বারিকদা। এমনকি আজগরের সঙ্গে যে রঙ্গ করতে করতে লঞ্চঘাটের দিকে ভাতের হোটেলে যায়, কী যেন নাম, মোসলেম তার নাম হাতড়ায়। মনেও পড়ে, জরিনা। জরিনাও যখন বারিকের সামনে এসে বসে, ডাকে বইঅলা বারিকদাদা। কিন্তু পিছনে ঠিকই বারিক বুড়ো। তা বারিকের বড়োসড়ো পেটের সাইজ আর চুলের রঙ মিলিয়ে একটু বুড়োই লাগে। আর কী ভাব! চোখ দুটো প্রায় খোলেই না। কিন্তু দেখে নাকি সবই। একেবারে পেট ফুলিয়ে বসে থাকে, কোনওদিকে চাওয়া চাইয়ি নেই। সুকুমার বলে, ‘সাক্ষাৎ ভোলানাথ শিব ঠাকুর। জরিনা তাই শুনে একদিন বলেছিল, ‘একদিন সামনে ওয়ার দুম্নারে আইনে দিলি পারো! তহোন দেইহেনে নড়বেনে। বেটা মানুষ, মাইয়ে মানুষ পালি সব জায়গা নইড়ে ওঠে!’ অবশ্য মোসলেম তখন তার গাম্ভীর্যপূর্ণভাব ঠিকই রাখে, এসব মেয়েকে বেশি পাত্তা দিতে হয় না। সোজা বাংলায় বাজারি মাইয়ে। চান্স পালিই কোলে উঠে বসপে। পুরুষ মানুষ নিয়ে কোনও অস্বস্তি নেই, সে আল দুধ গজাতি গজাতি ভাইঙে গেছে। ফলে, মোসলেমকে বলতে হয়, ‘বাদ দে, বাড়িঘর নেই। কোথায় কোথায় থাহে। বিয়ে করল না কোনওদিন। ছওয়াল মাইয়ের প্রশ্ন নেই। এখন তারে তুই আবার বিয়ে দিতিচিস!’
কথা এগোয়। জরিনা বলে, ‘ও কাকা, কইয়ে দেহেন, কলিই বিয়ে বসপে।‘
‘তুই কইচিস?’
‘চান্স পালি তো? তয় সুকুমারদা কইল—’
‘কী কয়?’
‘হাসে। তয়, আজগরদার সাতে খায়খাতির ভালো।‘
‘আজগরের সাতে তো তোরও খায়খাতির ভালো, তুই করিচিস আজগররে বিয়ে?’
‘হয়, খাইয়ে কাজ নেই। ওই চেটের বান্দরচোদা পদের সাতে বিয়েয় বসপানি! আপনি আর মানুষ পালেন না?’
‘কেন, তুই থাহিস না আজগরের সাতে?’
‘কইচে কেডা আপনারে? ওই সুকুমারদা?’
সুকুমার এখানে আছে। তখন বিকেল। সবার জিরানোর সময়। কোর্ট চত্বরে একটু একটু করে স্থবিরতা আসছে। অথবা, একটি কর্মক্লান্ত দিন এই কিছুক্ষণের ভিতরে শেষ হবে। ঘেরা দেয়া ডিসি অফিসের পুবদিকে মেইন রোড লাগোয়া টাইপিস্টদের বড়ো একচালা ঘরের সামনে বসে এই আলাপ। কিছুক্ষণ পরই, সন্ধ্যা লাগতেই এ আসর ভাঙবে। সুকুমার তার বাক্স-পোটলা গুছিয়ে আশেপাশে গিয়েছিল, এখন আবার এল। তখন মোসলেম উদ্দিন বলছে, ‘সুকুমারের কতি হবে কী জন্যি, আমরা দেইহে কিছু বুঝি না? চোখ নেই আমাগে?’
সুকুমার জানতে চায়, ‘কী হয়েছে?’
মোসলেম উদ্দিন বলে, ‘হবে আর কী? এ সুকুমার, ক’দেহি, জরিনা থাহে না ওই আজগরের সাথে?’
জরিনা সুকুমারের দিকে তাকায়, সুকুমার জরিনার দিকে। অবশ্য জরিনার চোখের তারায় কোনও বাড়তি কাপন দেখা গেল না। সুকুমার যা ইচ্ছে তাই বলুক। যদি মোসলেমের কথায় সায়ও দেয়, তাতে তার কিছুই আসে যায় না। কিন্তু জরিনার কেন যেন মনে হয়, সুকুমার হয়তো কোনও কারণে সেকথা বলবে না। কিন্তু জরিনার ঈষৎ সলজ্জ মুখের দিকে তাকিয়ে মোসলেম উদ্দিন যা বলেছিল যেন প্রায় তাই বলল সুকুমার, ‘ওই আর কি মোসলেমদা, বোঝেন তো সবই!’
‘তালি, এ ছেমড়ি, তুই যে কলি ওই আজগররে তুই বিয়ে করবি না!’
‘একসাতে থাহি তাতে হইচে কী সেই জন্যি বান্দর নাচানোরে বিয়ে করতি হবে?’
‘কী ফাও কথা কইস?’ মোসলেমের আপাত মার্জিত রুচিতে একটু খোঁচা লাগে। এসব মেয়ের সঙ্গে এই জন্যেই তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কথা নেই বার্তা নেই, কথায় কথায় মুখ খারাপ! কোন সময় কী কয় তারও যেন কোনও ঠিক নেই। আজ আছে আজগরের সাথে, কাল যদি সুকুমারের সাথে দেখে রাত্তিরে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পরশু যদি সাপের খেলা আর গাছগাছড়া বেচা ইব্রাহিম শেখের সঙ্গে লঞ্চঘাটের কোনও হোটেলে ঘুমায় তাতেও-বা কী?
জরিনার এ কথায় অন্য সময় হলে মোসলেম উদ্দিনের মেজাজ খিচে যেত। সুকুমার অথবা অন্য যে কেউ কাছে থাকলে বলত, ‘মার এই ছেমড়িরে কানপাটি জড়াইয়ে ঠাটাইয়ে একখান চড়।‘ এখন তা না বলার কারণ অবশ্য আজগর। আজগরের কাছে তার দরকার। আজগর বানর দুটো নিয়ে নদীর পাড়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরলে মোসলেম তার প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বাজারের দিকে যাবে। আলেকজান বলেছিল পাউডার বানানোর জিনিসপত্রে টান পড়েছে। সেগুলো কিনে কিছু কাঁচা বাজার-সদাইও করতে হবে। প্রতিদিন প্রায় এক কাজ। সেকথা ভাবতে মোসলেমের আর ভালো লাগে না। মনে হয়, এ জীবন এই রকম টানতে টানতে যেতে হবে। সুকুমারের মতন যদি গানের গলা থাকত, তাহলে গলা ছেড়ে দিয়ে গাইতে পারত, ‘এই জীবন তো একদিন চলতে চলতেই থেমে যাবে। কেউ তো জানে না, শেষ কোথায় হবে!’ সত্যি এই দুনিয়াদারির শেষই-বা কোথায়, রোজ কেয়ামতের দিনই-বা কেমন? তা যদি জানা যেত। কিন্তু সেকথা জেনে মোসলেমের লাভটা কী? সেদিন পর্যন্ত এই দুনিয়ায় আছে নাকি সে? আলেকজানকে সঙ্গে নিয়ে এই জীবনটাকে যদি কোনওমতো বাকি কয়টা কাটিয়ে যেতে পারে, তাতেই তার চলে।