মোসলেম উদ্দিন যেদিন দ্বিতীয় বার ক্যানভাস শুরু করে, তখন হয়তো ট্রেজারির দিকে ফাঁকা জায়গায় তিন ফলকের খেলাসহ চলে ছোটোখাটো সার্কাসের আসর অথবা বানর খেলা। ঝিবুতপালা অর্থাৎ ছোটো ছেলেরাই সেখানে বেশি যায়। আবার উলটোও হয়, সে তখন ট্রেজারির দিকে কুলগাছের কাছে তার ক্যানভাস শুরু করেছে আর কোর্ট বিল্ডিংয়ের প্রায় সামনে তখন বড়োসড়ো মজমা মিলিয়েছে কেউ। ধ্বজভঙ্গের ওষুধ কিংবা মহাশংকর তেল কিংবা শক্তিবর্ধক গাছ-গাছরা মাথার খুলি এইসমস্তর গুণাগুণ বর্ণনা করছে ওপারের আকিল সিকদার।
আলমকে এক কাপ চা দিতে বলে, লাঠিখানা চায়ের দোকানের বাইরের দেয়ালে রেখে, মোসলেম দেওয়াল ধরে দাঁড়ায়। এমনিতে দাঁড়াতে পারে সে, কিন্তু ডান হাঁটুতে ভর রেখে অনেকখানিক নীচু হয়ে যেতে হয়। এখন সেভাবে দাঁড়ানো যাবে না। মাজায় কি তার একেবারে বল নেই। একখানা পা লুলা কিন্তু এই কোমরের জোরে লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে প্রায় খাড়া হয়ে হেঁটেই কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন। কিন্তু এখন এত মানুষের ভিতরে দেয়াল ধরে এক পায়ে একটু খাড়া হয়ে না দাঁড়ালে চলে?
চা খেতে খেতে মোসলেম চারদিকে তাকায়। এটা অবশ্য তার অনেকদিনের অভ্যেস। চা খাওয়ার সময়, যদি চায়ের দোকানের ভিতরে না-ঢোকে তাহলে চারধারে গিজগিজে মানুষের মুখ দেখতে তার ভালো লাগে। এখানে কাটিয়ে দিল এতটা কাল, স্বাধীনতারও আগে প্রায় বছর পনেরো আর এই দিকেও তো সতের বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। দিন যে কীভাবে যায়। আজকাল সকালে নদীতে গোসল করে, ছোটো আয়নাখানার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোসলেম দেখতে পায় সামনে ও মাঝখানে, দুই পাশে কত চুল যে পাতলা হয়ে গেছে। এখন সামনে চুল আছে তবে পাতলা, আঁচড়ালে প্রায় মাথার চাড়ার সঙ্গে শুয়ে থাকে। তা দেখতে দেখতে মোসলেমের মনে হয়, আর কত দিন তো কম হল না। এই গলার উপর দিয়ে পেটে ভাত। এই গলা চালায় জগৎ-সংসার। শরীরও কম ধকল সইল না। এখনও যে মাথায় চুল আছে এই বেশি।
সেকথা মনে করে মোসলেম চায়ের ছোট্ট গ্লাস সামনের চা বানানোর টেবিলের উপর রেখে, আলত করে মাথার চুলে হাত ঘষে। পকেটের ছোটো ডায়েরির ভিতর থেকে টাকা বের করে। আবার সে টাকা ডায়েরির ভিতরেই রেখে দেয়। জামার পাশের পকেটে হাত দিয়ে পঞ্চাশ পয়সার একটা রেজগি বের করে চায়ের ছোট্টো গেলাসটার পাশে রাখে। তারপর আবার মাথায় হাত ডলে। এটাও মোসলেমের বহুদিনের অভ্যাস। এই আলত হাত ঘষার কায়দাটা অন্ধকারে দেখলেও, এটা যে মোসলেম তা যে চেনে সে সনাক্ত করতে পারবে। দেয়াল থেকে লাঠি নেওয়ার আগে বুক পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ায়। তারপর রাস্তা পার হয়ে বার কাউন্সিলের সামনে আসে।
এ সময়, এই সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ মোসলেমের মনে হয়, এত রোদ অনেক দিনের ভিতরে সকালবেলা ওঠেনি। রোদ উঠুক। রোদ উঠলে দিন ভালো। সঙ্গে সঙ্গে এও ভাবে, যদি এইভাবে রোদ চেতে, তাহলে চত্বরে কোনও মানুষ থাকবে? যদিও মোসলেম সকালের খেপেই ক্যানভাস শুরু করবে মেহগনি গাছটার কাছে। গাছটা চত্বরের দক্ষিণ কোণে। মেইন রোড ঘেঁষে একটা বড়ো মেঘনিশ গাছ আছে, সে গাছের ছায়া প্রায় সারাটা চত্বর জুড়ে। কিন্তু এমন রোদ হলে দুপুরের পর পর আর দ্বিতীয়বার আর ক্যানভাস করা হবে না।
বার কাউন্সিলের সরু পথের পর বিল্ডিঙের পিছনের চত্বর হয়ে সোজা রেজিস্ট্রি অফিসের কোনায় এসে মোসলেম একটা বিড়ি জ্বালায়। পাশের ট্রাফিক ব্যারাকের সামনে সার্জেন্ট মোটর সাইকেল স্টার্ট দিচ্ছে। মোসলেম বিড়িটা তালুতে গোঁজে। সার্জেন্ট ক্লাবের সামনে গতি কমিয়ে জেলখানার দিকে গেলে সে শোনে, দুই ট্রাফিক পুলিশ প্যান্টে জামা ইন করতে করতে সার্জেন্টকে নিয়ে বেশ রসালো কথা বলছে। তা ওই আলতাফ সার্জেন্টকে নিয়ে শহরে কিছু রসালো কথা প্রচলিত আছে বইকি! মোসলেম উদ্দিনের মতন প্রায় কোনও খোঁজ খবর না-রাখা মানুষের কানে যখন আসে, তখন সে সব কথা কিছুটা হলেও সত্যি। শহরের কোন বাড়িতে তার যাতায়াত। শহরের কে কে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার পরে, নতুন করে তাদের সঙ্গে খায়খাতির শুরু করেছে এই সার্জেন্ট, সে সব সংবাদের কিছু কিছু তারও কানে আসে। কার মেয়ে কার সঙ্গে চলে গিয়েছিল, কাটাখালি না কোথা থেকে মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে এই সার্জেন্ট উদ্ধার করে এনেছে। তারপর থেকে সেই মেয়েকেই কখনও কখনও আলতাফের মোটর সাইকেলের পিছনে ঘুরতে দেখা গেছে, সে সব খবর যতই উড়ো হোক আর ঠিকই হোক মোসলেমের কানে আসে। এখন এই দুই ট্রাফিক আর নতুন কী বলছে। মোসলেম বরং বিড়বিড় করতে করতে কোর্ট বিল্ডিং আর ট্রেজারির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে কোর্ট চত্বরের দিকে যায়, সুযোগ পালি তোমরাও কম পারো না!
মোসলেম উদ্দিনের বিড়ি টানা শেষ। চা খাওয়ার পর পর একটা বিড়ি জ্বালানো ও আয়েস করে টানার এই অভ্যেস তার দীর্ঘদিনের। আজকাল বিড়ি টানা কমেছে, কিন্তু এখনও সকালে মজমা মিলানোর আগে এক কাপ চা খেয়ে তারপর একটা বিড়ি টেনে অতি ধীর পায়ে কোর্ট চত্বরের মেহগনি তলার দিকে তার আগমন যেন কোনও প্রবীণ অভিনেতার মঞ্চে সদর্প আবির্ভাব। জীবনে। যাত্রাপালা একেবারে কম দেখেনি সে। মুনিগঞ্জে নদীর ওপর চরগাঁয়ে যাত্রা আগে হত, এখনও হয়, তবে আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। কেউ জানতে চাইলে, মোসলেম এক নিশ্বাসে অনেকগুলো পালার নাম বলতেও পারবে। জীবনে ওই সাধ কোনওদিন পূরণ হবে না, হলও না, হওয়ার নয়। এমন লুলো মানুষকে স্টেজে উঠাবে কোন অধিকারী? তবু একবার লুলো এক ভিখারির ভূমিকায় সে গ্রামের অ্যামেচার যাত্রা পালায় অভিনয় করেছিল।