ব্যাটার কথার কী ছিরি! সব তাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখলেই ওই এক কথা। মানষির যেন ওই কাজ ছাড়া আর কোনও কাজে ধারে আসার কোনও কারণ নেই। খালি ফাও কথা। যদি জানত এই জায়গায় কেন?
তা আলি নামের ওই লোক জানবে কী করে। জানে জরিনা। এই গরমে রাত একটু গম্ভীর হলে আজগর তার খুপড়িতে ঘুমাতে যায়। জরিনাও এক পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এতক্ষণ নদীর কূলে ওইভাবে বসেছিল যেন এই ঘুম আনার জন্যে। প্রায় চারদিন আটকা, মাথার কাছে ছোট্ট একটা কপাট, এমন বদ্ধ ঘরে মানুষ ঘুমাতে পারে। কিন্তু রাতের ওই বাতাসে চারদিক জুড়িয়ে আসলে আজগর শুয়ে পড়েই ঘুমিয়ে যায়। জরিনা চোখ খুলে এটা-ওটা ভাবে। আজগরের শুয়ে পড়ামাত্রই ঘুম। জরিনার ঘুম আসে দেরিতে। কিন্তু একবার এলে আর ভাঙে না। তাছাড়া আজগরের এই ঝুপড়িতে সে ঘুমায় একটু ভয়ে ভয়ে। শত হলে আজগর পরপুরুষ। যত আপনারাই হোক, যতই এই কয়দিনের জন্যে এক সাথে থাকুক আপনার বলে ভাববার কোনও উপায় আছে। কিন্তু পাশে ঘুমালে সেই মানুষটাকে বড়ো আপনার মনে হয় জরিনার। ঘণ্টায় ঘন্টায় ঘুম ভাঙে। মাঝেমধ্যে কোনওদিন উঠে নদীর কূলে পেচ্ছাপ করতে যায়। এসে ঘটিটা ধরে চুমুক দিয়ে পানি খায়। জরিনা ঘুমের ঘোরে তা টের পায়। কোনওদিন ওই যে পেচ্ছাপ করতে ওঠে, তারপর এসে আর ঘুমায় না। জরিনা ঘুমিয়ে থাকে। কখনও এই ছোট্ট তক্তপোশে একটু পাশ ফিরলে টের পায়, পাশে আজগর নেই।
একদিন এমন হলে অন্ধকারে জরিনা চোখ খুলে জেগে থাকে। তার গাঢ় ঘুম, একবার কেটে গেলে আবার আসতে সময় লাগে। কিন্তু এই করে সময় কেটে যায়। জরিনার চোখ আবার ঘুমে জুড়িয়ে আসে। কিন্তু আজগর না আসা পর্যন্ত আর সে ঘুমাবে না। কিন্তু চাইলেও কী তা হয়। কোনও কোনও দিন সে আজগরকে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে চায়, কোনও দিন আজগর তাকে নিঃস্ব করে দেয়, একেবারে তখন আর তার শরীরে কোনও বল ভরসা থাকে না। এই নিঃস্ব করে দেয়ার কায়দাটা বুড়ো বেটা ভালোই জানে। এত মানুষ তার শরীরের উপর দিয়ে আসল গেল, এত দেখল, কিন্তু আজগর যেমন বান্দর নাচায়, একইভাবে আজগর তার নিজের শরীরটাকেও ওই বান্দরের মতোই চঞ্চল করে তোলে আর জরিনার শরীর যেন সুন্দরবনের গেওয়া গাছ, যার ডালে ডালে আজগর বান্দরের মতন বেয়ে বেয়ে চলছে। তখন জরিনা ওই সমুদ্রের তীরে হারিয়ে যায়, তার সারাটা গায়ে এসে কোত্থেকে বাতাস লাগে, সারাটা শরীরে অনেকগুলো ফাঁকা, সেখানে হু-হু বাতাস ঢুকছে! আজগর সেখানে সেই বাতাসের ভিতরে তার শরীরটাকে আরও হালকা করে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে।
আজ রাতেও তাই ঘটেছিল। তারপর জরিনার চোখ জুড়ে ঘুম। কিন্তু আজগর বাইরে, নদীর কূল গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে থাকে। এরপর জরিনা গেলে পাশের দোকানের বেঞ্চিখানা টেনে এনে দুইজন কাছাকাছি বসে। নদীতে জোয়ার আসছে। অমাবশ্যার গোন। চারদিক বড়ো বেশি অন্ধকার। হঠাৎ হঠাৎ একটি দুটি মশা এসে উড়ে পায়ে বসে। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে। তাদের আলাপের যাতে কোনও পরিবর্তন ঘটে না। তারপর এক সময়, আজগরের মনে হয়, সত্যি রাত গম্ভীর হয়েছে, শরীর ক্লান্ত, যতই ঘুম না-আসুক এখন ঘুমাতে হবে। সকালেই বানর দুটো জেগে খিদেয় ছটফট করবে। সে সময় হতে তেমন বেশি বাকি নেই।
কিন্তু সেই ঘুম আজগর ঘুমাল কোথায়? কিছুক্ষণ বাদে পেচ্ছাপ করতে উঠে গেল, যদিও ঘুমাতে আসার আগে নদীর কূলে পেচ্ছাপ করে এসে ঘুমিয়েছিল। জরিনাও তখন আজগরের দেখাদেখি একটু তফাতে গাঢ় অন্ধকারে গিয়ে বসেছিল। তারপর অভ্যাস মতন, প্রায় কোনও কথা না বলে আজগরের শুয়ে পড়া। পায়ের দিকে বেড়ানো দরজাটা আধ ভেজানো। জরিনার এতে ভয় করে। কিন্তু সেকথা আজগরকে বলে আগে ধমকও খেয়েছে। বলেছে এই জায়গায় চোররাও আজগরের এই ঘর চেনে, এই জায়গায় নেই কিছু, এই দিক আসপে না কেউ। দিনে সারাদিন প্রায় উদলাই থাকে, কেউ আসে না। এহোনও আসপে না। তা সত্যি, আজগরের যত চিন্তা তার ওই বানর দুটো নিয়ে।
হঠাৎ ঘুম ভাঙলে জরিনা টের পায় আজগর পাশে নেই। চারধার বড়ো নিকষ অন্ধকার। নিশ্চয়ই শহরে কারেন্ট চলে গেছে। লঞ্চঘাটের কোনার লাইটটাও জ্বলছে না। নাকি কদম আলি সেই লাইটটা বন্ধ করে রেখেছে।
জরিনা আজগরকে খোঁজে। কোথায় যেতে পারে তার জানা আছে। নিশ্চয় লঞ্চঘাটের পন্টুনে বসে আছে। অথবা ঘাটে বাঁধা কোনও লঞ্চে। একা–পানির দিকে তাকিয়ে! অন্ধকারে লোকটা পানিতে কী দেখে!
জরিনা যা ভেবেছিল তাই। পন্টুনে নেই আজগর, সে দুই দিকেই দেখে এসেছে। উঠেই সামনের দিকটা দেখাই যায়। দক্ষিণ দিকে গেলে সেখান থেকে দেখা যায়, আজগরের ঝুপড়ি ঘর। কোথায় গেল? সাত-আটটা লঞ্চ বাঁধা। মূলত দুটো লঞ্চ আর গোটা পাঁচেক ট্রলার। সবকটায় উঠে দেখা সম্ভব না। লঞ্চে মানুষ ঘুমায়, এই অন্ধকারে, সেখানে জরিনার ওঠা ঠিক হবে?
জরিনা পন্টুনের উত্তর কোনায় আসে। ভাটার পানি নামছে। সেখানে পানি আটকে কুল কুল শব্দ। জরিনা টের পায় যেন এই শব্দের সঙ্গে মিলে আছে কান্নার শব্দ। পাশের ছোটো ট্রলারটার উপরে হাঁটুমুড়ে বসে আছে আজগর।
জরিনা কাছে যায়। আজগরের চুলে বিলি কাটে। আজগর মাথা তোলে না। চুলে ওই আঙুল পড়তেই বুঝেছে এই হাত জরিনার! জরিনা আজগরের আরও কাছে এসে বসে। জানতে চায়, কী হইছে তোমার?