গতকাল আবার লাশকাটা ঘরের সামনে সেই বাতাস তার গায়ে লাগলে মোসলেমের বহুদিনের আগের কথা মনে পড়ে। সঙ্গে কেউ নেই। সে একা। হাতে সম্বল লাঠিখানা। এখনও তাই। একটি পা ল্যাংচে মোসলেম চলে, তার এই লুলা পা-খানাই তার সাথি। বুকে সাহস থাকতে হবে, সে জেনেছিল। ওই সাদা কাপড়খানা দেখে সে উলটে পড়লে তো আর তার বাঁচন ছিল না। ওই মুহূর্তে মোসলেমের মনে হয়েছে, এই শহর, শহরের কংক্রিটের রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে সে, এখন তার সেদিনের কথা মনে পড়ছে কেন? সেই সাদা কাপড়, শ্মশান, দল বেঁধে বড়ো বোনের বাড়ি যাওয়া, সেখান থেকে সন্ধ্যা উৎরে ফিরে আসা।
পরদিন সকালে বোনটা মরেছিল। তার মানে ওই সাদা কাপড়খানা ছিল অমঙ্গলের। সঙ্গীরা কেউ যদিও সে-কথা বলেনি পরদিন। এখন মনেও নেই, কেন সে সেদিন বড়ো বোনের বাড়িতে গিয়েছিল? মা বলেছিল, পোয়াটেক মাইল দূরে ওই বাড়িতে গিয়ে বোনটারে দেখে আসতে। নাকি হা-ডু-ডু খেলা শেষ হলে, কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোসলেম বারইখালি গ্রামের সবার সঙ্গে সেদিকে রওনা দিয়েছিল। বিকেলে মায়ের বলা কথাটা মনে পড়েছিল সেই সন্ধ্যায়। সে সব কোনওকিছু আজ আর মনে নেই। তবে গতকাল সন্ধ্যায় তার সেই স্মৃতি জড়াজড়ি করে হামলে পড়লে, নাগেরবাজার থেকে পৌনে এক মাইল পথ হেঁটে প্রায় পুরানো বাজারের কাছে আসতে আসতে তার সত্যি মন খারাপ হয়। লাশকাটা ঘর, বোনটার স্মৃতি, আরও কত কী! সামনে মুনিগঞ্জ পর্যন্ত আরও প্রায় আধা মাইল পথ। মোসলেমকে বাসায় পৌঁছতে হবে। মালোপাড়ার কোল ঘেঁষে বাসা। সেখানে পৌঁছে আজকের মতন জিরোবে। একটা দিন গেল। আলেকজান প্যাকেটগুলো ঠিক। মতো করেছে কি না? ছেলেগুলো একটাও আর কাছে থাকে না। একজন বাড়ির জায়গা বেচে গেল সৌদি, এখন খোঁজ নেই। আর-এট্টা যশোরে কোথায় যেন মেকানিকের কাজ করে, মোসলেম মানুষকে বলে, সে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তার পরেরটা খুলনায় আজম খান কমার্স কলেজে পড়ে।
এসব প্রায় সকলের জানা কথা। কোর্ট চত্বরে মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গের বাকি ক্যানভাসাররা প্রায় সবাই তার সম্পর্কে জানে। কিন্তু কাল সন্ধ্যা থেকে তার কেন মনটা খারাপ, আজ কেন একবারও মেঘনিশ গাছ তলায় আসতে ইচ্ছে করছে না তার, তা তারা জানবে কোত্থেকে?
মোসলেম বার কাউন্সিলের থেকে কোর্টের বিল্ডিংয়ে যাবার সরু পথ ধরে এগিয়ে, চত্বরের সামনের ফাঁকা জায়গাটা দেখে আবার ফিরে এসে এসব ভাবে। চারদিকে মানুষে ভরে গেছে। চত্বরেও মানুষ। যদিও আজ হাটবার নয়, তাও শহরে এত লোক, নিশ্চয় কোনও বিশেষ মামলা আজ কোর্টে উঠবে। তা যাই উঠুক সেসব কোনওকিছুই জানার প্রয়োজন নেই তার। এই চত্বরে কাপড় ধোয়া পাউডারের ক্যানভাস করতে করতে জীবনটা পার করে দিল সে, কিন্তু কোনও দিনও কোনও কারণে কোর্টের বারান্দায় উঠেছে? না, কোনওদিন সেখানে ওঠার কোনও প্রয়োজন তার পড়েনি। আর তার মতন মানুষ, কোর্টে কোন কেস উঠল আর উঠল না, কোথায় কী হল আর হল না, তা জানার কোনও দরকার আছে? আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর দিয়ে দরকার কী? কিন্তু মোসলেম উদ্দিন যতই আদার ব্যাপারি হোক আর যাই হোক, তারও তো মন খারাপ হতে পারে? হয়তো হয়েছে আগেও। কাল সন্ধ্যা রাত্তির থেকে বড়ো বোনটার কথা মনে পড়েছে। তারপর নারকেল গাছের পাতার বাতাস, সেই সঙ্গে ওই বোনের কথা, এখন যদি একবার সে আবার গাছগুলোর আগায় তাকায়, তাতে অসুবিধা কী?
কিন্তু এই চিলতে সরু পথটুকু দিয়ে আকাশের কোনও অংশই দেখা যায় না। গাছের পাতাও না। কোর্ট বিল্ডিংয়ের পিছনে এক সারিতে গোটা পাঁচেক নারকেল গাছ, মাঝারি আকারের গাছগুলোর কাণ্ড দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পাতা দোল খাচ্ছে কি না তা দেখা যায় না।
ওখান থেকে বামে এলে পিছনের চত্বর, বারে যাদের কাজ সেখানে তাদের আনাগোনা, ডানে নামলেই মেইন রোড। উলটো দিকে একটা স’-মিল। একটু এগোলে আর-একটা। পরেই নদী। স’-মি দুটোর মাঝখানে কয়েকটা ওষুধের দোকান। সামনে এগোলে বাঁয়ে ডাক বাংলো তারপর বাগেরহাট স্কুলের দিক থেকে আসা রাস্তা ফেলে পোস্টাপিস। আবার, পিছনে একটু গেলেই লঞ্চঘাট বায়ে, ডানে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠ আর উলটো দিকে ডিসি অফিস। মোসলেম উদ্দিন ওই চিলতে ছাউনি দেয়া পথের প্রায় শেষ মাথার পরে ডানে মেইন রোডে আসে। স’-মিল দুটো ছাড়িয়ে আলমের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। ভিতরে ভিড়, বাইরেও মানুষ মন্দ না। আইজকে সারা শহরের হলটা কী? শহরে আজ এত মানুষ কেন? এত মানুষ দেখলে এখন আর মোসলেম চোখের কোনা খুশিতে ঝিলিক মারে না। আগে মারত। ভাবত, এত মানুষ! আলেকজান মাত্তর কয় প্যাকেট গুড়া সাবান বানাইচে, তাতে কুলোবে নানে। সব তার ক্যানভাসের গুণে এক ধাক্কায় বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু পরে বুঝেছে, খদ্দের-কাস্টমারও ওই আকাশের মতন, যত গর্জে কোনও কালেই তত বর্ষে না। চত্বরে মানুষ যতই থাক প্যাকেট তার ফুরবে না।
তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে ওসব কথা ভেবে এখন আর কোনও লাভ নেই। এখনও কেউ ক্যানভাস শুরুও করেনি, প্রায়ই দিন মোসলেম উদ্দিনই সাধারণত সবার আগে ক্যানভাস শুরু করে। তারপর অন্যরা। দুপুর গড়িয়ে যেতে যেতে মোসলেম কোনও কোনওদিন দ্বিতীয় বার। তার সঙ্গে তো কোনও টক্কর নেই কারও। যেমন, কোনও টক্কর নেই বইঅলা বারিক বুড়োর সঙ্গে কারও। সে ওই বট গাছটার নীচে নীলচে পলিথিনের ছাউনি আর মাটিতে একখানা বড়োসড়ো ছালার চট পেতে বসে থাকবে তো থাকবে।