কী জানি?
ইব্রাহিম গেইচে পর আর আসে নাই?
না। এদিক আর তো দেকলাম না।
গেল দেহি তোর সেই পরিচিত ছেমড়ির সাতে? কী যেন নাম ওই ছেমড়ির?
ওই ছেমড়ির নাম দিয়ে তোমার দরকার কী? সুকুমারদা আর এদিক আসিনি। ওই যে বারিক বুড়ো মেয়ার গাছতলায় তার খেলার জিনিসপাতি।
আজগর সেদিকে তাকায়। সত্যি, সঙ্গে সঙ্গে আজগরের মনটা একটু খারাপ হয়। ছেমড়ার সাতে হোন না-বাধালিই হইত। আইজের খেপ গেল। যদিও এখন কোর্ট চত্বরে মানুষজন তেমন নেই। তাছাড়া সুকুমারের আয় রোজগার বেশ ভালো। একদিনের খেপ না দিলে কিছুই হবে। দেখা গেল, বিকাল হতে না-হতে ছুটল রেল লাইনের দিকে। কিন্তু রেল নিয়ে কী সমস্ত ঝামেলা হচ্ছে। আজগরের মতন মানুষ তা সব অবশ্য জানেও না।
আজগর বিড়ি ছুঁড়ে জরিনাকে বলল, চল, যাই। খাওয়া লাগবে। পেট পুজো করি। পেটে দুটো দেখার জন্যিই এত কিছু!
জরিনা হাসে। এইবার না বান্দরনাচানো আজগর আসল কথায় আইচে। একটু আগে তার ভান দেখে জরিনার মনে হচ্ছিল আজ যেন আর খাবেই না। হাওয়া খেয়ে আজকের দিন পার করে দেবে।
লঞ্চঘাট ফেলে ঝুপড়ির দিকে যেতে যেতে আজগর আবার একই কথা বলে, খুব তো রঙ্গ ওই দিলদারের সাতে, যাইতি তার সাতে খাইতে!
জরিনা আবার এক ঝটকায় আজগরের চোখে চোখ রাখে। না-সেখানে এখন আলাদা কোনও ইঙ্গিত নেই। ক্লান্ত চোখ। এবার ক্যানভাস করে এসে লোকটা এক গ্লাস পানিও খায়নি। এখন খাবে। বান্দর দুটো বেঁধে আজগর ঘরের দরজা খুলে ঘটি বের করে। পানি প্রায় তলানিতে। সেটুকু চুমুক দিয়ে খায়। হাতের ফাঁকা ঘটিটা জরিনাকে দেয়। জরিনা যেন খাওয়ার পরে এই ঘটিভরতি পানি আনে হোটেলের পিছনের চাপকল থেকে। ওই কলের পানি খুব ঠান্ডা, নোনা ভাব কম আর পাতলাও। পানি যে পাতলা আর ঘন (আয়রন বেশি) ওই কলের পানি খাওয়ার পর আজগর বুঝেছে। কোর্টের কোনায় ওই ট্রাফিক পুলিশদের ব্যারাকের সামনে একটা চাপকল আছে, সেখানকার পানি মাঝে মাঝে খায় আজগর, খুব ঘন সেই পানি। পরে শুনেছে, আয়রন না কী বলে, ওই পানিতে তাই খুব বেশি।
দুপুরে খেয়ে এসে ঝুপড়িতে শুয়ে পড়তে পড়তে আজগর আবার ঘটিতে চুমুক দিয়ে পানি খায়। জরিনা বলে, এইভাবে চুমুক দিয়ে পানি খালি সেই ঘটির পানি আবার মানষির খাতি ইচ্ছা করে। আর তোমার দাঁতের ঝা ছিরি, মুখের চার পাশের যে অবস্থা। দাড়ি মোচ।
খালি খাও, না খালি নিজের জন্যি ঘটি এট্টা কি না নিয়া আসো।
খালি খোটা দাও। তুমি খোটা না-দিয়ে কোনও কতা কতি পারো না, না?
না, পারি না।
ঝুপড়ির দরজা খেলা। আজগর ভিতরের দিকে পা-দিয়ে শুয়ে পড়েছে। জরিনা মাথার কাছে বসা। আজগর বলে, জরিনা সুন্দরী, এবার মাথার চুল কয়ডা এট্টু টাইনে দাও।
তোমার ওই খোটা দেয়া এট্টু বাদ দাও।
হইচে। পান খাইয়া ঠোঁট তো এহেবারে রাঙা লাল!
হইচে আর অত পিরিত দেহানো লাগবে না।
কেন হইচে কী?
ফাও কতা কইয়ে না। সামনে লঞ্চঘাট। দিন দুপুর। এই রাস্তা দিয়ে মানুষজন হাইটে যায়। বান্দরের সাতে থাইহে থাইহে তোমারও বান্দরামতিতে পাইচে এই বুড়ো বয়সে।
তোমারে কইচে। আজগর আবার বুড়ো হলো কবে? খালি কয়ডা দাঁত পড়িছে তাও পোকে খাইয়ে।
হয় বুজিছি, নিজেরে আরও কচি খোকা বানান লাগবে না।
কেডা বানায় কচি খোকা?বলে আজগর জরিনাকে ঝুপড়ির ভিতরের দিকে ঢুকতে বলে। আজগর ভিতরের দিকে মাথা দেয়া একখানা ভাঙা তক্তপোশ, তার মাথায় একটা বালিশ। সেইদিকে মাথা দিয়ে জরিনা আজগরের দিকে আসতেই আজগর ভিতর থেকে দরজা আটকায়। জরিনা বোঝে, আজগর এখন কী করবে।
শুধু একবার বলে, এই দিনে দুপুরে দরজা দেও। পেটের ভাতও হজম হল না!
পেটের হাত একটু ঝাঁকি-ঝুঁকি খাইলে এমনেই হজম হইয়া যাবে।
জরিনা হাসে। হাসিতে শব্দ হয়। কিন্তু খিলখিল ভাবটা নেই। বরং, হাসির সঙ্গে মুখে-ঠোঁটে জড়ানো কথা। তার পরনের শাড়িখানা আজগরের অবুঝ টানে ও চাপে কুচকে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় সে খুলে ফেলে। অথবা, হতে পারে উলটো দিকে খোলা পাল্লা, যা টানলেও লাগে না, সেখানে শাড়িখানা দিয়ে দেওয়া। ঝুপড়ি তাতে একটু অন্ধকারও হল। এতে জরিনার লাজশরমও যেন উধাও। সে একবার আজগরকে বোঝাবে, এই দুপুরে একবেলা ভাত খাইয়ে এখানে তারে এনে এ কোন রঙ্গ!
ফলে, জরিনার কারণে আজগর ঘুমে তলায়। ওই চোখ দুটোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, কতকাল যেন লোকটা ঠিকঠাক ঘুমায় না। প্রায়শ এই দুপুরের দিকে এখানে জরিনাকে নিয়ে আসে। কোনও কোনওদিন রাতেও থাকে জরিনা। সেই সব রাতে, রাত একটু গম্ভীর হলেই আজগর ঘুমে তলায়। তখন জরিনা পাশে আছে অন্য কেউ বোঝা যায় না। তারপর জরিনা জানে, হঠাৎ মাঝরাতে লোকটা ঘুম ভেঙে ঝুপড়ির দরজা কোনওমতে চেপে দিয়ে লঞ্চঘাটে চলে যাবে। পন্টুনে বসে থাকবে। হয়তো ঘাটে বাঁধা কোনও একখানা লঞ্চের উপরেও উঠে বসে থাকতে পারে। পশ্চিম আকাশে ঢলে-পড়া চাঁদের আলো নদীর জলে। দূরে শহরের কোনও বাড়ির আলো এখান থেকে। চোখে পড়ে। ট্রেজারির ঘণ্টা রাত্তির জানান দেয়। উঁচু পাঁচতলা রাহাত হোটেলের উপরের কোনও একটি রুমে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে তাকিয়ে জরিনার মনে হয় আজগর আসলেই অন্ধকারে বসে আছে। সেও যেন অনেকখানিক অন্ধকার পথ সাঁতরে এখানে এসেছে। পন্টুনের কেয়ারটেকার লোকটা একবার জেগেছিল, কিন্তু আজগরকে দেখে সঙ্গের ছোটো রুমটায় আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে, জরিনাকে দেখলে হয়তো খ্যাকখ্যাক করত। একদিন করেছিল। বলেছিল, এই রাইতে আজগরের সাতে এই জায়গায় কী? যা করার আজগরের খুপড়িতে যাইয়ে কর।