ধরবানে, ধরবানে, ধইরে দেকপানে তুমি নাচাও কীরাম
আজগরের চাইয়ে খারাপ নাচানো নানে–আইসো!
উভয়ের চোখে দারুণ ভাষা খেলে। দিলদার কথায় জরিনাকে আটকাতে চেয়েছিল, কিন্তু জরিনা এতটা সহজে তার ইঙ্গিত বুঝবে ভাবেনি। ফলে, আর কিছু না-বলে দিলদার বলে, এহোন বইসে থাহো, আজগরের প্রায় শেষ। আবার দেহা হবেনে। এট্টু লঞ্চঘাটের দিকদে ঘুইরে আসি।
লঞ্চঘাট কী?
খাব। আলতাফের দোকানে—
আমারে খাওয়াইনে একদিন। আলতাফের ওইহেনে দেখি মাংস রান্দে—
আচ্ছা। কলাম তো যন্তর ধরলি নাচ দেখপো আর খাব।
জরিনা দিলদারের কথায় ইঙ্গিত পুরোপুরি বুঝল। তাকাল চারদিকে। কেউ শোনেনি তো। বারিক বুড়োর চোখ বন্ধ, কিন্তু কান নিশ্চয়ই ভোলা।
জরিনা চোখ ঘুরিয়ে জমায়েতে আনে। আজগরের বানর নাচানো প্রায় শেষ দিকে। কয়েকদিন ধরে দেখতে দেখতে জরিনা তা বুঝতে পারে। আজগর জানাল, বুড়া এখন হাই জাম্প দেবে। বলে লাঠিটা উঁচু করে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ধরল। লাঠিটার উপর দিয়ে মর্দা বানরটা এক লাফে এপাশ থেকে ওপাশ পার হয়ে চলে গেল। হয়তো আজগরের বলার ভিতরেই কায়দাটা আছে, এই বানর জোড়া এতদিন ধরে শুনতে শুনতে তা বুঝে গেছে। আবার এই যে তার হাতের লাঠিটা, এই লাঠিই তো কখনও কখনও বাঁদরদের পিঠে আছড়ে পড়ে! এখন লাঠিটা সে এমন ভাবে উঁচু করে ধরে যেন মর্দা বানরটা দেখেই বুঝতে পারে তাকে কী বলা হচ্ছে। কী চাই। লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। প্রতিবারই সফলতার সঙ্গে লাফিয়ে পার হয়। তবে, আজকাল আগের তুলনায় একটু কম উঁচুতে লাঠিটা ধরে আজগর। আগের মতন আর প্রায় আড়াই হাত মতন উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারে না, আজগরের ভাষায়, এই ল্যাঙ্গেরা পাহাড়ের বুড়া-তুড়া। কে জানে কেন এইসব বলে সে, এই বলে ল্যাঙ্গেরা পাহাড়ের বুড়া, কিন্তু সঙ্গে জানায় সুন্দরবন থেকে আনা এই বানর। সুন্দরবনে পাহাড় আসবে কোথা থেকে, সে-কথা কেউ কখনও প্রশ্ন করে না।
জরিনা চেয়ে চেয়ে আজগরকে দেখে। আজগর খেলার এই শেষ দিকে, তার মজমায় হাজির সবার উদ্দেশে জানিয়েছে, যে যা পারে যেন এই বানর দুটোর খাওয়ার জন্যে দেয়। বানর দুটোর রশিতেও ঢিলে দিয়েছে আজগর। তারা পায়ের উপর ভর দিয়ে চারদিকে সবার কাছে হাত পাতছে। কেউই বলতে গেলে এক টাকা দেয়নি। সবই রেজগি। কেউ ছুঁড়ে দেয়, কেউ দেয় বানরের হাতে। বানর তাই এনে আজগরের সামনে রাখে। আবার যায়। সেই স্কুল-পালানো ছেলেরা এতক্ষণে চলে গেছে। কোর্ট মসজিদ রোডের মসজিদে জোহরের আজান হয়েছে কিছু আগে, নামাজিরাও চলে গেছে, টাকা বা পয়সা দিয়ে দর্শকরা পাতলা হতে থাকলে, সেই চত্বরে এখন এই জায়গায় আছে একমাত্র আজগর আর তার দুটো বানর। পাশে তার মলিন অপরিষ্কার পুটলিটা। আর আজগর বরাবর সোজা পিছনে বারিকের দোকানের পাশে দাঁড়ানো জরিনা।
আজগর সব গুছিয়ে নিয়ে জরিনার কাছে যায়। জরিনা আজগরের দিকে চেয়ে হাসে। মাথায় আজগর আর জরিনা প্রায় সমান, সেই দিক দিয়ে আজগর খাটোই জরিনা তুলনায় লম্বা। ফলে, সরাসরি পরস্পরের চোখে চাইতে পারে। বানর দুটো আজগরের হাতে দড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। কিছুটা ক্লান্ত। তাই তাদের স্বাভাবিক বাঁদরামি নেই। আজগর টাইপিস্টদের বড়ো ঘরটার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলে বানরদের বাধে তারপর জরিনাকে সেখানে দাঁড়াতে বলে মেইন রোডের দিকে যায়। সেখান থেকে চারটে কলা কিনে আনে। বানরদের দেয়। কলা খেতে খেতে বানররা চাঙা হয়, আজগর বোঝে। তা জরিনাও কিছুটা বুঝতে পারে। যখন মর্দা বানরটা দ্বিতীয় কলাটা খাওয়া হলে খোসাটা একটু দূরে ছুঁড়ে মারে আর তারচেয়ে আকৃতিতে ছোটো মাদি বানরটার কাছ থেকে সেটার না খাওয়া কলার অর্ধেক নিতে ছোটাছুটি করে।
জরিনা বলে, এই শুরু হইচে তোমার বান্দরের বাদরামি—
আমার বান্দর আর কত ভালো হবে। তয় অন্য মানুষও বান্দর কোম না!
কেন হইচে কী? দেখলাম দিলদারের সাথে হাইসে কতা কইলা!
জরিনা দ্রুত চকিতে তার চোখ আজগরের চোখে রাখে। হয়তো বলত, কইচি তা হইকে কী? এমনিতে তো এমন কত কত সোমায় কই। কিন্তু এখন তা বলল না, আজগরের চোখের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, এইরে তুমি বান্দরামি কও? তা ইব্রাহিম ভাইর সাতে তো কতো কতা কই!
না, বেশ ঢলতিলি! এটা অবশ্য আজগর দেখেনি, এমনিতেই আওয়াজ দিল। শুনবে জরিনা কী বলে?
কোতায়? দেখলা কোতায় ঢলতিলাম—
ও। মনে হল।
নিজে বান্দর নাচাতি নাচাতি ওই দুই চোহে বান্দরামতি ছাড়া আর কিছু দেহো না, না?
এই সময় বানরদের কলার সঙ্গে নিজের জন্যে কিনে আনা বিড়ি ধরিয়ে আজগর কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে। জরিনা ভেবেছিল এখনই হয়তো আজগর লঞ্চঘাটের দিকে যাবে। বানর দুটোকে নিজের ঝুপড়ির পাশে বেঁধে রেখে কোথাও ভাত খেতে যাবে। যাবে আর কোথায়, নিশ্চয় রাহাত হোটেলের গলি ধরে নদীর কূলের ভাতের হোটেল। লঞ্চঘাটের পাশের নদীর কূল ধরেও যাওয়া যায়। আজগরের ঝুপড়ির পরে আর কতটুকুই-বা পথ। কিন্তু একটু এগোলে একটা ড্রেন নেমেছে। ড্রেনের পাশের মাটি সরে যাওয়ায় এখন তা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া কষ্টকর। কিন্তু এখন কী আজগরের সেইসমস্ত কোনও চিন্তা আছে? বরং, আজগর তার কাছে উলটো খবর জানতে চায়, এই জরি, সুকুমার খেলা দেহাবে না?