জরিনা একইভাবে বসে থাকে। আজগরের কাণ্ড দেখে। আজগর বড়ো ছোটো জোয়ান বুড়ো, কোর্টের কাজে অথবা এমনি ঘুরতে আসা এই মজমায় সামিল সব ধরনের লোকের চোখ নিরিখ করে। মুখের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে বানর-ধরা দড়ির হাত থেকে সরিয়ে বৃত্ত বড় করে। মাথার চার দিক থেকে দড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসে, সঙ্গে বানরটাও তার চারপাশে সেভাবে ঘুরে আসে। আজগরের বৃত্ত বড়ো হয়। স্কুলে-পড়া ছেলেদের দিকে তাকিয়ে সে বলে, দেখি, বাচ্চালোগ তালিয়া বাজাও। বলে হাসে। তালি বাজে। আজগর তাদের মুখের দিকে তাকায়। জানে, এই যারা তালি বাজাচ্ছে, এদের কারও কারও সঙ্গে পথ চলতে দেখা হলে জানতে চাবে, ভালো আছেন? আজগর জানে, তারা তার খেলা দেখেছে। এমনকি কখনও কখনও এমনও হয়, আজগরকে লক্ষ্য করে পথ চলদে তারা নীচু গলায় একে অন্যকে বলে, এই যে ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া-তুড়া যায়!… বুড়া এখন বুড়িকে আদর করবে! শুনে, আজগর তখন হাসে। কিন্তু এখন কী সেই হাসি হাসা যায়।
বরং, আজগর জানায়, খেলা দেখবেন, হা করে থাকবেন না। সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল থেকে এসেছে এই অবলা জানোয়ার। আজ আপনাদের কাছে খেলা দেখাবে। কী দেখাবি না? বলেই একটা বানরকে সে খোঁচা মারল। বানরটা এই কথার সঙ্গে সঙ্গে একটু সামনের দিকে এগোল আর হাত নাড়াল। আজগরের বানর। পারেও, জরিনা দেখে আর ভাবে।
এরপর, খেলা শুরু। এই বুড়া, তুই এই আসরের সবাইকে সালাম দে–কুর্নিশ কর। বানরটা তাই করে। এই দেখেন, বানর আপনাদের সালাম-আদাব দিয়েছে, আপনারা হাততালি দেন, বাচ্চালোক তালিয়া বাজাও। এবার বুড়ো, দই বিক্রি করতে বের হবে। হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে দিল আজগর। বানরটা সেই লাঠিটা ঘাড়ে নিয়ে চারদিকে এক চক্কর ঘুরে এল। এদিকে বুড়ি তখন রান্না করছে। বুড়ো বাড়ি ফিরলে খেতে দেবে। আজগর ধারাভাষ্য দিয়ে চলে। বানর দুটো একের পর এক তাই করে। আজগর জানায় খাওয়া দাওয়া শেষ, এবার বুড়ো বুড়িকে আদর করবে। মাদি বানরটা তখন বসে থাকা মর্দা বানরের কোলের ভিতর গিয়ে বসে। মর্দাটা মাদিটার গায়ে মাথায় হাত বোলায়। এরপর আজগরের ভাষ্য মতো মাদিটা মর্দাটার মাথার উকুন বেছে দেয়।
এরপর আজগর তাদের ডাকে। তারা কাছে আসতে আসতে বলে, এবার এ দুটো ভদ্দরলোক হবে। বুড়া জামা কাপড় পরবে। বলে পাশের মলিন ঝোলা থেকে একটা ছোট্টো স্কার্ট মতন বের করে, সেটাই বুড়ার প্যান্ট। বুড়ো অর্থাৎ মর্দা বানরের শরীরের নীচের দিকে তা পেচিয়ে দিলে, সেটা এখন ভদ্দরলোক সেজে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। এই দৃশ্যটা আনন্দদায়ক, মর্দা বানর পোশাক পরে, কোমর দুলিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। বালকরা হাততালি দেয়। ভিড়ের কারণ বারিকের দোকানের সামনে বসা জরিনা কিছুই দেখতে পারছে না, কিন্তু তখন সেই সোজা ভিড়টা যেন একটু পাতলা, সেখান থেকে একটি বানরের এমন করসৎ জরিনা দেখে। সেও হাতে তালি দেয়। সেই তালিতে বারিক বুড়োর তন্দ্রা টোটে অথবা কিছু একটা ঘটেছে বুঝে বারেক চোখ খোলে। চোখটা একটু কচলে নিয়ে তাকায়, দেখে কিছুই ঘটেনি। আজগরের বান্দর নাচানো দেখে জরিনা খুশিতে হাততালি দিয়েছে। তাতে বারিক যেন একটু নাখোশ, যা, ওই জায়গায় যাইয়ে দেখ।
জরিনা বারিকের দিকে তাকায়, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, ও কা?
সেয়া দিয়ে তোর কাজ কী?
জরিনা একটু আগে আজগরের সঙ্গে তার বিষয়টা মিলিয়ে নিতে চায়। তাহলে বারিক বুড়োও ঘুমায়। তাহলে আজগর যে বলল, কোনওভাবে বুড়োর বই হাতসাফাই করা যায় না? জরিনার হিসেব মেলে না। সে আবারও বারিকের দিকে তাকায়। বলে, ভুল হইয়ে গেইচে। কিন্তু কাকা, ওই জায়গায় বিটি মানুষ হইয়ে অত বেটাগো মদ্যি যাইয়ে বান্দর খেলা দেখা যায়?
বারিক তা শুনেছে অথবা শোনেনি। আবারও তার চোখে তন্দ্রা।
এদিকে জরিনার সামনের সেই ভিড় আবার জমেছে। সে দেখতে পায় না কিছুই। তার একটু পিছনে, বারিকের দোকানের পর ছোট্ট ড্রেনের কোনায় ছোট্ট একটা বক্স মতো যন্ত্র নিয়ে বসা দিলদার। এই যন্ত্র নাকি বাত ছাড়ায়। সে সেখান থেকে বারিককে বলে, কাকা, আমার এই যন্তরটা থাকল, এট্টু ঘুইরে আসি। দেইহেন।
জরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে দিলদারকে দেখল, । হইছে, ওইয়ে দিয়ে মানষি আইজকাল বাত ছুটোতি আসপে নানে, পুলিশে পিটোইয়ে সব বাত ছুটোইয়ে দিতিচে।
সমস্যা নেই, কেউরে না-পালি তারপর তোর বাত ছুটোবানি। দেহিস–তুই ধরবি আর যন্তরডা এমন ঘুল্লি ঘুরব, তুই এহেবারে তিড়িং বিড়িং নাচতি থাকপি!
হইচে, ধইরে দেকপানি তোমার ওই বালের যন্তর, দেহি নাচি কীরাম?
হয়। তুমি তো আজগরের যন্তর ধইরে নাচতিচো!
জরিনা যেন একটু লজ্জা পেল। সে উলটো দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যেতে থাকা দিলদারকে দেখে। দিলদারের চোখের ভাষা বুঝতে চায়। দিলদার ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে। কিন্তু এখন আর কিছু বলল না। যেন, যা বলার জরিনার উদ্দেশ্যে বলেই ফেলেছে। তাছাড়া বারিক বুড়ো কাছেই। সে চোখ নাচিয়ে বলে, কী?
জরিনা দাঁড়ায়, কী? ধীর পায়ে এগিয়ে দিলদারের কাছে যায়।
দিলদার এইবার গলা নামিয়ে বলে, কী? কলাম তো, ওই আজগরের যন্তর ধরিচো তো ধরিচো, ওইয়ে ধইরে তিড়িং বিড়িং নাচতিচো, আমার তা এট্টু ধরলি পারি?